১৯১৪ সালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। কী কী কারণে এই যুদ্ধটি শুরু হয় সেটার একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছিলো পূর্বের একটি লেখায়। এক পক্ষে জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং ইতালি; আরেকটি পক্ষে ফ্রান্স, রাশিয়া এবং ব্রিটেন। এই যুদ্ধটি জলে, স্থলে, আকাশে সব জায়গায় সংগঠিত হয়। তাই যারা এই ৩টি ক্ষেত্রে শক্তিশালী হবে তাদের যুদ্ধ জেতার সম্ভাবনা বেশি।
জার্মানি জল স্থল সবক্ষেত্রেই শক্তিশালী ছিল। জার্মানীর কাইজার তার দেশের নৌবাহিনীকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকে অনেক শক্তিশালী করে গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশদের নৌবাহিনী আরো বেশি শক্তিশালী ছিল। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ব্রিটিশ নৌবাহিনী জার্মানদের সমুদ্র বন্দরগুলো ঘিরে ফেলে। ফলে যুদ্ধের সময় জার্মান সৈন্যদের জন্য খাবার, অস্ত্র-সরঞ্জাম, কাঁচামাল পাঠানো সম্ভব হয়নি। প্রতিপক্ষের এরকম দুঃসহ অবস্থার সৃষ্টি জার্মানদের হারাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
কোনো দেশই যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে না এমনকি খুব বেশি দিন টিকতেই পারবে না যদি তাদের জন্য খাবার বা কাঁচামাল সরবরাহ না করা যায়। কিন্তু প্রথমেই ব্রিটিশরা জার্মানদের দমানোর এই পথ বেছে নেয়। যদিও সবার আশা ছিল এমন যে দুই প্রতিপক্ষ দেশের শক্তিশালী নৌবাহিনী সামনাসামনি যুদ্ধ করে জয়ী হবে। এতে কে বেশি শক্তিশালী সেটা বোঝা যাবে। কিন্তু আদৌ সেরকম হয়নি। আসলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম কিছুদিন এই দুই দেশের নৌবাহিনীর মধ্যে সামনে থেকে যুদ্ধ হলেও ব্রিটিশরা যখন জার্মান বন্দরগুলো নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসে তখন থেকে আর এমন যুদ্ধ হয়নি।
এমনকি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অনেক জার্মান সৈন্য যারা স্থলভাগে আকস্মিক আক্রমণের জন্য তৈরি হয়ে সমুদ্রপথে আসছিলো তারাও মাঝ পথে ধরা পড়ে যায়। এমনকি জার্মানি পর্যন্ত তারা এগোতে পারেনি। দুই দেশের অ্যাডমিরাল খুব সজাগ ছিলেন এই যুদ্ধ নিয়ে। তারা জানতেন যে, দুই দেশের মধ্যে যেকোনো একটি দেশও যদি বড় কোনো জলযুদ্ধে পরাজিত হয়, তাহলে সেই দেশ একদিনও যুদ্ধে টিকতে পারবে না।
কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জলজ পথে যুদ্ধের আধুনিক প্রায় সব অস্ত্রাদি তৈরি হয়েছিলো এমনকি সাবমেরিনও। তখনও পর্যন্ত আকাশ পথে যুদ্ধ করার মতো আধুনিক বিমান তৈরি হয়নি। কিছু বিমান তৈরি হয়েছিলো যেগুলো যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিলো কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেভাবে আকাশ পথের সাহায্য নেওয়া হয়েছিলো প্রথম যুদ্ধে সেরকমটি হয়নি। তাই যেকোনো দেশের নৌবাহিনী শক্তিশালী হলেই তাদেরকে শক্তিশালী দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
ব্রিটিশরা অনেকভাবে জার্মানদেরকে তাদের বেস ক্যাম্প কিয়েল এবং উইলহেল্মশেভেন থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিল। আবার জার্মানরাও রসিথ এবং স্কাপা ফ্লো থেকে ব্রিটিশদের সরে যেতে বলেছিলো। ১৯১৪ সালে যুদ্ধের শুরুর দিকে হেলিগোল্যান্ড এবং ডগার ব্যাঙ্ক নামক দুটি জায়গায় যুদ্ধ জার্মান এবং ব্রিটিশ প্রমোদতরীর সাথে যুদ্ধ হয়। কিন্তু এই যুদ্ধগুলো হয়েছিল স্বল্প পরিসরে। তবে জার্মানরা এই ছোট যুদ্ধের বোমা বারুদ এবং গোলাগুলির সাহায্যে ব্রিটিশদের উপর আক্রমণ করে। তাদের গোলাগুলি ইয়ারমাউথ, স্কারবোরো এবং হারটেলপুলের উপর প্রভাব ফেলেছিলো। এই আক্রমণের প্রভাব ব্রিটিশ বন্দরগুলোতেও পড়েছিলো।
