জার্মানির কাছে নিজেদের পশ্চিমাঞ্চল এবং সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে পূর্বাঞ্চল হারানোর পর পোল্যাণ্ড সরকার ধরা চলে একপ্রকার নিজের দেশ থেকে বিতাড়িত অবস্থাতেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলো। এরপর জার্মানি যখন রাশিয়া আক্রমণ করলো তখন রাশিয়া তাদের যুদ্ধবন্দি পোলিশ সৈন্যদের ছেড়ে দেয়। সেই মুক্তি পাওয়া সৈন্যরা পুনরায় একত্র হয়ে ছোট ছোট সৈন্যদলে রূপ নিতে থাকে।
১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে এরকমই ছোট একটি পোলিশ সৈন্যদল পারস্যে আগমন করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পারস্যের পার্বত্য এলাকা দিয়ে ভ্রমণ করে মিশর ও ফিলিস্তিনে প্রবেশ করা। যেখানে তারা ইংরেজ সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে পুনরায় সংঘবদ্ধ হতে পারবে। যে কাহিনী প্রচলিত রয়েছে তা হলো, সেই পার্বত্য এলাকা দিয়ে ভ্রমণের সময় এই ছোট সৈন্যদল এক ইরানী রাখাল বালকের সাক্ষাৎ পায়, যার কাছে একটি সিরিয়ান বাদামী বাচ্চা ভালুক ছিল। বাচ্চা ভালুকটি ছিল অনাথ। ধারণা করা হয়, তার মাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো।
সেসময় খাবারের জন্য চারিদিকে ছিল হাহাকার। রাখাল ছেলেটিও ছিল ক্ষুধার্ত। তাই সে খাবারের বিনিময়ে ভালুকটিকে দিয়ে দিতে রাজি হয়। পোলিশ সৈন্যদল তৎক্ষণাৎ কিছু টিনজাত মাংস রাখাল ছেলেটিকে দিয়ে বাচ্চা ভালুকটিকে নিয়ে নেয়।
ভালুকটিকে পাওয়ার এই গল্পটির সত্যতা নিয়ে যদিও সন্দেহ রয়েছে, তবে সেই পোলিশ সৈন্যদলটির সত্যিকার অর্থেই একটি বাচ্চা ভালুক ছিল। তারা বাচ্চাটির নাম রেখেছিল Wojtek, যার উচ্চারণ ‘ভয়টেক’ এবং অর্থ ‘যে যুদ্ধ উপভোগ করে’ বা ‘হাসিখুশি যোদ্ধা’। ভালুকটি দ্রুত সৈন্যদলটির একপ্রকার মাস্কটে পরিণত হয়ে যায়। তবে সে মাস্কটের থেকেও আরো বেশি কিছু ছিল তাদের জন্য। Voytek the Soldier Bear বইয়ের লেখক গ্যারি পলিন বলেন,
“পোলিশ সৈন্যদের তখন নিজের বলতে কিছুই ছিল না, কারণ তারা যুদ্ধে সবকিছু হারিয়েছিলো। ভালুকটি সেসময়ে মাস্কটের থেকেও বেশিকিছুতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল তাদের কাছে। তাদের মনোবল ধরে রাখতে এবং উৎসাহ দিতে সে ছিল একপ্রকার আশার প্রতীক।”
সে সময়ে পোলিশ-২ কর্পের, আর্টিলারি ডিভিশনের ২২তম ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির বেসরকারি সদস্যে পরিণত হয় ভয়টেক। কোম্পানিটি যখন ইরানের পর সিরিয়া এবং এরপর ফিলিস্তিন ও মিশর ভ্রমণ করে, ভয়টেকও তখন তাদের সফরসঙ্গী হিসেবে থেকেছে।
শিশু অবস্থায় সৈন্যরা প্রথমে তাকে ফাঁকা ভদকার বোতলে করে দুধ খেতে দিত। শক্ত খাবার খেতে অভ্যস্ত হওয়ার আগপর্যন্ত তাকে এভাবে একে একে ফলমূল, মধু এবং বিভিন্ন সিরাপ খেতে দেওয়া হত। একটি ভালুকের সঠিক যত্ন ও খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকার কারণে তারা তাকে অন্যান্য সৈন্যদের মতোই পরিচর্যা করতো। তার জন্য বরাদ্দকৃত খাবারের নাম দেয়া হয় ‘বেয়ার রেশন’, যা ভয়টেক বেশ উপভোগ করেই খেত। এমনকি বছরের মধ্যেই সে ধূমপানেও অভ্যস্ত হয়ে উঠে!
