খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগ থেকে রোমান সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অবক্ষয়ের সূচনা হয়। প্রজাতন্ত্র বিস্তৃত হবার সাথে সাথে এর কোষাগারও পাল্লা দিয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে। কিন্তু এর সুফল সীমাবদ্ধ ছিল সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মধ্যে। সাধারণ রোমান নাগরিক বঞ্চিত থেকে যায়। ফলে ক্রমশ তাদের মাঝে ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
রোমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার মূল উৎস ছিল রোমান সিনেট, যা গড়ে উঠেছিল মূলত প্যাট্রিশিয়ান পরিবারগুলোর সমন্বয়ে। প্রজাতন্ত্রের প্রথমদিকে এরাই রোমান সেনাবাহিনীতে অশ্বারোহীর যোগান দিত। ধীরে ধীরে সিনেটের বাইরে অন্য ধনবান রোমান নাগরিকেরাও অশ্বারোহী দলে অন্তর্ভুক্ত হয়। এদের একটা সুবিধা ছিল এই যে, তারা সেনাবাহিনী ত্যাগ করার পরে ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হতে পারত। সিনেটরদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী লাভজনক কাজে নিয়োজিত হওয়া ছিল অসম্ভব। ফলে সিনেটের অন্তর্ভুক্ত প্যাট্রিশিয়ান পরিবারগুলোর বাইরেও একটি ধনবান অভিজাত গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এদেরকে বলা হত ইকুইট। সিনেট ও ইকুইটরা মিলে তৈরি হয়েছিল একটি রক্ষণশীল গোষ্ঠী, অপ্টিমেট। যুদ্ধলব্ধ অর্থ বেশিরভাগই চলে যেত তাদের হাতে।
এছাড়া রোমানদের দখলকৃত জমি নাগরিকদের মাঝে বণ্টন করে দেয়ার আইন থাকলেও অপ্টিমেটরা তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অধিকাংশ ভূ-সম্পত্তি অধিকার করে নিচ্ছিল। ফলে তাদের সম্পদের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছিল। নিজেদের অর্থ ও ক্ষমতা খাটিয়ে তারা সাধারণ রোমান নাগরিকদের কাছ থেকে তাদের ছোট ছোট কৃষিজমিও কিনে নিতে থাকে। অপ্টিমেটরা তাদের সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে প্রচুর দাস ক্রয় করে। এদের খাটানো হতো জমি চাষ ও দেখাশোনার জন্যে, ফলে সাধারণ রোমান নাগরিক যারা ছিল, তারা জমির পাশাপাশি কাজ করার সুযোগটুকুও হারিয়ে ফেলে। অপ্টিমেটরা অভিজাতকেন্দ্রিক রোমান প্রজাতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল। তারা মনে করত একমাত্র তাদের নেতৃত্বেই রোমান প্রজাতন্ত্রের উন্নতি ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত হবে, এবং সে কারণে তারা এর লভ্যাংশের প্রধান দাবিদার।
অপ্টিমেটদের বিপরীতে কিছু অভিজাত পরিবার রোমান সাধারণ নাগরিকদের স্বার্থরক্ষার দাবিতে সোচ্চার হয়। এরা ছিল পপুলার বা জনতুষ্টি দল। তারা রোমান নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রের অধিভুক্ত জমি সবার মধ্যে সুষ্ঠুভাবে ভাগ করে দেয়ার আহ্বান জানাতে থাকে। এই দলের উত্থান হয় গ্র্যাকাস ভ্রাতৃদ্বয়ের হাত ধরে। তারা সিনেটকে পাশ কাটিয়ে প্রজাতন্ত্রের প্রধান আইন প্রণয়নকারী সংঘ, প্লেবেইয়ান কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার খেলা শুরু করে। প্লেবেইয়ান কাউন্সিল গঠিত হতো রোমের সকল নাগরিকদের প্রতিনিধিত্বে। সুতরাং একে কাজে লাগিয়ে জনতুষ্টিমূলক নানা আইন পাশ করিয়ে নেয়ার সুযোগ ছিল। তাদের উদ্দেশ্য মোটা দাগে জনহিতকর মনে হলেও অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন আসলে সাধারণ রোমান জনগণকে ব্যবহার করে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করাই তাদের লক্ষ্য ছিল।
এই দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থান রোমান সমাজে সৃষ্টি করেছিল দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা। তাদের হানাহানি মারামারি প্রায়শই সহিংসতায় পর্যবসিত হতো, যা প্রজাতন্ত্রকে ঠেলে দেয় পতনের দিকে।
সামাজিক সমস্যা
