বিশ্ব রাজনীতির মোটামুটি খবর রাখেন কিন্তু এডওয়ার্ড স্নোডেনকে চেনেন না, এমন মানুষ খুব কমই আছে। ২০১৩ সালে তিনি ‘মোস্ট ওয়ান্টেড আমেরিকান’ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটিয়ে। গত চার বছর ধরে এডওয়ার্ড স্নোডেন মস্কোতে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। অথচ মার্কিন নাগরিক এই যুবকের কী না ছিল? হাওয়াইতে ছিল সুন্দর ছিমছাম একটা বাড়ি, দু’লাখ ডলার বাৎসরিক বেতনের চাকরি, বন্ধু-বান্ধবী, পরিবার-পরিজন সবই ছিল তার। এই আয়েশি জীবন ছেড়ে স্বদেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। কারণ তার সরকার তার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে মামলা করেছিল। তার দেশের রাজনীতিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের রাঘববোয়ালেরা তাকে আখ্যায়িত করেছিল বিশ্বাসঘাতক, রাষ্ট্রদ্রোহী, রাশিয়ান চর, এমনকি চোর হিসেবেও!
মার্কিন সরকার যতই মামলা করুক না কেন, সত্যিটা হলো বিশ্বগোলকের অধিকাংশ মানুষ স্নোডেনকে তার কাজের জন্য নায়ক ভাবে এবং স্নোডেন নিজেও নিজেকে মানবাধিকার কর্মী হিসাবে দাবি করেন। তাহলে কোন উদ্দেশ্যে তিনি ফাঁস করলেন দেশের জন্য আত্মঘাতী এমন সব তথ্য? কেমনই বা আছেন তিনি বর্তমানে? চলুন পুরোটা জেনে নেই।
গোড়ার ঘটনা
২০০৪ সালে স্নোডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি রিজার্ভের একটি বিশেষ বাহিনীতে প্রশিক্ষণের জন্য আবেদন করেন। তিনি ইরাক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। কারণ তিনি মনে করতেন একজন মানুষ হিসেবে নিপীড়িত মানুষকে সাহায্য করা তার দায়িত্ব। কিন্তু কোনো প্রশিক্ষণই তিনি সেখান থেকে নিতে পারেননি। প্রশিক্ষণকালে এক দুর্ঘটনায় উভয় পা ভেঙে গিয়েছিল। ফলে ২০০৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তাকে বরখাস্ত করা হয় প্রশিক্ষণ থেকে।
মিলিটারিতে যোগ না দিতে পেরে ২০০৫ সালে তিনি মেরিল্যান্ডের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি অব ল্যাংগুয়েজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা কেন্দ্রের সিকিউরিটি স্পেশালিস্ট হিসাবে এক বছরেরও কম সময় কাজ করেছিলেন। এই গবেষণা কেন্দ্রটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসএ) দ্বারা পরিচালিত ছিল।
২০০৬ সালের মাঝামাঝিতে একটি জব ফেয়ারে অংশ নিয়ে স্নোডেন সিআইএর গ্লোবাল কমিউনিকেশন বিভাগের একটা পজিশনের জন্য চাকরির প্রস্তাব পান। তিনি সেটা গ্রহণ করেন। এজেন্সি তাকে ভার্জিনিয়ার ল্যাংলেতে সিআইএ সদর দপ্তরে সিআইএর কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করে। এখানে এসেই স্নোডেন বুঝতে পারেন, আইটিতে তার অসাধারণ দক্ষতা তার জন্য রাষ্ট্রের সমস্ত কাজের দরজা খুলে দেবে। তিনি অনলাইনে লিখলেন ,
“First off, the degree thing is crap, at least domestically. If you ‘really’ have 10 years of solid, provable IT experience… you CAN get a very well-paying IT job.“
২০০৭ সালের মার্চ মাসে স্নোডেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আসেন আইটির একটি দল নিয়ে। তার দায়িত্ব ছিল সিআইএকে সেখানকার ব্যাংকিং শিল্পখাত সম্পর্কে তথ্য দেওয়া। মূলত তাকে জাতিসংঘের পক্ষে মার্কিন মিশনের জন্যই নিযুক্ত করা হয়েছিল সেখানে।
