খান-ই-খানান বৈরাম খান: অভিভাবক থেকে বিদ্রোহী হয়ে ওঠার গল্প

হিন্দুস্তানের মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবেই যে ব্যক্তিটির নাম বারবার উচ্চারিত হয়, তিনি হচ্ছেন বৈরাম খান। সাধারণ অবস্থান থেকে যাত্রা শুরু করে পরিবর্তীতে তিনিই হয়েছিলেন দুর্ধর্ষ মুঘল সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ তথা সেনাপ্রধান ও সাম্রাজ্যের প্রধান উজির। ১৫৫৬ সালের শেষ দিক থেকে শুরু করে বরখাস্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বলতে গেলে তিনিই ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

১৫০১ সালের জানুয়ারী মাসে মধ্য এশিয়ার বাদাখশানে জন্মগ্রহণ করেন বৈরাম খান। পূর্বপুরুষদের দিক থেকে তিনি ছিলেন কারা কুয়ুনলু সাম্রাজ্যের বাহারলু তুর্কোমান গোত্রভুক্ত। মুঘলদের সাথে বৈরাম খানের বংশের সম্পর্ক সেই সম্রাট বাবরের আমল থেকেই। বৈরাম খানের দাদা জানালি বেগ বাহারলু আর পিতা সাইফ আলী বেগ বাহারলু সম্রাট বাবরের সেনাবাহিনীতে কাজ করেছিলেন।

সম্রাট বাবরের হিন্দুস্তান বিজয়ের পূর্বেই পূর্বপুরুষের দেখানো পথ ধরে তিনিও মুঘল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৫৩০ সালের শেষের দিকে সম্রাট বাবরের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের মসনদে বসলেন তার পুত্র হুমায়ুন। বৈরাম খান সম্রাট হুমায়ুনের অধীনে সেনাবাহিনীতে রয়ে গেলেন। সম্রাট হুমায়ুনের নেতৃত্বে বানারস, বাংলা আর গুজরাটের যুদ্ধে তিনি কৃতিত্বের সাক্ষর রাখলেন। তাছাড়া, সম্রাট হুমায়ুনের নির্বাসনকালীন সময়ে তিনি সম্রাটের প্রতি চরম আনুগত্য দেখিয়ে সম্রাটের মন জয় করে নিয়েছিলেন।

সম্রাট হুমায়ুন; Image Source: Wikimedia Commons

১৫৪৫ সালে সম্রাট হুমায়ুন পারস্য ত্যাগ করে পুনরায় হিন্দুস্তান দখলের অভিযানে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সম্রাটের হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে বৈরাম খানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেন। তার ভূমিকায় খুশি হয়ে সম্রাট তাকে ‘খান-ই-খানান’ উপাধীতে ভুষিত করলেন। যার মানে দাঁড়ায় ‘রাজাদের রাজা’। উপাধীটি থেকেই মুঘল দরবারে বৈরাম খানের প্রভাব-প্রতিপত্তি বোঝা যায়।

১৫৫৬ সালের জানুয়ারী মাসে সম্রাট হুমায়ুন তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ইন্তেকাল করেন। সম্রাটের মৃত্যুর কয়েকমাস পরেই আফগান শাসক আদিল শাহের হিন্দু সেনাপতি হিমু দিল্লি আর আগ্রা থেকে শুরু করে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ মুঘল শহরগুলো দখল করে নিতে থাকে। একপর্যায়ে নিজের প্রভু আদিল শাহকে উপেক্ষা করে নিজেই ‘রাজা’ উপাধী নিয়ে দিল্লির মসনদে বসে গেলেন।

ফলে অবধারিতভাবেই হিমুর সাথে মুঘলরা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গেলেন। সেই দ্বন্দ্ব গড়ালো যুদ্ধের মাঠ পর্যন্ত। পানিপথের দ্বিতীয় এই যুদ্ধে মুঘল সেনাবাহিনী হিমুর বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করলো। আকবর দিল্লি আগ্রাসহ একে একে অন্যান্য শহরগুলোর উপর দখল নিতে শুরু করলেন।

