ভারতবর্ষে বর্ণাশ্রম নির্ভর সমাজের ইতিহাস অনেক দিনের। তবে এখানে বর্ণাশ্রমের আকার কাছাকছি হলেও প্রকার হিসেবে প্রদেশ ও অঞ্চলের ভিত্তিতে কিছু কিছু পার্থক্য দেখা যায়। এজন্য সব অঞ্চলে এর তীব্রতা সমান নয়, কড়াকড়িও এক নয়।
আবার এমনও দেখা যায়, মন্দির থাকা জনপদে জাতিভেদ অকাট্য নিয়ম হিসেবে বেশি মানা হয়। সেসব ক্ষেত্রে নিচু জাতির লোকেদের বিশেষ বিশেষ পথে চলাচলেও তীব্র বাধানিষেধ থাকে। এর ব্যতিক্রম দেখা গেলে পরিণতি রক্তপাতের মতো ঘটনায়ও গড়াতে পারে। মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের কাছে এই প্রথা ঘৃণ্য মনে হলেও প্রথায় অভ্যস্থ লোকজন হয়তো একে মোটেই খারাপ হিসেবে ভাবেন না।
তবে এর বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে জনরোষও দেখা গেছে। আর তার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় আর দেশীয় রাজনীতির উপর। তবে এমন ঘটনা আজ অবধি ছোট বা বড় ধরনের নাড়া দিতে পেরেছে, মূল সমস্যা একেবারে দূর করতে পারেনি।
ভারতের দক্ষিণতম প্রদেশ কেরালা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে অপরূপ এক স্থান। তবে অবমিশ্র সুন্দর কোথাও দেখা যায় না। একথা এখানেও প্রাসঙ্গিক। এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে জাতিভেদ প্রথা তার নির্দয় ছায়া কঠোরভাবে মেলে ধরেছিলো। উপাসনার স্থান তো দূরের কথা, উচ্চবর্ণের মানুষের ব্যবহৃত সড়ক ব্যবহারের অনুমতিও ছিলো না নিচু জাতের মানুষের। এর সামান্য ব্যতিক্রম হলে নেমে আসতো নির্মম শাস্তি।
এই রাজ্যের ত্রিবাঙ্কুর ইংরেজ আমলে ‘প্রিন্সলি স্টেট’ বা দেশীয় রাজ্য হসেবে গণ্য হতো। কেরালার অন্যান্য স্থানের মতো এখানেও হিন্দু সমাজে কঠোর জাতিভেদ মেনে চলা হতো। গ্রাম্য রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে ‘রাজবিধি’ এবং ‘গ্রামবিধি’ নীতি প্রয়োগ করা হতো। আর ‘গ্রামবিধি’র স্পষ্ট নির্দেশ ছিলো নিচু জাতির মানুষের পথ ব্যবহারে নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। মন্দিরে যাবার পথ তো দূর, তার আশেপাশের পথও ছিলো এই ঘৃণ্য আইনের আওতার মধ্যে।
কোট্টায়াম জেলার একটি গ্রামের নাম বৈকম। তথাকথিত নিচু জাতির প্রতি এমন অমানবিক প্রথা এখানে আরো তীব্র ছিলো। গ্রামের শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই অনাচারে সামান্য কারণে পদে পদে অপদস্থ করা হতো। এমনকি ভারতের তৎকালীন বিখ্যাত ধর্মসাধক শ্রী নারায়ণগুরুও এই অনাচারের কবলে পড়েছিলেন।
১৯০৫ সালে ত্রিবাঙ্কুরের রাজসভায় গ্রাম্য পথ ব্যবহারে সকল বর্ণের অধিকারের দাবি তোলা হয়েছিলো। কিন্তু সামাজিক বিশৃঙ্খলার ভয়ে তৎকালীন রাজা থিরুনাল ভার্মা কোন রকম পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। কেরালার বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক টি কে মাধবন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার চাইলে তা উপেক্ষা করা হয়েছিলো।
এভাবেই অনেকটা সময় অতিবাহিত হলো। ১৯২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর টি কে মাধবন জাতীয় কংগ্রেসের সাড়া জাগানো নেতা মহাত্মা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। গান্ধী তাদের আবেদনের মানবিক দিকটির সাথে একমত হয়েছিলেন, তবে পরামর্শ দিয়েছিলেন সময় ও পরিস্থিতি বুঝে কাজ করার।
