সোনা ও সোনার তৈরি সামগ্রীর প্রতি মানুষের আগ্রহ ও মুগ্ধতা চিরন্তন। অধিকাংশ মানুষই চায় নিজের সাধ ও সাধ্য অনুযায়ী কিছু সোনা নিজের মালিকানায় রাখতে। কিন্তু সোনার প্রতি এই অদম্য আকর্ষণের পেছনের কারণ কী? সোনার নজরকাড়া ঝলমলে রূপ, নাকি বিরল ধাতু হিসেবে এর উচ্চ মূল্য?
বেলজিয়ামের একদল গবেষক অবশ্য বলছেন, সোনার প্রতি মানুষের আকর্ষণের রহস্য লুকিয়ে আছে দেহে প্রাণ টিকিয়ে রাখার আদি ও মৌলিক নিয়মের মাঝে। সোনার রঙের দিকে লক্ষ্য করলে সেটিকে কেবল একটি রং নয়, বরং পানির মতো ঢেউ খেলানো, চকচকে একটি পৃষ্ঠতল বলে মনে হয়। আর যেহেতু মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পানির প্রয়োজন, তাই তার চোখ সবসময়ই এমন বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয়, যা দেখতে পানির মত চলনশীল। বস্তুত, প্রজাতি হিসেবে আমাদের ব্যাপক সাফল্য ও অগ্রগতি সাধিত হলেও আজও আমরা আমাদের সহজাত আদিম প্রয়োজনীয়তার দিকেই ধাবিত হই। সোনার প্রতি মানুষের সহজাত আকর্ষণই এর প্রমাণ।
সোনার রং মনে সুনির্দিষ্ট অনুভূতি জাগ্রত করে
সোনার রং কেবল একটি রং নয়, এটি এক প্রকার ক্রোমেচার অর্থাৎ রঙের বিশেষ বিন্যাস, যা মানুষের মনে সুনির্দিষ্ট ধরনের অনুভূতি তৈরি করতে সক্ষম। যেমন, একটি লোমশ বাদামী ভালুকের শরীরের একাংশের একটি ছবি, এবং সেই একই বাদামী রংয়ের সাধারণ একটি ছবি যদি পাশাপাশি রাখা হয়, তবে ভালুকের লোমের ছবিটি দেখা মাত্রই দর্শকের মনে একটি ভালুকের ছবি ভেসে উঠবে। অন্যদিকে, সাধারণ বাদামী রংয়ের ছবিটি দেখলে তেমন কোনো অনুভূতি জাগ্রত হবে না।
তেমনি সোনার তৈরি জিনিসের রংগুলোও ক্রোমেচার। কারণ, এগুলো দেখতে হলদেটে হলেও এটি সাধারণ হলুদ রং নয়। সোনার রং চোখে দু’ভাবে ধরা দেয়। কখনো একে গাঢ় হলুদ দেখায়, আবার কখনো আলো প্রতিফলনের ফলে এটিকে হলুদ, সাদা বা কালো রংয়ের বলে মনে হয়। এ ধরনের ক্রোমেচারের ফলে মানুষের মনে এটি সুগভীর ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়।
ধর্মচর্চায় সোনার ব্যবহার
সোনার চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য, অনন্যসাধারণ দীপ্তি, চাকচিক্য ও রঙের তীব্রতা মানুষকে যুগে যুগে অভিভূত করেছে। তার এই ভিন্নধর্মী, অপার্থিব সৌন্দর্যের রহস্যময়তা মানুষকে জুগিয়েছে ভাবনার রসদ। আর তাই মানুষ সোনাকে স্রষ্টার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, পবিত্র কোনো উপাদান হিসেবে ধরে নিয়েছে। যেমন- অ্যাজটেকরা মনে করতো সোনা হচ্ছে দেবতাদের বিষ্ঠা। ইনকা সভ্যতার বিশ্বাস অনুযায়ী সোনা হচ্ছে সূর্যের ঘাম বা অশ্রু।
ওদিকে প্রাচীন মিসরে সোনাকে দেবতাদের মাংস বলে ভাবা হতো। তাদের মধ্যে মৃতদেহকে সোনার তৈরি মুখোশ (Burial Mask) পরিয়ে দেওয়ারও চল ছিল। যে কারণে ফারাওদের কবর থেকে প্রচুর পরিমাণে সোনা পাওয়া যায়। কেবল তুতেনখামেনের কবরেই এক টনেরও বেশি সোনা ছিল বলে জানা যায়। এছাড়া দেবতাদের ছোট আকারের মূর্তি, নৈবেদ্য অর্পণ করার অলংকৃত পাত্র এবং গহনা তৈরিতেও সোনা কাজে লাগতো। কিন্তু সোনার এত বহুমুখী প্রয়োগের সবটাই ছিল তখন ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কাজে, দৈনন্দিন জীবনে সোনার কোনো ব্যবহার ছিল না।