দিল্লির মসনদে হিমু; Image Source: Wikimedia Commons

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় আকবর ছিলেন নিতান্তই নাবালক। কাজেই বলা যায়, মূলত লড়াইটি হয়েছিল হিমু আর বৈরাম খানের মধ্যেই। এ যুদ্ধে হিমুর তুলনায় মুঘল সেনাবাহিনীর শক্তি তুলনামূলক অনেক কম ছিল। কিন্তু, নিজের সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধির সাহায্যে সেই লড়াইয়ে রাজা হিমুকে পরাজিত করে হিন্দুস্তানে মুঘল সাম্রাজ্যের অবস্থান পাকাপোক্ত করলেন খান-ই-খানান বৈরাম খান।

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমুর শোচনীয় পরাজয়; Image Source: Wikimedia Commons

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর বৈরাম খান সম্রাট হুমায়ুনের বোন গুলরুখ বেগমের কন্যা সেলিমা সুলতানা বেগমকে বিয়ে করলেন। সম্রাট হুমায়ুনই বৈরাম খানের সাথে নিজের আত্মীয়দের মধ্য থেকে কাউকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, পরবর্তীতে আকবরের অনুমতিতে সেই বিয়েটি হয়ে গেল। এই বিয়ের ফলে বৈরাম খান মুঘল রাজপরিবারের সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে গেলেন, সেই সাথে মুঘল দরবারে বেড়ে গেল তার মর্যাদা।

সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর মুঘল শাসনের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নাবালক আকবরকেই দিল্লির মসনদে বসাতে হয়েছিল। কিন্তু, সাম্রাজ্য পরিচালনায় আকবর তখনো উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেননি। কাজেই বৈরাম খান নিযুক্ত হলেন আকবরের অভিভাবক হিসেবে। এর পরের কয়েকটি বছর বৈরাম খান বালক আকবরের পক্ষে মুঘল সাম্রাজ্য শাসন করতে লাগলেন।

এ সময়ে তিনি গোয়ালিয়র দুর্গ, আজমীর, সম্ভল আর জৌনপুর দখল করেন। যদিও তার রণথম্বোর আর চুনার অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। বৈরাম খানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল সম্রাট আকবরের অল্প বয়সের সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠা বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন মুঘল মীর্জাদের দমন করা। এসব করতে করতে একপর্যায়ে তিনি নিজেই হয়ে উঠলেন মুঘল সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট।

সমস্যার শুরু এখান থেকেই। একদিকে মুঘল রাজদরবারে তার কথাই যেমন ছিল শেষকথা, অন্যদিকে আকবরের প্রতিও তার শ্রদ্ধাবোধ দিন দিন কমে যেতে লাগলো। দুটি ভিন্ন ভিন্ন দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে বৈরাম খান দুজন মাহুতকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। এই দুজনই ছিলেন স্বয়ং আকবরের ব্যক্তিগত মাহুত। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সময় বৈরাম খান একবারও ভাবেননি যে তিনি সম্রাট নন, সম্রাট হচ্ছেন আকবর, আর তিনি স্বয়ং আকবরেরই মাহুতকে অন্যায় শাস্তি দিচ্ছেন।

সিংহাসনে আকবর; Image Source: Wikimedia Commons

আকবরের মাহুতকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া নয়, মূল সমস্যা হলো যত দিন যেতে লাগলো বৈরাম খান ক্ষমতার দিক থেকে ততই অপ্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠতে লাগলেন। এতে মুঘল দরবারের অনেক অভিজাতই নিজেদের নিরাপত্তাহীন বোধ করতে লাগলেন।

মুঘল অভিজাতরা দুটি দলে বিভক্ত ছিলেন। একদল ছিলেন তুর্কী পন্থী সুন্নী সম্প্রদায়, অন্য পক্ষে ছিলেন পারস্য পন্থী শিয়া সম্প্রদায়। বৈরাম খান ছিলেন শিয়া মতালম্বী, কাজেই তিনি পারস্য পন্থী গ্রুপের মাঝে পড়লেন। বৈরাম খানের এমন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জনে মুঘল দরবারের তুর্কী পন্থী সুন্নী আমিররা গেলেন ভড়কে। ভড়কানোরই কথা, কারণ সুন্নী-শিয়া দ্বন্দ্ব বহু পুরাতন। আর দুই পক্ষই চায় অন্য দলকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত করে ঐ দলের উপর আধিপত্ত বিস্তার করতে।