সিআইএ এজেন্টদের নৈতিকতার ব্যাপারে জেনেভাতেই প্রথম ধারণা লাভ করেন স্নোডেন। তিনি জানতে পারেন:
- এজেন্টরা কী পরিমান সোর্স রিক্রুট করেছে- এর উপর ভিত্তি করে তাদের পদোন্নতি দেয়া হতো। তাই তারা সোর্স নিয়োগের ক্ষেত্রে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো। তারা সোর্সের মূল্য বিচার না করেই যে কাউকে নিয়োগ দিতে চেষ্টা করতো।
- এজেন্টরা টার্গেট করা লোকদেরকে মদ পান করিয়ে তাকে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করত। তারাই আবার তাদেরকে মদ্যপ অবস্থায় ড্রাইভিং এর কারণে জেলে ঢুকাতো, জরিমানা করত, আবার জেল থেকে বের করে আনতো তারাই।
- জেনেভাতে অনেক গুপ্তচরের সাথে দেখা হয়েছে তার, যারা মধ্যপ্রাচ্যে ইরাক ও মার্কিন নীতির গভীরভাবে বিরোধিতা করেছিল।
- সিআইএর অফিসাররা চলে যাচ্ছিল স্বদেশে। কিন্তু নেটওয়ার্ক সিকিউরিটির টিমকে তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার আদেশ করা হয়েছিল কম্পিউটার সিস্টেম ও নেটওয়ার্ক অপারেশন চালু রাখার জন্য। কারণ তাদের দরকার যুদ্ধের আগাগোড়া তথ্য। এ সমস্ত তথ্য দিয়েই যে কাউকে টার্গেট করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।
এসব দেখে স্নোডেনের মনে ঘৃণা জন্মেছিল সিআইএর প্রতি। বিষয়গুলো গভীরভাবে তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল।
২০০৮ সালে এলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। স্নোডেন ছিলেন রন পল ও রিপাবলিক দলের জন ম্যাককেইন এর সাপোর্টার। তিনি ওবামাকে সমর্থন করতেন না। ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর, স্নোডেন তাকে সহ্যই করতে পারছিলেন না। জেনেভাতে তিনি দেখেছিলেন তার সরকার কীভাবে কাজ করে এবং তা কতটা ক্ষতিকর। তিনি উপলব্ধি করছিলেন, তিনিও সরকারের এমন খারাপ কাজের অংশীদার। এই উপলব্ধি থেকে ২০০৯ সালে তিনি সিআইএর চাকরিটা ছেড়ে দেন। পরে জাপানে মার্কিন সামরিক বেসে এনএসএর চুক্তিভিত্তিক কর্মী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। জাপান ছিল তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
স্নোডেন ২০১২ সালে জাপান ছেড়ে হাওয়াই চলে যান। হনলুলুর কাছাকাছি একটা দ্বীপে তিনি নতুন করে একটা কাজ নেন এনএসএর আঞ্চলিক ক্রিপ্টোলজিকাল সেন্টার (সেন্ট্রাল সিকিউরিটি সার্ভিস) এর ঠিকাদারি বা চুক্তিভিত্তিক কর্মী হিসেবে।
তবে তিনি সেখানেও কাজ করেছেন মার্কিন গোয়েন্দাদের পক্ষ হয়ে। এনএসএ বিদেশী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপর গোয়েন্দা নজরদারি করত, বিশেষত চীনা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপর। শুধু মাত্র বিদেশীদের উপরেই নয়, মার্কিন প্রত্যেক নাগরিকের উপরও নজরদারি করত তারা। যাদের করের টাকায় রাষ্ট্র চলে, যাদের ভোটে সরকার নির্বাচিত হয়, তাদেরই চলাফেরা থেকে শুরু করে সব কাজের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি করছে সরকার! মার্কিন জনগণসহ বিশ্বের অসংখ্য মানুষের ব্যক্তিগত টেলিফোন আলাপ গোপনে রেকর্ড করেছে এনএসএ।