তার এই ধূমপানের অভ্যাস এবং বিশেষ করে যথেষ্ট পুষ্টিকর খাবার না পাওয়ায় ভয়টেক অন্যান্য ভালুকের তূলনায় আকারে ছোট থেকে যায়। দৈর্ঘ্যে সে ছিল ৬ ফুটের কাছাকাছি এবং ওজনে ছিল ৪৮৫ পাউন্ড। তার প্রিয় কাজের মধ্যে ছিল সাথী সৈন্যদের সাথে মারামারি করা। তবে সে একসময় বুঝতে পারে যে, মারামারির সময় সে বেশ কঠোরভাবে আঘাত হানছে, যা তার সাথীরা মোটেই উপভোগ করছেনা। পাশাপাশি সে এটাও বুঝতে পারে কেন সে যত বড় হচ্ছে, তত তার সাথীরা তার সাথে মারামারি করা কমিয়ে দিচ্ছে। যার ফলে এরপরে মারামারি করার সময় সে শক্তিশালী আক্রমণ করা কমিয়ে দেয়; এমনকি মাঝে মাঝে লড়াইয়ে তার সাথীর কাছে ইচ্ছাকৃতভাবে হারও মেনে নেয়।
মানুষের পাশাপাশি ভয়টেক অন্য প্রাণীদের সাথে খেলাধুলা করতেও পছন্দ করতো। সেখানকার একজন ইংরেজ কর্মকর্তার পোষা কুকুর ছিল তার খুব কাছের বন্ধু। তারা একসাথে খেলতে ও মারামারি করতে বেশ পছন্দ করতো। তবে সব প্রাণীরা যে ভালুকটিকে সহ্য করতে পারতো তা কিন্তু নয়। একবার ভয়টেক খোলা মাঠে একটি ঘোড়া দেখতে পায়। হয়তো ভেবেছিল এই প্রাণীটিই হতে পারে তার মারামারির যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী! তাই সে এগিয়ে যায়। কিন্তু বেশ কয়েকবার নিজের ঘাড়ে এবং মাথায় লাথি খেয়ে তাকে পালিয়ে আসতে হয়েছিলো। এরপর থেকে সে আর কখনোই ঘোড়া এবং খচ্চরমুখো হয়নি।
ফিলিস্তিনে থাকার সময় ভয়টেক একবার একটি চোর ধরতেও সাহায্য করেছিলো! চোরটি গোলাবারুদ রাখার ঘরে প্রবেশ করেছিলো। আর সেই ঘরে গোলাবারুদের পাশেই ভয়টেক মাঝেমাঝে নিদ্রা যেত। গোলাবারুদের স্থানে একটি ভালুককে দেখে চোরটি বেশ ভয় পেয়ে যায় আর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আশেপাশে রাখা জিনিসপত্রের সাথে ধাক্কা খেয়ে বেশ শব্দ করে ফেলে। কিছু সৈন্য সেই শব্দ শুনে ফেলে এবং চোরটিকে ধরে ফেলে। এরপর পুরষ্কার স্বরূপ ভয়টেককে বিয়ারের একটি বোতল দেওয়া হয়।
১৯৪৩ সালের দিকে সৈন্যরা ইতালির যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশের যত নিকটে আসতে থাকে, তত তারা ভয়টেককে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে থাকে। তারা ভাবতে থাকে ভালুকটিকে কি এখানেই রেখে যাবে নাকি যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সাথে নিয়ে যাবে। ১৯৪৪ সালে মিশর থেকে ইতালির নেপলসে রওনা দেওয়ার সময়ে সমস্যাটা বেশ বড় আকার ধারণ করে। কারণ সৈন্যরা তাকে সাথে নিতে চাইলেও জাহাজের কর্মকর্তারা একটি ভালুককে তাদের জাহাজে নিতে নিষেধাজ্ঞা জানায়।
সৈন্যরা অবশ্য দ্রুতই সে সমস্যার সমাধান করে ফেলে। তারা ভয়টেকের জন্য নির্দিষ্ট পে-বুক, র্যাংক এবং সিরিয়াল নাম্বার তৈরি করে ফেলে। এমনকি তারা তাকে একজন সৈন্যের মতো করে ঠিকঠাক স্যালুট দেওয়াটাও শিখিয়ে দেয়। সবধরনের কাগুজে কার্যকলাপ শেষ হবার পর ভয়টেক সরকারিভাবে পোলিশ-২ কর্পের একজন সদস্যে পরিণত হয়ে যায় এবং জাহাজে করে ভ্রমণে তার আর কোনো বাধা থাকে না।
ব্রিটিশ দূত আর্চিবাল্ড ব্রাউনের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো ইংরেজদের সাথে মিশর থেকে নেপলসে আসা পোলিশ সৈন্যদের তত্ত্বাবধান করার। তিনি একে একে সৈন্যদের নাম ডাকতে থাকেন এবং খাতায় টুকে নিতে থাকেন। কিন্তু তিনি যখন ‘ভয়টেক’ নামটি ডাকেন তখন কেউ সাড়া দেয় না। এ ব্যাপারে ব্রাউন তার কয়েক বছর পরে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, “আমরা বারবার তালিকাটি পরীক্ষা করে দেখছিলাম। সেখানে শুধু কর্পোরাল ভয়টেক নামেই একজন ছিল যে শুধু অনুপস্থিত।” এরপর তিনি অন্য সৈন্যদের জিজ্ঞেস করেছিলেন ভয়টেক কেন তার ডাকে সামনে এগিয়ে আসছে না? তখন একজন সৈন্য মজা করে উত্তর দিয়েছিলো, “কারণ হয়তো সে শুধু পোলিশ এবং পারস্য ভাষাই বোঝে!”। তারপর ব্রাউন যা দেখলেন, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। দেখলেন খাঁচায় করে একটি ভালুককে তার সামনে নিয়ে আসা হলো, যে কিনা আসলে কর্পোরাল ভয়টেক!
তবে শুধু মাস্কটে পরিচিতি লাভের থেকেও ভয়টেক যুদ্ধে বেশ উপকারে এসেছিলো। ব্যাটল অব মন্টি ক্যাসিনো নামক যুদ্ধে ভয়টেকের শারীরিক শক্তি বেশ কাজে লেগেছিলো। সে ট্রাকে করে নিয়ে আসা ভারি গোলাবারুদগুলো বহন করে নিয়ে যেত যুদ্ধের সম্মুখভাগে থাকা মিত্র সেনাদের কাছে, যার মধ্যে ছিল গুলির বড়বড় বাক্স এবং ভারি কামানের গোলাও।
যুদ্ধের পর ভয়টেকের কামানের গোলা বহন করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি সেই ২২তম ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির সরকারিভাবে প্রতীকি চিহ্নে পরিণত হয়। চিহ্নটি পরবর্তীতে বিভিন্ন যানবাহন, পতাকা এবং ইউনিফর্মে ব্যবহার করা হয়েছিলো।
যুদ্ধশেষে প্রায় ৩,০০০ পোলিশ সেনা এবং তাদের ভালুকটি স্কটল্যান্ডে দু’বছর ধরে অবস্থান করে। এরপর ১৯৪৭ সালে তাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। চলে যাবার সময় তারা ভয়টেককেও বিদায় জানিয়ে যান। পরবর্তীতে ভয়টেকের স্থান হয় এডিনবরার চিড়িয়াখানায়। সেখানে সে দর্শকদের প্রধান আকর্ষণে পরিণত হয়ে উঠে। বছর ধরে ভয়টেকের অনেক সেনাসাথীও তাকে দেখতে এসেছিলো। চিড়িয়াখানাটির একজন পরিচারক বলেন,
“ভালুকটির পুরনো বন্ধুরা প্রায়ই আসতো, তারা প্রাচীরের উপর লাফিয়ে উঠে ভালুকটিকে আদর করতো, মাঝে মাঝে বিয়ারের বোতলও দিতো। ভালুকটি যখনই পোলিশ ভাষা শুনতো, তখনই উৎফুল্ল হয়ে উঠতো।”
বন্য এলাকায় সিরিয়ান ভালুকেরা সাধারণত ২০-৩০ বছর বাঁচে। তবে বন্দিদশায়, সযত্নে রাখলে তারা ৪৮ বছর পর্যন্তও বাঁচতে পারে। কিন্তু ভয়টেকের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। সে ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মাত্র ২২ বছর বয়সে মারা যায়। পরবর্তীতে এডিনবরায় ভয়টেকের স্মরণে তামার তৈরি একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়।
ফিচার ইমেজ: catdumb.com