মারিয়াসের সংস্কারের আগে আইন ছিল যে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমির মালিক যারা, তারাই শুধু সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবে। অপ্টিমেটদের কাছে বিপুল ভূ-সম্পত্তি কুক্ষিগত হবার কারণে বহু সংখ্যক রোমান নাগরিক ভিটামাটিহারা হয়ে রোমে জড়ো হতে থাকে। এই বিপুল পরিমাণ রোমান প্রচলিত আইন অনুসারে সেনাবাহিনীর জন্য অযোগ্য ছিল। এদিকে ধনবান অপ্টিমেটদের অনেকেই নিজেদের অর্থ ও ক্ষমতার জোরে সামরিক দায়িত্ব পালনে অব্যাহতি নেয়ার ফলে শূন্যতা তৈরি হয়।
বিশাল ভূখণ্ড ধরে রাখতে রোমের প্রয়োজন ছিল বিরাট সেনাবাহিনী, কিন্তু ভূমিহীন জনগোষ্ঠী বেড়ে যাওয়ায় নতুন নতুন লিজিওন গঠন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এদিকে এই নিঃস্ব বেকার জনতার খাদ্যের চাহিদা মেটাতে গিয়ে সঙ্কট দেখা দেয়। তার উপর এদের অনেকেই ছিল ঋণের ভারে জর্জরিত। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছিল দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা। এই পরিস্থিতিকেই কাজে লাগাতে চাইছিলেন গ্র্যাকাস ভ্রাতৃদ্বয়-টিবেরিয়াস গাইয়াস।
টিবেরিয়াস সেম্প্রোনিয়াস গ্র্যাকাস (জন্ম-১৬৩, মৃত্যু-১৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
গ্র্যাকাস ভ্রাতৃদ্বয়ের বড়জন, টিবেরিয়াস জন্মেছিলেন সোনার চামচ মুখে নিয়ে। তার পিতা ছিলেন হিস্পানিয়ার একসময়ের গভর্নর এবং প্রাক্তন রোমান কন্সাল, অন্যদিকে তার মা এসেছিলেন সম্ভ্রান্ত সিপিও পরিবার থেকে। টিবেরিয়াসের রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি সিপিও অ্যামেলিয়ানাসের কাছে। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে হিস্পানিয়াতে তিনি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। সেখানকার কেল্টিক গোত্রের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে তিনি তাদের সাথে চুক্তির প্রস্তাব করেন, যার ফলে প্রায় ২০,০০০ রোমান সেনার প্রাণ বাঁচত। কিন্তু সিনেটের কাছে তা ছিল পরাজয়ের সামিল। তারা চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। এই ঘটনায় টিবেরিয়াস নিন্দার স্বীকার হন এবং তার সম্মানহানি ঘটে।
রোমে ফিরে এসে টিবেরিয়াস তার মর্যাদা পুনরুদ্ধারে মনোযোগী হন। তিনি জনতুষ্টিবাদকে হাতিয়ার করে সাধারণ জনগণের দুঃখকষ্টের কথা বলতে থাকেন। তিনি সাধারণ নাগরিকদের ভাগ্য ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দেন। ফলে ১৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জনগণের ভোটে তিনি ট্রিবিউন নির্বাচিত হন।
টিবেরিয়াসের ভূমি সংস্কার আইন
ট্রিবিউন হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই টিবেরিয়াস ৩৬৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রণীত একটি আইন পুনরুজ্জীবিত করতে উদ্যোগী হলেন। এই আইনে জমির মালিকানার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দেয়ার কথা ছিল। টিবেরিয়াস প্রস্তাব করেন যে, প্রত্যেক রোমান নাগরিক নিজের জন্য সর্বোচ্চ ৫০০ একর, এবং সর্বোচ্চ দুজন ছেলে সন্তানের জন্য ২৫০ একর করে আরো ৫০০ একর জমি নিজের কাছে রাখতে পারবেন। বাকি জমি রাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করতে হবে এবং রাষ্ট্র তা ভূমিহীন রোমান নাগরিকদের মাঝে ভাগ করে দেবে। যারা দান করবেন, তাদের অধিকৃত জমিতে বংশানুক্রমে তারা ট্যাক্সমুক্ত সুবিধা ভোগ করবেন।
টিবেরিয়াস মূলত দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের পর যেসব এলাকা রোমানদের হস্তগত হয়েছিল, সেখান থেকে জমি ভাগবাটোয়ারার দাবি করেন। সিনেটের কাছে এই প্রস্তাব ছিল অগ্রহণযোগ্য, কারণ এর ফলে তাদের প্রচুর ভূ-সম্পত্তি হারাতে হবে। সিনেটের অনীহা টিবেরিয়াস জানতেন, তাই তিনি প্রচলিত প্রথা ভেঙে সরাসরি প্লেবেইয়ান কাউন্সিলে তার আইন অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করেন। নতুন যেকোনো আইন সিনেটে আলোচনাই ছিল রীতি, কিন্তু টিবেরিয়াস এর ব্যত্যয় করলে সিনেট তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।