১৯২৪ সালের ২৪ জানুয়ারী কেরালার ইর্নাকুলাম শহরে ‘আনটাচেবিলিটি অ্যাবোলিশন কমিটি’ গঠন করা হলো। এর সদস্য হলেন টি কে মাধবন, কে কেলাপ্পান, কুরুর নম্বুদ্রি, কৃষ্ণস্বামী আইয়ার ও বেলুধ মেনন। সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজপথ ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা লেখা বিলবোর্ড অপসারণের দাবি তোলা হলো। এর ফলে দেখা গেলো মিশ্র প্রতিক্রিয়া। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের এই দাবির বিরোধিতা করতে দেখা গেলো। স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে তারা কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের কাছে তাদের কার্যক্রম স্থগিত করার আবেদন করলেন।
১৯২৪ সালের ৩০ মার্চ একটি সংগঠিত পদযাত্রার তারিখ হিসেবে ঠিক করা হলো। স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছিলো। তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করতে লাগলো এই পদযাত্রায় বাধা দিতে।
অবশেষে সেই দিনটি এলো। সকালে শুরু হলো পদযাত্রা। সংগঠিত জনতা একসাথে মন্দিরের পথে বিলবোর্ডের কাছে এসে দাঁড়ালো। তাদের দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছিলো কোনো রকম সহিংস কর্মকাণ্ডে না জড়াতে। পরনে খাদির কাপড় ও হাতে কংগ্রেসের পতাকা হাতে তারা অগ্রসর হচ্ছিলো। একপর্যায়ে তাদের থেকে তিনজন একসাথে সামনে এগিয়ে গেলেন। পুলিশ আগে থেকেই প্রচলিত আইনের কারণে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তাদের পক্ষ থেকে বলা হলো উচ্চবর্ণ ছাড়া অন্যান্য বর্ণের লোকজন যেন স্থান ত্যাগ করেন। কিন্তু সবাই একত্রে থাকায় গ্রেফতার হলেন। বিচারে তাদের জরিমানা ও কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হলো।
এই ঘটনা জনমনে ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছিলো।
তবে আন্দোলনের সার্থকতার বিষয়টি দেখার প্রয়োজন হলো। মহাত্মা গান্ধী পরিস্থিতির কারণে আন্দোলন কয়েকদিনের জন্য স্থগিত রাখতে অনুরোধ করলেন। এদিকে তাকে কেরালার রক্ষণশীল অভিজাত সমাজের সভ্যগণ আন্দোলন থেকে সমর্থন তুলে নিতে অনুরোধ করছিলেন। তাদের দাবি ছিলো, মন্দিরে যাবার পথটি ব্যক্তিগত সম্পত্তির আওতায় পড়ে বলে এই আন্দোলন অযৌক্তিক। ৭ এপ্রিল আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে টি কে মাধবন গ্রেফতার হলেন।
সংবাদপত্রের মাধ্যমে এই আন্দোলন সারা ভারতে সাড়া জাগিয়েছিলো। ভারতের অন্যান্য স্থানের রাজনীতিবিদরা অকুণ্ঠভাবে এই আন্দোলনে সমর্থন দিলেন। পাঞ্জাবে শিখদের রাজনৈতিক সংগঠন ‘আকালি দল’র সদস্যরা সুদূর বৈকমে এসে আন্দোলনকারীদের জন্য রান্নার ব্যস্থা করলো। তবে হিন্দু ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ পরোক্ষভাবে অন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়ায় গান্ধীজী এ পর্যায়ের বিরোধিতা করলেন।
