১৯৪৪ সালের ৪ আগস্ট। গ্রীষ্মের এক উষ্ণ দিন। আমস্টারডামের ২৬৩, প্রিন্সেনগ্র্যাচ বাড়িতে হানা দিল চার গেস্টাপো। বাড়িটির বর্ধিতাংশে একটা দেওয়ালে লাইব্রেরির মতো। কিন্তু সেটাকে ধরে একপাশে চাপ দিতেই ধীরে ধীরে সরে যায় দেওয়াল। দেওয়ালের মাঝে গোপনে আশ্রয় নিয়েছে আটজন। অটো ফ্রাঙ্ক, তার স্ত্রী, দুই সন্তান, ভ্যান পেলসের তিনজনের পরিবার, আর একজন দাঁতের ডাক্তার। প্রথমে তাদের ওয়েস্টারবর্ক ক্যাম্পে নেওয়া হল । সেখান থেকে গবাদি পশুর গাড়িতে গাদাগাদি করে নিয়ে যাওয়া হল অসউইজ ক্যাম্পে। তাদের সবার মাঝে শুধু অটো ফ্রাঙ্কই ফিরে এসেছিলেন।
গেস্টাপোর এক সদস্য যখন অটো ফ্রাঙ্কের ব্যাগে দখল করা মালপত্র তুলছিল, হাত ফসকে পড়ে যায় কিছু কাগজ। তার ভেতর ছিল ১৩ বছরের আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি। গেস্টাপোরা চলে গেলে আনা ফ্রাঙ্কদের আশ্রয়দাতাদের একজন ডায়েরিটা তুলে নিজের কাছে রেখে দেয়। অটো ফ্রাংক ফিরে এসে বই আকারে ডায়েরিটি প্রকাশ করেন। এটিই হয়তো সর্বোচ্চ সংখ্যকবার পঠিত যুদ্ধের দলিল। কিন্তু প্রশ্ন রয়েই গেলো, সেদিনের অতর্কিতে আক্রমণ কি কাকতালীয় ছিল? অন্য কোথাও হানা দিতে এসে হঠাৎই কি গেস্টাপো বাহিনী খুঁজে পেয়েছিল লুকিয়ে থাকা আটজন মানুষ? নাকি সেদিন খুব কাছের কেউ ঠকিয়েছিল আনা ফ্রাংকের পরিবারকে?
আজ পর্যন্ত নিশ্চিত হয়ে কেউ বলতে পারেনি, আসলে কে ছিল সেই প্রতারক। আমস্টারডাম পুলিশের রাজনৈতিক তদন্ত বিভাগ ১৯৪৮ সালে এক তদন্তকাজ শুরু করে। তেমন কোনো তথ্য উদঘাটিত না হওয়ায় দ্বিতীয়বারে ১৯৬৩ সালে আবার তদন্ত করা হয়। এসব ছাড়াও ১৯৯৮ সালে মেলিসা মুলার ও ২০০২ সালে ক্যারল অ্যান লি যথাক্রমে আনা ও অটো ফ্রাংকের জীবনী লেখেন। তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ লেখায় প্রতারককে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
টনি এহলার
২০০২ সালে ক্যারল অ্যান লির লেখা অটো ফ্রাংকের জীবনী প্রকাশিত হয়। সেখানে নতুন করে সেই সন্দেহটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বই প্রকাশিত হওয়ার আগে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ক্যারল বলেছিলেন, টনি এহলারই সেই লোক যে আশ্রিতদের প্রতারণা করেছিল। এরকম ভাবার অনেক কারণ ছিল ক্যারলের। কোনো গুজবের উপর ভিত্তি করে তিনি এসব বলেননি।
টনি ছিল গুন্ডা ধরনের লোক। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত তার নামের সাথে ছিল অনেকগুলো মামলার অপবাদ। বহুবার ইহুদী মালিকানাধীন ক্যাফেটেরিয়াতে গন্ডগোল করার সাথে তাকে জড়িত পাওয়া গেছে। এহলার ভীষণ ইহুদী বিদ্বেষী লোক ছিলেন। যুদ্ধ চলাকালে লুকিয়ে থাকা ইহুদীদের নামে বহু কটুকথা বলেছেন তিনি। এমনকি যুদ্ধশেষেও একথা স্বীকার করতে বাঁধেনি তার। কিন্তু একইসাথে তিনি ছিলেন দাম্ভিক আর পাকা মিথ্যাবাদী। তাই শুধু তার