এই অভিজ্ঞতা থেকে স্নোডেন চাইলেন নাগরিকদের স্বার্থে তার কিছু করা উচিৎ। ঠিক এখান থেকেই তিনি সিআইএ ও এনএসএর সব অনৈতিক কার্যক্রমের তথ্য ফাঁস করার পরিকল্পনা করেন। তাই বিভিন্ন সাংবাদিকদের সাথে বেনামে যোগাযোগ করতে আরম্ভ করলেন তিনি। স্নোডেন চেয়েছিলেন শীর্ষ গোপন নথিপত্রগুলো কপি করে সেগুলো সাংবাদিকদের কাছে তুলে দেবেন। তিনি ভাবলেন, গতানুগতিক মিডিয়ার হাতে তথ্যগুচ্ছ তুলে দেয়াটা বোকামি হবে। তাই তিনি বিকল্প হিসাবে স্বাধীনচেতা সাংবাদিকদের খুঁজতে থাকলেন, যারা প্রশাসনের ভুল ধরিয়ে দিয়ে যেকোনো লেখালেখি করতে পারেন। ব্লগিং এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার সমস্ত বাতায়নেই যারা সিদ্ধহস্ত এবং এই প্রজন্মের কাছে যারা বিশ্বস্ত, স্নোডেন তেমন সাংবাদিকদের কাছেই সংবাদ দেবেন বলে ঠিক করলেন। এমনই একজন হিসেবে তিনি নির্বাচন করলেন আমেরিকান আইনজীবী ও সাংবাদিক গ্লেন গ্রিনওয়াল্ডকে, যিনি তখন ব্রিটেনের দৈনিক গার্ডিয়ান এর জন্য লেখতেন। গ্রিনওয়াল্ডকে স্নোডেন ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বেনামে ই-মেইল করলেন। তাতে শুধু লিখলেন “আমার কাছে এমন কিছু আছে যেগুলো আপনি খুব পছন্দ করবেন।” কিন্তু গ্রিনওয়াল্ড এর কোনো জবাব দেননি। কারণ ই-মেইলটা এসেছিল বেনামি একটা আইডি থেকে।
স্নোডেন কোনোভাবেই যখন গ্রিনওয়াল্ডের সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না, তখন তিনি গ্রিনওয়াল্ডের বন্ধু লরা পইত্রাসকে ই-মেইল করলেন। লরা পইত্রাস হলেন একজন অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা। স্নোডেন ইমেইলে লেখলেন “I am a senior member of the intelligence community. This won’t be a waste of your time”। যদিও স্নোডেন এজেন্সির বড় মাপের কোনো সদস্য ছিলেন না, তবু তিনি নিজেকে ‘বড়’ বলেই পরিচয় দিয়েছিলেন, যাতে তার ইমেইলের জবাব পান। এভাবেই লরা পইত্রাসের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে গেলেন তিনি।
২০১৩ সালে লরা পইত্রাসের কাছে স্নোডেন মেইল করলেন, তার কাছে রয়েছে ২০ পাতার পুরো রাষ্ট্রপতি পলিসির নির্দেশিকা এবং ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত একটি ‘টপ সিক্রেট’ শ্রেণীর ১৮ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট। তিনি এগুলোর সব প্রমাণ সহ দিতে পারবেন বলে জানালেন। এই কথা শুনে পইত্রাস নড়ে চড়ে বসলেন। তখন তিনি স্নোডেনকে গুরুত্ব দিয়ে নিউইয়র্ক আসলেন।
স্নোডেন তারপর প্রিজম নিয়ে একটা পাওয়ার পয়েন্ট ফাইল পইত্রাসকে মেইল করলেন। সাথে বলে দিলেন, পরদিন দেখা হচ্ছে হংকং এ। এ সময় স্নোডেন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপে, আমেরিকান নিরাপত্তা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাজ অ্যালান হ্যামিল্টনের কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। তিনি দরখাস্ত করলেন এই বলে, তার শরীর ভালো না, তাই তিনি ছুটি চান। এরপর তিনি মেমোরি কার্ডে সব তথ্য কপি করে রুবিকস কিউবের ভিতর সেই মেমোরি কার্ড লুকিয়ে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে এলেন বাজ অ্যালান হ্যামিল্টনের সেই সিকিউরড বাঙ্কার থেকে।
তিনি আমেরিকা ছেড়ে চলে গেলেন হংকং। সেখানে একটা হোটেলে উঠলেন। লরা পইত্রাস, গ্লেন গ্রিনওয়াল্ড এবং গার্ডিয়ানের ওয়াশিংটন সংবাদদাতা এওয়েন ম্যাকাসকিল হোটেলে উঠে স্নোডেনের সাথে দেখা করলেন। এই প্রথম তারা স্নোডেনকে দেখলেন এবং প্রত্যেকেই আশ্চর্য হলেন। সবাই ভেবেছিলেন এনএসএর ষাটোর্ধ কোনো কর্মকর্তার সাথে তারা এতদিন যোগাযোগ করেছিলেন। তারা ভাবতেও পারেননি, মাত্র ২৯ বছর বয়সী একজন যুবক এত বড় কাজ করতে যাচ্ছেন।
