ম্যানহ্যাটন প্রজেক্ট; নামটা কম-বেশি সবারই জানা। ১৯৪২-৪৬ সাল পর্যন্ত ধরা হয়ে থাকে এই প্রজেক্টের সময়কাল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টানা হয় এর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মান পারমাণবিক গবেষণার তথ্য চালান ও নিজস্ব পারমাণবিক গবেষণাই মূল উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন এই প্রজেক্টের। পরবর্তীতে এটি পৃথিবীকে উপহার দেয় এক অতিমানবীয় শক্তির, যার নাম ‘পারমাণবিক বোমা’।
১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই ট্রিনিটি পরীক্ষার মাধ্যমেই শুরু হয় পারমাণবিক যুগের সূচনা, যা ছিল পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার প্রথম নজির। ২২ কিলোটন টিএনটির সমান শক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো থেকে ৩৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে ঘটানো হয় ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ। পরবর্তীতে নাগাসাকি ও হিরোশিমা সাক্ষী হয় প্রাণঘাতী এই অস্ত্রের দানবীয় ধ্বংসলীলার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর কখনোই যুদ্ধক্ষেত্রে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার হয়নি। তবে পরবর্তী কয়েক বছরের মাঝেই সোভিয়েত ইউনিয়নও আত্মপ্রকাশ করে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে। ১৯৬৪ সাল নাগাদ সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫টি দেশে[১]; যুক্ত হয় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও চীন। পরবর্তীতে এই কাতারে যুক্ত হয় ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েল, উত্তর কোরিয়ার মতো রাষ্টসমূহ। দক্ষিণ আফ্রিকা পারমাণবিক শক্তিধর হয়েও ১৯৯৩ সালের মে মাসে[২] পার্লামেন্টে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের গুটিয়ে নেয় এই ক্ষমতা প্রদর্শনের দৌড় থেকে।
পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো পারমাণবিক পরীক্ষাসমূহ চালায় তার শক্তির জানান দিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধের প্রধান অংশ জুড়ে ছিল পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেদের শক্তির জানান দেয়া। যদিও পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালের ৫ আগস্ট মস্কোতে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য বায়ুমন্ডলে ও মহাসাগরীয় অঞ্চলে পরীক্ষা বন্ধে Limited Test Ban Treaty (LTBT)-তে [৩] স্বাক্ষর করে। বর্তমানে এই চুক্তিতে সম্মতি প্রকাশ রাষ্ট্রের সংখ্যা ১২৩টি।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ১৯৪৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ২০৫৩টি পারমাণবিক অস্ত্রের সফল পরীক্ষা সম্পন্ন হয়, যার শতকরা ৮৫ ভাগই চালায় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর মাঝে ৫৩০টি পারমাণবিক অস্ত্র, অর্থাৎ শতকরা ২৫ ভাগ পারমাণবিক অস্ত্রের সফল পরীক্ষা বায়ুমণ্ডল ও মহাসাগরীয় অঞ্চলে চালানো হয়, এবং ১৫১৭টি পারমাণবিক অস্ত্র, তথা শতকরা ৭৫ ভাগ সফল পরীক্ষা চালানো করা হয় ভূ-গর্ভে। বায়ুমণ্ডল ও মহাসাগরীয় পরীক্ষাসমূহের প্রায় ৫৪ ভাগ দায়ভার সোভিয়েত ইউনিয়নের, যার পরিমাণ ২৮৫ মেগাটন টিএনটির সমান।
যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুমণ্ডলীয় পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষণে নির্গত শক্তির পরিমাণ প্রায় ২০০ মেগাটন টিএনটির সমপরিমাণ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও চীন- সকলেই উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত হওয়ায় ৯০ ভাগ পারমাণবিক পরীক্ষাই চালানো হয় এই গোলার্ধে। উল্লেখ্য, পৃথিবীর জনসংখ্যার সিংহভাগের বসবাস উত্তর গোলার্ধে।
UNSCEAR (United Nation’s Scientific Committee on the Effects of Atomic Radiation) এর তথ্যমতে[৪], গত ৭০ বছরে বায়ুমণ্ডল ও জলজ পরিবেশে মানবসৃষ্ট তেজস্ক্রিয়তার জন্য সিংহভাগ দায়ভার পারমাণবিক অস্ত্রের পরিক্ষা চালনা। তাদের মতে, পারমাণবিক পরীক্ষার ফলে কার্বন, ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়াম, স্ট্রনশিয়াম ও আয়োডিনের তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বায়ুমণ্ডল ও পানিতে উন্মুক্ত হয়। কার্বন-১৪ তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ খুব তাড়াতাড়ি বাতাসে অবস্থিত অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে তেজস্ক্রিয় কার্বন মনোক্সাইড ও তেজস্ক্রিয় কার্বন ডাই অক্সাইডে পরিণত হয়, এবং বায়ুমণ্ডল, সমুদ্রতীর ও সমুদ্রবক্ষে বৈশ্বিক কার্বন মজুদের অংশ হিসেবে যুক্ত হয়। এই তেজস্ক্রিয় কার্বন খুবই ভয়াবহ, কারণ এই পরমাণুর অর্ধায়ু প্রায় ৫,৭৩০ বছর। উত্তর আমেরিকার পশ্চিম তীরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক মাছের উপর গবেষণা থেকে তথ্য পাওয়া যায়, ২০০০ সাল নাগাদ সামুদ্রিক মাছে তেজস্ক্রিয় উপাদানের পরিমাণ অত্যন্ত বিপজ্জনক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে, যা প্রায় সাধারণ তেজস্ক্রিয়তার মানের চেয়ে ৩ গুণ বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতহাসে সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালানো হয় নেভাডা টেস্ট সাইটে। UNSCEAR এর তথ্যমতে[৪], এখানে প্রায় ৮০০ পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করা হয়েছে, যার মাঝে কমপক্ষে ৩২টি পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আয়োডিন-১৩১ তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বায়ুমণ্ডলে ও ভূগর্ভস্থ পানিতে অবমুক্ত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে[৪]। নেভাডা, কলোরাডো, উতাহ, ওউমিং, নিউ মেক্সিকো ও নর্দার্ন এরিজোনায় ১৯৫১-৫৮ সালে গবাদিপশুর জন্য ঘাস ও তাদের দুধের উপর গবেষণায় দেখা যায়, সেই ঘাসে ক্রোমোজমাল ও ডিএনএ মিউটেশানের হার অনেক বেশি, এবং স্বাভাবিকভাগেই দুধ উচ্চমাত্রায় তেজস্ক্রিয়[৫]। পরবর্তী ৪০ বছরে এ অঞ্চলসমূহে থাইরয়েড ক্যান্সারের হার প্রতি ১০ হাজারে ৮ জন থেকে বেড়ে গড়ে ২৫ জনে দাঁড়িয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে আশংকাজনকভাবে বেশি।
সোভিয়েত ইউনিয়নে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার জন্য সংরক্ষিত এলাকা ছিল বর্তমান কাজাখস্তানের সেমিপালাতিনস্ক অঞ্চল[৬]। এ অঞ্চলের বায়ুমণ্ডল ও ভূগর্ভস্থ পানিতে তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়ামের মাত্রা নিয়ে গবেষণা হয়। দেখা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে যেখানে স্বাভাবিকমাত্রা প্রতি লিটার পানিতে মাত্র ১৫ মাইক্রোগ্রাম, সেখানে এর মাত্রা সেমিপালাতিনস্ক অঞ্চলে কয়েকগুণ বেশি। বিবিসির ২০১০ এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সেমিপালাতিনস্কে প্রতি ২০ জনের মাঝে একজন শিশু এখনও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম নিচ্ছে।
একইভাবে, চীনের জিয়ানজিয়াং টেস্ট সাইটে ১৯৬৪-৮০ সাল পর্যন্ত ২৩টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো হয়। বর্তমান গবেষণা মতে, সেখানে ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার হার এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় প্রায় ৩০-৩৫ ভাগ বেশি।
পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার ইতিহাসে সবচেয়ে নেক্কারজনক ঘটনা ১৯৫৪ সালে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের ক্যাসেল ব্রাভো দ্বীপের বিকিনি এটলে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার ঘটনাটি[৫]। লিথিয়াম-৭ পরমাণুর অপ্রত্যাশিত চেইন বিক্রয়ায় সম্ভাব্য ৬ মেগাটনের পরিবর্তে ১৫ মেগাটনের দানবীয় শক্তি নিয়ে অস্ত্রটির বিস্ফোরণ ঘটে, যাতে করে প্রশান্ত মহাসাগরে ছড়িয়ে পড়ে বিপুল পরিমাণে অনিয়ন্ত্রিত তেজস্ক্রিয় বর্জ্য, যা পরবর্তীতে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলেও বিস্তৃত হয়। তৎক্ষণাৎ অনেক জলজপ্রাণীর মৃত ভেসে ওঠে, পরবর্তীতে যা আরো খারাপ আকার ধারণ করে। ১৯৬৪ সাল থেকে দ্বীপটি থাকার উপযোগী ঘোষণা করা হলেও ১৯৭২ সালে সেখানে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ ছিল ৫০ রন্টজেন, যেখানে তা থাকার কথা ৫ রন্টজেন, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। ১৯৯৭ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে জরায়ু ক্যান্সারে মৃত্যুহার স্বাভাবিকের চেয়ে ৬০ গুণ বেশি। ফুসফুসের ক্যান্সারে মৃত্যুহার স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ গুণ বেশি।
পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার হাজারো হুমকি থাকা সত্ত্বেও থামছে না অস্ত্র পরীক্ষা ও শক্তিমত্তা প্রদর্শনের হিড়িক। শান্তির ওয়াদা দিয়ে যে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তাদের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে এসব করছে, যে মানুষ ও বাজারের প্রয়োজনে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় পারমাণবিক শক্তি প্রদর্শন করছে, সেই পৃথিবীতে শান্তির স্বপ্ন বাস্তবায়নেরর জন্য কতগুলো প্রজন্ম নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে, তা-ই এখন দেখার বিষয়। পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা হয়তো আমাদের সমীকরণের অংশ না হয়েও বড় অংশ- এই অস্ত্র প্রয়োগই নয়, পরীক্ষাও ডেকে আনতে পারে বড় বিপর্যয়।
এই বিষয়ে আরও জানতে সংগ্রহ করতে পারেন রোর বাংলার এই বইটি:
১) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমার হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর জীবন সংগ্রামের সত্য ঘটনা