শেষ হয়েছে দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ।
প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম রক্তক্ষয়ী এই সংঘাতের পরিণামে ভূমধ্যসাগরে রোমের নিরঙ্কুশ আধিপত্য চ্যালেঞ্জ করার বিন্দুমাত্র ক্ষমতাও কার্থেজ হারিয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে ঠিকই, তবে তার আগে রোমান সাম্রাজ্য হবে আরও বিস্তৃত।
নিজেদের সবথেকে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করে রোম দৃষ্টি প্রসারিত করল পূর্বে, এককালে যেসব অঞ্চল অ্যালেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে আছে মিশর, সিরিয়া, গ্রিস ও মেসিডোনিয়া। গ্রিসের সাথে রোমের যোগাযোগ আগে থেকেই ছিল। ইলাইরিয়ানদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পর থেকেই গ্রিসের বহু নগররাষ্ট্রের সাথে রোমের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে রোমের অধীনস্থ কিছু এলাকাও রয়েছে।
গ্রিসের আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে তিনটি পক্ষ বিদ্যমান ছিল। পেলোপন্নেসেসের গ্রিক রাজ্যগুলোকে নিয়ে গড়ে উঠা ইটালিয়ান লিগ ও মধ্য গ্রিসের আকিয়ান লিগের মধ্যে পারস্পরিক রেষারেষি অনেককাল আগে থেকেই। অন্যদিকে, মেসিডোনিয়া তখন সামরিক দিক থেকে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী পক্ষ। কাজেই রোম যখন গ্রিসে অনুপ্রবেশ শুরু করল, তখন মেসিডোনিয়ার তৎকালীন রাজা পঞ্চম ফিলিপ শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। তার ইচ্ছা, পুরো গ্রিসকে মেসিডোনিয়ার পতাকাতলে নিয়ে আসা, রোমের উপস্থিতি তার সাজানো স্বপ্নে আঘাত হানল।
প্রথম মেসিডোনিয়ান যুদ্ধ (২১৫-২০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
২১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কান্নের লড়াইতে হ্যানিবাল রোমান সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে দেন। তার সাফল্যে মেসিডোনিয়ার পঞ্চম ফিলিপ নড়েচড়ে বসলেন। তিনি ২১৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হ্যানিবালের কাছে দূত পাঠিয়ে তার সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন। রোমান সিনেট এতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। লিভি দাবি করেন যে, ফিলিপ হ্যানিবালের সাথে মিলে ইটালিতে আগ্রাসনের পরিকল্পনা করছিলেন। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকরা এই দাবির সাথে একমত নন।
কারণ, মেসিডোনিয়া সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী হলেও ইতালিতে অভিযান চালানোর মতো ক্ষমতা তার ছিল না। তাছাড়াও ফিলিপ জানতেন, তিনি যদি ইতালিতে হামলার জন্য মেসিডোনিয়া ত্যাগ করেন, তাহলে গ্রিসে তার শত্রুরা সক্রিয় হয়ে উঠবে এবং তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে মেসিডোনিয়া আক্রমণ করে বসতে পারে। তবে হ্যানিবালকে ফিলিপ সাহায্য করতে পারেন, এই আশঙ্কা রোম ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে চাইল, যাতে ফিলিপ গ্রিসের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।
ব্রুন্ডিসিয়ামের রোমান ন্যাভাল কম্যান্ডার ভ্যালেরিয়াস লেভিনাসকে দায়িত্ব দেয়া হলো ফিলিপকে গ্রিসে আটকে রাখার জন্য। দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে, তাই গ্রিসে রোম কয়েক হাজারের বেশি সৈন্য রাখেনি। তারা স্থানীয় মিত্র ও লেভিনাসের নৌবাহিনীর উপরই ভরসা করছিল। সত্যিকার অর্থে প্রথম মেসিডোনিয়ান যুদ্ধে রোম ও ফিলিপের মাঝে তেমন বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষ হয়নি।
২১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ১২০ জাহাজের বহর নিয়ে ফিলিপ গ্রিসে রোমের অধীনস্থ অরিকাম ও অ্যাপোলনিয়া অবরোধ করলেন। অরিকাম দখল করে তিনি যখন অ্যাপোলনিয়া নিয়ে ব্যস্ত, তখন লেভিনাস স্থল ও নৌবাহিনীর সহায়তায় অরিকাম পুনর্দখল করে নিলেন। ফিলিপের অজান্তে তিনি অ্যাপোলনিয়াতে কিছু রোমান সেনা ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হলেন।
