মার্টিন লুথার কিং আমেরিকায় বর্ণবৈষম্য দূর করার পেছনে একজন অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটনের লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ভাষণটি সবাই এখন ‘I have a dream’ শিরোনামে জানে। এই ভাষণে উঠে এসেছে নিগ্রোদের প্রতি অত্যাচারের কথা, তাদের বৈষম্যের শিকার হওয়ার কথা। তিনি বলেছেন তার স্বপ্নের কথা। স্বপ্ন দেখেছেন সাম্যের, স্বপ্ন দেখেছেন শোষণমুক্ত এক সমাজের যেখানে সব মানুষ সমান হবে। আজ সেই ভাষণ বাংলায় উপস্থাপন করা হলো রোর বাংলার পাঠকদের জন্য।
“আপনাদের সাথে থাকতে পেরে গর্বিত অনুভব করছি। আজকের এই দিন ইতিহাসের পাতায় আমাদের দেশের স্বাধীনতার নিদর্শন হিসেবে লেখা থাকবে। পাঁচ বছর আগে একজন মহান আমেরিকান মুক্তির ঘোষণা সই করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ আইনটি লাখ লাখ নিগ্রো দাসের কাছে আশার আলো হিসেবে এসেছিল, যারা বিধ্বংসী অবিচারের আগুনে পুড়ছিল। রাতভর অত্যাচারের পর এটা এসেছিল ভোর হিসেবে।
কিন্তু এর একশ বছর পরেও নিগ্রোরা স্বাধীন নয়। একশ বছর পরেও নিগ্রোরা পৃথকীকরণ এবং বৈষম্যের বেড়াজালে বন্দী হয়ে আছে। একশ বছর পরেও নিগ্রোরা আজ জাগতিক ধন-সম্পদের সাগরে দারিদ্র্যের এক দ্বীপে বাস করে। একশ বছর পরেও নিগ্রোদের আমেরিকান সমাজের এক কোনায় দুর্বল করে ফেলে রাখা হয়েছে, যেন নিজেদের দেশে নিজেরাই নির্বাসিত। আমরা আজ এই লজ্জাজনক অবস্থার রূপ দেখতে এসেছি।
আমরা এক অর্থে দেশের রাজধানীতে এসেছি একটা চেক ভাঙানোর জন্য। যখন আমাদের দেশের কারিগরেরা সংবিধানের অসাধারণ শব্দগুলো লিখেছিলেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, তখন আসলে তারা একটি কর্জপত্র সই করছিলেন, যার উপর সব আমেরিকানের অধিকার আছে। এটা একটা অঙ্গীকার ছিল যে, সব মানুষ সাদা-কালো নির্বিশেষে ‘জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখের’ জন্য একই অধিকার পাবে। বর্ণভেদে আমেরিকা এই অঙ্গীকার পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আমেরিকা নিগ্রোদের একটি খারাপ চেক দিয়েছে, যে চেকে লেখা আছে পর্যাপ্ত ব্যাল্যান্স নেই।
কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি না বিচারের ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা বিশ্বাস করি না এই দেশের বিশাল ভল্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ সুযোগ নেই। আর তাই আমারা এই চেক ভাঙাতে এসেছি, যে চেক আমাদের স্বাধীনতা এবং সুবিচার দেবে।