এদিকে যতই ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করছিলেন, বৈরাম খান ততই রাজনৈতিক ভুল করতে শুরু করলেন। ইতোমধ্যেই তো তিনি তরদী বেগকে অন্যায়ভাবে হত্যা করিয়েছিলেন, যাকে বৈরাম খানের মূল প্রতিপক্ষ ভাবা হচ্ছিল। এই ব্যাপারটি মুঘল দরবারের সুন্নী আমিররা কখনোই ভুলতে পারেননি। কাজেই বৈরাম খানের উত্থানে তারা নিজেদের অরক্ষিত ভাবতে লাগলেন।

ভাবাটা ভুল কিছু না। কারণ এর ভেতরেই বৈরাম খান আকবরের শিক্ষক ও মুঘল রাজপরিবারের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক থাকা নাসির-উল-মুলক পীর মুহাম্মদকে বরখাস্ত করে মক্কা যাওয়ার নির্দেশ দেন। এতে স্বাভাবিকভাবেই সবাই আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। বৈরাম খান যে সুকৌশলে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দী ও মুঘল পরিবারের প্রতি অনুগতদের সরিয়ে দিচ্ছেন, এমন একটি বদ্ধমূল ধারণা সবার মাথায় গেঁথে যায়।

ক্ষমতাবানরা তাদের আশেপাশে তাদের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান কাউকে দেখতে চান না। এদিক থেকে বলতে গেলে বৈরাম খান ধীরে ধীরে স্বয়ং আকবরের চেয়েও ক্ষমতাবান হয়ে উঠছিলেন। গোটা মুঘল সেনাবাহিনী আর প্রশাসন তখন বৈরাম খানের দখলে ছিলেন। কাজেই বৈরাম খানের এই ধরনের সিদ্ধান্তে আকবরও বেশ বিরক্ত ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে শুরু করলেন।

তাছাড়া বৈরাম খান দরবারের অন্যান্য আমিরদের সহজে আকবরের কাছে ভীড়তে দিতেন না। এমনকি রাজপরিবারের সদস্যরাও সহজে আকবরের কাছাকাছি যেতে পারতো না। বৈরাম খানের যুক্তি ছিল, সাম্রাজ্যের এ কঠিন পরিস্থিতিতে সুযোগসন্ধানী অনেকেই আকবরকে ভুল পরামর্শ দেবে এবং নানান রকমের সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেবে। বৈরাম খানের এ ধরনের পদক্ষেপে স্বাভাবিকভাবেই অন্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। কারণ রাজদরবারে বিশেষ গুরুত্ব না পাওয়ায় তাদের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না।

এছাড়া অভিযোগ ছিল বৈরাম খান যোগ্যতার মাপকাঠিতে নিয়োগ না দিয়ে শিয়া ও তার পরিচিতদের মধ্য থেকে উচ্চপদে নিয়োগ দেওয়া শুরু করেছেন। বাস্তবিক অর্থেই একপর্যায়ে দেখা গেল পুরো মুঘল প্রশাসন আর সেনাবাহিনীই বৈরাম খানের হাতে চলে গিয়েছে। ক্ষমতার এই নিরঙ্কুশ দাপটে বৈরাম খান নানাভাবেই উদ্ধত আচরণ প্রকাশ করতে লাগলেন। একপর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে- মুঘল সাম্রাজ্য হবে হয় বৈরাম খানের না হয় আকবরের।

আকবরের মা এবং মুঘল পরিবারের প্রতি অনুগতরা ঠিক এ ভয়টাই পাচ্ছিলেন। তারা ধারণা করছিলেন আকবরের অভিভাবক হিসেবে বৈরাম খান যে প্রভাব প্রতিপত্তি ভোগ করছেন, তা নিজ ইচ্ছায় কখনোই ছাড়বেন না। নিজের শিয়া পরিচয়ের কারণে হয়তো বৈরাম খান কখনোই সরাসরি মসনদে বসে নিজেকে সম্রাট দাবি করতে পারবেন না, তবে আকবরকে আজীবন নিজের হাতের পুতুল করে রেখে ঠিকই ক্ষমতা ভোগ করবেন।

