মধ্যযুগে পোল্যান্ড ছিল ইউরোপের সবচেয়ে স্বাধীন চিন্তা-চেতনা লালনকারী দেশগুলোর একটি। ইতিহাসের একটি লম্বা সময় ধরে পোলিশরা বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের আনন্দচিত্তে তাদের ভূমিতে স্বাগত জানিয়েছে, যাদের একটি বড় অংশ ছিল ইহুদি। এজন্য দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে পোল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০% ছিল ইহুদি, ইউরোপের সব দেশের মধ্যে যা ছিল সবচেয়ে বেশি। ইউরোপের অনেক দেশের মতো সেখানে জীবিকার্জন কিংবা স্বাভাবিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য না থাকায় ইহুদিরা শান্তিতেই বসবাস করে আসছিল শত শত বছর ধরে। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা যখন পোল্যান্ড আক্রমণ করে তখন।
জীবিকার্জন কিংবা নাগরিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে প্রতিটি রাজধানীতে একটু আলাদা সুবিধা থাকে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে। যেমন বলা যায় শিক্ষা, চিকিৎসার কিংবা আয়ের উৎস তালাশের জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো জায়গা নিঃসন্দেহে রাজধানী ঢাকা। এজন্য দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি, অন্যান্য স্থান থেকে মানুষের আগমন বেশি। পোল্যান্ডের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ঠিক একই ছিল। ইহুদিরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে (বিশেষ করে ইউরোপ) আগমনের পর বসবাসের জন্য রাজধানী ওয়ারশকেই বেছে নিয়েছিল, কারণ নাগরিক সুবিধা ছিল এখানে বেশি।
রাজধানী ওয়ারশতে যুদ্ধ শুরুর সময় মোট অধিবাসী ছিল ১৩ লাখ, যেখানে ইহুদি অধিবাসী ছিল প্রায় ৪ লাখ! এজন্য যখন জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে, তখন ওয়ারশ শহরের বিপুল সংখ্যক ইহুদি যেন নাৎসিদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক কোনো কার্যক্রমে অংশ নিতে না পারে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল জার্মানরা।
পোল্যান্ডে নাৎসিরা আক্রমণ করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার একেবারে প্রথমদিকে, ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তি থাকার কারণে প্রথমদিকে পুরো পোল্যান্ড জার্মান সৈন্যরা করায়ত্ত করতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তীতে চুক্তিভঙ্গ করে ১৯৪১ সালে হিটলারের সৈন্যরা সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করলে চুক্তি অকার্যকর হয়ে যায়, পুরো পোল্যান্ড দখল করতে জার্মানির আর আইনগত কোনো বাধা ছিল না। দেশটি দখলের পর রাজধানী ওয়ারশর ইহুদিদের উপর নিপীড়ন শুরু হয়। তাদের নাগরিক অধিকার রদ করা হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে তাদের বিদায় করা হয়, প্রার্থনার স্থানগুলো হয় ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হয় নতুবা জেলখানায় পরিণত করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জাদুঘরে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
একটি জাতি বা সম্প্রদায়কে একঘরে করে ফেলার, পিছিয়ে দেয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ন্যূনতম মানবিক অধিকারগুলো কেড়ে নেয়া, যেটি জার্মানরা পোল্যান্ড দখলের পর খুব সুচারুভাবে সম্পন্ন করে। এরপরের পদক্ষেপ হিসেবে তারা শহরের সমস্ত ইহুদি অধিবাসীদের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় আটকে ফেলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং অল্প সময়ের মধ্যে তা বাস্তবায়নও করে। পোল্যান্ডের রাজধানীর ওয়ারশতেই বিভিন্ন এলাকা থেকে ইহুদিদের ধরে এনে ঘেটো (Ghetto) বা বস্তি-ঘরানার একটি এলাকায় তাদেরকে আটকে ফেলা হয়। এক বর্গমাইল এলাকায় অসংখ্য ছোট ছোট ঘর তৈরি করা হয়। এলাকাটি প্রায় দশ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়, যাতে কোনো ইহুদি পালাতে না পারে। দেয়াদের উপর বাড়তি সতর্কতার জন্য আবার কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হয়, আর সশস্ত্র নাৎসি সৈন্যরা সবসময় পাহারা দিতে যাতে কেউ পালাতে না পারে।
