দিনের পর দিন কলুর বলদের মতো খেটে মরবে সমাজের সিংহভাগ জনগণ। আর মনুষ্যসৃষ্ট জাতিভেদের দোহাই দিয়ে ফায়দা লুটে লাভের গুঁড় খাবে সংখ্যালঘু অভিজাত সমাজ। সমাজের আপমর জনতা মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও দিনাতিপাত করতে বাধ্য হয় সতত; অন্যদিকে আলস্যসকাশে মহানন্দে থাকছে এক বিশেষ সিন্ডিকেট শ্রেণী। লঘু পাপকে গুরু দন্ডে প্রতিবিহিতের বরাদ্দ কেবল দলিতের নোনতা ললাটের জন্যে; অথচ বিচারের বাণী জাত্যাভিমানের মারপ্যাঁচে হারিয়ে যায় সভ্যতার আস্তাকুঁড়েতে। কঠোর পরিশ্রমের পরেও করের অন্যায় বোঝা চাপে শুধু মজলুমের ঘাড়ে আর জালিমের ধন-ভান্ডার সমৃদ্ধির পথে বলগা হরিণের ন্যায় ছুটে চলে।
সমাজে যখন এই উল্টো চলার নীতি পরিগৃহীত হয়, তখন প্রতিবাদী প্রতিরোধ প্রতিটি পরিক্লিষ্ট প্রকোষ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়। অত্যাচারিতের জর্জর পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে গিয়ে তাকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দেয়, জীবনের তাগিদে সে তখন প্রাণের মায়ার বীরোচিত বিসর্জনেও থাকে অকুতোভয়। ফরাসিরা ভিতরে ভিতরে ফুঁসে উঠেছিল; দীর্ঘদিনের সঞ্চিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ তখন সময়ের ব্যাপার ছিল। অসহ্য মাত্রায় নিষ্পেষিত জনগণ একাট্টা হয়ে ওঠে; হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। তাদের প্রতিবাদী সুরে ওঠে বিপ্লবের জাগ্রত রাগিণী। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, বলছি ইউরোপের দিনবদলের পাঞ্জেরী ফরাসি বিপ্লবের কথা। এটা তো আমরা সবাই জানি যে, অষ্টাদশ শতকের ফরাসি বিপ্লব সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এক অভূতপূর্ব প্রভাব (সেটা কম হোক বা বেশি) রেখেছিল। কিন্তু আমাদের কি জানা আছে, সেই দিন বদলের বসন্তে বিশেষ অবদান রেখে ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছে এক বাঙালি যুবা! সমুদ্রসকাশে বড় হয়ে ওঠা চট্টগ্রামের জামর ছিল ফরাসি বিপ্লবের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র! আসুন, পরিচিত হই তৎকালীন সুবা বাংলার বাঙালি জামরের সাথে।
কে এই জামর?
বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় ইউনিয়ন জ্যাকের কালো আঁধারে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তর রুধিরাক্ত হয়ে ওঠে দেশপ্রেম আর দেশদ্রোহিতার মিথস্ক্রিয়ায়। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার মহান অধিপতি নবাব সিরাজউদ্দৌলা এখন অতীত। মসনদের নিয়ন্ত্রণ এখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাতে। স্বাধীন সার্বভৌম এ দেশবাসী হঠাৎ হওয়া এই পরাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। ক্ষণে ক্ষণেই বিদ্রোহী হয়ে উঠছেন তারা। আর এমনই এক ক্রান্তিলগ্নে ১৭৬২ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন জামর।
অবশ্য তার সঠিক জন্মসাল নিয়ে কারো কারো দ্বিমত আছে। এর কারণও আছে অবশ্য। মাত্র এগারো বছর বয়সে এক ইংরেজ দাস ব্যবসায়ীর করাল থাবায় পাচার হয়ে যান ছোট্ট জামর। জাহাজে করে তাকে নিয়ে আসা হয় আফ্রিকার মাদাগাস্কারে। সেখান থেকে এক ফরাসি দাস ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ফ্রান্সে। অতঃপর বিক্রি করে দেওয়া হয় ফ্রান্সের তৎকালীন রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের কাছে। পঞ্চদশ লুই জামরকে তার উপপত্নী মাদাম ব্যারির (১৭৪৩ – ১৭৯৩) কাছে হস্তান্তর করেন। মাদাম ব্যারি জামরকে পছন্দ করতেন। তিনি জামরকে পড়াশোনা করার সুযোগ দেন। শুরু হয় জামরের ফরাসি ভূমিতে দিনযাপন। পেছনে ফেলে আসেন তার জন্মভূমি চট্টগ্রামকে; তার ছোট্টবেলার স্মৃতিকে।