সোনার তৈরি জিনিসের পৃষ্ঠতলে আলো প্রতিফলিত হওয়ার কারণে এগুলোকে দেখলে ভ্রম হয় যেন এর ভেতর থেকে স্বর্গীয় আলো ছড়াচ্ছে। এ ধরনের বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ সোনাকে অলৌকিক কোনো উপাদান বলে মনে করতো।
তাছাড়া সারা বিশ্বেই মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মঠ সহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মিনার, গম্বুজ, প্রতিমা তৈরি বা অন্যান্য সাজসজ্জায় আজও সোনার ব্যবহার দেখা যায়।
ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে সোনার গুরুত্ব
দেশ ও সংস্কৃতিভেদে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে কেবল সাজসজ্জা বা জাঁকজমক প্রকাশের জন্যই নয়, বরং অন্তর্নিহিত গভীর তাৎপর্যের কারণে সোনার নানাবিধ ব্যবহার হতে দেখা যায়। যেমন- দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিয়ের অনুষ্ঠানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে সোনা। হিন্দুদের বিশ্বাস, বিয়েতে ঘরের লক্ষ্মী, অর্থাৎ কনের গায়ে সোনার গহনা পরানো থাকলে তা পরিবারের জন্যে উন্নতি, ধনসম্পদ এবং দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদ নিয়ে আসে। নতুন বউ শ্বশুরালয়ে স্বর্ণ নিয়ে আসাটাকে অত্যন্ত শুভলক্ষণ হিসেবে ধরা হয়।
চীনা সংস্কৃতিতে সোনালী রংয়ের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এটি একদিকে যেমন রাজকীয় মর্যাদা ও প্রতিপত্তির চিহ্ন বহন করে, অপরদিকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্যে এটি শোকের প্রতীক। স্প্রিং ফেস্টিভ্যালের সময় চীনে সোনা ও সোনার তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর বিক্রি বেড়ে যায়। মানুষ নিজের এবং প্রিয়জনের জন্যে এসময় সোনার জিনিস ক্রয় করে থাকে। এছাড়া চীনা সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ ড্রাগন তৈরি ও অলংকরণেও সোনা ব্যবহার করা হয়।
বড়দিন উদযাপনের সঙ্গেও স্বর্ণের যোগসূত্র রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, যিশু খ্রিস্টের জন্মের সময় যে তিনজন জ্ঞানী ব্যক্তি তাঁকে দেখতে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন, আরবের রাজা মেলকিয়োর, তাঁকে সোনা উপহার দিয়েছিলেন। সোনাকে যিশুর সম্মান, শুদ্ধতা ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক ধরে বড়দিন উদযাপনে সোনার উপস্থিতি রাখা হয়।
মুদ্রা হিসেবে সোনার ব্যবহার
খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সালে লিডিয়ান বণিকগণ প্রথমবারের মতো ধাতব মুদ্রা হিসেবে সোনার ব্যবহার শুরু করেন, যার নাম দেওয়া হয় ইলেক্ট্রাম। এগুলো মূলত খোদাই করা ধাতব পিণ্ড ছিল, যার ৬৩ শতাংশ থাকতো সোনা আর বাকি ২৭ শতাংশ রূপা। এই মুদ্রা আবিস্কারের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ সহজতর হয়ে ওঠে এবং পণ্য বিনিময় প্রথার চর্চা কমে আসে