কথার উপর নির্ভর করে সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ করে ফেলা দুরূহ। এহলারের ব্যবসাও ছিল অনেকটা অটো ফ্রাংকের ব্যবসার মতো। এমন হতে পারে যে জিনিসপত্রের খোঁজ করতে করতে স্প্রিন্সেনগ্র্যাচের গোপন ঘরের কথা জানতে পেরেছিলেন। হয়তো এভাবেই তার যোগাযোগ হয়েছিল উইলিয়াম ভ্যান মারেনের সাথে। এনএসবির তিন সদস্য আর স্লিগারের সবার সাথেই পরিচিত ছিল এহলার। কিন্তু এই সম্পর্ককে এহলারের প্রতারক হওয়ার প্রমাণ বলতে নারাজ অনেক বিশেষজ্ঞ। ক্যারলের বই প্রকাশ পাবার দুদিন পরেই এক অনাকাঙ্খিত ফোন পান তিনি। ফোন করেছে টনি এহলারের ছেলে, ক্যারলের সাথে সে দেখা করতে চায়। ক্যারল দেখা করলেন। এহলার পুত্র তাকে জানায়, তার বিশ্বাস তার বাবাই সেই ব্যক্তি!
ছেলেবেলা থেকে বাবার হাতে মার খেতে খেতে বড় হয়েছে সে। তার মায়ের উপরেও কম নির্যাতন চালায়নি টনি এহলার। এমনকি তার ছোট মেয়ের কাছেও সে শুনেছে, তার দাদু তাকে গর্বের সাথে আনা ফ্রাঙ্ক পরিবারকে গেস্টাপোর তুলে দেওয়ার গল্প শুনিয়েছে তাকে। কিন্তু টনি এহলার পরিবারের কাছে দানবের মতো ছিলেন। ছিলেন ভয়ানক মিথ্যাবাদীও। এমন হতে পারে যে পিতার প্রতি বিদ্বেষ থেকেই তিনি আসামী বলে তাকে দাবী করেছেন। ক্যারল দেখা করতে গিয়েছিলেন টনির স্ত্রীর সাথে। কিন্তু টনির স্ত্রী তার সাথে দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দেন। তার বিশ্বাস তার স্বামী এমন কিছু করতেই পারে না। মামলা চলাকালে টনির স্ত্রীকে ঠিকমতো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। আজ আর সে সুযোগও নেই।
উইলিয়াম ভ্যান মারেন
স্টকরুমের ম্যানেজার উইলিয়াম ভ্যান মারেনকে প্রতারক হিসেবে সন্দেহ করা হয়েছিল। কিন্তু তার সাথে নাৎসি যোগাযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জিনিসপত্র চুরিতে সে ওস্তাদ ছিল। আনার ডায়েরি অনুসারে, আশ্রিত লোকেরাও তাকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করতো না। যুদ্ধের পর জিজ্ঞাসাবাদে তাকে দোষী প্রমাণ করে এমন কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি।
মারেন বেশ চতুর লোক ছিল। সে একদিন তার কর্মচারীরদের জিজ্ঞাসা করে এখানে কখনো ফ্রাঙ্ক পরিবার এসেছিল কিনা। কেন হঠাৎ তার মাথায় ফ্রাঙ্ক পরিবারের নাম এসেছিল তা কেউ জানে না। টনি এহলার ও ভ্যান মারেন একে অপরকে চিনতো। হয়ত সে-ই এহলারের জন্য খবর সংগ্রহের কাজ করেছিল। সন্দেহ করলেও ভ্যান মারেনকে পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে দোষী সাব্যস্ত করা যায়নি।
লেনা হার্টগ
