ফকল্যান্ড, দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে ছোট্ট ৭৭৮টি দ্বীপের সমষ্টি। সবথেকে বড় দুটোর নাম পূর্ব এবং পশ্চিম ফকল্যান্ড। দ্বীপপুঞ্জের মোট আকার বেশি না, মাত্র ৪,৭০০ বর্গ মাইল। ১৯৮২ সালে এর জনসংখ্যাও ছিল খুব কম, ১,৮২০ জন মানুষ আর ৪ লক্ষ ভেড়া। তো এহেন একটা সাদামাটা দ্বীপ নিয়ে যুদ্ধ বেধে যাবে, এমন ভাবাটা কষ্টকর।
যুদ্ধ কিন্তু বেধেছিলো। ১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনার সেনাবাহিনী এই দ্বীপ দখল করে নেয়। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ আসলে ব্রিটিশ প্রোটেক্টোরেট। এর অর্থ দ্বীপটি স্বশাসিত এবং এর সামরিক দেখভাল করার দায়িত্ব গ্রেট ব্রিটেনের। দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরাও প্রায় সকলেই ব্রিটিশ বংশোদ্ভুত ছিল। আর্জেন্টাইনদের কাছে এই দ্বীপপুঞ্জ ‘লাস মালভিনাস’ নামে পরিচিত।
১৯৮২ সালের ২ এপ্রিল; আচমকা ৬০০ জন আর্জেন্টাইন সৈন্য ফকল্যান্ড দ্বীপটি আক্রমণ করে নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। সে সময় ফকল্যান্ডে ব্রিটিশ সেনা উপিস্থিতি ছিল না বললেই চলে। আর্জেন্টাইনরা বহুদিন ধরেই ফকল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ দাবি করে আসছিলো, এবারে তারা সেটার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল অস্ত্রের জোরে। বেধে গেল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর প্রথম কোনো যুদ্ধ, যেখানে নৌ আর বিমানবাহিনীই চালকের আসনে থাকবে।
কেন আর্জেন্টিনা ফকল্যান্ড দখল করলো?
কারা ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করেছিলো তা নিয়ে বিতর্ক চলমান। তবে গ্রেট ব্রিটেন সেই ১৬৯০ সাল থেকেই এই দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ দাবি করে এসেছে। সময়ের পরিক্রমায় ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ কখনো ফরাসীদের হাতে, কখনো ব্রিটিশদের হাতে, কখনো স্প্যানিশদের হাতে আবার কখনো আর্জেন্টিনার নিয়ন্ত্রণে ছিল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও মাস দুয়েক দ্বীপখানা নিজেদের কব্জায় রেখেছিলো। এহেন ঘোলাটে ইতিহাস না ঘেটে সরাসরি বলে দেওয়া যায়, ১৮৩৩ সালে থেকেই আর্জেন্টিনা আর যুক্তরাজ্যের মধ্যে এই দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে মন কষাকষি চলছে।
১৯৪৫ সালে শেষ হল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদের এক অন্তিমকাল শুরু হল এই মহাযুদ্ধের পরে। বিশ্বময় একের পর এক স্বাধীন রাষ্ট্র মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, পিছু হটছে ইউরোপীয় শক্তিগুলো। আর্জেন্টিনা দেখলো, এটাই সুযোগ। জাতিসংঘে তারা নিয়ে গেল ফকল্যান্ডের দাবি। এই নিয়ে চাপান উতোর চললো ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে একবার, মার্গারেট থ্যাচার ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাজ্য আসলেই দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ আর্জেন্টিনার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলো, তবে সংসদীয় জটিলতা এবং দ্বীপের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী যুক্তরাজ্যের সাথে থাকার দাবি জানালে সেসব প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি।