দর্শন ও সাহিত্যে জামরের আগ্রহ বাড়তে থাকে। তিনি গোপনে গোপনে বিপ্লবী দার্শনিক ও লেখক জ্য জ্যাক রুশোর সব সাহিত্যকর্ম পড়ে ফেলেন। এগুলো জামরের মনে দাগ কাটে। তিনি ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। রাজনীতির প্রতি তার আগ্রহ বাড়তে থাকে। গোপনে যোগাযোগ রাখতে থাকেন লুকিয়ে থাকা সুপ্ত বিপ্লবীদের সাথে। জামর প্যারিসের রয়্যাল ক্যাফেতে নিয়ম করে যাতায়াত করতেন। সেখানে ইংরেজ বিপ্লবী জর্জ গ্রিভের সঙ্গে জামরের বন্ধুত্ব হয়। পরবর্তীকালে জামরের কাছে শোনা তথ্যের ভিত্তিতে মাদাম ব্যারিকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে গ্রিভ ভূমিকা রাখেন।¹ যা-ই হোক, ‘থার্ড স্টেট’ বলে সে সময় পরিচিত সাধারণ জনগণের ক্ষোভ যখন তুুঙ্গে, ফ্রান্সের মসনদে তখন অত্যাচারী রাজা ষোড়শ লুই।
শত শত বছরের চেপে থাকা ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিলো ফ্রান্সের অলিতে-গলিতে; নির্যাতিত ও বঞ্চিত সাধারণ মানুষদের প্রতিটি দারিদ্রপীড়িত গৃহে। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত জনগণ হানা দেয় কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গে। শুরু হয় ইতিহাস বিখ্যাত ফরাসি বিপ্লব। আর এই গণজাগরণের অগ্রভাগে যারা ছিলেন, তাদেরই একজন চট্টগ্রামের জামর।
ফরাসি বিপ্লবে জামরের ভূমিকা
বিলাস ব্যসনে উন্মত্ত ভোগ-বাসনার চরিতার্থতায় আকণ্ঠ নিমগ্ন ফরাসি রাজপরিবারকে টেনে হিঁচড়ে গদি থেকে মাটিতে নামান বিপ্লবী জনতা। গণহারে বন্দী হয় অভিজাত শ্রেণী ও দুর্নীতিগ্রস্ত ধর্মগুরুরা। পতন ঘটে স্বৈরাচার, নির্যাতন ও জুলুমের প্রতীক বাস্তিল দুর্গের। ফরাসিদের এই বিপ্লবে রাজপ্রাসাদের বাসিন্দা জামর বিপ্লবীদের পক্ষ নেন। যোগ দেন বিপ্লবকালীন অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংঘ জ্যাকোবিন ক্লাবে। ফরাসি বিপ্লবের ফসল এই সংঘের মূলমন্ত্র ছিল ‘Vivre libre ou mourir’ অর্থাৎ ‘Live free or die‘; ভাবার্থে ‘স্বাধীনভাবে বাঁচো অথবা মৃত্যুকে বেছে নাও (তবুও পরাধীনতা নয়)’।
বার্তাবাহক হিসেবে জামরের অবদান তাকে কমিটি অব পাবলিক সেফটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত করে। ১৭৮৯ থেকে ১৭৯২, জামর এখন কমিটির একজন সেক্রেটারি, যার কাজ ছিল সমাজের অভিজাতদের উপর নজর রাখা। তার কথায় ১৭৯২ সালে গ্রেফতার করা হয় কাউন্টেস ব্যারিকে। তার দেওয়া সাক্ষ্য নিশ্চিত করে রাজবংশের এই কাউন্টেসের মৃত্যুদণ্ড। এক সময়ের অচিন্ত্য ক্ষমতার অধিকারী এসব মানুষকে (ষোড়শ লুইসহ) গিলোটিনে নিয়ে শিরশ্ছেদ করে নির্যাতিত বিপ্লবীরা।
জামরের পরিণতি ও শেষকাল
কাউন্টেস ব্যারি তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এটাই জানতেন যে, জামর আফ্রিকার কোনো এক দেশের অধিবাসী। সবাইও তাই জানতো। জামর তাদের এই ভুল ভাঙান কাউন্টেস ব্যারির বিচারের সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেবার সময়। কাউন্টেসের অনুপস্থিতে দেওয়া তার এই সাক্ষ্যে তিনি নিজের সত্যিকারের পরিচয় দেন। বলেন, তিনি আফ্রিকার নয়; বরং সুবা বাংলার চট্টগ্রামের ছেলে। দাস ব্যবসায়ীরা তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় মাদাগাস্কার । সেখান থেকে এখানে অর্থাৎ ফ্রান্সে।
