আমাদের প্রতিদিন চলার পথে দিন মাসের হিসেব রাখার গুরুত্ব আর নতুন করে বলার কিছু নেই। আমাদের ইট পাথরের দেয়ালে হয়ত আর বাঁধানো ক্যালেন্ডার এর শোভা আজকাল তেমন পাওয়া যায় না, তবুও হাতের স্মার্ট ফোনটিতে সময়ের হিসেবের সাথে দিন তারিখ মাসের হিসেব না চাইতেও ঠিকই ফুটে ওঠে।
মাসের হিসেব আমাদের জন্য আরও একটু বেশিই তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার হিসেব, রোজার মাস, ঈদের ছুটি, পূজার ছুটি এসব তথ্যের সাথে লুকিয়ে রয়েছে হরেক ধরনের পরিকল্পনা। সবকিছুই যেন এই মাসের ছক মেনেই চলে। গুটি গুটি পায়ে এক একটি মাস শেষ হয় আর আমরা যেন ততই নতুন আরেকটি বছরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। জানুয়ারি মাস থেকে বছরের শুরু করে ধাপে ধাপে এগারটি মাস পেরিয়ে যখন বারো মাসে বা ডিসেম্বর মাসে পোঁছায় তখন লেখার ছাপে এক বছর এগিয়ে আনার প্রত্যয় শুরু হয়, নয়ত আগের বছর লেখার ভুল হতে থাকে প্রতিনিয়ত। সে এক অন্য আলোচনা। কিন্তু এই ইংরেজি মাসের নামকরণ কিভাবে শুরু হলো তা কি জানেন? তাহলে চলুন ইংরেজি মাসের গোড়াপত্তন কিভাবে হল তাই জানা যাক।
যুগ যুগ ধরে যে মাসের নামগুলো আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সে সব নামের পাশে আছে এক একটি ইতিহাস বা কারণ। বিভিন্ন ঘটনা বা উল্লেখযোগ্য রোমান দেব-দেবী অথবা বিভিন্ন সংখ্যাধারা থেকে এসেছে এক একটি ইংরেজি মাসের নাম। প্রথমে আমরা যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি তার উৎপত্তি সম্পর্কে একটু ধারণা দেয়া যাক। এখন যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয় তার নাম মুলত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বা খ্রিস্টান ক্যালেন্ডার। ১৫৮২ সালে প্রথম এই ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু করেন পোপ দ্বাদশ গ্রেগরি।
এর পূর্বে যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হত সেটি ছিল ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’। খ্রিস্টপুর্ব ৪৫ সালে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার এই ক্যালেন্ডারের প্রচলন শুরু করেন। দিনের হিসেবে সামান্য ফারাক থাকলেও মাসের নামগুলো কিন্তু দুটো ক্যালেন্ডারেই এক। তবে এখানে জেনে রাখা ভাল, জুলিয়ান ক্যালেন্ডার এর পুর্বসুরি ‘রোমান ক্যালেন্ডার’-এ মাসের নামগুলো ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। এই ক্যালেন্ডারে বছর শুরু হত মার্চ মাস থেকে। এখন যে-যে নামে আমরা মাস চিনি, তার নামকরণ হয় জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সময় থেকেই। এবার এক এক মাসের পেছনের গল্পগুলো জানা যাক।
জানুয়ারি
‘জানুস’ নামের একজন রোমান দেবতার নামে এই মাসের নাম রাখা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী দেবতা জানুস’কে বলা হয় ‘গড অফ ডোরস’। কোনও কিছু শুরু করার দরজা। বিভিন্ন জাদুঘরে এই দেবতার দু’দিকে দুটো মুখবিশিষ্ট মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। এমনটা মনে করা হয় যে, ইনি ভূত এবং ভবিষ্যৎ দুটোই দেখতে পেতেন। তাই মনে করা হয় আগের বছরের শেষ আর নতুন বছরের শুরুর দিকে ঘোরানো তার দুই মুখ।
ফেব্রুয়ারি
অনেক কাল আগে থেকে পাশ্চাত্যে বসন্তকালের শুরুর দিকে এক ধরনের উৎসব পালন করা হত যার নাম ছিল ‘ফেব্রুয়া’। এই উৎসবে বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট সব পরিষ্কার করা হত। এই শোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের আত্মা এবং মনেরও এক ধরনের শুদ্ধিকরন হত। আর এই উৎসবের নাম থেকেই মাসটির নামকরণ করা হয় ‘ফেব্রুয়ারি’।
মার্চ
মার্চ মাসের নামকরণের পেছনে দুটো তত্ত্ব আছে। আর দুটোই গড়ে উঠেছে রোমান যুদ্ধদেবতা ‘মার্স’ কে ঘিরে। এই মাস থেকেই প্রবল ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে বলে এর হিংস্রতা বা প্রচণ্ডতাকে তুলনা করা হত ‘মার্স’ এর সাথে। আবার আরেক মত অনুসারে, আগে মার্চ মাস দিয়ে শুরু হত রোমানদের বছর। তাই এই সময়ে সব যুদ্ধের অবসান ঘটত। সেই সুত্র ধরে যুদ্ধদেবতা মার্সের নামানুসারে নামকরণ করা হয় মাসটির।