এবারে নজর ফেরানো যাক আর্জেন্টিনার দিকে। ১৯৭৪ সাল থেকে সেখানে চলছে ‘ডার্টি ওয়ার’, ক্ষমতায় সামরিক জান্তা। লা প্লাতা নদীতে বিমান থেকে হাজারে হাজারে মানুষ ফেলে দেওয়া হচ্ছে, চলছে গুম, খুন আর নির্যাতন। দেশ ভুগছে তীব্র বেকারত্ব আর আর্থিক মন্দায়। একসময় পৃথিবীর শীর্ষ ৭ ধনী দেশের অন্যতম আর্জেন্টিনার নাগরিকেরা যে এতে বেজায় নাখোশ হবেন সেটাই স্বাভাবিক। কাজেই সাহসী এক চাল চাললেন সামরিক জান্তার প্রধান লিওপোল্ডো গালতিয়েরি। সিদ্ধান্ত নিলেন ফকল্যান্ড দখল করবেন এবং দেশপ্রেমকে পুজি করে মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত করবেন। তার অ্যাডমিরাল হোর্হে আনিয়া ধরে নিলেন ১৩,০০০ কিলোমিটার দূরের একটা ছোট্ট দ্বীপপুঞ্জ দখল করবার জন্য যুক্তরাজ্য বিশেষ চেষ্টা চরিত্র করবে না।
কাজেই আর্জেন্টিনা ফকল্যান্ড দখল করলো, ওড়ালো নীল সাদা পতাকা এবং অপেক্ষায় রইলো ব্রিটেনের প্রতিক্রিয়া দেখবার জন্য।
গ্রেট ব্রিটেনের পাল্টা জবাব
দক্ষিণ আমেরিকার একটা দেশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটা অংশ দখল করে নিবে, এটা ব্রিটিশ জনগণ মানতেই পারলো না। লৌহ মানবী মার্গারেট থ্যাচার উঠে পড়ে লাগলেন আর্জেন্টাইনদের একটা উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। দুটো বিমানবাহী উড়োজাহাজ আর অন্যান্য রণতরী পাঠানো হল ফকল্যান্ডের দিকে। সেই সাথে পাঠানো হল টাস্ক ফোর্স। সব মিলিয়ে ১২৭টি জাহাজের বিরাট বহর চললো দক্ষিণ আটলান্টিক সাগরের দিকে।
যুদ্ধ
ফকল্যান্ডের যুদ্ধে অনেকগুলো ছোট-বড় ঘটনা আছে। এই যেমন যুদ্ধের শুরুর দিকে ব্রিটিশদের হাতে যুদ্ধবিমান ছিল মাত্র ৪২টি। এদিকে আর্জেন্টাইনদের হাতে সব মিলিয়ে প্রায় ১২২টি। যদিও ব্রিটিশরা শুরুতেই ২১-২৫ এপ্রিলের মধ্যে সাউথ জর্জিয়া দ্বীপ দখল করে নেয়। আর্জেন্টাইনদের একটি সাবমেরিন ডুবে যায়, ব্রিটিশরা হারায় দুটি হেলিকপ্টার।
এরপরে বেশ কিছুদিন চললো বিমান যুদ্ধ। কোনো পক্ষই ছেড়ে কথা বলতে রাজি নয়। এরই মধ্যে ব্রিটেন আর্জেন্টাইন ক্রুজার জেনারেল বেলগ্রানোকে ডুবিয়ে দিলে প্রায় ৭০০ আর্জেন্টাইন নাবিক প্রাণ হারায়। এই ঘটনা আর্জেন্টাইন সেনা কর্মকর্তাদেরকে দিলো আরো ক্ষেপিয়ে। ৪ মে আর্জেন্টাইন বিমান আক্রমণে ডুবলো এইচ এম এস শেফিল্ড। শুধু তা-ই নয়, এইচ এম এস আর্ডেন্ট ২১ মে, এইচ এম এস অ্যান্টিলোপ ২৪ মে, এইচ এম এস কভেন্ট্রি আর এম ভি আটলান্টিক কনভেয়র ডুবলো ২৫ মে। বিমান আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিরা সিদ্ধান্ত নিলেন অনেক হয়েছে, এবারে ফকল্যান্ড দ্বীপে সেনা নামিয়ে আর্জেন্টাইনদের বিমানঘাটি গুড়িয়ে দিতে হবে। উল্লেখ্য, আর্জেন্টাইন বিমান বাহিনীর হাতে দূরপাল্লার বিমান ছিল না। কাজেই তাদের পক্ষে মূল আর্জেন্টাইন ভূখন্ড থেকে ৩০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এসে ব্রিটিশদের ওপরে হামলা চালিয়ে আবার ফিরে যাওয়া সম্ভব হত না। আর্জেন্টিনার মিসাইল ঘাটি আর যুদ্ধবিমানগুলো ফকল্যান্ডের রাজধানী পোর্ট স্ট্যানলীর বিমানবন্দরেই মজুত থাকতো।
