১৮৮৮ সালের ৫ আগস্ট একই সাথে রচিত হয়েছিল বিশ্বের ইতিহাসের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বার্থা বেঞ্জ নামের এক নারী এদিন তার স্বামীর নব-আবিস্কৃত তিন চাকার মোটর গাড়িটি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন স্বামীকে না জানিয়েই। রাস্তা বলতে অবশ্য তখন কিছু ছিল না, ছিল শুধু ঘোড়ার গাড়ি চলার উপযোগী উঁচু-নিচু মাটির পথ। বার্থার উদ্দেশ্য ছিল, এই দুর্গম পথে ১০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে তার বাবার বাড়িতে পৌঁছানো। আর এই দুঃসাহসী অভিযানের মধ্য দিয়েই তিনি ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লিখিয়ে নেন খোলা রাস্তায় বিশ্বের প্রথম গাড়ি চালক হিসেবে।
ঘটনাবহুল দীর্ঘ এ যাত্রায় একই সাথে রচিত হয় বিশ্বের প্রথম গাড়ির বিজ্ঞাপন প্রদর্শন, প্রথম গাড়ি বিকল হওয়া, প্রথম গাড়ি মেরামত করা এবং প্রথম ফিলিং স্টেশনের ব্যবহারের ইতিহাস। একইসাথে এটি ছিল স্বামীর অনুমতি ছাড়া গাড়ি নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ারও প্রথম ঘটনা!
বেঞ্জ দম্পতির মোটরগাড়ি নির্মাণ
১৮৪৯ সালে জার্মানির ফোরজেইম শহরের এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করা বার্থা বেঞ্জ ছিলেন বিশ্বের প্রথম মোটরগাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। জার্মান প্রকৌশলী কার্ল বেঞ্জের সাথে তার বিয়ে হয় ১৮৭২ সালে। বিয়ের আগেই বার্থা তার হবু স্বামীর নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য আর্থিক সাহায্য দিয়েছিলেন যৌতুকের অংশ হিসেবে। কিন্তু সেই ব্যবসায় সফল হতে না পেরে, বিয়ের পর কার্ল মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বেঞ্জ এবং কাই প্রতিষ্ঠা করেন। এবারও তাকে অর্থের যোগান দেন স্ত্রী বার্থা।
ব্যবসা সফল হওয়ায় কার্ল তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন, যন্ত্রচালিত গাড়ি তৈরির গবেষণা শুরু করেন এবং ১৮৮৫ সালে সর্বপ্রথম মোটরচালিত গাড়ি তৈরি করতে সক্ষম হন। তিন চাকার এ গাড়িটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫ মাইল বেগে চলতে পারত। জার্মান আইন অনুযায়ী, বিবাহিত নারীরা কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে পারত না। তাই পরবর্তী বছর কার্ল যখন মোটরগাড়িটির স্বত্ত্ব লাভ করেন, তখন তা তার নিজের নামেই নিবন্ধন করেন। কিন্তু বাস্তবে যে প্রতিষ্ঠানের অধীনে তিনি গাড়িটি নির্মাণ করেন, সেটির পেছনে তার স্ত্রী বার্থার অর্থনৈতিক অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি।
বার্থার দুঃসাহসী অভিযান
কার্ল ছিলেন অসাধারণ মেধাবী একজন প্রকৌশলী, কিন্তু তার ব্যবসায়িক জ্ঞান এবং ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা ছিল না। তিনি তার ওয়ার্কশপে নীরবে-নিভৃতে কাজ করতেই বেশি পছন্দ করতেন। কাজেই মোটরগাড়ি আবিস্কারের পর দু’বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি সেটিকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারে উন্মুক্ত করতে পারেননি। বরং তিনি সেটিকে কীভাবে আরো উন্নত করা যায়, তা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। এর মধ্যে অবশ্য তিনি অল্প কিছু প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন, কিন্তু সেগুলো ছিল তার ওয়ার্কশপের আঙিনায় স্বল্প দূরত্বে চালানোর প্রদর্শনী। সেগুলো কাউকে প্রভাবিত করতে পারেনি। বরং একটি প্রদর্শনীতে গাড়ির ড্রাইভার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দেয়ালে আঘাত করলে সেটি দর্শকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
