১. সিলফিয়াম গাছ
প্রাচীনকালে গ্রিসে সিলফিয়াম নামে খর্বাকৃতির একধরনের গাছ পাওয়া যেত। জন্ম নিয়ন্ত্রণকারী উপাদান ধারণ করাই এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। ফলে গ্রিসের জনগণের কাছে গাছটি বেশ পরিচিতই ছিল। Ferula গণের অন্তর্গত এ গাছটির সন্ধান পেয়েছিল প্রাচীন গ্রিসেরই সিরিন শহরের একদল বণিক। বর্তমান লিবিয়ার শাহ্হাত অঞ্চলের নিকটবর্তী সেই এলাকা থেকে পাওয়া সিলফিয়াম গাছগুলো বিক্রিও হতো প্রচুর পরিমাণে।
চেষ্টা করা হয়েছিল যাতে সিরিনের বাইরেও অন্যান্য অঞ্চলে গাছটির চাষ করা যায়। কিন্তু সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। ওদিকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার ফলে মানুষজন গাছটির উপর অধিক হারে নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় আস্তে আস্তে গাছটির সংখ্যা কমতে শুরু করে। ১ম শতাব্দীর দিকেই দুষ্প্রাপ্যতার দরুন গাছটির দাম বেশ বেড়ে গিয়েছিল। সর্বশেষ ৪র্থ শতাব্দীতে গাছটিকে দেখা গিয়েছিল বলে জানা যায়।
২. বেজির অণ্ডকোষ
সিলফিয়ামের কিছু অবশেষ খুঁজে পেয়ে বিজ্ঞানীরা অন্তত এ বিষয়ে একমত হতে পেরেছিলেন যে, গাছটির মাঝে আসলেই কিছু জন্ম নিয়ন্ত্রণকারী উপাদানের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এর পাশাপাশি তৎকালীন গ্রিসের মানুষজন এমন সব জাদুমন্ত্র ও অলীক বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, যা ভাবলে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। মন্ত্র, মন্ত্রপড়া বিভিন্ন দ্রব্য, তাবিজ-কবচ ইত্যাদি নানা ধরনের বিষয়ের উপর তারা জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। এসব তারা ব্যবহার করতো সন্তান লাভের প্রত্যাশাতেও।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় বেজির কথা। বেচারা বেজিকে তারা এ উদ্দেশ্যে এমনভাবে ব্যবহার করতো যে, আজকের দিনের বেজিরা যদি তাদের গ্রিসের পূর্বপুরুষদের কষ্ট সম্বন্ধে জানতে পারে (এবং সেটা বুঝতেও পারে!), তাহলে কষ্টে তাদের চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লেও অবাক হবার মতো কিছু হবে না।
Cyranides (2.7) নামক প্রাচীন এক গ্রীক পুঁথি থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, যদি কোনো দম্পতি তাদের সংসারে নতুন কোনো সদস্যের আগমন প্রত্যাশা করতো, তাহলে মিলনের পূর্বে প্রথমে একটি বেজির ডান অণ্ডকোষটি সংগ্রহ করতো। এরপর সেটা পুড়িয়ে ছাইয়ে পরিণত করে সেই ছাইকে তারা মেশাতো গুল্ম থেকে প্রাপ্ত তিক্ত স্বাদের সুগন্ধী একপ্রকার আঠার সাথে। এরপর সেই মিশ্রণকে ছোট একটি পশমের তৈরি বলের সাথে মিশিয়ে তা নারীর লজ্জাস্থানের ভেতরে স্থাপন করতো।
অন্যদিকে, যদি তারা এই একই প্রাণীকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করতে চাইতো, তাহলে কেটে নিত তার বাম অণ্ডকোষটি! বেচারা বেজি! এরপর সেই অণ্ডকোষকে একটি খচ্চরের চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে সেটি একজন নারীর শরীরে বেঁধে দেয়া হতো। অবশ্য এভাবে বেজির অণ্ডকোষ ঝুলিয়ে রাখা কিংবা শরীরের ভেতরে প্রবেশ করানো কীভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ বা পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে, তা আজও আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে বোধগম্য নয়।
৩. পুরুষদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ
এবার জানা যাক পুরুষদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে। প্রাচীন গ্রিসের কিছু উৎস থেকে জানা যায়, তখন নাকি সেখানে একটি গাছ পাওয়া যেত, যার নাম পেরিক্লাইমেনন। তৎকালীন পুরুষেরা মনে করতো যে, এ গাছটি পুরুষদের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে থাকে। অবশ্য বর্তমান সময়ে অনেক অনুসন্ধান চালিয়েও পেরিক্লাইমেননের সন্ধান পাওয়া যায় নি।
এ গাছটি সম্পর্কে জানা যায় বিখ্যাত গ্রীক চিকিৎসক গ্যালেনের মাধ্যমে। তিনি জানান, তৎকালীন গ্রীক ক্রীড়াবিদেরা তাদের জননাঙ্গ উত্থান রোধ করতে এ গাছের সাহায্য নিত। একই কথা জানা যায় তৎকালীন গ্রীক পুরোহিতদের ব্যাপারেও। তারাও নাকি নিজেদের যৌনাবেগ দমনে এ গাছের পাতা চিবোতেন।
আধুনিককালে এ জাতীয় অন্যান্য গাছের নির্যাস কুকুরকে খাইয়ে দেখা গেছে, সেটি শুক্রাণুর উৎপাদন রোধে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
৪. গর্ভপাত
গর্ভপাতের বিষয়টিও তৎকালীন গ্রিসে বেশ প্রচলিত ছিল। সেই সময়ের নানা কাগজপত্র থেকে জানা যায় যে, গর্ভপাতের সার্জিক্যাল ও কেমিক্যাল উভয় প্রকার পদ্ধতি সম্পর্কেই অবগত ছিল তারা। তবে সার্জিক্যাল পদ্ধতিটি মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরুপ হতো বলে, সাধারণত কেমিক্যাল পদ্ধতিকেই উৎসাহিত করা হতো।
সক্রেটিসের মা পেশায় ছিলেন একজন ধাত্রী। তিনিও জানান যে, যদি গর্ভবতী মহিলার পরিবারের সদস্যরা গর্ভপাত করাতে চাইত, তাহলে বিভিন্ন ঔষধ ও মন্ত্রের মাধ্যমে তারা সেটা করে থাকতেন। ব্রাহ্মী, গাছের আঠা, জুনিপার গাছ ইত্যাদি ব্যবহৃত হতো গর্ভপাত ঘটানোর উদ্দেশ্যে।
যদিও তৎকালীন গ্রীসের অনেক শহরেই গর্ভপাত ঘটানো নিষিদ্ধ ছিল, তবে সেটা কি তখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল কিনা সেই সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। তৎকালীন বিভিন্ন নথিপত্র থেকে জানা যায়, দেহব্যবসায়ী রমণীদের মাঝেই গর্ভপাতের চল বেশি ছিল।
৫. শিশুহত্যা
নির্মম শোনালেও এ কথা সত্য যে, এককালে গ্রিসে শিশুহত্যা ছিল বেশ স্বাভাবিক একটি ঘটনা। জন্মের নির্দিষ্ট সময় পর শিশুর জন্য নাম রাখা উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান হতো, তার নাম ছিল অ্যাম্ফিড্রমিয়া। এ নাম রাখার দায়িত্ব ছিল বাবার কাঁধে। এর আগে যদি তিনি তার সন্তানকে হত্যা করে ফেলতেন কোনো কারণে কিংবা বিনা কারণে, তবে তাকে শাস্তি দেয়ার কোনো বিধান পর্যন্ত ছিল না! এখানে যেমন তাকে আইনের চোখে দোষী সাব্যস্ত হতে হতো না, তেমনই বিবেকের দংশনেও তাদেরকে দংশিত হতে দেখা যেত না।
সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো, তৎকালীন গ্রিসের আইন ব্যবস্থায় কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে শিশুহত্যার মতো জঘন্য বিষয়কে উৎসাহিত পর্যন্ত করা হয়েছিল। কখনো কখনো শিশুর বাবা-মা তাকে বাইরে ফেলে রেখে আসতেন। এর ফলে হয় অনাহারে, অসুস্থতার দরুন শিশুটির মৃত্যু ঘটতো, নাহয় অন্য কেউ সৌভাগ্যবশত তাকে দেখতে পেলে দয়াপরবশ হয়ে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিত।
