ধরুন, আপনাকে বলা হলো ভারতের বিখ্যাত শিল্পপতি জামসেটজি টাটা, ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশ, বলিউড অভিনেতা বোমান ইরানি, পরমাণু বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা, খ্যাতিসম্পন্ন ব্যবসায়ী আরদেশীর গোদরেজ, রাজনীতিবিদ ফিরোজ গান্ধির নাম। এঁদের মধ্যে একটা সাধারণ যোগসূত্র কি জানেন? এঁরা সবাই এমন এক সম্প্রদায় থেকে উঠে এসেছেন, জনসংখ্যার হিসেবে যারা অতি ক্ষুদ্র, কিন্তু ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বিত্তশালী ও সফল সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম। তারা হলো ভারতের পারসি সম্প্রদায়, অর্থাৎ প্রাচীন পারস্যদেশের (ইরান) জরথুস্ত্রপন্থী জাতিবিশেষ। হাজার বছর ধরেই ক্ষুদ্র এই গোষ্ঠী বসবাস করে আসছে ভারতে।
ভারতের সমগ্র ইতিহাস প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পারসিদের ছাড়া অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। ভারতের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ভারতীয় পারসি সম্প্রদায়ের অবদান অনস্বীকার্য। ভারতের প্রথম স্টিল মিল, ভারতের প্রথম বাণিজ্যিক বিমান পরিবহনব্যবস্থা, প্রথম বিলাসবহুল হোটেল, এশিয়ার প্রথম স্টক এক্সচেঞ্জ– এগুলোর প্রতিটির পেছনেই রয়েছে কোনো না কোনো পারসির হাত। অষ্টম থেকে দশম শতকে ইরান থেকে যে জরথুস্ত্রপন্থি মানুষেরা ভারতে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে ঠাঁই নেয়, তাদেরকেই ভারতীয় পারসি বলে অভিহিত করা হয়। পারসি সম্প্রদায়ের লোকেরা যে ধর্মে বিশ্বাস করে, তার নাম হলো ‘জরথুস্ত্রবাদ‘ বা ‘পারসিক ধর্ম’। অতিপ্রাচীন এই ইরানীয় ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন জরথুস্ত্র।
আবেস্তা বা জেন্দাবেস্তা হলো তাদের ধর্মগ্রন্থ। প্রায় ৪,০০০ বছর পূর্বে উদ্ভব হওয়া এই ধর্মকে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একেশ্বরবাদী ধর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়। সপ্তম শতাব্দীতে পারস্য (ইরান) ছিল সাসানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে। ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিমদের পারস্য বিজয় পতন ঘটায় সাসানীয় সাম্রাজ্যের। এই বিজয়ে পারস্যে ক্রমশ ম্লান হয়ে আসে জরথুস্ত্রীয় ধর্মের প্রভাব। এরপর থেকে ছোট ছোট পারসিকদের দল খণ্ড খণ্ডভাবে আসতে থাকে ভারতে। ভারতে আজকে যাদের পারসি বলে ডাকা হয়, তারা এদেরই বংশধর। ইতিহাসবিদদের ধারণা, দুই কারণে পারসিরা পাড়ি জমিয়েছিল ভারতে। প্রথমত, স্বীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ, দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা।
হাজার বছর আগে পারসিকদের ভারত আগমন ছাড়াও উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে ইরানের অধিবাসীদের আরেকটি দল ভারতের ভূখণ্ডে এসে থিতু হয়েছিল। বর্তমানে এদের বংশধরদের পারসি নয়, বরং ইরানি বলে ডাকা যাবে। পারসি আর ইরানিদের মাঝে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান। হাজার বছর পূর্বে আসা অভিবাসীদের সাথে শ’-দু’শ বছর আগে আসা অভিবাসীদের সংস্কৃতি, ভাষা এবং জীবনধারায় অনেক পার্থক্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে হ্যাঁ, তারা দুই দলই জরথুস্ত্রপন্থী। কিন্তু ভারতবর্ষ কীভাবে গ্রহণ করেছিল প্রাচীন পারসিকদের? কেমন ছিল তাদের ভ্রমণবৃত্তান্ত? সেসবের ইতিহাস তেমন বিস্তৃতভাবে লিপিবদ্ধ নেই। ‘কিসসা-এ-সানজান‘ নামক ফারসি বিবরণীতে এই বিষয় সম্পর্কিত কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। জরথুস্ত্রপন্থীদের ভারতে আগমনের অন্তত ছয়শ বছর পরে রচিত হয় গ্রন্থটি।
