ইতিহাসের অনেক ঘটনাই রহস্যাবৃত। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির মৃত্যুরহস্য কিংবা মৃত্যুর পর অনেকের সমাধি সৌধের অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়া আজও ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। ইতিহাসের এমনই এক চরিত্র ভলফগ্যাং আমাদিউস মোৎজার্ট। একজন ধ্রুপদী শিল্পী হিসেবে সঙ্গীতের ইতিহাসে যার নাম অমর হয়ে আছে। তার সঙ্গীতজীবন যেমন রূপকথার মতো, তেমনি তার মৃত্যু আর সমাধি নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা রহস্যময় ধুম্রজাল।
৫ ডিসেম্বর, ১৭৯১। ছবির মতো শহর অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা সেদিন সকাল থেকেই যেন মন খারাপ করে আছে। আকাশজুড়ে কালো মেঘের আনাগোনা। তুমুল ঝড়ে ভেসে যাচ্ছিল পুরো ভিয়েনা শহর। সেই দুর্যোগের দিনে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন আঠারো শতকের এক অসাধারণ সুরকার মোৎজার্ট।
একদিন যার সুরঝঙ্কারে মানুষ ভুলে ছিল জীবনের দুঃখ-কষ্ট, বেদনার কথা, যার সিম্ফনি শুনে বিমোহিত হতো সারা দুনিয়ার মানুষ- সেই সুরসম্রাট বড় একাকী, প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। মৃত্যুর আগে অসমাপ্ত রেখে যান তার অনন্য এক সৃষ্টি ‘রিকোয়েম’। এ যেন তার নিজেরই শোকগাঁথা। অনেকে আবার বলে থাকেন, নিজের মৃত্যুর শোক সঙ্গীত নিজেই রচনা করে গেলেন এই মহান সুরস্রষ্টা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই পৃথিবীর আপামর মানুষের ভালবাসা পাওয়া সেই সুরসম্রাটের মৃত্যুর সময় ছিলেন না তার সেসব ভক্ত। ছিলেন না তার একসময়ের বন্ধুস্থানীয় সঙ্গীতজ্ঞ বন্ধুরা।
সেদিনের বৃষ্টিস্নাত সকালবেলায় মোৎজার্টের শবদেহ বহন করার জন্য তার পরিবারের সদস্য ছাড়া ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন পারিবারিক বন্ধু। সেই ঘোর দুর্যোগের দিনে তার শবের মিছিল নিয়ে প্রায় অন্ধকার রাজপথ ধরে তারা চলতে লাগলেন। তাদের গন্তব্যস্থল ভিয়েনা থেকে বেশ খানিকটা দূরে দরিদ্রদের জন্য নির্মিত গোরস্থানে।
মোৎজার্ট অষ্টদশ শতকের একজন জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে এই বিস্ময়কর বালক গোটা সিম্ফনি লিখে তাক লাগিয়ে দেন বিশ্বের সুর বোদ্ধাদের। সারা বিশ্বের শ্রোতাদের মাঝে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এ সময় আর্থিকভাবেও যে তিনি বেশ স্বচ্ছল ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু অত্যন্ত বেহিসাবী জীবনযাপন করতেন মোৎজার্ট। শেষ সময়ে নিজের এবং পরিবারের জন্য তেমন কোনো সঞ্চয়ই রেখে যেতে পারেননি। যেদিন তিনি মারা গেলেন সেদিন, তার স্ত্রী কনস্টানজের কাছে কোনো টাকাপয়সাই ছিল না। তাই মোৎজার্টকে বড় করুণভাবে এই সুরেলা পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। মৃত্যুর কিছুদিন আগে জীবনে ঘটেছিল এক অদ্ভূত ঘটনা। এক অচেনা পাগলাটে লোক এসে তাকে রিকোয়েম (শোক সঙ্গীত) লিখতে বলেন।