জামরের জন্মস্থান নিয়ে ভুল তথ্য জানার প্রমাণ তাকে নিয়ে আঁকা ছবিগুলোতে প্রতীয়মান। এসব যৎকিঞ্চিত ছবির প্রতিটি জামরকে আফ্রিকা থেকে আগত দাস হিসেবে উপস্থাপন করেছে। যা-ই হোক, কাউন্টেসের শিরশ্ছেদের পরপরই জিরোন্ডিনরা জামরকেও গ্রেফতার করে। এই জিরোন্ডিনরাও ফরাসি বিপ্লবের বিপ্লবী। কিন্তু এই তারাই জামরকে জ্যাকোবিন ক্লাবের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতার করে। প্রায় ছয় সপ্তাহের মতো তাকে জেলে বন্দী থাকতে হয়। ছাড়া পেয়ে জামর ফ্রান্স থেকে পালিয়ে যান।
১৮১৫ সালে ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর জামর আবার ফিরে আসেন ফ্রান্সে। বসবাস করতে থাকেন প্যারিসে। বাচ্চাদের একটা স্কুলে শিক্ষকতাও করেন কিছুদিন। ১৮২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জামর মারা যান। অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেওয়া এই বিপ্লবীর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে খুবই কম সংখ্যক মানুষ নাকি উপস্থিত হয়েছিল।
জামরের আরেকটা নাম ছিল। ফ্রান্সে তিনি লুই বেনোয়া নামেও পরিচিত। খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হবার পর জামর এই নাম গ্রহণ করেন। এতকিছুর পরও একটা কথা না বললেই নয়। ব্যক্তিগত জীবনে জামর বুদ্ধিমান ও পড়ুয়াটাইপ হলেও স্বভাবে খুবই দুর্জন ছিলেন। Lenotre-এর Romances of the French revolution বইতে উল্লিখিত কাউন্টেস ব্যারির কথনেও এর প্রমাণ নিহিত,
The second object of my regard was Zamor, a young African boy, full of intelligence and mischief; simple and independent in his nature, yet wild as his country. Zamor fancied himself the equal of all he met, scarcely deigning to acknowledge the king himself as his superior.
এছাড়াও ১৮১৫ সালের পর জামরের ফিরে এসে যে স্কুলে শিক্ষকতা করাতেন, সেখান থেকেও তাকে বের করে দেওয়া হয় তার বাজে স্বভাব আর শিশুদেরকে নির্দয়ভাবে প্রহারের অভিযোগে।
ফরাসি লেখিকা ইভ রুজিয়ের তার ‘লো গেভ্ দ্য জামর‘ তথা জামরের স্বপ্ন (২০০৩) উপন্যাসের মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন,
“কৈশোরে ভারতের দক্ষিণের বেলাভূমিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় জামরের জীবন। সাগর-মহাসাগর আর দ্বীপের বন্দরে বন্দরে কেটেছে জীবনের একটা সময়। দাস হিসেবে সে এসে পৌঁছায় কাউন্টেস ব্যারির কাছে। কৃষ্ণাঙ্গ এ তরুণ একসময় হয়ে ওঠে ভার্সাইবাসীর চোখের মণি। কিন্তু এ সৌভাগ্যের আড়ালে ছিল তিক্ততা ও অসম্মান, যা একসময় তীব্র হয়ে ওঠে।”
ফরাসি বিপ্লবে জামরের অবদান সেই রকম আহামরি টাইপের কিছু হয়তো নয়। কিন্তু এদেশের ভূমিতে জন্ম নেওয়া একজন সন্তান হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেওয়া এক বিপ্লবে তার উপস্থিতি বিশেষ কিছু বৈকি। জামর হয়তো দুর্জন বিদ্বান বলে ঐতিহাসিকদের কাছে পরিচিত; কিন্তু দাসপ্রথার নির্লজ্জ আগ্রাসনে সুবা বাংলার এক সহজ-সরল এগারো বছরের বালকের জীবন তছনছ হয়ে যাওয়ার পর তার চারিত্রিক বিশ্লেষণ করা কতটুকু যৌক্তিক এটাও ভাবা উচিৎ নয় কি? ফরাসি বিপ্লবে জামরের অনস্বীকার্য অবদান তার চরিত্রের ঋণাত্মকতাকে ছাপিয়ে হিরণ্ময় দ্যুতিতে চিরভাস্বর হয়ে আছে এবং থাকবে।
ফুটনোটঃ
1. Haslip, Joan (August 6, 2005). Madame du Barry: The Wages of Beauty. Tauris Parke Paperbacks. p. 150 & 191. ISBN : 1-85043-753-X.