২৭ তারিখে ব্রিটিশ সেনারা গ্রুজগ্রীনের যুদ্ধ জিতে নেয়। দখল করে আশেপাশের বেশ কিছু পদ্ধতিগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এভাবে দ্বীপে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করবার পর অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় রাজধানী স্ট্যানলী দখল করবার জন্য।
আর্জেন্টাইনরা কিন্তু এদিকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দ্বীপে ব্রিটিশরা ৫,০০০ সৈন্য নামালো ১ জুনের মধ্যে। ব্লাফ কোভের কাছে এই সেনারা আর্জেন্টাইন স্কাইহক যুদ্ধবিমানের হামলার মুখে পড়লে ৫৬ জন নিহত হয়। পাশাপাশি আহত হয় আরো ১৫০ জন।
যা-ই হোক, ক্ষয়ক্ষতি সামলে ১১ জুন আবার ব্রিটিশরা যুদ্ধে নামলো। একে একে মাউন্ট হ্যারিয়েট, মাউন্ট লংডন আর মাউন্ট টাম্বলডাউন দখল করে নিল ব্রিটিশরা। এর মধ্যে বিশেষ করে মাউন্ড লংডনে লড়াইটা হয়েছিলো হাড্ডাহাড্ডি। অবশেষে আর্জেন্টাইনরা বুঝলো যুদ্ধ করে আর বিশেষ লাভ নেই। ওদিকে ব্রিটিশ নৌ বেষ্টনী ভেঙ্গে তাদেরকে উদ্ধার করাও আর্জেন্টাইন সরকারের পক্ষে সম্ভব না। উপায়ন্তর না দেখে আর্জেন্টাইন কমান্ড্যার মারিও মেনেন্ডেজ আত্মসমর্পণের ঘোষণা দিলেন। শেষ হল ফকল্যান্ডের যুদ্ধ।
যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি উভয়পক্ষেরই যথেষ্ট হয়েছিলো। বাজে আবহাওয়া, কুয়াশা আর ঝড়ের কারণে দুর্ঘটনার সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। ৭৩ দিনব্যাপী যুদ্ধে ব্রিটিশরা ৭টি যুদ্ধজাহাজ, ২৪টি হেলিকপ্টার আর ১১টি যুদ্ধবিমান হারায়। প্রাণ হারায় ২৫৫ জন সৈন্য, আহত হয় ৭৫৫ জন। আর্জেন্টাইনদের ক্ষয়ক্ষতির পাল্লা আরো ভারি। ৯টি জাহাজের পাশাপাশি ২৫টি হেলিকপ্টার আর ৭৫টি বিমান হারায় তারা। অবশ্য এর মধ্যে অনেকগুলো ছিল হালকা ট্রেইনার এয়ারক্রাফট, যেগুলো যুদ্ধের উপযুক্ত না। সাড়ে ছয়শ আর্জেন্টাইন সৈন্য প্রাণ হারায় যুদ্ধে, আহত হয় দেড় হাজারেরও বেশি।
পরিশেষে
ফকল্যান্ডের যুদ্ধের আগে ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন কনজার্ভেটিভ দলের অবস্থা বিশেষ সুবিধার ছিল না। কিন্তু এই যুদ্ধে জয়ের ফলে রাতারাতি তাদের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় ও ১৯৮৩ সালে মার্গারেট থ্যাচার বিপুল ভোটে পুনর্নির্বাচিত হন। ওদিকে আর্জেন্টাইন সামরিক জান্তার ক্ষেত্রে ফল হয় উল্টো। যুদ্ধে পরাজয়কে আর্জেন্টাইনরা জাতীয় অপমান হিসেবে ধরে নেয়, সামরিক বাহিনীকে এর আগে আর্জেন্টাইন সমাজে খুবই উচুঁ নজরে দেখা হত। সেই ভাবমূর্তিও লোপ পায়। যুদ্ধের কিছুদিন পরেই ১৯৮৩ সালে আর্জেন্টিনায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, পতন ঘটে সামরিক জান্তার।
আর্জেন্টিনায় এখনো ফকল্যান্ড খুব স্পর্শকাতর একটি বিষয়। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তী ডিয়েগো ম্যারাডোনা তার আত্মজীবনী ‘আই অ্যাম এল ডিয়েগো’-তে লিখেছেন যে ১৯৮৬ ফুটবল বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার জয়টি ছিল মূলত ফকল্যান্ড যুদ্ধে হারের প্রতিশোধ। আর্জেন্টাইন প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা ক্রিচনার এই ২০১৩ সালেও ফকল্যান্ড ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন।