একটা সময় আফ্রিকার কালাে বর্ণের মানুষদের মানুষ হিসেবে স্বীকার করতো না সাদা চামড়ার বেনিয়া ইউরোপীয়রা। বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন কালো বর্ণের মানুষদের চিড়িয়াখানায় রাখা হতো প্রদর্শনের জন্য। দর্শকদের বোঝানো হতো এরা মানুষ নয়, তবে মানুষের মতোই আচরণকারী প্রাণী। স্পষ্ট করে প্রচার করা হতো, ইউরোপীয় নন্দনতত্ত্ব অনুযায়ী এসব মানুষের মাঝে কোনো সৌন্দর্য নেই।
আফ্রিকান কালো মানুষদের পুরো জাতিটিকেই আলাদা নজরে দেখা হতো একটা সময়। বৈজ্ঞানিক কিছু তত্ত্ব ও শ্রেণীকরণ সেই সময়ে ইউরোপের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পালে হাওয়া লাগিয়েছিল জোরেশোরেই। এসব থেকেই শুরু হয় বর্ণবাদের। অবশ্য বর্ণবাদের মতো কলঙ্কজনক প্রথার শিকার যে শুধু আফ্রিকার কালো মানুষগুলোই হয়েছে এমনটা ভাবলে বোধহয় ভুল হবে। উপনিবেশের সাথে বর্ণবাদের সমান্তরাল সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায়। উপনিবেশের মানুষদের আলাদা চোখে দেখা হতো।
আফ্রিকার সহজ-সরল কালো মানুষদের দাস হিসেবে ধরে আনা হয়েছিল ইউরোপে। নির্মমভাবে বেগার খাটানো হতো এদের। নাগরিক অধিকারের বালাই নেই, স্বাধীনতা নেই। শুধু আফ্রিকা থেকে ইউরোপে ধরে আনতে যাত্রাপথেই যে কত প্রাণ ঝরে যেত, তার ইয়ত্তা নেই। আর শ্বেতাঙ্গ দাস-ব্যবসায়ী মনিবদের অবাধ্য হলে প্রাণ কেড়ে নেওয়া সে সময়ে ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
আজকের দিনে ঘানা বলে যে দেশটি আছে, সে দেশেরই উপকূলের একটি ঐতিহাসিক দুর্গ এলমিনা ক্যাসল। সাব-সাহারান আফ্রিকার সবচেয়ে পুরনো ইউরোপিয়ান স্থাপত্য হিসেবে আলাদা খ্যাতি আছে এই দুর্গের। কিন্তু দুর্গের ইতিহাস জানার পর এই খ্যাতি আদতে কুখ্যাতিতে পরিণত হয়। দুর্গ প্রতিষ্ঠার সময় হিসেবে ইতিহাসে লিখিত রয়েছে ১৪৮৬ সাল। প্রতিষ্ঠাকারী পর্তুগিজ। চার বছর সময় লেগেছিল পুরো দুর্গ সম্পন্ন করতে। এলমিনা নামের একটি ছোট শহরে অবস্থিত এটি।
ঔপনিবেশিক যুগের প্রাথমিক সময়ে পর্তুগিজরা এই জায়গায় আসে, তখন এখানকার প্রধান বাণিজ্যিক পণ্য ছিল স্বর্ণ। স্বর্ণের দাম এতই কম ছিল যে, পর্তুগিজরা ভেবেছিল এখানে বোধহয় স্বর্ণের খনি আছে। নইলে এতো স্বল্পমূল্যে কীভাবে স্বর্ণ মেলে? তাই পর্তুগিজরা এই অঞ্চলের নামকরণ করে ‘এলমিনা’। পর্তুগিজ ভাষায় যার অর্থ খনি।
কেউ কেউ দাবি করেন, এটি ছিল পর্তুগিজদের কলঙ্কিত দাস-ব্যবসার একটি ঘাঁটি বা পোতাশ্রয়। আফ্রিকার বিভিন্ন স্থান থেকে দাসদের এখানে এনে জড়ো করা হতো। যাচাই-বাছাইয়ের পর দাসদের জাহাজে চড়িয়ে রওনা হতো ইউরোপ কিংবা আমেরিকার দিকে। উল্লেখ্য আরবি ভাষায় এলমিনা শব্দের অর্থ পোতাশ্রয়।
ঘানার সমুদ্র সৈকতের একদম কাছাকাছি অবস্থিত এই দুর্গটি সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আফ্রিকার অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান। এর পাশেই গিনি উপসাগর, যার বিশাল জলরাশি মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ে উপকূলের বেলাভূমিতে। দুর্গের জানালা দিয়ে যখন বিশাল গিনি উপসাগরের ঠাণ্ডা হাওয়া প্রবেশ করে, তখন স্বর্গীয় অনুভূতির সৃষ্টি হয় দুর্গ ভ্রমণকারীদের মনে।
নাবিকদের সুরক্ষার কথা ভেবে এই দুর্গটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ইউরোপ থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে নাবিকরা যেন আফ্রিকার এই উপকূলে কোনো বাধার সম্মুখীন না হয়, সেটি ভেবেই এই দুর্গের গোড়াপত্তন হয়েছিল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, স্থানীয় আফ্রিকানরা এই দুর্গে যতটুকু আক্রমণ করেছে, তা অন্যান্য ইউরোপীয় জাতির তুলনায় সিকিভাগও নয়। উপকূলে অবস্থিত হওয়ায় জলপথে অন্যান্য ইউরোপীয় জাতি ও জলদস্যুদের সাথে বেশিরভাগ সময় মোকাবিলা করতে হয়েছে পর্তুগিজদের।