এপ্রিল
এই মাসের নামকরণ নিয়েও আছে ভিন্ন ভিন্ন মত। কেউ কেউ মনে করেন ‘দ্বিতীয়’ কথাটির লাতিন শব্দ থেকে এসেছে নামটি। আবার অনেকে মনে করেন লাতিন শব্দ ‘আপেরিরে’ যার অর্থ খোলা বা ফোটা, এর থেকে এসেছে নামটি। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয় এপ্রিল মাসে সবকিছু নতুন করে ফোটে। প্রকৃতি সাজে এক নতুন রূপে আর সেই বিচারেই এর নামকরণ। আরেক মতে এই নামকরণের পেছনে আছেন রোমান দেবী ‘অ্যাফ্রোদিতি’।
মে
রোমানদের এক দেবী ছিলেন। তার নাম ছিল ‘মেইয়া’। তিনি দেবতা অ্যাটলাসের মেয়ে এবং মারকিউর তার ছেলে। কথিত আছে এই দেবীই ছিলেন সমস্ত শস্যের রক্ষাকর্ত্রী। তাই এই শস্য ফলনের মাসটিকে তার নামে উৎসর্গ করা হয়।
জুন
রোমানদের সবচেয়ে বড় দেবতা ‘জুপিটারের’ স্ত্রী ‘জুনো’। রোমানদের মতে তিনি বিয়ের দেবী। আর প্রাচীনকাল থেকেই এই মাসে অনেক বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। সেই বিবেচনায় মনে করা হয়, দেবী জুনোর নাম থেকেই এই মাসের নামকরণ করা হয়।
জুলাই
খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ সালে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার যে ক্যালেন্ডার এর প্রচলন করেছিলেন তার নাম ছিল ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’। আর এই ক্যালেন্ডার এর প্রবর্তক জুলিয়াস সিজারের নামানুসারেই ‘জুলাই’ মাসের নামকরণ করা হয়।
অগাস্ট
এই মাসটি বছরের ষষ্ঠ মাস। পূর্বে এই ষষ্ঠ মাসটিকে ‘সেক্সটিলিয়া’ (লাতিন ভাষায় ছয়) বলা হত। পরবর্তীতে এই নাম পরিবর্তন করা হয় অগাস্ট নামে। জুলিয়াস সিজারের একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিলেন অগাস্টাস সিজার। তার পর তিনিই সিংহাসনে বসেছিলেন। মনে করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব অস্টম সাল নাগাদ অগাস্টাসের নাম অনুসারে এই মাসের নাম করা হয় অগাস্ট।
সেপ্টেম্বর
লাতিন ভাষায় ‘সেপ্টেম’ মানে সাত। সেখান থেকেই এসেছে এই নামটি। গ্রেগরিয়ান এবং জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে এটি নবম মাস হলেও দশমাস বিশিষ্ট রোমান ক্যালেন্ডারে এটি ছিল সপ্তম মাস। অপরিবর্তিত ভাবে সেই নামটিকেই ধরে রাখা হয়েছে পরবর্তী ক্যালেন্ডারগুলোতেও।
অক্টোবর
অক্টোবরের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই যুক্তি খাটে। ল্যাটিনে ‘অক্টো’ মানে বোঝায় আট। রোমান ক্যালেন্ডারের অষ্টম মাস পরবর্তীতে অন্যান্য ক্যালেন্ডার এ হয়ে গেল দশম মাস। কিন্তু উৎস একই বলে অক্টোবর মাসটিই পরবর্তিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
নভেম্বর এবং ডিসেম্বর
নভেম্বর এবং ডিসেম্বর দুটোই এসেছে লাতিন ভাষার নবম ও দশম মাসের নাম থেকে। লাতিন ভাষায় ‘নোভেম’ মানে নয় এবং ‘ডিসেম’ এর অর্থ দশ। কিন্তু লাতিন ভাষার এই দুটো মাসই পরবর্তীতে এগার এবং বারো মাসে রূপান্তরিত হয়। আর এই ডিসেম্বর মাস থেকেই একটি বছরের সমাপ্তি ধরা হয়ে থাকে। পুরনো বছরের জরাজীর্ণতাকে বিদায় দিয়ে নতুন করে নতুন বছরে বাঁচার প্রেরণার সাথে সাথে ডিসেম্বর মাসকে বিদায় দেয়া হয়। আর এই জন্যই ডিসেম্বর মাস খুব জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালন করা হয়ে থাকে।
ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মাস গুলো প্রধানত উঠে এসেছে রোমানদের জীবনধারা, দেব-দেবীর প্রতি মান্যতা এবং পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। ইংরেজি মাসের নামগুলো এখন আমাদের জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনও কখনও হয়তো মনের মাঝে উঁকি দিয়েছে কী করে এলো এই মাস গুলো? ভাবতে মাঝে মাঝে অবাকও লাগে কত আগে থেকেই এই দিন মাসের গণনা শুরু হয়েছিল। তারপর থেকে পরিবর্তিত হতে হতে আজকের এই ইংরেজি ক্যালেন্ডার।