ফোনে কোন কল আসলে আমরা প্রায় সবাই রিসিভ করেই যে কথাটা সর্বপ্রথম বলি তা হলো ‘হ্যালো’। বর্তমানে বিশ্বের মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে বর্তমানে ৯৮% ব্যক্তিই প্রথমে হ্যালো দিয়ে কথা বলা শুরু করেন। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি কেন আমরা ‘হ্যালো’ বলে কথোপকথন শুরু করি? আর কীভাবেই বা এই ‘হ্যালো’ শব্দের সূচনা হলো? আসুন আজ এ সম্পর্কে জানা যাক।
আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের প্রেমিকার নাম ছিল হ্যালো?
চলুন, প্রথমেই আমরা এই ‘হ্যালো’ সম্পর্কে যে ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে সে সম্পর্কে জানি। সর্বপ্রথম টেলিফোন আবিষ্কার করেছিলেন আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল। বলা হয়ে থাকে, আমরা সবাই ‘হ্যালো’ শব্দটিকে সম্ভাষণ হিসেবে ব্যবহার করে থাকি কারণ গ্রাহাম বেলের প্রেমিকার নাম ছিল হ্যালো! এবং পরবর্তীতে বেল তাকে বিয়ে করেছিলেন। সে হিসেবে তার স্ত্রীর নাম হওয়া উচিত হ্যালো বেল।
আবার অনেকে বলে থাকে, গ্রাহাম বেলের প্রেমিকার নাম ছিল মার্গারেট হ্যালো। টেলিফোন কলের উত্তর দেয়ার জন্য একটি মানসম্মত শব্দ ব্যবহার করতে গিয়ে বেল তার প্রেমিকার নাম-ই ব্যবহার করেছিলেন। প্রেমিকার প্রতি নিজের ভালবাসা প্রকাশের নিদর্শন স্বরূপ তিনি ‘হ্যালো’ শব্দটি ব্যবহার করেন যাতে পরবর্তীতে সবাই তার ভালোবাসার কথা মনে রাখে।
যদিও প্রচলিত এই ধারণাগুলো সত্যি হলেই বরং ভাল লাগতো, তবুও সত্যিকার অর্থে এগুলো পুরোপুরি ভ্রান্ত কাহিনী। প্রথমত, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল যাকে বিয়ে করেছিলেন তার নাম ম্যাবেল গার্ডিনার হুবার্ড। বিয়ের পর তার নাম হয় ম্যাবেল বেল। এছাড়াও এ পর্যন্ত কোনো সত্যিকারের প্রমাণ পাওয়া যায়নি বেলের তথাকথিত প্রেমিকা মার্গারেট হ্যালো সম্পর্কে। বিয়ের আগে অন্য কোনো নারীর সাথে বেলের প্রেমের সম্পর্ক ছিল এমন কোনো দলিলও ইতিহাসের কোথাও পাওয়া যায় না।
তবে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের ভালবাসার সত্যিকারের একটি নিদর্শন আসলেই পাওয়া গিয়েছে তার ছাত্রী ম্যাবেলকে বিয়ে করার মাধ্যমে। কারণ ম্যাবেল হুবার্ড কানে শুনতে পেতেন না। তার প্রতি বেলের মনে জন্মেছিল অপরিসীম মায়া এবং ভালবাসা। সে থেকেই তিনি পরে এই মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বধির হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে বিয়ে করেন। তাই গ্রাহাম বেলের প্রেমিকার নাম থেকে যে হ্যালো শব্দটি সম্ভাষণ স্বরূপ এসেছে তা পুরোটাই ভ্রান্ত ধারণা।
তাহলে টেলিফোনে বলা প্রথম শব্দ কী ছিল?