সেই শোকগাঁথা রচনা করতেই করতেই মোৎজার্টের মনে হয়েছিল, স্বয়ং ঈশ্বর যেন তার নিজেরই শোকগাঁথা রচনার আদেশ করেছেন। তাই হাতের কাছে শেষ না হওয়া অনেক কাজ অসমাপ্ত রেখেই নতুন উৎসাহে মেতে ওঠেন মোৎজার্ট। রাত-দিন সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন রিকোয়েমের সুর সৃষ্টিতে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীর ক্রমেই ভেঙে পড়তে থাকে। আর কয়েকদিন পর তার ৩৬তম জন্মদিন। জাঁকজমকের সাথে তা পালনের ব্যাপারে তার বন্ধুরা বেশ উৎসাহিত ছিলেন। এ নিয়ে সকলে নানা রকম প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তার কয়েকদিন আগেই তার জীবনপ্রদীপ নিভে গেল। অসম্পূর্ণ থেকে গেল তার রিকোয়েমের সুর।
পরিবারের সদস্য আর কয়েকজন আত্মীয় পরিজন মোৎজার্টের শবদেহ নিয়ে উপস্থিত হলেন সেন্ট স্টিফেনস গির্জায়। এখানে শেষকৃত্যের পর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হলো সেন্ট মার্কস গোরস্থানে। সেখানে পৌঁছানোর পর দেখা গেল, মোৎজার্টের সমাধি দেয়ার জন্য যে ন্যূনতম খরচটুকু দেয়া প্রয়োজন, মোৎজার্ট পত্নী তা-ও দিতে অক্ষম। পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের এক দিকপাল, যার সুরের আশ্রয়ে শান্তি পেতো কত মানুষ, তার অন্তিম যাত্রায় এত বিড়ম্বনা!
সেন্ট মার্কস গোরস্থানে ঠাঁই হলো না মোৎজার্টের। শেষ পর্যন্ত তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হলো সেন্ট মার্কস গোরস্থানের সাথেই লাগোয়া আরেকটি গোরস্থানে, যা নিম্নবিত্ত মানুষদের কবর দেয়ার জন্য পরিচিত ছিল। পথের ভিখারি, বেনামী, আশ্রয়হীন লোকদের ঠাঁই হতো এই কবরস্থানে। এখানেই মোৎজার্টকে কবর দেয়া হয়। নিম্নবিত্ত লোকদের কবর স্থায়ী হতো না। কিছুদিন পর পর সেই কবরস্থানে আবার অন্য কোনো লোকের ঠিকানা হতো। ফলে মোৎজার্টের পরিবার-পরিজনের পক্ষে মোৎজার্টের সমাধিস্থানে পাথর খোদাই করে সুন্দর সমাধিফলক দেয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না। তাই ইতিহাসের পাতায় নির্দিষ্ট রইলো না মোৎজার্টের কোনো সমাধি।
ইতিহাসের এই জায়গা বেশ অন্ধকারচ্ছন্ন। উনিশ শতকের অনেক গবেষকই এই যুক্তির সাথে একমত নন। অনেকেই মনে করেন, ১৭৯০ সালের দিকে মোৎজার্টের আর্থিক অবস্থার বেশ উন্নতি হয়। এই সময়ে হাঙ্গেরি এবং আমস্টারডামের অনেক ধনী পৃষ্ঠপোষকের মনোরঞ্জনের জন্য মোৎজার্ট একের পর এক সুর সৃষ্টি করে গেছেন। এর বিনিময়ে তিনি বেশ মোটা অঙ্কের মাসোহারা পেতেন। ফলে আর্থিকভাবে তিনি তখন বেশ স্বাবলম্বী ছিলেন এবং বাজারে তার যে দেনা ছিল তা-ও এ সময় পরিশোধ করেন। কিন্তু এ বিষয়ে তেমন সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি।