আমরা এই পবিত্র জায়গায় এসেছি আমেরিকাকে এখনই পদক্ষেপ নেয়ার গুরুত্বকে মনে করিয়ে দিতে। অবস্থা শান্ত হওয়ার জন্য সময় দেয়ার কিংবা ক্রমানুসারে পরিবর্তনের ঘুমের ওষুধ খাওয়ার বিলাসিতা করার সময় নেই। এখনই গণতন্ত্রের প্রতি সত্যিকারের অঙ্গীকার করার সময়। এখনই অন্ধকার থেকে জেগে ওঠার এবং বৈষম্যের উপত্যকাকে জনশূন্য করে সূর্যের আলোয় স্নাত জাতিগত ন্যায়বিচারের দিকে যাওয়ার সময়। এখনই সময় আমাদের দেশকে জাতিগত অবিচারের চোরাবালি থেকে উঠিয়ে ভ্রাতৃত্বের কঠিন পাথরে নিয়ে আসার। এখনই সময় ঈশ্বরের সব সন্তানের জন্য ন্যায়বিচারকে বাস্তবে পরিণত করার।
এই মুহূর্তের গুরুত্বকে এড়িয়ে গেলে তা এই দেশের জন্য সর্বনাশা হবে। নিগ্রোদের বৈধ অসন্তোষের এই তীব্র তাপ ততক্ষণ পর্যন্ত যাবে না যতক্ষণ না স্বাধীনতা ও সাম্যের উদ্দীপ্ত শরৎকাল আসবে। ১৯৬৩ শেষ নয়, বরং শুরু। যারা আশা করে নিগ্রোদের ঠাণ্ডা হওয়া উচিত, তারা এখন তুষ্ট হবে, কারণ পুরো দেশ জেগে উঠলে এটা খুব কঠিন এক জাগরণ হবে। নিগ্রোদের নাগরিক অধিকার দেয়ার আগপর্যন্ত আমেরিকাতে কোনো বিশ্রাম থাকবে না। ন্যায়বিচারের দিন আসার আগপর্যন্ত বিদ্রোহের ঘূর্ণিঝড় এ দেশের ভীতকে নাড়াতে থাকবে।
যারা ন্যায়বিচারের প্রাসাদের পথে দাঁড়িয়ে আছে, আমি আমার সেই মানুষদের বলতে চাই। আমাদের বৈধ দাবি আদায়ের জন্য কোনো ভুল কাজ করব না। আমরা আমাদের স্বাধীনতার তৃষ্ণাকে তিক্ততা এবং ঘৃণার পেয়ালা থেকে নিবারণ করবো না। আমাদের সৃজনশীল প্রতিবাদকে শারীরিক আক্রমণে পরিণত করবো না। আমরা বারংবার শারীরিক শক্তির সাথে আত্মিক শক্তির মিলন ঘটাবো।
নতুন জঙ্গিবাদ নিগ্রো সম্প্রদায়কে গ্রাস করে ফেলেছে। এটা যাতে সব শ্বেতাঙ্গের প্রতি আমাদের অবিশ্বাস গড়ে না তোলে। অনেক শ্বেতাঙ্গ ভাইদের কারণে আজকে আমাদের এখানে আসা সম্ভব হয়েছে। আমরা এটা বুঝতে পেরেছি যে তাদের ভাগ্য আমাদের ভাগ্যের সাথে একই সুতায় বাঁধা। তারাও বুঝতে পেরেছে তাদের স্বাধীনতা আমাদের স্বাধীনতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আমরা একা চলতে পারবো না। এবং যখন আমরা হাঁটবো আমাদের এই পণ করা উচিত, আমরা সবসময় সামনের দিকে এগোবো। আমাদের পেছনে ফেরা যাবে না।
তারা নাগরিক অধিকার সেবকদের জিজ্ঞেস করে, “তোমরা কখন সন্তুষ্ট হবে?” আমরা কখনও সন্তুষ্ট হবো না যতক্ষণ পর্যন্ত নিগ্রোরা পুলিশের অকথ্য ভয়ঙ্কর বর্বরতার শিকার হবে। আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হব না যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের বিদেশ ভ্রমণে অবসাদগ্রস্ত দেহ রাজপথের পাশের মোটেলে, শহরের হোটেলে থাকার জায়গা পাবে না। আমরা সন্তুষ্ট হব না যতক্ষণ পর্যন্ত