আবার কোনো শিশু যদি জন্মগত কোনো প্রকার ত্রুটি নিয়ে পৃথিবীর বুকে আসতো, তাহলে তাকে অনেক সময় সেই অল্প বয়সেই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হতো। এমনটা দেখা যেত মূলত স্পার্টায়। প্লুটার্কের বর্ণনা থেকে জানা যায়, স্পার্টায় কোনো শিশুর যখন জন্ম হতো, তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হতো পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের কাছে, যাতে করে তারা শিশুটিকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
যদি শিশুটি জন্মগতভাবে সুস্থ-সবল থাকতো, তাহলে তারা বাচ্চাটিকে ঠিকঠাক মতো বড় করার ব্যাপারে তার বাবাকে নির্দেশ দিতেন। কিন্তু যদি সেই শিশুটি জন্মগতভাবে কোনো রোগে আক্রান্ত থাকতো কিংবা বিকলাঙ্গ হতো, তাহলে তাকে পাঠানো হতো অ্যাপোথেটি নামক এক জায়গায়। সেটা ছিল আসলে টাইগেটাস পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত একটি খাদের মতো অংশ। সেখান থেকেই ছুঁড়ে ফেলে শিশুটিকে হত্যা করা হতো। কারণ তারা মনে করতেন, যে শিশুটিকে প্রকৃতি জন্মের শুরু থেকেই এমন অসম্পূর্ণভাবে পাঠিয়েছে, সে সমাজ কিংবা তার নিজের, কোনো পক্ষেরই কোনো কাজে আসবে না!
৬. সমকামিতা
এ ব্যাপারটিও কম বিস্ময়কর নয়। তৎকালীন গ্রিসে নাকি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে লাগাম টেনে ধরতে সমলিঙ্গের মাঝে যৌন সম্পর্কের মতো এ বিষয়টিকে বেশ উৎসাহিত করা হতো, বিশেষত একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও একটি অল্পবয়স্ক বালকের মাঝে যৌন সম্পর্ককে। অন্তত এমনটাই দাবি করেন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম পার্সি। এরিস্টটলও দাবি করেছেন (Politics 2.1272a 22–24), ক্রেটান সমাজে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও অল্পবয়স্ক বালকের মধ্যকার শারীরিক সম্পর্কে উৎসাহিত করা হতো জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনার উদ্দেশ্যে।
তাদের মতে, যদি সমকামিতায় লোকজনকে আকৃষ্ট করা যায়, তাহলে বিপরীত লিঙ্গের সাথে মানুষের মিলিত হবার প্রবণতা কমবে। এতে চূড়ান্ত ফলাফল হবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কিছুটা হলেও কমে আসা!
৭. জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিবিধ পন্থা
তৎকালীন গ্রিসের বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে জন্ম নিয়ন্ত্রণের আরো বেশ কিছু পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়।
১ম শতাব্দীতে গ্রীক চিকিৎসক ডায়োস্কোরাইডস জন্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে পুরুষাঙ্গে সীডার গাছের আঠা এবং নারীর জরায়ুতে ফিটকিরি লাগাতে বলতেন। তখনকার মানুষজন মনে করতো, এগুলো প্রয়োগ করে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হলে মায়ের শরীর সন্তান ধারণ করবে না।
এর পাশাপাশি আরেকটি পদ্ধতিও জনপ্রিয় ছিল। শারীরিক সম্পর্কের আগে নারীর যোনিপথে গোলমরিচ ও মধুর মিশ্রণ মাখিয়ে দেয়া হতো। আর মিলনের পর প্রয়োগ করা হতো গোলমরিচের আরেকটি মিশ্রণ। লোকে ভাবতো, এ জিনিসগুলো প্রয়োগ করলে জরায়ু পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং নারী তখন সন্তান ধারণ করবেন না!