পারসিদের ভারত আগমন নিয়ে মজার একটি কিংবদন্তি চালু আছে। শুরুতে ক্ষুদ্র জনসংখ্যার একটি পার্সি সম্প্রদায় আরব সাগর পাড়ি দিয়ে পা রাখে ভারতে। তৎকালীন গুজরাটের সাঞ্জান শহরের শাসক ছিলেন সম্রাট জাদি রানা। সেই সম্রাটের সাথে বাতচিতের জন্য পাঠানো হয় জরথুস্ত্র এক পুরোহিতকে। তিনি রাজাকে বলেন, আপনার রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে থাকতে দিলে আমাদের বেজায় উপকার হতো। কিন্তু রাজামশাই অপরিচিত এই সম্প্রদায়কে নিয়ে খানিকটা সন্দিহান ছিলেন। তিনি তাদের দুধে কানায় কানায় পূর্ণ একটি বাটি দেখিয়ে বললেন, আমার রাজ্যে জনসংখ্যার অবস্থা এই দুধের বাটির মতোই। অতিরিক্ত আরেকটু যুক্ত হলেই উপচে পড়ে যাবে। পুরোহিত তখন রাজার কাছে একমুঠো চিনির আবদার করেন। চিনি নিয়ে আসা হলে সেই চিনিকে দুধের পাত্রে মিশিয়ে দেন পুরোহিত। বলেন, দুধে এই চিনির মিশ্রণের মতোই আমরা আপনার রাজ্যে প্রজাদের সাথে মিলেমিশে থাকব। পুরোহিতের উপস্থিত বুদ্ধি দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হন সম্রাট। তাদেরকে দেওয়া হয় থাকার অনুমতি। কিন্তু এর সাথে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন তিনি। তা হলো:
- পারসি নারীদের অবশ্যই শাড়ি পরিধান করতে হবে।
- পারসি পুরুষেরা কোনো অস্ত্র বহন করতে পারবে না।
- পারসি ধর্ম সম্পর্কে রাজাকে বোঝাতে হবে।
- গুজরাটি ভাষা শিখতে হবে।
পরবর্তী কয়েকশো বছরে আরও ছোট ছোট কিছু পারসি গোষ্ঠী বসতি গড়ে গুজরাটের সাঞ্জান এলাকায়। তাদের সম্মানার্থে ১৯২০ সালে সাঞ্জান স্তম্ভ নামে এক স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। সময়ের সাথে সাথে সাঞ্জান শহরের গুরুত্ব কমে যাওয়ায় পারসিরা ভারতের অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ পাড়ি জমায় মুম্বাইয়ের পথে। সেজন্য বর্তমানে ভারতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পারসি পাওয়া যায় মুম্বাই শহরে।
তারা মনোনিবেশ করে ব্যবসা এবং কারুশিল্পের দিকে। ব্রিটিশরা মুম্বাই আসার পর ব্যবসায়ী ও কারুশিল্পীদের খোঁজ করতে থাকলে মুম্বাইয়ে পারসিকদের চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ। তারা সফল এবং ধনবান হবার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আফিম ও তুলার ব্যবসা। সতের এবং আঠারো শতকে পারসিরা চীনবাসীর সাথে আফিম এবং তুলার ব্যবসা শুরু করে।