স্বাস্থ্যের ওপর সোনার প্রভাব
প্রাচীনকালের বিশ্বাস অনুযায়ী, সোনা শরীরের ওপর উষ্ণ ও উদ্দীপ্তকারী প্রভাব ফেলে, অপরদিকে রূপার ভূমিকা হচ্ছে শীতল ও বাধাদানকারী। এই ধারণা থেকে হাজার হাজার বছর ধরে আকুপাংচার চিকিৎসায় সোনা ও রূপার তৈরি সূচের ব্যবহার হয়ে এসেছে। তবে আধুনিককালে এ ধারণা বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমানে আকুপাংচার চিকিৎসায় কেবল স্টিলের সূচই ব্যবহার করা হয়।
এদিকে চীনের আলকেমিস্টরা মনে করতেন, সোনা পান করলে এবং খাওয়ার কাজে সোনার বাসন-কোসন ব্যবহার করলে দীর্ঘায়ু লাভ করা যায়। খাবারকে আকর্ষণীয় করে তুলতে এবং সোনার স্বাস্থ্যকর গুণাগুণ দ্বারা উপকৃত হতে আজও বিভিন্ন খাবারে সোনার পাত ব্যবহার করা হয়।
বিংশ শতাব্দীর পূর্বে সিফিলিস, হৃদরোগ, গুটিবসন্ত প্রভৃতি রোগের চিকিৎসায় সোনা ব্যবহার করা হতো। বলা হয়ে থাকে, যদি খাঁটি (২৪ ক্যারাট) সোনা নিয়ে কোনো সংক্রমণ বা ক্ষতস্থানের ওপর রাখা হয়, তবে এটি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং ক্ষত সেরে উঠতে সাহায্য করে। এছাড়া সোনা রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটায়, ফলে শরীরের সব অংশে অক্সিজেন ভালোভাবে পৌঁছতে পারে, শরীর থাকে সুস্থ ও রোগমুক্ত। শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সোনা বাইরের তাপমাত্রা পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে শরীরকে সুরক্ষিত রাখে। সোনার প্রদাহরোধী ক্ষমতার কারণে এটি পরিধান করলে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের উপসর্গসমূহের উল্লেখযোগ্য হারে উপশম হয়।
খাঁটি স্বর্ণ স্পর্শ করলে মখমলের মতো কোমল ও মসৃণ একটা অনুভূতি পাওয়া যায়, যা মনকে শিথিল করে বলে মনে করা হয়। তাই প্রাচীনকাল থেকেই মানসিক চাপ দূরীকরণে খাঁটি সোনার ব্যবহার হয়ে আসছে।
সোনার মধ্যে বার্ধক্যের ছাপ রোধ করার ক্ষমতা আছে, এই বিশ্বাস থেকে রানী ক্লিওপেট্রা নিজের ত্বকের যৌবন ধরে রাখার জন্যে খাঁটি সোনার মুখোশ পরে থাকতেন। আধুনিক মেডিকেল গবেষণা অনুযায়ী, সোনা কোষের পুনর্গঠন ও কোলাজেনের ক্ষয়রোধে সহায়তা করে। শরীরে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া করে না এবং সহজেই শরীরের সাথে মানিয়ে যায় বলে দাঁতের আর্টিফিসিয়াল ক্রাউন, ব্রিজ, অর্থোডন্টিক অ্যাপ্লায়েন্স তৈরিতে এবং দাঁতের ফিলিং চিকিৎসায় অনেক সময় সোনা ব্যবহার করা হয়। ক্যান্সারের চিকিৎসায়ও বর্তমানে রেডিওঅ্যাকটিভ গোল্ড আইসোটোপ প্রয়োগ করা হচ্ছে
যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করতে হয় সোনা
সোনা এবং সোনালী রং শুধু সম্পত্তি আর ক্ষমতার প্রতীকই নয়, বরং মেধা ও প্রতিভার মূল্যায়নেও এটি ব্যবহৃত হয়। সাফল্য, অর্জন আর উন্নতির সঙ্গে রয়েছে এর সংযোগ। তাই উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পুরস্কার হিসেবে সোনার ব্যবহারের সূচনা হয়। নোবেল পুরস্কার, ফিফা কাপ, অলিম্পিক মেডেল, অস্কার কিংবা গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড- এসব প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের সম্মানার্থে সোনার পদক দেওয়া হয়। মূলত ‘সোনা একটি বিরল ধাতু। আর সোনার মতই বিরল, অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী কোনো ব্যক্তিকেই এটি শোভা পায়।‘- এ ধরনের ধারণা থেকেই প্রতিযোগিতার বিজয়ীদেরকে স্বর্ণপদক দেওয়ার রীতি চালু হয়।