নিগ্রোদের গতিশীলতা কেবল ছোট বস্তি থেকে বড় বস্তিতে। আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হব না যতক্ষণ পর্যন্ত ‘শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গদের জন্য’ এই প্রতীক দিয়ে আমাদের শিশুদের আত্মপরিচয়, তাদের মর্যাদা ছিনিয়ে নেয়া হবে। আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হব না যতদিন মিসিসিপির নিগ্রোরা ভোট দিতে পারবে না এবং নিউইয়র্কের নিগ্রোরা ভোট দেয়ার মতো কাউকে পাবে না। না, না, আমরা সন্তুষ্ট না এবং সন্তুষ্ট হব না যতদিন ন্যায়বিচার পানির মতো বইবে না, ন্যায়পরায়ণতা বিশাল স্রোতের মতো বইবে না।
তোমরা এখানে অনেকেই কঠিন দুঃখ কষ্টের মধ্য থেকে এসেছ, এ ব্যাপারে আমি উদাসীন নই। তোমাদের কেউ সদ্য জেল থেকে এসেছ। তোমাদের অনেকেই এমন জায়গা থেকে এসেছ যেখানে তোমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে নিপীড়নের ঝড় দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে এবং পুলিশি নির্মমতার ঝড়ো হাওয়া দিয়ে ছুরি মারা হয়েছে। বিশ্বাসের সাথে কাজ করছ, কিন্তু যে কষ্টের মূল্য পাওয়া যায় না তা মুক্তির ডাক আনে। মিসিসিপি, আলাবামা, সাউথ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া, লুইজিয়ানাতে ফিরে যাও, বস্তি এবং মহল্লাতে ফিরে যাও, এই অবস্থা পরিবর্তন হতে পারে এবং পরিবর্তন হবে।
বন্ধুরা, আজ আমি তোমাদের বলছি, তোমরা হতাশার উপত্যকায় অধঃপতিত হবে না। যদিও আমরা আজকের এবং কালকের বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছি, তা-ও আমার একটি স্বপ্ন আছে। এই স্বপ্নের শিকড় আমেরিকান স্বপ্নের মধ্যে প্রোথিত।
আমি স্বপ্ন দেখি এই জাতি একদিন জেগে উঠবে এবং এর ধর্মবিশ্বাসের সত্যকে জীবনে কাজে লাগাবে যে, “আমরা এই সত্যগুলোকে প্রমাণিত বলে মানি যে, সব মানুষকে সমান করে সৃষ্টি করা হয়েছে।”
আমি স্বপ্ন দেখি একদিন জর্জিয়ার লাল পাহাড়ে, আগের দাসদের সন্তানরা এবং আগের দাস মালিকদের সন্তানরা ভ্রাতৃত্বের টেবিলে একসাথে বসতে পারবে। আমি স্বপ্ন দেখি, এমনকি মিসিসিপি প্রদেশ যেটা অবিচার এবং নিপীড়নের তীব্র তাপে জর্জরিত, তা-ও একদিন স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের আশ্রয়স্থলে পরিণত হবে।
আমি স্বপ্ন দেখি আমার ছোট ছোট চার সন্তান এমন একটি দেশে বাস করবে যেখানে তাদেরকে তাদের গায়ের রং দিয়ে বিচার করা হবে না, বরং তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিচার করা হবে। আজ আমার একটি স্বপ্ন আছে।