আবার আরেকদল গবেষক মোৎজার্টের মৃত্যুর পর তার কবর নিয়ে এত ধোঁয়াশার পেছনে তৎকালীন অস্ট্রিয়ান শাসক দ্বিতীয় জোসেফকে দায়ী করেন। ১৭৮৪ সালে দ্বিতীয় জোসেফ ভিয়েনায় প্রতিষ্ঠিত কবরস্থানগুলো নিয়ে এবং মৃতদেহ সৎকার নিয়ে এক আদেশ জারি করেন। এই আদেশে বলা হয়, কোনো ব্যক্তির জন্য আলাদা কোনোো সমাধিস্থল রাখা যাবে না। মৃতদেহ যাতে তাড়াতাড়ি মাটির সাথে মিশে যেতে পারে এবং একই কবর যাতে বারবার ব্যবহার করা যায়, সেজন্য মৃতদেহকে যেখানে শায়িত করা হবে সেখানে মৃতদেহের শরীরে কোনো কাপড় রাখা যাবে না এবং লিনেনের তৈরি ব্যাগে মৃতদেহের কবর দিতে হবে।
এই আদেশের কারণে মোৎজার্টকে যেখানে কবর দেয়া হয় সে স্থানে কিছুদিন পরেই আরও বেশ কয়েকজনের কবর দেয়া হয়। আর সম্রাটের আদেশের কারণে কবরস্থানে কোনো সমাধিফলকও রাখার ব্যবস্থা ছিল না। ফলে সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে থাকে মোৎজার্টের সমাধিস্থল। এ কারণে পরবর্তীকালে গবেষকদের পক্ষে তার সমাধিক্ষেত্র নির্ধারণ করাও সম্ভব হয়নি।
এভাবে অনেক বছর কেটে গেল। ১৮৫৫ সালের দিকে ভিয়েনাবাসীর খেয়াল হলো তারা কী ভুল করেছে। যে মানুষটাকে সারা বিশ্বের মানুষ এক নামে চেনে, সেই মানুষটির নিজের শহরেই তার নামে কোনো কিছু নেই। ফলে মোৎজার্টের সমাধিক্ষেত্র চিহ্নিত করার জন্য নতুন করে চেষ্টা শুরু হলো। অনেক অনুসন্ধানের পরও মিললো না মোৎজার্টের সমাধি।
সবাই ভেবে নিয়েছিলেন, সেন্ট মার্কসের গোরস্থানের কোথাও ঘুমিয়ে আছেন অভিমানী মোৎজার্ট। আর তাই সেখানে তার নামে নির্মাণ করা হলো বাহারি সমাধিফলক। পরে সরকার থেকে শুরু করে ভিয়েনার অনেক প্রথিতযশা মানুষদের কাছে মনে হলো সম্মানটা যথেষ্ট হয়নি। বেটোভেন, শুবার্ট, ব্রামসের মতো নামজাদা সব সুরকার যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন, সেই সেন্ট্রাল ফ্রিডহোফেই হওয়া উচিত মোৎজার্টের সমাধি। কারণ এটিই শহরের অভিজাত গোরস্থান। তাই সেন্ট মার্কসের সমাধিস্থান থেকে তার কথিত সমাধিফলক সরিয়ে আনা হলো। সেন্ট্রাল ফ্রিডহোফের বিখ্যাত সব সুরকারের সমাধিফলকের মাঝে ঠাঁই পেলো মোৎজার্টের সমাধিফলক।
পরবর্তীকালে সেন্ট মার্কসেও তৈরি করা হলো তার নামে সুন্দর একটি স্মৃতিফলক। তার নাম লেখা স্মৃতিফলকের পাশে ভারী মন খারাপ করা মুখে দাঁড়িয়ে এক কিশোর দেবদূতের ভাস্কর্য। সে দেবদূতের মুখে যেন এক কম্পোজারের দুঃখী গল্পের ছায়া। মোৎজার্টকে শ্রদ্ধা জানানোর, সম্মান জানানোর আরও একটি ঠিকানা। প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে অনেক পর্যটকেই এখানে মোৎজার্টকে সম্মান জানাতে আসেন।
ছত্রিশ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে কত অসাধারণ সব কনচের্তো, সোনাটা, অপেরা, সিম্ফনী রচনা করেছেন মোৎজার্ট, আনন্দ দিয়েছেন অসংখ্য সুর শ্রোতাদের। তার অসাধারণ সব কম্পোজিশনে মুগ্ধ করেছেন সারা পৃথিবীর মানুষকে। কিন্তু তার শেষ বিদায়কালে সেসব মানুষ তাকে ভুলে গেলেও ভুলে যায়নি প্রকৃতি। তাই অবিরাম বৃষ্টির সিম্ফনির মাধ্যমে যেন তাকে চিরবিদায় জানিয়েছিল প্রকৃতি।