সিনেটের বিরোধিতা এবং আইন পাশ
সিনেটের অঙ্গুলিহেলনে আরেক ট্রিবিউন অক্টাভিয়াস কাউন্সিলের সভায় নতুন আইনের বিপক্ষে ভেটো দেন। ফলে টিবেরিয়াস ব্যর্থ হন। তিনি এর প্রতিশোধ নিতে সভাতে পাঠানো সিনেটের সকল আইনের বিরুদ্ধে ভেটো দিতে থাকেন, ফলে আইনসভাতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। তিনি আশা করেছিলেন, এর ফলে সিনেট তার বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকবে এবং তিনি পরবর্তী সভাতে আইনটি পাশ করিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু অক্টাভিয়াস ভেটো দিলেন। ক্ষুব্ধ টিবেরিয়াস প্লেবিসসাইট, বা প্লেবেইয়ান কাউন্সিলের সদস্যদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাকে অপসারণ করেন। এরপর সহজেই তার আইন অনুমোদিত হল। জনরোষের ভয়ে সিনেট শেষ পর্যন্ত এই আইন মেনে নিল।
সিনেটের নতুন চাল
আইন যথাযথ প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যে তিনজনের কমিটি করা হলো- টিবেরিয়াস, তার ছোট ভাই গাইয়াস এবং শ্বশুর পুলচার। পুলচার ছিলেন নামকরা রোমান সিনেটর। তাদের উদ্যোগে ৭৫,০০০ এর মতো ভূমিহীন রোমান নাগরিক কৃষিজমি প্রাপ্ত হয়। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন দেখা দেয়। বরাদ্দ শেষ হয়ে গেলে টিবেরিয়াস আরো অর্থের আবেদন করলেন, কিন্তু সিনেট নতুন করে এর জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বাজেট দিতে অস্বীকৃতি জানাল।
টিবেরিয়াসের অর্থ সংস্থান
সিনেট রাষ্ট্রীয় কোষাগার বন্ধ করে দিলেও টিবেরিয়াস দমে গেলেন না। তিনি এবার নতুন প্রস্তাব নিয়ে প্লেবেইয়ান কাউন্সিলে হাজির হলেন। এশিয়া থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের একাংশ ভূমি আইনের পরিপূর্ণ প্রয়োগের তাগিদে খরচ করার আহ্বান জানানো হল। ফলে পররাষ্ট্র ও বাজেট ব্যবস্থাপনা, যা এতকাল সিনেটের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে ছিল, তাতে চিড় ধরল। সিনেট প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হলেও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ভয়ে তার কথা মেনে নিতে বাধ্য হলো।
টিবেরিয়াসের পতন ও মৃত্যু
বারবার সিনেটের বিরুদ্ধে গিয়ে টিবেরিয়াস তাদের খেপিয়ে তুলছিলেন। তিনি সিনেটের সাথে সমঝোতার কোনো চেষ্টা করেননি, বরং তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে প্লেবেইয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে সিনেটকে পাশ কাটিয়েছেন। ট্রিবিউন হবার কারণে তিনি বিচারের সম্মুখীন করা সম্ভব ছিল না এবং তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা কঠিন অপরাধ বলে গণ্য হতো। কিন্তু তার নিয়োগের স্থায়িত্ব ছিল এক বছর, সুতরাং এরপর সমূহ সম্ভাবনা ছিল যে তাকে সিনেট কাঠগড়ায় তুলতে পারে, বা চরম পরিস্থিতিতে তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হতে পারেন। এমন হওয়াও বিচিত্র ছিল না যে, তারপর যিনি ট্রিবিউন হবেন, তিনি তার ভূমি সংস্কার আইন বাতিল করে দেবেন।
সবদিক বিবেচনা করে টিবেরিয়াস সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ১৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ট্রিবিউন নির্বাচনে দাঁড়াবেন। যদিও জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে তার নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ, কিন্তু এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তিনি রোমান সংবিধানের এক অন্যতম স্তম্ভ, পরপর দুবার একই সরকারি অফিস অধিকার না করা, তার ব্যত্যয় করেন। নিয়ম অনুযায়ী, তাকে নির্দিষ্ট বিরতি দিতে হতো, তারপরই কেবল তিনি পুনরায় ট্রিবিউন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপযুক্ত হতেন।