২০১৩ সালের জুন মাসে গ্লেন গ্রিনওয়াল্ড স্নোডেনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গার্ডিয়ানে ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখতে শুরু করেন। মার্কিন শাসকদের মাথায় বাজ পড়তে শুরু করল, ক্রোধে ফেটে পড়তে থাকল হোয়াইট হাউস। কিন্তু গ্রিনওয়ার্ল্ড স্নোডেনের নাম প্রকাশ করেননি। গার্ডিয়ানে গ্লেন গ্রিনওয়াল্ডের সাড়া জাগানো প্রতিবেদনগুলো প্রকাশের একপর্যায়ে যখন জানাজানি হয়ে যায় যে, ইতিহাসের সর্ববৃহৎ গোপন তথ্য ফাঁসের এ ঘটনার নেপথ্যে আছেন স্নোডেন, তখন তিনি তার স্বদেশের সরকারের কাছে হয়ে গেলেন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ আমেরিকান। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক হুলিয়া জারি করে মার্কিন সরকার। হাওয়াইতে স্নোডেনের সাথে থাকতেন তার গার্লফ্রেন্ড লিন্ডসে মিলস। তখন লিন্ডসে মিলসের হাওয়াইয়ের বাসায় সরকারের লোকজন গেলে মিলস আত্মগোপন করেন। স্নোডেন হংকংয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেন, কারণ যুক্তরাষ্ট্র সরকার হংকং সরকারের উপর চাপ দিচ্ছিল স্নোডেনকে গ্রেপ্তার করে তাদের হাতে তুলে দিতে। সেই চাপে হংকং সরকারের যেন নতি স্বীকার করতে না হয় তাই স্নোডেন হংকং ত্যাগ করেন।
এর মধ্যে গোপনে তার সাথে যোগাযোগ ঘটে উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের, যিনি তখন নির্বাসিত ছিলেন লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাসে। অ্যাসাঞ্জ স্নোডেনকে ইকুয়েডরে পাঠানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু হংকং থেকে বিমানে চড়ে ইকুয়েডরে পৌঁছানো স্নোডেনের পক্ষে সম্ভব হয়নি, মাঝপথে তিনি থেকে যান মস্কো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ট্রানজিট লাউঞ্জে। মার্কিন সরকারের চাপের কারণে কোনো দেশের বিমান কোম্পানি স্নোডেনকে বহন করে ইকুয়েডর কিংবা কিউবা নিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। স্নোডেন রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। রাশিয়া সাথে সাথেই সে প্রার্থনা মঞ্জুর করেনি, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক চাপ রাশিয়ার ওপরেও ছিল প্রচণ্ড। আর তখনো ওবামার সাথে পুতিনের সম্পর্কের এতটা অবনতি ঘটেনি, যতটা ঘটেছে ইউক্রেনে রাশিয়ার নাক গলানো ও ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার পর। তবে শেষ পর্যন্ত রাশিয়ায় স্নোডেনের সাময়িক রাজনৈতিক আশ্রয় মেলে, যেটা এখন ২০২০ পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়েছে। তিনি প্রায় দেড় মাস পর বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে মস্কো শহরের কোনো এক স্থানে আশ্রয় নেন। সেই থেকে তিনি মস্কোতেই আছেন। তার সাথে ছিল তিনটি ল্যাপটপ। শোনা যায়, তার কাছে আমেরিকার যত ‘টপ সিক্রেট’ তথ্য রয়েছে, এর সবই তিনি দিয়ে দিয়েছেন রুশ গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষকে। স্নোডেন অবশ্য এটি অস্বীকার করেন।