এদিকে ১৫৬০ সালে আকবর তখন ১৮ বছরে পূর্ণ টগবগে যুবক। এতদিন বৈরাম খানের সহায়তায় সাম্রাজ্য শাসন করলেও ১৮ বছরে এসে অনুধাবন করলেন যে এখনই সময় সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেওয়ার। তবে তিনি এও বুঝলেন বৈরাম খান কখনোই তা হতে দেবেন না। কাজেই তিনি বৈরাম খানকে পদচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে বৈরাম খানের প্রভাবের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আকবর বেশ ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে এগুতে লাগলেন।

যদিও বৈরাম খানকে পদচ্যুত করার সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন আকবরই, তবে আকবরকে সিদ্ধান্তটি নিতে প্ররোচনা দিয়েছিল আকবররেই ঘনিষ্ঠ কিছু লোকজন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের এই শিকড়টা ছিল অনেক গভীরে। এই ষড়যন্ত্র বৈরাম খানকে তো ধ্বংস করবেই, সেই সাথে খোদ আকবরকেই গিলে খেতে চেষ্টা করবে। যথাসময়ে সেই আলোচনা হবে।

বৈরাম খান আর আকবরের দ্বন্দ্ব যখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে, তখনই একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে বৈরাম খান আকবরকে সরিয়ে কামরান মির্জার পুত্র আবুল কাসিমকে মসনদে বসাতে যাচ্ছেন। এমনকি মুঘল পরিবারের মাঝে উপযুক্ত কাউকে পাওয়া না গেলে সিকান্দার শাহ সুরির এক পুত্রকে ক্ষমতায় বসানো হবে। ঘটনা সত্য না মিথ্যা তা জানা গেল না, জানার উপায়ও নেই, তবে আকবর বুঝে গেলেন আর সময় নেই। যা করার এখনই করতে হবে, নয়তো তা আর কখনোই করা হবে না।

১৫৬০ সালের ১৯ মার্চ। এই দিনে আকবর শিকার করবেন জানিয়ে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীর বাছাই করা ৩০০ জন যোদ্ধা নিয়ে আগ্রা ত্যাগ করেন। ইতোমধ্যেই নিরাপত্তার খাতিরে আকবর তার চাচাতো ভাই আবুল কাসিমকে তার সাথে শিকারে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলে আবুল কাসিমও সম্রাটের সঙ্গী হলেন। আগ্রা ত্যাগ করে আকবর উপস্থিত হলেন সিকান্দ্রায়। সিকান্দ্রায় এ সময় আকবরের দুধ মা মাহাম আগা তার বিশ্বস্ত অনুচরদের নিয়ে আকবরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বৈরাম খানের উপর নানান কারণে মাহাম আগাও বেশ চটে ছিলেন, তাই তিনিও সুযোগ হাতছাড়া করলেন না তাদের নিয়ে আকবর দ্রুত চলে গেলেন দিল্লিতে।

দিল্লির পুরাতন দুর্গ; Image Source: Wikimedia Commons

দিল্লিতে এ সময় আকবরের মা হামিদা বানু অবস্থান করছিলেন। আকবর দিল্লি পৌঁছেই হামিদা বানুর অসুস্থতার মিথ্যা খবর পাঠিয়ে আগ্রায় বৈরাম খানকে জানালেন তিনি তার মাকে দেখতে এসেছেন। দিল্লিতে আকবরকে স্বাগত জানাতে জাকজমকপূর্ণ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। তবে আকবরের মূল মনোযোগ ছিল বৈরাম খানের সমর্থকদের উপর। আকবর কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিলেন না। দ্রুতই বৈরাম খানের চিহ্নিত সমর্থকদের আটক করার নির্দেশ দেওয়া হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে কিছু সমর্থক পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো।

এর মাঝেই আকবর দিল্লির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নিয়ে সেনাবাহিনীকে যুদ্ধাবস্থার জন্য প্রস্তুত করে ফেললেন। সাথে আকবর সবগুলো মুঘল দুর্গে বৈরাম খানের পদচ্যুতি আর সর্বময় ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বার্তা পাঠিয়ে দেন। দিল্লির গভর্নর শিহাবউদ্দিন আতাগাকে ‘খান-ই-খানান’ ঘোষণা দেওয়া হয়।