স্বামীর ব্যবসায়িক ব্যর্থতায় হতাশ বার্থা সিদ্ধান্ত নেন, তিনি নিজেই মোটরগাড়ি বাণিজ্যিকীকরণের উদ্যোগ নেবেন। ১৯৮৮ সালের ৫ আগস্ট (মতান্তরে ১২ আগস্ট) তিনি তার দু’ছেলেকে নিয়ে কার্লের নতুন নিবন্ধন করা তিন চাকার মডেল-৩ গাড়িটি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। তারা তখন থাকতেন জার্মানির মেইনহ্যাম শহরে। আর তাদের গন্তব্য ছিল প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরবর্তী শহর ফোরজেইমে অবস্থিত বার্থার মায়ের বাড়ি। কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাস্তা জুড়ে গাড়িটির প্রদর্শনী করা।
বার্থা এবং তার ১৫ ও ১৩ বছর বয়সী দুই ছেলে মিলে যাত্রা শুরু করেন ভোর ৫টার দিকে, কার্ল তখন গভীর ঘুমে অচেতন। তার দুই ছেলে গাড়িটিকে হাত দিয়ে ঠেলে গ্যারেজ থেকে বের করে রাস্তায় নিয়ে আসে, যেন তাদের বাবার ঘুম না ভাঙে। বাসা থেকে যথেষ্ট দূরে যাওয়ার পরেই কেবল বার্থা গাড়িটির ১.৬ লিটারের ইঞ্জিনটি চালু করেন। বার্থা অবশ্য কার্লের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি রেখে এসেছিলেন, যেখানে তিনি জানিয়েছিলেন, কিছুদিনের জন্য তিনি তার মায়ের বাড়িতে যাচ্ছেন।
যাত্রাপথের বিরতিহীন সমস্যা ও সমাধান
তাদের যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। সেসময় রাস্তায় কোনো পেট্রোল স্টেশন ছিল না, গাড়ি মেরামতের ওয়ার্কশপ ছিল না, স্পেয়ার পার্টসের দোকান ছিল না, এমনকি গাড়ি চলাচলের জন্য উপযোগী রাস্তাও ছিল না। গাড়িটি এত দূরের রাস্তা চলতে পারবে কিনা, সেটাও কেউ জানত না। তাদের অভিযান ব্যর্থ হওয়ার সব রকম সম্ভাবনাই ছিল। তারপরেও বার্থা সাহস করে যাত্রা শুরু করেছিলেন।
যাত্রাপথে প্রথম সমস্যা দেখা দেয় পানির সরবরাহ নিয়ে। উত্তপ্ত ইঞ্জিনকে ঠাণ্ডা করার জন্য একটু পর পর তার উপর পানি ঢালতে হতো, আর সেই সেই পানি বাষ্পীভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে ইঞ্জিনকে ঠাণ্ডা রাখত। নিরবচ্ছিন্ন পানির সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য যাত্রাপথে বার্থার দুই ছেলেকে একটু পরপরই নদী, ঝর্ণা এবং দোকানপাটের সন্ধান করতে হচ্ছিল।
এরপরেই দেখা দিল পেট্রোলের সমস্যা। গাড়িতে তখনও পেট্রোল ধারণের জন্য অতিরিক্ত কোনো পেট্রোল ট্যাংক ছিল না। তাছাড়া সে সময় পেট্রোল স্টেশন বলতেও কিছু ছিল না। বার্থাকে তাই যাত্রাপথে এক ফার্মেসিতে নেমে সেখানে কর্মরত রসায়নবিদের কাছ থেকে বেনজিন কিনতে হয়েছিল।
ওয়েইজ্লচ শহরের এক ফার্মেসিতে নেমে বার্থা যখন ১০ লিটার বেনজিন কিনতে চাইলেন, তখন সেখানকার কেমিস্ট মনে করলেন তিনি বুঝি তার জামার ময়লা পরিস্কার করার জন্য বেনজিন চাচ্ছেন। তিনি বার্থাকে বললেন, ১ লিটার বেনজিনই তার জন্য যথেষ্ট হবে। কিন্তু কেমিস্টকে অবাক করে দিয়ে বার্থা ফার্মেসিতে থাকা বেনজিনের সম্পূর্ণ সংগ্রহই কিনে নিলেন। ওয়েইজ্লচ শহরের সেই ফার্মেসিই পরিণত হলো বিশ্বের প্রথম পেট্রোল স্টেশনে!