দেখতে দেখতে ১৪ এপ্রিল এসে পড়লো। মাদ্রাজ থেকে বিখ্যাত তামিল নেতা পেরিয়ার রামস্বামী এলেন বৈকমের এই আন্দোলনে যোগ দিতে। সাথে ছিলেন তার স্ত্রী নাগাম্মাই। জনসম্মুখে বক্তৃতা দেবার ক্ষেত্রে তার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিলো। তা অমান্য করায় তিনি গ্রেফতার হলেন। নাগাম্মাই এই আন্দোলনে সাধারণ নারীদের যুক্ত করতে লাগলেন। এতে মহাত্মা গান্ধী ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি ভাবছিলেন, এর ফলে আন্দোলনের পরিস্থিতি বদলে তা সহিংস হয়ে উঠতে পারে। তিনি চাচ্ছিলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক সমস্যা নিরসনে অন্য সম্প্রদায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত না হোক।
কেরালার বিখ্যাত ধর্মসাধক শ্রী নারায়ণগুরু ৫ মে আন্দোলনে অংশ নিলেন। তিনি আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া থেকে বিরত থাকার পক্ষে ছিলেন। তার মতে, হিন্দু সমাজের আচারকেন্দ্রীক এই সমস্যা সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরের কার্যকলাপের মাধ্যমেই সমাধান করা উচিত। তবে আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সাথে তার মতভেদ দেখা গিয়েছিলো। সংগঠনের কাজের পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে কিছু ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছিলো।
এসময় মহাত্মা ভাবছিলেন, উচ্চবর্ণের মহৎ মানুষরা নিম্নবর্ণের সমর্থনে এগিয়ে আসলে তা জনমনে আরো বেশি প্রভাব ফেলবে। তিনি বৈকম আন্দোলনের নেতাদের সাথে দেখা করলেন। জানালেন, শুধু উচ্চবর্ণের মানুষের একটি মিছিল যদি নিম্নবর্ণের মানুষের অধিকারের পক্ষে দাবি তোলে, তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা আরো বেড়ে যাবে। ১৯২৪ সালের ১ নভেম্বর মান্নাথু পদ্মনাভনের নেতৃত্বে উচ্চবর্ণের ৫০০ জন হিন্দু নেতা এক মিছিল নিয়ে বৈকমের পথে অগ্রসর হলেন। এই উদ্যোগ আশাতীত সাফল্য পেলো। শ্রী নারায়ণগুরু আন্দোলনের নেতাদের উন্মুক্তভাবে আশীর্বাদ করলেন। বৈকমের সাধারণ মানুষও আন্দোলনের দাবির পক্ষে মুখরিত হয়ে উঠলো।
সে বছরের ১৩ নভেম্বর উচ্চবর্ণের ২৫,০০০ মানুষের স্বাক্ষর করা এক স্মারকলিপি ত্রিবাঙ্কুরের রানীর কাছে পাঠানো হয়েছিলো। রানী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ভার নির্বাহী বিভাগের হাতে ছেড়ে দিলেন। সেখানে নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য বৈকমের পথ উন্মুক্ত করে দেওয়ার উপর ভোট অনুষ্ঠিত হলো। আশ্চর্যজনকভাবে এই প্রস্তাব ২২-২১ ব্যবধানে হেরে গেলো।
এর পরে গোঁড়াপন্থী উচ্চবর্ণের কিছু লোকের উস্কানিতে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা হয়েছিলো। কিন্তু আন্দোলনকারীরা তাদের অহিংস নীতিতে অটল ছিলেন। এদিকে সারা দেশ তখন অপেক্ষা করছিলো বৈকম আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া দেখতে।
অবশেষে আন্দোলনের ফল ধীরে ধীরে আসতে দেখা গেলো। স্থানীয় প্রশাসন নমনীয় হতে রাজি হলো। মহাত্মা গান্ধী ও আন্দোলনকারীরা সমঝোতার পথে আসতে সম্মত হলেন।
১৯২৫ সালের ২৩ নভেম্বর। উচ্চবর্ণ ও অভিজাত সমাজের করা অমানবিক বিধান কিছুটা শিথিল করা হলো।
১৯২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বৈকমের পথে চলাচলের উপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার আইন পরিবর্তন করা হলো। বৈকমের শিবমন্দিরের পূর্বদিকের প্রবেশপথ ছাড়া অন্য সব পথ নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। ১৯২৮ সালে ত্রিবাঙ্কুরের রানী বৈকমের সব রাস্তা বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে একটি রাজকীয় ঘোষণা জারি করেন।