ক্ষমতার পরিচায়ক
সোনার আভিজাত্য, উজ্জ্বলতা এবং সময়ের সাথে এর ক্ষয় বা বিবর্ণ না হওয়ার গুণের কারণে সভ্যতার সূচনাকাল থেকেই এটিকে দেব-দেবী এবং রাজবংশের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে বিবেচনা করা হয়। সোনাকে বলা হয় ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। যেকোনো যুদ্ধের পর অধিকৃত এলাকা থেকে যে সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতো, তার মধ্যে অন্যতম ছিল সোনা। এমনকি প্রাচীন রোম এবং মধ্যযুগীয় ইউরোপে উচ্চবংশীয় পরিবারের সদস্য ব্যতীত আর কারও জন্য স্বর্ণ পরিধান করা আইনত অবৈধ ছিল। এসব উচ্চপদস্থ ব্যক্তির পোশাকে সোনা ও রূপার সুতা এবং দামী পাথর ব্যবহার করা হতো, যার ফলে তাদের পোশাকগুলো শক্ত, ভারী এবং বেশ অস্বস্তিকর হয়ে পড়তো। এছাড়াও রাজদরবারের সাজসজ্জা, রাজা-রানীর সিংহাসন, মুকুট, তলোয়ার ও গহনার অলংকরণে সোনার ব্যাপক ব্যবহার চোখে পড়ে।
বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তৈরিতে সোনার ব্যবহার
ক্ষয় প্রতিরোধী হওয়ায় এবং নিরবচ্ছিন্ন তড়িৎ প্রবাহের ক্ষমতা থাকার কারণে বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তৈরিতে সোনা ব্যবহার করা হয়। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের মতে, একটি মোবাইল ফোনে পঞ্চাশ মিলিগ্রাম পর্যন্ত সোনা থাকতে পারে। সেলফোন, ল্যাপটপ, ক্যালকুলেটর, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম ইউনিট, এমনকি টেলিভিশন তৈরিতেও সোনা ব্যবহৃত হয়।
মানুষের মনস্তত্ত্বের ওপর সোনার প্রভাব
মানুষের মন এবং আচরণের ওপর একেক রং যে একেকরকম প্রভাব ফেলে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সোনালী রং উদার ও দানশীল, উপকারী ও রক্ষক, সদয় ও স্নেহশীল স্বভাবের প্রতিনিধিত্ব করে। সোনার রং হচ্ছে দৃষ্টি আকর্ষক, আত্মবিশ্বাসের পরিচায়ক। এটি আভিজাত্য, অমিতব্যয়িতা, সাফল্য, আড়ম্বর ও উষ্ণতা প্রকাশ করে। কেউ আবার সোনার অতি প্রাচুর্যের মধ্যে থাকলে আরও ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির সন্ধানে অহংবোধে আচ্ছন্ন হতে পারেন, সুযোগসন্ধানী হয়ে উঠতে পারেন। সোনার নেতিবাচক প্রভাবের ফলে কেউ কেউ স্বার্থপরতা, দয়া ও ঔদার্যের অভাব, ব্যর্থতার ভয়েও ভুগতে পারেন।
সোনার যত বেশি গুণাগুণ প্রকাশ পেয়েছে, ততই ছড়িয়ে পড়েছে তার ব্যপ্তি। সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের সাথে সাথে এর প্রয়োগের ক্ষেত্রও বেড়েছে অনেকখানি। আর তাই নানামুখী গুণ, সৌন্দর্য আর রহস্যের আধার স্বর্ণের আবেদন এর আবিষ্কারের সময় থেকে আজ অবধি এতটুকুও কমেনি, বরং বেড়েছে।