কিছুদূর যাওয়ার পরেই ইঞ্জিনের তেল সরবরাহের লাইনে ময়লা জমে গাড়ি বিকল হয়ে গেল। ফলে বার্থাকে নেমে তার হ্যাট থেকে পিন খুলে, সেই পিন দিয়ে ময়লা পরিস্কার করে ইঞ্জিন চালু করতে হল। তারপর সমস্যা করতে লাগল একটি তার, যেটিকে বারবার উত্তপ্ত হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নিরোধক কোনো পদার্থ দিয়ে মুড়ে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। বার্থা তার মোজার রাবার ব্যান্ড দিয়ে সেটাও ঠিক করে ফেললেন। কাজেই বার্থা শুধু বিশ্বের প্রথম ড্রাইভারই ছিলেন না, তিনি একই সাথে বিশ্বের প্রথম মোটর গাড়ির মেকানিক হিসেবেও ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন।
গাড়ির ব্রেক-শু যখন ক্ষয় হয়ে আসছিল, তখন বার্থা স্থানীয় এক মুচির দোকানে নিয়ে সেটা ঠিক করিয়ে এনেছিলেন। সেখানে চামড়ার তৈরি বেল্টটিকেও টাইট করে নিতে হয়েছিল। এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম গাড়ি মেরামতকারী দোকান।
অভিযানের সমাপ্তি এবং প্রভাব
অবশেষে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ১৫ ঘণ্টার অভিযান শেষে বার্থা এবং তার দুই ছেলে নিরাপদেই তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছিলেন। যাত্রাপথে যদিও অনেকেই ঘোড়াবিহীন এই অদ্ভুত স্বয়ংক্রিয় যানের পেছনে এক মহিলাকে চড়তে দেখে তাদের উপর শয়তানের আছর হয়েছে বলে মনে করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বার্থার প্রচারণার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল হয়েছিল।
পরবর্তী মাসে কার্ল যখন মিউনিখে গিয়ে তাদের গাড়িটির প্রদর্শনী করেন, তখন সেটি ব্যাপক প্রচারণা লাভ করে। কার্ল এই বিস্ময়কর যানটির জন্য সোনার মেডেলও অর্জন করেন। এরপর থেকে বেঞ্জ দম্পতিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাদের নির্মিত প্রতিষ্ঠানটিকেই আমরা আজ মার্সিডিজ বেঞ্জ হিসেবে চিনি।
বার্থা বেঞ্জ, যে দূরদর্শী এবং অসাধারণ উদ্যোগী নারীর দুঃসাহসী অভিযানের কল্যাণে পৃথিবী প্রথম বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত উপহার পেয়েছে, তিনি ১৯৪৪ সালে ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। যে পথ ধরে তিনি তার এই ঐতিহাসিক অভিযানটি সম্পন্ন করেছিলেন, বেঞ্জ মেমোরিয়ালের উদ্যোগে স্থাপিত পথনির্দেশক চিহ্নের কল্যাণে আজও জার্মানির মেইনহ্যামে গেলে সে পথটি খুঁজে বের করা যাবে এবং তার পদচিহ্নকে স্মরণ করা যাবে।
ফিচার ইমেজ- Pinterest