সম্রাট আকবরের সক্রিয়ভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথেই সম্রাটের পক্ষে লাহোর দুর্গের নিয়ন্ত্রণ নেন মীর মুহাম্মদ কালান। আর, সম্রাটের পক্ষে কাবুলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেন মুনিম খান। প্রায় একই সাথে চারদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা দিল্লির দরবারে ছুটে আসেন আকবরের আনুগত্য স্বীকার করতে। এমনকি বৈরাম খানের ঘনিষ্ঠ শেখ গাদাইও আকবরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আকবরের আনুগত্য স্বীকার করে নেন।

এই শেখ গাদাইকে ‘সদর-ই-সুদুর’ বা প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে বৈরাম খান মুঘল দরবারের সুন্নীদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। শেখ গাদাই এমনিতে সুন্নী ও নিরীহ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তবে পারস্য বংশোদ্ভুত হওয়ায় আর বৈরাম খানের সাথে তার দহরম মহরম থাকায় তাকে শিয়া হিসেবে সন্দেহ করা হতো। উল্লেখ্য, পীর মুহাম্মদকে বরখাস্ত করা হয়েছিল শেখ গাদাইকে নিয়োগ দেয়ার জন্যই।

সে যা-ই হোক, দিল্লিতে যখন এতোকিছু চলছে, আগ্রায় বৈরাম খান তখন হতভম্ব হয়ে নিজেকে একা অবস্থায় আবিষ্কার করলেন। দরবারের প্রায় সবাই আকবরের আনুগত্য স্বীকার করেছে। এ সময় বৈরাম খানের অল্প কিছু সৈন্য ঘনিষ্ট কয়েকজন লোক ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

পরিস্থিতি নিজের দিকেই আছে বুঝে আকবর এবার আনুষ্ঠানিকভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলেন। এরপর তার গৃহশিক্ষক আবদুল লতিফের মাধ্যমে বৈরাম খানকে একটি বার্তা পাঠালেন। বার্তায় তিনি লিখলেন,

‘আপনার সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি পূর্ণ আস্থা থাকায় আমি রাষ্ট্রের সকল গুরুদায়িত্ব আপনার হাতে সমর্পণ করেছিলাম। তবে আমি এখন নিজ হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণে আগ্রহী। আপনি দীর্ঘদিন ধরে হজ্বে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন। আশা করছি এই সুযোগে আপনি হজ্ব আদায় করে নিতে পারবেন। আপনার ভরণপোষণে হিন্দুস্তানের একটি পরগণার জায়গীর আপনাকে দেওয়া হবে। আপনার প্রতিনিধিরা জায়গীরের রাজস্ব আপনার কাছে পৌঁছে দেবে।’

নিজের এই অপমানজনক বরখাস্তের সংবাদ শুনে বৈরাম খান আগ্রা ত্যাগ করে মেওয়াট ও বায়ানা হয়ে লাহোর আর সিরহিন্দের দিকে চলে যান। এসব জায়গায় বৈরাম খানের ব্যক্তিগত অনেক সম্পত্তি ছিল। তবে বৈরাম খানকে এভাবে বিদায় করার বিষয়টি বৈরাম খানের সাথে থাকা ঘনিষ্ঠরা সহ্য করতে পারছিলেন না। তারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বৈরাম খানকে বিদ্রোহ করতে বললেন। বিদ্রোহ না করলেও অন্তত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে বলছিলেন।

তবে বৈরাম খান এর কিছুই করতে রাজী হলেন না। তিনি দীর্ঘদিন বিশ্বস্ততার সাথে মুঘল সাম্রাজ্যের সেবা করেছেন। কখনো কেউ তার আনুগত্যে প্রশ্ন তুলতে পারেনি। এখন বরখাস্তের পর বিদ্রোহ করে তার দীর্ঘ বিশ্বস্ততার উপর তিনি কালিমা লেপন করতে চাননি। আর, বৈরাম খান ও আকবর দুজনই জানতেন, তারা কেউই একে অন্যের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে চাইবেন না। তাই বৈরাম খান আকবরের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না জানিয়ে অনেকটা হাসিমুখে পদচ্যুতির এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন। অনেকদিন তিনি প্রচণ্ড ব্যস্ততা আর দায়িত্বের মাঝে ছিলেন। এখন তারও বিশ্রাম প্রয়োজন।