এবার ওয়ারশ শহরের সেই কুখ্যাত ঘেটো এলাকা সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক। পুরো এলাকাতে খাবারের তীব্র অভাব দেখা দেয়। বাইরে থেকে ঘেটো এলাকায় ঠিক কতটুকু খাবার ঢুকবে– এটা নিয়ন্ত্রণ করত জার্মানরা। স্বভাবতই তারা প্রয়োজনের তুলনায় অতি অল্প খাবার রেশন আকারে এলাকার ইহুদিদের মাঝে বিতরণ করত। এ কারণে ক্ষুধার তাড়নায় একসময় ঘেটোর ইহুদিরা চোরাই পথ অবলম্বন করতে শুরু করে। বাইরের মানুষদের মাধ্যমে এবং জার্মান পাহারাদার সৈন্যদের ঘুষ (ঘুষ হিসেবে সাথে থাকা মূল্যবান জিনিস দিতে হতো) প্রদানের মাধ্যমে তারা বাইরে থেকে কিছু খাবার সংগ্রহ করতে পারতো, তবুও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি অল্পই ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, প্রতিটি ঘরে গাদাগাদি করে ইহুদিদের থাকতে হতো। এক বর্গ মাইল এলাকায় যদি প্রায় চার লাখ মানুষকে রাখা হয়, তাহলে জনপ্রতি অতি অল্প জায়গা বরাদ্দ থাকাই স্বাভাবিক। ঘেটোর নোংরা পরিবেশে একসময় ছোঁয়াচে রোগ দেখা দেয় এবং প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যেতে শুরু করে। এদিকে পালানোরও কোনো উপায় ছিল না, কারণ যারা পালানোর চেষ্টা করেছিল তাদেরকে নাৎসি সশস্ত্র পাহারাদারদের হাতে গুলি খেয়ে মরতে হয়েছে।
যুদ্ধের সময় যত বাড়তে থাকে, নাৎসিদের আরও বেশি করে কর্মক্ষম জনশক্তির প্রয়োজন বাড়তে থাকে। এজন্য তারা একসময় প্রচার করতে শুরু করে যে, ওয়ারশর ঘেটোস্থ ইহুদিদের লেবার ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হবে। আসলে এটি ছিল একটি মিথ্যা কথা। জার্মান প্রশাসন ‘গ্রেট অ্যাকশন প্ল্যান’ হাতে নেয়, যেখানে ইহুদিদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে তাদের উপর গণহত্যার গোপন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওয়ারশর ঘেটো এলাকা থেকে ইহুদিদের ত্রেব্লিংকা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসের মধ্যেই প্রায় দুই লাখ ষাট হাজার ইহুদিকে সেই ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়।
পঞ্চান্ন থেকে ষাট হাজার ইহুদি ওয়ারশতে থেকে গিয়েছিল এবং তারা জানতে পেরেছিল যে ত্রেব্লিংকা ক্যাম্পে ইহুদিদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল মূলত গণহত্যার জন্য। তারা এটাও জানতো যে কিছু দিন পর তাদেরকেও সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে, তাদের উপরেও গণহত্যা চালানো হবে। এজন্য তারা শেষ চেষ্টা হিসেবে ওয়ারশ শহরের সেই ঘেটো এলাকাতেই গোপনে সশস্ত্র নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে (যেমন: জিউয়িশ কমব্যাট অ্যাসোসিয়েশন বা ZOB)। ঘেটো এলাকার বাইরে পোলিশ সৈন্য, যারা নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখেছিল, তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে ইহুদিরা হালকা অস্ত্রও যোগাড় করে। তবে নাৎসিদের পূর্ণমাত্রায় প্রতিরোধ করার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না, এ কথা বলাই বাহুল্য।
১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে বিদ্রোহের প্রথম স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। জানুয়ারির ১৮ তারিখে কিছু ইহুদিকে ত্রেব্লিংকা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার জন্য একদল নাৎসি সৈন্য ঘেটো এলাকায় প্রবেশ করে। লাইনে দাঁড় করানোর একপর্যায়ে ইহুদিরা লুকিয়ে রাখা অস্ত্র দিয়ে নাৎসি সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালায় এবং সাময়িকভাবে সফল হয়। নাৎসি সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয়, কিন্তু পরবর্তীতে কয়েক মাস ঘেটো এলাকা থেকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দিদের জোরপূর্বক নেয়া বন্ধ ছিল।
এপ্রিল মাসে ভারি অস্ত্রশস্ত্রসহ জার্মান সৈন্যরা আক্রমণ চালায় ঘেটো এলাকায়। প্রথমে তারা শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। কিন্তু ইহুদিরা তাদের সীমিত অস্ত্রসহ লড়াই চালিয়ে যায়। প্রায় এক মাস ধরে সংঘর্ষ চলে। জার্মানরা একের পর এক ঘর এবং বাংকার জ্বালিয়ে দেয়। ১৯ এপ্রিল থেকে ১৬ মে– প্রায় এক মাস ধরে চলা এই বিদ্রোহে প্রায় সাত হাজার ইহুদি মারা যায়, যাদের বেশিরভাগের মৃত্যু হয় আগুনে পুড়ে। বাকি ইহুদিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বিদ্রোহী ইহুদিদের মধ্যে অনেকে পালানোর চেষ্টা করে সফলও হয়, কিন্তু পরবর্তীতে নাৎসি সৈন্যরা তাদের অনেককে পুনরায় গ্রেফতার করে এবং ফাঁসিতে ঝোলায়। আত্মসমর্পণকৃত ইহুদিদের প্রায় সবাইকেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়।