এখন যদি আপনার মনে প্রশ্ন জেগে থাকে যে, যদি ‘হ্যালো’ মানুষের বলা টেলিফোনে বলা সর্বপ্রথম কথা না হয়ে থাকে তবে সেটা কী ছিল? এর উত্তর শুনে আপনি কিছুটা আশাহতও হতে পারেন। টেলিফোন আবিষ্কারের পর ১৮৭৬ সালের ১০ মার্চ আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল সর্বপ্রথম তার পাশের ঘরে থাকা সহকারীকে ফোন দিয়েছিলেন। টেলিফোনের মাধ্যমে যে কথাটি তিনি বলেছিলেন তা ‘হ্যালো’র মতো কোনো সম্ভাষণও ছিল না। কথাটি হচ্ছে, “Mr. Watson, come here. I want to see you.” যার বাংলা করলে দাঁড়ায় এমন, “জনাব ওয়াটসন, এখানে আসুন। আপনাকে আমার দরকার আছে।”
তাহলে ‘হ্যালো’র উৎপত্তি কীভাবে হলো?
মজার ব্যাপার হলো আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল টেলিফোন আবিষ্কার করলেও ‘হ্যালো’ সম্ভাষণটি বলার প্রচলন তৈরি করেছিলেন অন্য এক প্রতিভাবান ব্যক্তি। তিনি হলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী এডিসন। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, ইনিই হলেন বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারক সেই থমাস আলভা এডিসন।
প্রথমত যে টেলিফোন আবিষ্কার করা হয়েছিল সেখানে মূলত কোনো রিং বাজার ব্যবস্থা ছিল না। টেলিফোন ব্যবহার করাই হতো ব্যবসায়িক কাজে, যেখানে একপাশের টেলিফোন লাইনের সাথে অপর পাশের লাইন মূলত সবসময় উম্মুক্ত হিসেবে থাকতো। তাই কখনো কথা বলার প্রয়োজন পড়লে একপাশের ব্যক্তিকে অপরপাশের ব্যক্তিকে নিজের কথা বলার প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করতে কিছু একটা বলে ডাকা বা সম্ভাষণ করার প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন উপলব্ধি করে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল ‘অ্যাহয়‘ (ahoy) শব্দটি প্রচলন করার আহবান জানান। কিছু সময় ধরে ‘অ্যাহয়’ কে টেলিফোনের সম্ভাষণ হিসেবে ব্যবহার করাও হয়। ১৮৭৭ সালের ১৮ জুলাই থমাস আলভা এডিসন ‘প্রিন্সিপাল অব রেকর্ডেড সাউন্ড’ আবিষ্কার করেন। সেসময়ে তার পরীক্ষানিরীক্ষার কাজে তিনি যে শব্দটি বারবার উচ্চস্বরে ব্যবহার করেছিলেন তা হলো ‘Halloo’। আর এই শব্দটিই তিনি প্রথম তার উদ্ভাবিত ‘পেপার সিলিন্ডার ফনোগ্রাফ’ যন্ত্রে রেকর্ড করেছিলেন। এই শব্দটি সেসময়ে ব্যবহৃত হতো মূলত কোন পোষা কুকুরকে শিকারের সময় উৎফুল্ল ও উত্তেজিত করতে এবং কোনো নির্দেশ প্রদানের ক্ষেত্রে। পাশাপাশি কোনো ব্যক্তির মনোযোগ আকর্ষণ করার ক্ষেত্রেও শব্দটির ব্যবহার প্রচলিত ছিল। বলা হয়ে থাকে যে, শব্দটির বারংবার ব্যবহারের ফলে একসময় তা বিকৃত এবং পরিবর্তিত হয়ে ‘হ্যালো’ তে পরিণত হয়। অনেকে আবার বলে থাকেন শব্দটির মূল আবিষ্কারক ছিলেন এডিসন নিজেই। কিন্তু ১৮৭৭ সালের অনেক আগে থেকেই ‘হ্যালো’ শব্দটির প্রচলন ছিল।
অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি অনুযায়ী, সর্বপ্রথম ‘হ্যালো’ শব্দটির ব্যবহার লিপিবদ্ধ হয় ১৮২৭ সালে যা এখন থেকে প্রায় ২০০ বছরের কিছুটা কম সময় আগেই। তখন এই শব্দটি দু’ভাবে ব্যবহার করা হতো কিন্তু যার কোনোটাই সম্ভাষণ হিসেবে ছিল না। প্রথমত কোন কিছুতে অবাক হয়ে গেলে তা প্রকাশের ক্ষেত্রে ‘হ্যালো’ ব্যবহৃত হতো। যেমন; “Hello, what do we have here?” দ্বিতীয়ত, হুট করে কারো দৃষ্টি এবং মনোযোগ আকর্ষণ করার ক্ষেত্রেও শব্দটির ব্যবহার হতো। যেমন, “Hello, what do you think you’re doing?” আবার ১৮৬০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ক্লাসিক ইংরেজি সাহিত্যেও দেখা গিয়েছে বিভিন্ন চরিত্র নিজেদের ভেতর সম্ভাষণের ক্ষেত্রে “hullo” অথবা “hallo” ব্যবহার করছেন। বেশ দূরে থাকা কাউকে ডাকার ক্ষেত্রেও শব্দগুলোর ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে। তবে এটা সঠিক যে থমাস আলভা এডিসনের সেই ‘হ্যালো’ শব্দটির রেকর্ড করার মাধ্যমেই সকল ক্ষেত্রে টেলিফোনে সম্ভাষণ স্বরূপ এটির প্রচলন শুরু হয়ে যায়।
‘হ্যালো’র সফলতার কারণ
এখন অনেকেই ভাবতে পারেন টেলিফোনের আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের নিজের প্রস্তাবিত ‘অ্যাহয়’ এর পরিবর্তে এডিসনের ‘হ্যালো’ কেন পরিচিতি এবং সফলতা পেলো? প্রথম প্রথম ‘অ্যাহয়’ কে সম্ভাষণ হিসেবে ব্যবহার করা হলেও পরবর্তীতে এডিসনের প্রস্তাবিত ‘হ্যালো’র সাথে তুলনা করে দেখা গেল ‘অ্যাহয়’ শব্দটা অনেকটাই কর্কষ, বন্য এবং হাস্যকর হিসেবে শোনায়। অন্যদিকে ‘হ্যালো’ বেশ সহজ এবং একটা উৎফুল্ল ভাব আছে এতে।
পাশাপাশি ১৮৭৮ সালে নিউ হেভেন, কানেকটিকাটের ডিস্ট্রিক্ট টেলিফোন কোম্পানি সর্বপ্রথম একটি ফোনবুক বের করে। সেসময় তাদের মোট ৫০ জন টেলিফোন গ্রাহক ছিল। তাদের প্রকাশিত সেই ফোনবুকে সকলের ফোন নাম্বারের পাশাপাশি ফোন ব্যবহার করার কিছু নির্দেশনাও দিয়ে দেয়া হয়েছিলো। তারা সেখানে তাদের গ্রাহকদের কোনো ফোনকল শুরু করার প্রথমে ‘hulloa’ এর মতো নরম এবং স্ফূর্তিযুক্ত শব্দ দিয়ে কথা বলা শুরু করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। শেষের ‘a’ ছিল অনুচ্চারিত। ফোনবুকে কথা শেষ হলে কি বলে শেষ করতে হবে সে সম্পর্কেও বলা হয়েছিলো। এক্ষেত্রে ‘That is all’ বলে কথা শেষ করার পরামর্শও দেয়া হয়েছিলো। যদিও ‘That is all’ সেভাবে সফলতার মুখ না দেখলেও ‘হ্যালো’ সবকিছুর বাধা পেরিয়ে আজ সবখানে প্রচলিত হয়ে গিয়েছে।
ফিচার ইমেজ: npr.org