টিবেরিয়াস যখন সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘন করলেন, সিনেট তাদের সুযোগ পেয়ে গেল। টিবেরিয়াস যখন তার সমর্থকদের নিয়ে নির্বাচনী সমাবেশে ব্যস্ত, তখন সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষার অজুহাতে টিবেরিয়াসেরই খালাত ভাই সিপিও ন্যাসিকা ও আরেক সিনেটর পপিলাসের নেতৃত্বে সিনেটরদের একটি দল তাদের উপর হামলা করল। বেঞ্চের পায়া দিয়ে পিটিয়ে টিবেরিয়াসকে হত্যা করা হলো। তার প্রায় ৩০০ সমর্থক হতাহত হলেন। একজন সাধারণ অপরাধীর ন্যায় টিবেরিয়াসের মৃতদেহ টিবের নদিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হলো।
বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দিতে সিনেট সিপিও অ্যামেলিয়ানাসকে অনুরোধ করল। তিনি শহরে এসে সব শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করলেন। টিবেরিয়াসের আইন বাতিল করা হলো।
গাইয়াস সেম্প্রোনিয়াস গ্র্যাকাস (জন্ম-১৫৪, মৃত্যু-১২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
বড় ভাইয়ের মতো গাইয়াসও সিপিও অ্যামেলিয়ানাসের কাছে রাজনীতির দীক্ষা নেন। তিনি কন্সাল নির্বাচিত হয়ে দু বছর সার্ডিনিয়া শাসন করেন। এরপর তিনি রোমে ফিরে এসে ট্রিবিউন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তার জনপ্রিয়তা এবং বাগ্মিতা ছিল টিবেরিয়াসের থেকেও বেশি। একে পুঁজি করে তিনি সিনেটের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পরপর দুই মেয়াদে ১২৩ এবং ১২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ট্রিবিউনের দায়িত্ব পালন করেন।
গাইয়াসের সংস্কার
টিবেরিয়াসের থেকে গাইয়াসের পদক্ষেপ ছিল আরো সুদূরপ্রসারী। তিনি রোমান জনতাকে তার ভাইয়ের হত্যায় মদদদাতা পপিলাসের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলেন, ফলে পপিলাস নির্বাসনে যেতে বাধ্য হলেন। গাইয়াস এবার আইন পাশ করলেন, কোনো সরকারি কর্মকর্তা জনগণের ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হলে তিনি আর কখন কোনো সরকারি অফিস অধিকার করতে পারবেন না। এভাবে বিরোধীদের তিনি প্রথমেই সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় করে দিলেন। এরপর তিনি বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেন, যার অনেকগুলোই সিনেটের বাড়া ভাতে ছাই দেবার মতো:
১। গাইয়াসের পৃষ্ঠপোষকতায় আইন পাশ করে ইকুইটদের প্রাদেশিক রোমান কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিচারে জুরি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পূর্বে শুধু সিনেটররাই এই কাজ করতে পারতেন। ইকুইটদের জুরি করে তাদের ক্ষমতা হ্রাস করাই ছিল গাইয়াসের উদ্দেশ্য।
২। এশিয়া থেকে রাজস্ব আদায় ছিল সিনেটের ক্ষমতাধীন। গাইয়াস এবার সেখানে হাত দিলেন। তিনি রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ইকুইটদের হাতে তুলে দেয়ার আইন প্রণয়ন করলেন।
৩। প্রাদেশিক গভর্নর ও অন্য অফিসারদের আয়-ব্যয়ে নজরদারি বৃদ্ধি করা হলো। সকল হিসেবের এক কপি করে প্রদেশে রেখে আর এক কপি রোমে জমা দেবার নির্দেশ দেওয়া হয়।
৪। টিবেরিয়াসের ভূমি সংস্কার আইন পুনরায় জারি করা হয়।
৫। রোমান জনগণের জন্য স্বল্পমূল্যে খাদ্যশস্যের ব্যবস্থা করা হয়। রাষ্ট্রের ভাঁড়ার থেকে রোমান নাগরিকরা বাজারমূল্যের অর্ধেক দামে শস্য কিনতে পারতেন।
৬। নতুন রাস্তা তৈরি, পুরনো রাস্তা মেরামত, বন্দরের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, গণ শৌচাগার নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করা হয়।