এদিকে সম্পত্তি সংগ্রহ করতে পাঞ্জাবের দিকে গিয়ে বৈরাম খান একটু বেশি সময়ই কাটিয়ে ফেলেছিলেন। এতে মুঘল দরবারে সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছিল। তারা ভাবছিল এভাবে কালক্ষেপণ করে বৈরাম খান অন্য কিছু করার চেষ্টা করছে না তো? তাই বৈরাম খান সত্যিই মক্কার দিকে আগ্রসর হচ্ছেন কি না, এটা নিশ্চিত করতে আকবর ৫০০০ সৈন্য সহ পীর মুহাম্মদকে পাঞ্জাব অভিমুখে পাঠিয়ে দেন।

এই সতর্কতা অবশ্যই যৌক্তিক ছিল। কারণ, বৈরাম খান দীর্ঘদিন মুঘল সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মুঘল সেনাবাহিনীর একটি বিরাট অংশ বৈরাম খানের অনুগত ছিল। চাইলেই বৈরাম খান সেনাবাহিনীর উপর তার প্রভাব খাঁটিয়ে আকবরের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহের আয়োজন করে ফেলতে পারতেন। কাজেই বৈরাম খানের কর্মকাণ্ডে আকবর নিশ্চিত হতে পারছিলেন না, এ কারণেই এই বাড়তি সতর্কতা। কিন্তু সমস্যা বেঁধে গেলো অন্য জায়গায়। পীর মুহাম্মদের অগ্রযাত্রার সংবাদ শুনে বৈরাম খান গেলেন রেগে। কারণ পীর মুহাম্মদের সাথে বৈরাম খানের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল।

অকৃতঘ্ন এই পীর মুহাম্মদ একসময় বৈরাম খানের দেওয়া সুযোগ সুবিধা পেয়েই বিপুল ধন সম্পদ অর্জন করেছিলেন, সেই সাথে পেয়েছিলেন ক্ষমতার স্বাদ। কিন্তু, অর্থ ও ক্ষমতা পেয়ে তিনি স্বয়ং বৈরাম খানকেই অসম্মান করতে শুরু করলেন। ক্রুদ্ধ বৈরাম খান পীর মুহাম্মদকে নির্বাসনে পাঠালে পীর মুহাম্মদ গুজরাট হয়ে মক্কার দিকে অগ্রসর হন।

কিন্তু, ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! পীর মুহাম্মদ গুজরাটেই বৈরাম খানের বরখাস্তের সংবাদ শুনে দিল্লি গেলে আকবর তাকে তার দরবারে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। বৈরাম খানের রাগটা ছিল এখানেই। বরখাস্তের সংবাদে তিনি যতটা না অপমানিত বোধ করছিলেন, তারচেয়েও বেশি অপমানিত বোধ করছিলেন বৈরাম খানে হিন্দুস্তান ত্যাগ নিশ্চিত করতে পীর মুহাম্মদকে প্রেরণের ঘটনায়।

এভাবে একের পর এক অপমানিত হতে থাকায় বৈরাম খান এবার নিজের মত পরিবর্তন করলেন। তিনি আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নিলেন। মূল পরিকল্পনাটা ছিল এরকম- বৈরাম খান যুদ্ধ করে পীর মুহাম্মদকে পরাজিত করে হিন্দুস্তান ত্যাগ করবেন। এতে এটা বোঝানো সম্ভব হবে যে বৈরাম খান পীর মুহাম্মদের তাড়া খেয়ে হিন্দুস্তান ত্যাগ করেননি, বরং তিনি হিন্দুস্তান ত্যাগ করছেন সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায়।

সে যা-ই হোক, বৈরাম খানে লক্ষ এবার জলন্ধর। (চলবে…)

[এই সিরিজের পূর্বের প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]

This article is written in Bengali language. It's a short biography of Great Khan-E-Khana Bairam Khan, who became rebel from gurdian of Emperor Akbar.

References:

1. আকবর দ্য গ্রেট, মূল: সৈয়দ আবিদ রিজভি, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য, প্রকাশকাল: এপ্রিল, ২০১৭

2. মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়, সাহাদত হোসেন খান, আফসার ব্রাদার্স, ২য় মুদ্রণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩

3. ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ: মোগল পর্ব), এ কে এম শাহনাওয়াজ, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ৩য় সংস্করণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০২

4. Akbar The Great Mogul 1542-1605, Vincent A. Smith, Oxford University Press, 1917

Ferature Image: trip101.com

Related Articles

Exit mobile version