এলমিনা দুর্গের সব দেয়ালের রং সাদা। দেয়ালগুলো পাথরের পুরু আস্তরণে তৈরি। কামানের গোলার আঘাতেও যেন দুর্গের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকটি বিবেচনা করেই দুর্গের অবকাঠামো শক্তিশালী করে তৈরি করা হয়েছিল। কারণ তাদের ভালো মতোই জানা ছিল, অন্যান্য ইউরোপীয়রা তাদের একচেটিয়া দাস-ব্যবসায় ভাগ বসাতে বেশিদিন দেরি করবে না।
এরা যখন প্রথম আসে, তখন প্রধান পণ্য ছিল স্বল্পমূল্যে পাওয়া স্বর্ণ। কিন্তু ধীরে ধীরে স্বর্ণের কারবারের চেয়েও দাস-ব্যবসা লাভজনক হয়ে ওঠে তাদের কাছে। আফ্রিকার বিভিন্ন স্থান থেকে সহজ সরল মানুষদের ধরে আনা হতো এই দুর্গে। ইতিহাস বলে, তাদেরকে প্রায় তিন মাস ধরে এখানে থাকতে বাধ্য করা হতো। এই তিন মাস তাদের পায়ে সবসময়ের জন্য শিকল পরানো থাকতো, যাতে পালানোর কোনো উপায় না থাকে। খাবার দেওয়া হতো যৎসামান্য।
যাদের ধরে আনা হতো, তাদেরকে বিভিন্নভাবে যাচাই বাছাই করা হতো এখানে। তাদের বয়স পরিমাপের জন্য দাঁত দেখা হতো। দাঁত দেখে ধারণা করা হতো, তাদের বয়স কতো। বয়সের হেরফেরে দামও হেরফের হতো। শক্তি-সামর্থ্য যাচাই করার জন্য চাবুক দিয়ে কষে মারা হতো। এতে যে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাতো, লাফ দিতো বা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠতো, তাকে শক্ত-সামর্থ্য দাস হিসেবে ইউরোপে নিয়ে যাবার জন্য মনোনীত করা হতো।
এই দুর্গে দাসদের জন্য রাখা হয়নি কোনো শৌচাগার। যে মেঝেতে রাখা হতো, সেখানে খড় বিছানো থাকতো। তাদেরকে ঝুড়ি দেয়া হতো একটি, থাকার জন্য। কিন্তু পায়ের শেকলের কারণে সে ঝুড়িতে থাকাটা খুব কষ্টকর হয়ে উঠতো তাদের জন্য।
তাদের আলাদা আলাদা করে চিহ্নিত করতেও নির্মম পন্থা অবলম্বন করতো ইউরোপীয়রা। শরীরে অক্ষর লেখা হতো, যেটা বেশি ব্যথাদায়ক ছিল না তাদের জন্য। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যেতো, ধাতব ছাঁচ গরম করে শরীরে সেঁক দেয়া হয়েছে। যাতে দীর্ঘ যাত্রাকাল পাড়ি দেয়ার পরও শরীর থেকে দাগ মুছে না যায়। সারাজীবন সে দাগ বয়ে বেড়াতে হতো।
পর্তুগিজরা এই দুর্গের নির্মাতা হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকলেও এর মালিকানা ধরে রাখতে পারেনি। ১৬৩৭ সালে ডাচরা দুর্গের উত্তরদিক থেকে বোমাবর্ষণের মাধ্যমে পর্তুগিজদের বিতাড়িত করে এবং দুর্গের উপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৭০ সালের দিকে ডাচরা এই দুর্গের আরও সম্প্রসারণ ঘটায় আর দুর্গকে আরও শক্তিশালী ও দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলে।
১৮১৪ সালে নেদারল্যান্ডস দাস-ব্যবসা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে এলমিনা দুর্গের ডাচদের কাছে যে গুরুত্ব ছিল, তা হারিয়ে যায়। ১৮৭২ সালে ব্রিটিশদের কাছে এই দুর্গ হস্তান্তর করে ডাচরা। ব্রিটিশরা একটি নিরাপত্তা ফাঁড়ির ভূমিকা থেকে খুব বেশি ব্যবহার করতে পারেনি এই দুর্গটিকে।
আঠারো শতকের প্রতি বছরে গড়ে ত্রিশ হাজার আফ্রিকান কালো মানুষকে দাস হিসেবে এই দুর্গ থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠানো হয়েছে। যাদেকে পাঠানো হয়েছিল, সবাই কিন্তু আর পৌঁছাতে পারেনি। অসংখ্য মানুষ রোগে ভুগে মারা গিয়েছে। শ্বেতাঙ্গ মনিবদের অবাধ্যতার ফল হিসেবে গুলি করে মেরে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হয়েছে অনেকের লাশ।
মানুষের মাঝে শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্ব জাহির করে যে বর্ণবাদ ও দাস ব্যবসা হাজির করা হয়েছিল, তারই সাক্ষী এলমিনা দুর্গ। দেখতে যতই নয়নাভিরাম দৃশ্যের ছোঁয়া থাকুক না কেন, এই দুর্গের যে ইতিহাস রয়েছে, তা পাঠ করলে গা শিউরে উঠার যোগাড় হয়। অসংখ্য মানুষের আর্তনাদ, হাহাকারের সাক্ষী হয়ে আছে দুর্গের সাদা দেয়ালগুলো। আফ্রিকার কালো মানুষদের সাথে একটা সময়ে যে নির্মম আচরণ করেছিল ইউরোপের শ্বেতাঙ্গরা, তার দায় কি ইতিহাস মোচন করবে?