ইউরোপের উপনিবেশ বিস্তারকারী দেশগুলোর মধ্যে সেদিনের হল্যান্ড বা আজকের নেদারল্যান্ডসকে হয়তো কিছুটা ব্যতিক্রমই বলা চলে। অবস্থান ও শক্তিমত্তার দিক থেকে দেশটি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা স্পেনের মতো ছিল না। কিন্তু বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য তাদের সমৃদ্ধিকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিল। এর ফলে পৃথিবীর অন্যান্য শক্তিমত্তা এলাকা তো বটেই, খোদ ইউরোপে অনেকের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আজ যে অঞ্চল ইন্দোনেশিয়া নামে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের সন্ধিস্থলে অবস্থান করছে, তা নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়িক স্বার্থের ফলেই সার্বভৌমত্ব হারিয়ে উপনিবেশ হয়ে পড়েছিল।
ষোল শতকের কথা। মসলা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ইউরোপে নৌ-শক্তি বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছিল। অন্যদের চেয়ে পর্তুগীজরা এদিক থেকে কিছুটা এগিয়ে ছিল। আর তার প্রয়োগ দেখা গেল ষোল শতকে ভারতবর্ষে তাদের উপস্থিতির মাধ্যমে। ১৫১০ সালে পর্তুগীজ নাবিক আফোন্সো দ্য আলবুকার্ক দক্ষিণ পশ্চিম ভারতের গোয়া অঞ্চল দখল করে নেন। ১৫১১ সালে আলবুকার্ক মালাক্কা অঞ্চলে সেখানকার সুলতানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। একে ইন্দোনেশিয়ায় ইউরোপীয় শক্তির প্রভুত্ব বিস্তারের একরকম শুরু বলা যেতে পারে।
পর্তুগীজরা অঞ্চলের দখল পেলেও তাদের সামনে নতুন কিছু গুরুতর সমস্যা দেখা দিল। বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ তখনও তাদের হাতে পুরোপুরি আসেনি। অন্যদিকে প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর সাথে তাদের শত্রুতা ক্রমাগত বেড়েই চলছিল। এদিকে তারা চেষ্টা করছিল এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে তাদের বাণিজ্য প্রসারিত করার। ১৫৫৭ সালে চীনের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে গেলে তাদের বাণিজ্যনীতি অন্য দিকে মোড় নিলো।
পর্তুগীজদের পরেই এই অঞ্চলে ডাচ বা ওলন্দাজদের আগমন। পর্তুগীজদের চেয়ে আরও উন্নত নৌ-শক্তি, অস্ত্র, সাংগঠনিক ক্ষমতা, প্রযুক্তি ও বণিকবৃত্তি নিয়ে তারা ঘাঁটি স্থাপন করতে বেরিয়েছিল। ১৫৬০ সালে স্পেনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হবার জন্য ওলন্দাজদের সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। ফলে ইউরোপের মসলা ব্যবসায়ে পর্তুগীজ ও স্প্যানিশদের প্রতিপক্ষ হিসেবে ওলন্দাজদের স্থান কিছুটা নিচে নেমে যায়। দলে তাদের প্রয়োজন হলো মসলা অধ্যুষিত অঞ্চলে সরাসরি শক্তির পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার। এছাড়া তাদের অন্য কিছু সুবিধাও ছিল। অনেক পর্তুগীজ ও স্প্যানিশ জাহাজের নাবিক ও প্রকৌশলীর কাজ ওলন্দাজরা করতো, যা পরে তাদের অনেক সুবিধা এনে দেয়।
১৫৯৫ সালে ওলন্দাজ নাবিক কর্নেলিস দ্য হ্যটম্যান ইন্দোনেশিয়ার জাভা অঞ্চলে যে অভিযানের নেতৃত্ব দেন, তার আংশিক সফলতা দেখা গেল দু বছর পর জাহাজ ভর্তি মসলা নেদারল্যান্ডসে পৌঁছানোর মাধ্যমে। ফলে ১৫৯৮ সাল থেকে ইন্দোনেশিয়ায় শুরু হলো ওলন্দাজদের অভাবনীয় সফল মসলা বাণিজ্য।
বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি একচেটিয়া লাভ করার উদ্দেশ্যে ১৬০২ সালে ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ গঠন করলো। ইন্দোনেশিয়ার মাটিতে বিদেশী বণিক শক্তির ঘাঁটি কার্যত অনড়ভাবে গেড়ে বসলো। যা ধীরে ধীরে পুরো এলাকাটিকে উপনিবেশ ও দাসত্বের শেকলে বন্দী করে ফেলবে। উল্লেখ্য, এ অঞ্চলে ওলন্দাজদের মতো ইংরেজদেরও কম আগ্রহ ছিল না। কিন্তু স্যার জেমস ল্যাংকাস্টারের অভিযানের ব্যর্থতার পর একরকম বোঝা যাচ্ছিলো যে, ভারতবর্ষে ওলন্দাজদের যেমন, ইন্দোনেশিয়ায় ইংরেজদের তেমন কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আসলে নেই।
১৬৩০ সাল নাগাদ ইন্দোনেশিয়ায় নেদারল্যান্ডের বাণিজ্যিক ও সামরিক শক্তি বেশ মজবুত হয়ে উঠেছিল। ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সদর দপ্তর ছিল বাটাভিয়া অঞ্চলে।
এবার আসা যাক ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহ্যবাহী রাজ্যগুলোর প্রসঙ্গে।
মাতারম সালতানাত ছিল জাভার সমৃদ্ধ রাজ্যের এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। ইতিহাস বলে, ১৫৭০ সালে জাভার পাজাং এলাকার সুলতান হাদিয়ুজাওয়া গেধে পামানাহান নামের এক বিশ্বস্ত সেনানায়কের কাজে খুশি হয়ে তাকে মাতারম এলাকার শাসনভার দেন। গেধে পামানাহানের বংশধররাই পরের প্রজন্মে মাতারমের সুলতান হয়ে আসছিলেন। এই সালতানাত রাজ্যজয়ের মাধ্যমে সতেরো শতকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে উৎকর্ষ দেখিয়েছিল।
অষ্টাদশ শতকে এই সালতানাত বিভিন্ন ভাঙনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো। তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রাখছিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। মাতারম সুলতান আগাং এর পর রাজ্য কার্যত ভাঙনের দিকেই যাচ্ছিলো। শেষে এই ঐতিহ্যবাহী সালতানাত ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেলো। ১৭৫৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, যুবরাজ মাংকুবুমি ও সুলতান তৃতীয় পাকুবুয়োনো’র মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে রাজ্যটি ইয়োগিয়াকার্তা ও সুরাকার্তা নামে দু’টি ছোট রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়।
ফলে বেশি লাভ হয় ওলন্দাজ ব্যবসায়িক কোম্পানির। শুল্কারোপ ও আদায়ের সুযোগ ছাড়াও সালতানাতের সমান্তরাল ক্ষমতা তাদের হাতে এসে গেল। ফলে দরিদ্র কৃষক ও কারিগরের উপর অত্যাচার বেড়ে গেল। স্থানীয় মানুষের স্বার্থ দেখার কোনো দায় না থাকায় কোম্পানি বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। এদিকে তাদের প্রভুত্ব বিস্তারে ইয়োগিয়াকার্তা রাজ্যের অভিজাত মহলের নেতৃবৃন্দ চতুর ইউরোপীয় বণিকদের ওপর নাখোশ ছিলেন।
ইয়োগিয়াকার্তা সালতানাতের তৃতীয় সুলতান ছিলেন তৃতীয় হামেংকুবুয়োনো। তার সন্তান ও শাহজাদা দিপোনেগোরো রাজ্যের অবস্থা ও ওলন্দাজ বণিকদের দুঃসাহস ও বাড়াবাড়িতে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ছোট থাকতেই নিজের জন্মভূমিতে ১৮১০ সালে ইংরেজ ও ওলন্দাজ শক্তির মধ্যে জাভার দখলের লড়াই দেখে ক্ষুব্ধ হন। এছাড়া সালতানাতের ক্রমাগত অক্ষম হয়ে পড়া দেখেও তিনি দেশকে বাঁচানোর উপায় খুঁজছিলেন।
১৮১২ সালে দুই শত্রুভাবাপন্ন ইউরোপীয় বণিক শক্তির লড়াইয়ের খেসারত দিতে হলো ইয়োগিয়াকার্তা সালতানাতকে। রাজ্যের ব্যয়ভার ও বকেয়া শুল্ক পরিশোধের অজুহাতে একে কার্যত দু’ভাগে বিন্যস্ত করে দেওয়া হলো। আর রাজ্যের প্রশাসনের তোয়াক্কা না করে দরিদ্র কৃষকদের উপর চাপানো হয়েছিলো করের বোঝা। অত্যাচার ও অজন্মার কারণে ১৮১৫ সালে দেখা দিলো দুর্ভিক্ষ। এছাড়া বিউবোনিক প্লেগে জাভা অঞ্চলের অগণিত হতভাগ্য মানুষ প্রাণ হারালো।