এই ব্যবসার প্রভাব এখনও ঐতিহ্যবাহী পারসিদের মাঝে বিদ্যমান রয়েছে। সেসময় চীনা সিল্ক ছিল পারসিদের অতি পছন্দের এক সামগ্রী। ব্যবসায়ী পুরুষেরা চীন ভ্রমণে গেলে তাদের স্ত্রী-কন্যাদের জন্য চীনা সিল্কের শাড়ি নিয়ে আসত। এই শাড়িগুলো ভারতেও বিক্রি করা যেত। ইতিহাসের এই শাড়ি ‘গারা‘ নামে পরিচিত। ১৭২৯ সালে চীন সরকার আফিমের আমদানি ও বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কারণ, চীনে তখন মাদকদ্রব্যের প্রতি মানুষের আসক্তি পৌঁছেছিল চরম পর্যায়ে। ১৮৩০ আসতে আসতে পারসিরা আফিমের ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল। বিকল্প হিসেবে তারা তুলা উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করে। আর সেসময় তুলার চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী। তাই, ঝোপ বুঝে কোপ মেরে অল্প সময়েই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয় ভারতীয় পারসি সম্প্রদায়ের।
ব্রিটিশ রাজের শাসনামলে তারা নিজ সন্তানদের ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পাঠানো শুরু করে। পারসিদের সন্তানেরা শিখে ফেলে ইংরেজি ভাষা, আয়ত্ত করে পশ্চিমাদের আচার-ব্যবহার, যেটা সেসময়ের জন্য বিলাসপূর্ণ চালচলন হিসেবেই গণ্য করা হতো। এজন্য তারা নিজেদের এক ব্যক্তিত্বশালী সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছিল। তখন পারসি মাত্রই ছিল শিক্ষিত, প্রগতিশীল, এবং সফল এক সম্প্রদায়। তা ব্রিটিশ এবং ভারতীয়; কেউই অস্বীকার করত না।
জামসেটজি জেজিভয়; তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তুলা ও আফিম ব্যবসার মাধ্যমে। ওই জমানায় ভারতের শ্রেষ্ঠ ধনকুবেরদের মাঝে তিনি ছিলেন একজন। দান-খয়রাতও করতেন হাত খুলে। তৎকালীন পুনা (বর্তমান পুনে) শহরে জল সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতির পেছনে খরচ হওয়া অর্থের দুই-তৃতীয়াংশই বহন করেন তিনি। ১৮৫৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন Sir JJ School of Art নামে এক আর্ট স্কুল, যা এখনও মুম্বাইয়ের সবচেয়ে প্রাচীন আর্ট স্কুল হিসেবে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়াও তিনি জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে ১৮৪৫ সালে নির্মাণ করেন Jamsetjee Jeejeebhoy Hospital, যা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন এক হাসপাতাল। বর্তমানে তা মুম্বাইয়ের Grant Government Medical College এর একটি অংশ।
পারসিদের অনন্যসাধারণ একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তারা দানশীলতার সাথে সংযুক্ত। সমাজ ও নিজ সম্প্রদায়ের উন্নয়নে তারা দানকর্মে অংশগ্রহণ করে থাকে। এর বীজ প্রোথিত ছিল জরথুস্ত্র ধর্মের মূল ভিত্তিতে। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, সর্বদা সৎ কাজ করলেই মন্দকে দূরীভূত করা সম্ভব। বর্তমানে ভারতের মোট জনসংখ্যাতে পারসিরা মাত্র ০.০০৬% অংশ দখল করে আছে, সংখ্যার হিসেবে যা মাত্র ৫৭ হাজার। সংখ্যার বিচারে তারা অতি ক্ষুদ্র হলেও ভারতীয় অর্থনীতিতে পারসিদের অবদান দেখলে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। টাটা পরিবার, গোদরেজ পরিবার, ওয়াদিয়া পরিবারের নাম ভারতীয় শিল্পপতি পরিবারগুলোর তালিকায় বেশ উপরের দিকেই আছে।
জামসেটজি টাটাকে উল্লেখ করা হয় ভারতীয় শিল্পের জনক হিসেবে। তিনি টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠা এবং জামশেদনগর নামে এক শহর স্থাপনের সাথে জড়িত। জাহাঙ্গীর রতনজী দাদাভয় টাটা ছিলেন ভারতের প্রথম লাইসেন্সপ্রাপ্ত পাইলট। এয়ার ইন্ডিয়া, টাটা কনসালটেন্ট সার্ভিস, টাটা মোটরস, টাটা সল্ট, টাইটান কোম্পানি সবগুলোই টাটা পরিবারের অধীনে। ভারতীয় শিল্পপতি রতন টাটাকে কে না চেনে?