৭। নাগরিকত্ব আইন: গাইয়াস তখন প্রবল জনপ্রিয়। তার বিরোধিতা করার মতো সাহস সিনেটের ছিল না। এমন সময় রোমের লাতিন ও ইতালীয় মিত্রদের মধ্যে ক্রমাগত অস্থিরতা বাড়ছিল। মূল কারণ ছিল তাদের ভোটাধিকার না থাকা। তারা রোমান নাগরিকদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, যেমন রোমান অধিকৃত এলাকাতে ব্যবসা-বাণিজ্য করা, সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি করতে পারলেও সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচনে ভোট প্রদান করতে পারত না। এটা ছিল শুধুমাত্র রোমান নাগরিকদের অধিকার। ভোটাধিকার ব্যতিরেকে ভূমি সংস্কার আইনের আওতায় তারা ছিল না। কাজেই পূর্ণ নাগরিক সুবিধার দাবিতে লাতিন ও ইতালীয় অঞ্চলগুলো সোচ্চার হয়ে ওঠে। গাইয়াস তখন তার মিত্র ফ্ল্যাকাসের সহযোগিতায় এদের পূর্ণ নাগরিকত্বের প্রস্তাব করলেন।
গাইয়াসের পতন ও মৃত্যু
নিজেদের সুযোগ-সুবিধা অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করতে রোমান নাগরিকেরা রাজি ছিল না। নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়ন হলে লাতিন ও ইতালীয় জাতিগুলোও রাষ্ট্রের তরফ থেকে জমি পেত এবং বিভিন্ন কমিটিতে ভোটদান করতে পারত। রোমান জনগণ একে ভালভাবে নেয়নি। ফলে গাইয়াসের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। সুযোগ বুঝে সিনেট তার বিপক্ষে ড্রুসাস নামে এক ট্রিবিউনকে দাঁড় করাল। ড্রুসাস বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ করতে শুরু করলেন। তিনি রোমান নাগরিকদের অনুকূলে এবং তাদের লাতিন মিত্রদের প্রতিকুলে নানান আইন প্রস্তাব করতে থাকেন। গাইয়াস সিনেটের কৌশল বুঝতে দেরি করে ফেলেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি ১২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৃতীয়বার কন্সাল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও পরাজিত হলেন।
বিক্ষুব্ধ সমর্থকদের নিয়ে গাইয়াস ও ফ্ল্যাকাস শহরের মধ্যে দিয়ে মিছিল করে অ্যাভেন্টাইন পাহাড়ে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তার কিছু সমর্থক আইন লঙ্ঘন করে প্রকাশ্যে অস্ত্র বহন করছিল। অ্যাভেন্টাইন পাহাড়ে মিটিং থেকে গোলযোগের সূত্রপাত হলে সিনেট সে সুযোগ লুফে নেয়। কন্সাল অপিমিয়াস আগে থেকেই গাইয়াসকে দেখতে পারতেন না। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার অজুহাতে তিনি মার্শাল ল’ জারি করলেন। গাইয়াস ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষিত সেনা পাঠানো হলো। সংঘর্ষে গাইয়াস নিহত হন। তার প্রায় ৩,০০০ সমর্থক হতাহত হয়। তার করা আইন বাতিল করে সিনেট সমস্ত নিয়ন্ত্রণ আবার নিজের হাতে তুলে নেয়।
গ্র্যাকাস ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রভাব
দুই গ্র্যাকাস ভাই ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাদের সহিংস মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু তাদের উত্থান সাধারণ জনগণ এবং অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে বিভাজনকে সুস্পষ্ট করে তোলে। অভিজাত ও ধনবান পরিবারগুলোর নিজেদের মধ্যেও শুরু হয় ক্ষমতার কামড়া-কামড়ি। এই ক্ষমতার খেলায় ইচ্ছামতো আইনভঙ্গ ও প্রণয়নের উদাহরণ সৃষ্টি হয় গ্র্যাকাসদের সময় থেকেই। সহিংসতা ঢুকে পড়ে রোমান রাজনীতিতে, এবং পরে এর শিকার হন আরো অনেকে। রাজনীতির এই টানাপোড়েনে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকা প্রজাতন্ত্রের কাঠামো এক ভঙ্গুর অবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
ক্ষমতার যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তা পূরণ করতে আবির্ভাব হয় শক্তিশালী জেনারেলদের। গ্র্যাকাস ভ্রাতৃদ্বয়ের পথ ধরেই উত্থান ঘটে মারিয়াস, সুলা, পম্পেই এবং সবশেষে জুলিয়াস সিজারের। এবং শেষ অবধি রোম তার প্রজাতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে একক সম্রাটের ক্ষমতার বলিতে পরিণত হয়।