আমি স্বপ্ন দেখি, আলবামা, যেখানে রয়েছে দুশ্চরিত্র বর্ণবাদী লোক, যেখানের গভর্নরের মুখ থেকে হস্তক্ষেপ এবং অকার্যকর এ ধরনের শব্দ বের হয়, একদিন এই আলবামাতে ছোট ছোট কাল ছেলে মেয়েরা সাদা ছেলেমেয়েদের সাথে ভাই-বোন হিসেবে হাত মেলাবে।
আজ আমার একটি স্বপ্ন আছে। আমি স্বপ্ন দেখি, উপত্যকাগুলো সুউচ্চ হবে, প্রতিটি পাহাড় এবং পর্বতকে নিচু করা হবে, বন্ধুর পথকে সমতল করা হবে এবং বাকা জায়গাকে সোজা করা হবে। ঈশ্বরের অলৌকিকতা প্রকাশ পাবে এবং সকল রক্ত-মাংসের মানুষ তা একসাথে দেখবে।
এটাই আমাদের আশা এবং আমি এই বিশ্বাসে দক্ষিণে যাই। এই বিশ্বাসের সাথে আমরা হতাশার পর্বত থেকে আশার পাথর খুঁড়ে আনতে পারবো। এই বিশ্বাসের সাথে আমরা অনৈক্যকে ভ্রাতৃত্বের ঐকতানে পরিণত করতে পারবো। এই বিশ্বাসের সাথে আমরা একসাথে কাজ করতে পারবো, একসাথে প্রার্থনা করতে পারবো, একসাথে সংগ্রাম করতে পারবো, একসাথে জেলে যেতে পারবো, স্বাধীনতার জন্য একসাথে দাঁড়াতে পারবো, আমরা জানবো আমরা একদিন স্বাধীন হবো। এবং এটাই হবে সেই দিন- এটাই হবে সেই দিন যেদিন ঈশ্বরের সন্তানেরা নতুন অর্থের সাথে গান গাইতে পারবে-
আমার দেশ, এটা স্বাধীনতার ভূমি,
আমি এর গান গাই,
এখানেই আমার পূর্বপুরুষেরা মারা গিয়েছেন, এটা তীর্থযাত্রীদের গর্ব,
প্রতিটি পর্বতের গাত্র থেকে স্বাধীনতার ঘণ্টা বেজে উঠুক।
এবং আমেরিকাকে যদি একটা মহান রাষ্ট্র হতে হয় তাহলে এটা সত্য হতে হবে।
নিউ হ্যাম্পশায়ারের পাহাড়ের চূড়া থেকে স্বাধীনতার ঘণ্টা বাজুক। স্বাধীনতার ঘণ্টা বাজুক নিউইয়র্কের বিশাল পর্বত থেকে। পেনসিলভানিয়া এলেগেনির চূড়া থেকে স্বাধীনতার ঘণ্টা বাজুক। কলোরাডোর রকির তুষার চূড়া থেকে স্বাধীনতার ঘণ্টা বাজুক। স্বাধীনতার ঘণ্টা বাজুক ক্যালিফোর্নিয়ার মোহনীয় ঢাল থেকে। শুধু তা-ই নয়, জর্জিয়ার শিলা পর্বত থেকে স্বাধীনতার ঘণ্টা বাজুক। টেনেসির পর্বতের দৃশ্য থেকে স্বাধীনতার ঘণ্টা বাজুক। মিসিসিপির প্রতিটি পাহাড় এবং ঢিবি থেকে স্বাধীনতার ঘণ্টা বাজুক।
এবং এটা যখন হবে, আমরা যখন স্বাধীনতার ঘণ্টা বাজতে দেবো, প্রতিটা গ্রাম প্রতিটা পল্লী প্রতিটা প্রদেশ প্রতিটা শহর থেকে যখন আমরা স্বাধীনতার ঘণ্টাকে বাজতে দেবো তখন আমরা ঐ দিনটাকে ত্বরান্বিত করব যেদিন ঈশ্বরের সন্তানেরা, কালো এবং সাদা, ইহুদী এবং অইহুদী, প্রটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথোলিক, সবাই মিলে হাত ধরে নিগ্রোদের পুরনো আধ্যাত্মিক গানটা গাইতে পারবে-
অবশেষে মুক্তি পেলাম, অবশেষে মুক্তি পেলাম,
মহাশক্তিশালী ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমরা অবশেষে মুক্তি পেলাম।”
ফিচার ইমেজ: Gettyimages