তার ফাঁস করা তথ্যগুলো
Planning Tool for Resource Integration, Synchronization, and Management (PRISM) বা প্রিজম মানে হল গোপনে আড়িপাতার কর্মসূচি, যেটা ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চালু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ কোনো রকম ঘোষণা ছাড়াই গোপনে আড়িপাতার কর্মসূচি চালু করেছিলেন। এ কর্মসূচির মাধ্যমে সব রকম তথ্যের দখল নিতে পারে গোয়েন্দারা, যেটা একটা অবৈধ কাজ। কারণ এতে করে নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতা চরমভাবে হুমকির মধ্যে পড়ে।
মাসকুলারও প্রিজমের মতোই একটি গোপন কার্যক্রম। তবে মাসকুলার হলো ব্রিটেনের Government Communications Headquarters এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের National Security Agency-র যৌথ গোয়েন্দা নজরদারির গোপন প্রোগ্রাম। এডওয়ার্ড স্নোডেন বলেন, গুগল ও ইয়াহুর মতো ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ রেকর্ড ঘেঁটে দেখেন গোয়েন্দারা। সরাসরি ডাটা সেন্টার হ্যাক করার পরিবর্তে ডাটা সেন্টারে ব্যবহৃত ফাইবার অপটিক ক্যাবল ও অন্যান্য নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতি থেকে এসব ডাটা সংগ্রহ করেন গোয়েন্দারা। এগুলো এনক্রিপটেড ডাটা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কোথাও থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং পরে তা গোয়েন্দাদের মাসকুলার নামক গোপন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়। পরবর্তীতে এসব তথ্যের ভিত্তিতে নজরদারি করা হয়।
যেসব প্রতিষ্ঠানে আড়িপাতা হয়েছিল
ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, মাইক্রোসফট, ইয়াহু, গুগল, ফেসবুক, পালটক, এওএল, স্কাইপ, ইউটিউব, অ্যাপলের পাশাপাশি ড্রপবক্সের মতো নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারির বাইরে নয়।
নজরদারিতে বিশ্বনেতারা
জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) ৩৫ জন বিশ্বনেতার ফোনে আড়ি পেতেছিল। এর মধ্যে জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, ব্রাজিলের নেতাদের নাম রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ আড়িপাতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, নিয়মিতই এ কাজ করত এনএসএ।
স্নোডেনের বর্তমান
স্নোডেন এখন রাশিয়ার মস্কোতে আছেন। তার সাথে তার গার্লফ্রেন্ড লিন্ডসে মিলস আছেন। তার মার্কিন বন্ধুরাও আছেন সাথে। তিনি কিছুদিন আগে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে তার জন্য সুবিচার নেই, প্রায় ১০০ বছর আগের এক আইন অনুযায়ী তাকে দণ্ডবিধি দেয়া হয়েছে। তাই তার যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ইচ্ছে কমে যাচ্ছে বলে জানান স্নোডেন। তিনি টুইটারে @snowden নামের একটি একাউন্ট খুলেছেন। এই একাউন্ট দিয়েই তিনি এখন তার কথাগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরেন।
লোভনীয় চাকরি আর আরামদায়ক জীবন ছেড়ে সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্নোডেনকে দেশছাড়া হতে হলেও গোটা পৃথিবীর অনেক মানুষের চোখে স্নোডেন একজন বীর, স্নোডেন একজন সত্যিকারের মানবাধিকারকর্মী।
ফিচার ছবিসূত্র: Huffington Post