বিজ্ঞান শাখায় সমুজ্জ্বল হয়ে আছে হোমি জাহাঙ্গীর ভাভার নাম। ভারতীয় যশস্বী এই পরমাণু পদার্থবিদ ‘ভারতীয় পারমাণবিক কর্মসূচির জনক’ হিসেবে স্বীকৃতি পান। ভারতের প্রথম ফিল্ড মার্শাল স্যাম ম্যানেকশকে ভারতের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আর্মি অফিসার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর হয়ে বিরাট ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। রাজনীতির প্রসঙ্গ আনলে, ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজ গান্ধী ছিলেন একজন পারসি।
ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কথা বললে সে তালিকা বেশ লম্বা হয়ে যায়। অভিনেতা বোমান ইরানি, প্রযোজক রনি স্ক্রুভালা, কৌতুকাভিনেতা সাইরাস ব্রোয়াচা, অরুনা ইরানি, ডেইজি ইরানি সকলেই হলেন জরথুস্ত্রপন্থি। আর যদি পিতা-মাতা যেকোনো একজনকে পারসি হিসেবে ধরা হয় তাহলে সে তালিকায় আসবে জন আব্রাহাম, ফারহান আখতার, ফারাহ খান, জিম শরভ, আফতাব শিবদাসানিদের নাম!
তবে এখানে একটি পারসি মতবাদ সম্পর্কিত খটকা রয়ে গেছে। জরথুস্ত্রবাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, পারসিদের বংশের ধারা প্রবাহিত হতে পারবে শুধুমাত্র পুরুষদের মাধ্যমে। অর্থাৎ, একজন পারসি পুরুষের সাথে যদি একজন অ-পারসি মহিলার বিয়ে হয়, তাদের সন্তান হবে পারসি। অপরদিকে যদি একজন অ-পারসি পুরুষের সাথে একজন পারসি মহিলার বিয়ে হয়, তাদের সন্তানকে সেক্ষেত্রে পারসি বলা যাবে না।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি দশ বছরে ভারতে ১২% করে কমছে পারসি জনসংখ্যা। সেটা শুরু হয়েছিল ১৯৪১ সাল থেকে। ২০০১ সালে তাদের জনসংখ্যা ৬৯ হাজার থাকলেও ২০১১ সালের আদমশুমারিতে তা নেমে এসেছে ৫৭ হাজারে। এর কারণ হিসেবে, যৌন উর্বরতা হ্রাস, সন্তান জন্মদানে অনীহা, বিবাহ বিলম্ব, দেশান্তরকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার পারসি মহিলার সাথে অ-পারসি পুরুষের মিলনে জন্ম নেওয়া সন্তানকে পারসি হিসেবে গণ্য না করাও বড় একটি কারণ। কেউ কেউ মনে করে এর ফলে বৈষম্য হচ্ছে নারীদের সাথে, আবার কেউ কেউ বলে, এটা দিয়ে জারী রাখা হয়েছে প্রাচীন জরাথুস্ত্রীয় সাংস্কৃতিক প্রভাব।