প্রতারক হিসেবে সবচেয়ে কম সন্দেহে আসা নামটা লেনা হার্টগের। তার স্বামী ল্যামার্ট স্টকরুমে কাজ করতো। ল্যামার্টের অনেক বক্তব্যের সাথে বাস্তবতা মেলে না। যেমন, ল্যামার্ট বলেছিল এরেস্টের পরও কিছুদিন সে স্টকরুমে কাজ করেছে। কিন্তু আশেপাশের লোকদের বক্তব্য অনুযায়ী পুলিশ আসার সাথে সাথেই পালিয়েছিল ল্যামার্ট। একটি বিষয় হলো, লেনা জানত ২৬৩ নাম্বারে ইহুদীরা আছে। এই তথ্য সে তার স্বামী বা ভ্যান মারেনের কাছ থেকে পেয়েছিল। গেস্টাপোর ভাষায়, তাদের তথ্যসূত্র ছিল ‘নির্ভরশীল’ কেউ। এই নির্ভরশীল ব্যক্তিটি লেনা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তাহলে সেদিন সে তার স্বামীকে আগে থেকে সাবধান করে দিল না কেন? ১৯৯৮ সালে আনা ফ্রাঙ্কের জীবনী লেখিকা মেলিসা মুলারের কাছে আনা হার্টগই সম্ভাব্য প্রতারক।
মার্টিন স্লিগার
আশ্রিতরা লুকিয়ে ছিলেন প্রায় দুই বছর। এতদিন লুকিয়ে থাকতে থাকতে তারা কিছুটা অসতর্ক হয়ে উঠেছিলেন। পর্দা তুলে রাখতেন মাঝেমাঝেই। প্রায়ই ছাদের জানালা খোলা থেকে যেত। আগের চেয়ে বেশি শব্দও করতেন। এসব দেখে বাইরে থেকে হয়তো বোঝাই যেত অফিস সময়ের পরেও কেউ থাকছে বাসায়। বাসার আশেপাশের লোকেরা এসব নিয়ে আলোচনা করার সময় হয়ত এসব শুনেছিল গেস্টাপোর কোনো গুপ্তচর। ঘটনা এমন হলে নৈশপ্রহরী মার্টিন স্লিগার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অফিস প্রাঙ্গনে একটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। পরিদর্শন করতে নাৎসি পুলিস অফিসারকে সঙ্গ দিয়েছিল স্লিগার। তারা তদন্ত করার সময় বইয়ের তাকের সাথে ধাক্কা খায়। সেই বইয়ের তাকের পেছনেই লুকানো জায়গায় আশ্রিত ছিল ৮ জন। আনার ডায়েরিতে ডাকাতির ঘটনাও লিপিবদ্ধ করা আছে ১১ এপ্রিল, ১৯৪৪ তারিখে। স্লিগারের সাথে গ্রিংগুইসের পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে প্রতারণারও শক্ত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
একটি ঘটনার পেছনে হাজারো ডালপালা। অনেকগুলো মানুষের বিরুদ্ধে সন্দেহ। হতে পারে প্রতারক একজন নয়, একাধিক। কেউ কেউ মনে করে, আশ্রয়দাতাদের কেউ চাপের মুখে প্রতারণা করে বসেছিলেন। কেউ ভাবেন খোদ অটো ফ্রাঙ্কই অর্থের বিনিময়ে পুরো পরিবারকে তুলে দিয়েছিলেন নাৎসিদের হাতে। কিন্তু প্রতারক যে-ই হোক সে আশ্রিতদের পরিচিত ছিল। সন্দেহের সম্ভাবনাগুলো এত বছর পরেও প্রমাণিত হয়নি। মানুষ নিজের মনের ভেতর নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে প্রতারকের পরিচয়।
কিন্তু প্রাক্তন এফবিআই সদস্য ভিন্স প্যানকোক মনে করেন নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে এই রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব। তার ধারণা, এই মামলায় এখনো অনাবিষ্কৃত অনেক দিক আছে। প্রায় ৭৫ বছরের পুরোনো এই মামলা সামাধান করতে তার সাথে কাজ করবেন ইতিহাস, অপরাধ ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞেরা। ভিন্স আশা করেন ২০১৯ সালের ৪ আগস্ট, আনাদের ধরা পড়ার ৭৫ বছর পূর্তিতেই তিনি সামনে আনতে পারবেন মূল প্রতারককে। উন্মোচিত হবে ১৯ শতকের অন্যতম অমীমাংসিত রহস্য।
ফিচার ছবি: CNN