লিভির বর্ণনায়, এখানে রোমান ও মেসিডোনিয়ান ফৌজের লড়াই হয়। রাতের আঁধারে রোমান কিছু সেনা মেসিডোনিয়ান ক্যাম্পে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। সেখান তখন তিন হাজারের মতো মেসিডোনিয়ান যোদ্ধা ছিল। অতর্কিত রোমান আক্রমণে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে।
অবরোধ করতে এসে ফিলিপ নিজেই এখন অবরুদ্ধ অবস্থায় পড়লেন। একে তো অরিকাম হাতছাড়া হয়ে গেছে, অন্যদিকে পেছনে এসে উপস্থিত লেভিনাসের যুদ্ধজাহাজ। উপায়ান্তর না দেখে ফিলিপ তার সব জাহাজ পুড়িয়ে দিয়ে স্থলপথে পালিয়ে গেলেন।
পরবর্তী বছরগুলোতে রোম ও মেসিডোনিয়ার মধ্যে বিভিন্ন এলাকা দখল ও পুনর্দখলের প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। ইতোমধ্যে রোম ফিলিপের অন্যতম শত্রু ইটালিয়ান লিগের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। তাদের সাহায্যে গ্রিসে রোমের প্রক্সি ওয়ার চলতে থাকে। ২১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসের বেশকিছু এলাকা রোমের হস্তগত হয়। একই সময় রোমে আরও কিছু গ্রিক প্রতিবেশীর সাথে মৈত্রী স্থাপন করে, যার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো পার্গামনের রাজা অ্যাটালাস। অন্যদিকে, আকিয়ান লিগ এবং বিথাইনিয়ার রাজা প্রুসিয়াস ফিলিপের দলে যোগ দেন।
২০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইটালিয়ানদের মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে ফিলিপ দু’টি সফল যুদ্ধ পরিচালনা করে তাদের প্রভূত ক্ষতি সাধন করেন। একই বছর করিন্থের উপকণ্ঠে লুটতরাজ চালানোর সময় তার প্রেরিত অশ্বারোহীরা রোমের সেনাদের উপর আক্রমণ করে। এর পরপরই এলিসের কাছে ইটালিয়ান ও ইলিয়ানদের সম্মিলিত বাহিনী ফিলিপের মুখোমুখি হয়। লিভির মতে, এখানে চার হাজার রোমান সৈন্যের এক কন্টিনজেন্ট ছিল যুদ্ধে। ফিলিপের ঘোড়া শত্রুদের ছোঁড়া বর্শার আঘাত পেলে ফিলিপ মাটিতে পড়ে যান। সেখান থেকে তার বিশ্বস্ত যোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে। এই সংঘাতের পর রোমের সাথে প্রথম মেসিডোনিয়ান যুদ্ধে ফিলিপ আর কোনো বড় লড়াইতে জড়াননি।
সাগরে রোমান জাহাজ পাহাড়া দিতে থাকে। এরই মধ্যে চলমান সহিংসতার অবসান ঘটাতে ২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইটালিয়ান লিগ ও ফিলিপ এক চুক্তি স্বাক্ষর করে, কিন্তু ইটালিয়ান লিগ এ ব্যাপারে রোমকে কিছু জানায়নি, যা তাদের সম্পাদিত চুক্তির লঙ্ঘন ছিল। কাজেই ২০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেম্প্রোনিয়াস টিউডেটেনাস ৩৫টি জাহাজ, দশ হাজার পদাতিক আর এক হাজার অশ্বারোহী নিয়ে গ্রিসে হাজির হলেন। ইটালিয়ান লিগকে ফিলিপের বিরুদ্ধে উস্কে দিতে চাইলেও তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে রাজি হচ্ছিল না। ওদিকে রোমান সেনাবাহিনীর বেশিরভাগই কার্থেজের সাথে যুদ্ধে জড়িত।
এ পরিস্থিতিতে মেসিডোনিয়ার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সিনেট সঙ্গত মনে করেনি। তাই ২০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তারা ফিলিপের সাথে এক চুক্তিতে আসে, যার দ্বারা গ্রিসে রোমের অধীনস্থ অঞ্চলগুলোর ওপর রোমান কর্তৃত্ব ফিলিপ স্বীকার করে নেন। চুক্তির শর্ত মোতাবেক রোম গ্রিসে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও নতুন অঞ্চল দখলের পরিকল্পনা ত্যাগ করে।
এই চুক্তির মাধ্যমে ফিলিপ গ্রিসের রাজনীতিতে তার অবস্থান পাকাপোক্ত করলেন। রোমও তার চাহিদা অনুযায়ী গ্রিসে নিজস্ব অঞ্চল রক্ষা করতে পারল। এছাড়াও রোম সক্ষম হল ফিলিপকে গ্রিসের ভেতর রাখার। তবে রোমের অস্থির সময় মেসিডোনিয়া পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে বলে রোমানদের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা তৈরি হল। এর পথ ধরে এল দ্বিতীয় মেসিডোনিয়ান যুদ্ধ।