এর মধ্যে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসকদের পরোয়া না করে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় স্থাপনা তৈরি করতে শুরু করে। ১৮২৪ সালে ওলন্দাজরা একটি দীর্ঘ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এই সড়কের মধ্যপথে শাহজাদা দিপোনেগোরো’র পিতা ও মাতার সমাধিস্থল পড়তো। কিন্তু এ ব্যাপারে ওলন্দাজদের কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিল না। দিপোনেগোরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওলন্দাজ বণিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন।
১৮২৫ সালের ২১ জুলাই, দিপোনেগোরো সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দিলেন। সেরালং এলাকা থেকে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ল। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিপোনেগোরোকে গ্রেফতার করার জন্য সৈন্য পাঠাল। ফলে, তার পক্ষে সাধারণ মানুষের সমর্থন সহজ হয়ে গেলো। পূর্ব ও মধ্য জাভার বিদ্রোহ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। ইয়োগিয়াকার্তার ২৯ জন যুবরাজের মধ্যে ১৫ জন এবং অভিজাতদের ৮৮ জনের মধ্যে ৪১ জন তাকে সমর্থন করল। আর ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো তো তার পক্ষে ছিলই।
ওলন্দাজদের পক্ষে দেশী রাজ্যগুলোও সৈন্যবল দিয়ে সাহায্য করেছিল। তবে প্রথমদিকে বিদ্রোহীদের আক্রমণ বেশ তীব্র হয়ে উঠেছিল। তাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল বিদেশী কুঠি আক্রমণ। তবে সরাসরি যুদ্ধে ওলন্দাজদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হওয়া কঠিন ছিল বলে বিদ্রোহীরা গেরিলা যুদ্ধ করতে লাগল। ১৮২৬ সাল নাগাদ জাভার বিভিন্ন এলাকা থেকে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পিছু হটতে লাগল, বিদ্রোহীরা বিজয়ী হলো। ওলন্দাজরা উপায় না দেখে রাজ্যের সিংহাসনে নিয়ে কূটনৈতিক চাল দিতে চাইলেও তা ব্যর্থ হলো।
এবার তারা কৌশল পরিবর্তন করল। ১৮২৭ সালে তারা স্থানীয় বৈরিতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন অপরাধী গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে শাহজাদা দিপেনোগোরো’র বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিল। এদিকে, বিদ্রোহীরা প্রাথমিক বিজয়ের পর আগের উদ্যম কিছুটা হারিয়ে ফেলেছিল। ওদিকে, তার দলের মধ্যে ম্যালেরিয়া মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ল। ১৮২৮ সাল থেকে ওলন্দাজ ও তাদের পক্ষের দলের শক্তি বাড়তে লাগল। এ বছর বহু বিদ্রোহী গোষ্ঠী শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করল।
১৮২৯ সালের নভেম্বরে দিপোনেগোরো’র চাচা মাংকুবুমি ও অক্টোবরে সেনাপতি আলী প্রাউইরাদির্জা আত্মসমর্পণ করলেন। ১৮৩০ সাল নাগাদ বিদ্রোহের শেষ ফুলকিও নিভে গেলো। এই বিদ্রোহে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রায় ৮,০০০ ইউরোপীয় সদস্য নিহত হয়। আর শাহজাদা দিপোনেগোরোর পক্ষে লড়তে গিয়ে জাভার প্রায় ২,০০,০০০ মানুষ প্রাণ হারায়। তাকে সমঝোতার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো। কিন্তু, ২৮ মার্চ বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী যুদ্ধের পর বাহাদুর শাহের মতো তাকেও নির্বাসন দেওয়া হয়। ১৮৫৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ইউরোপের ইতিহাস লেখকরা এই বিদ্রোহকে নিছক এক ক্ষমতালোভী যুদ্ধ আখ্যা দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ায় আজও দিপোনেগোরো জাতীয় বীরের মর্যাদা পেয়ে থাকেন।