আবার বিখ্যাত ফকল্যান্ড যুদ্ধে জার্মানদের নৌ বহরকে ব্রিটিশরা ধ্বংস করে দিয়েছিলো প্রশান্ত মহাসাগরে। জার্মানদের বেশিরভাগ নৌবহরই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো শুধু একটি যুদ্ধজাহাজ ১৯১৫ সালের দিকে ব্রিটিশদের অধীনে জার্মান বন্দরে পৌছায় যদিও সেই বন্দর ব্রিটিশদের দ্বারা দখল করে রাখা ছিল। তবে এত কিছুর পরও জার্মানরা দমে যাওয়ার মতো জাতি নয়। তারা যুদ্ধে তাদের প্রভাব রাখার জন্য তাদের নিজেদের বিখ্যাত U-Boat ব্যবহার করে যেটা ছিল আসলে একধরনের আধুনিক সাবমেরিন। এই সাবমেরিন ব্যবহার করে তারা জলপথে ব্রিটিশদের উপর হামলা করতে থাকে।
তারা ব্রিটিশদের রসদ ভরা জাহাজকে সাগরে ডুবিয়ে দেয় এই সাবমেরিনের সাহায্যে। যেকোনো জাহাজ, যেটা ব্রিটেনের দিকে যায় তাদেরকেই লক্ষ্য করে আঘাত হানতো। একবার এমন যাত্রী বোঝাই একটি জাহাজ, নাম Lusitania যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রিটেনে যাচ্ছিলো। এই জাহাজকে জার্মান U-Boat ধ্বংস করে দেয় যেখানে ১,০০০ যাত্রী মারা যায়। যাত্রীদের মধ্যে বেশীরভাগ যাত্রীই ছিল আমেরিকান। এর ফলে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ করার একটি মুহূর্ত চলে আসে। এর সাথে জার্মানির বিরুদ্ধে একটি ক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি হয়। যদিও পরে জার্মান কাইজারের আদেশে U-Boat সরিয়ে নেয়া হয়।
ফকল্যান্ড যুদ্ধ ছাড়াও জলপথে আরেকটি যুদ্ধ হয় যাকে বলা হয় Battle of Jutland। জার্মানদের লক্ষ্য একটাই- যেভাবেই হোক যুদ্ধে জেতা। তাই সাগরে ভেড়ানো যুদ্ধজাহাজগুলোকে একসাথে যুদ্ধে নামাতে হবে। তাদের ইচ্ছা ছিল সাবমেরিন এবং অন্যান্য যুদ্ধ জাহাজ দিয়ে ব্রিটিশদেরকে ভড়কে দেওয়া। ১৯১৬ সালের ৩০ মে, জার্মান একটি নৌ বহর তাদের বন্দর থেকে রওনা দেয়। অপরদিকে ব্রিটিশরাও তাদের নৌ বহর নিয়ে রওনা দেয়। ব্রিটিশদের নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাডমিরাল জেলিকো।
দুই দেশের নৌ বহর ছিল মোট ২৫৯টি। তারা ডেনমার্কের সমুদ্রতীরে যুদ্ধে সামিল হয়, যাকে জাটল্যান্ড ব্যাটেল বলা হয়। কিন্তু যুদ্ধের সময়কার আবহাওয়া তেমন অনুকূলে ছিল না। চারদিকে ধোঁয়া এবং কুয়াশার কারণে সেদিনকার এক ভয়াবহ যুদ্ধের সাক্ষী হতে হয়নি পৃথিবীবাসীকে। ফিরে আসার পর দেখা যায়, ব্রিটিশদের ১৪টি নৌযান এবং ৬,০০০ জন সৈনিক নিহত হয়েছে। অপরদিকে জার্মানদের ১১টি নৌযান এবং ২,৫০০ জন সৈনিক নিহত হয়েছে। এই যুদ্ধের থেকে বোঝা যায় যে, ব্রিটিশদের নৌবাহিনীতে আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষার এবং প্রয়োগের অভাব ছিল। তাদের নৌবাহিনীর সংকেত দান, নৌতরীতে তৈরি অস্ত্রাগার পরিচালনায় ভুল ছিল। এরপরও উত্তর সাগরের পুরোটাই ব্রিটিশদের অধীনে ছিল, সেখান থেকে তাদেরকে সরানো যায়নি।
এরপর জার্মানরা তাদের সাবমেরিন U-Boat দিয়ে জলপথে আসা প্রায় সবকিছুই ধ্বংস করে দেয়। এই U-Boat দিয়ে জার্মানরা ব্রিটিশদের প্রায় ৬০০টি জাহাজ জলপথে ধ্বংস করে দেয়, বেশিরভাগ জাহাজই ছিল ব্রিটিশদের বাণিজ্য জাহাজ। ব্রিটিশদের খাবার আনা নেয়ার জাহাজগুলোকেও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিলো কিন্তু তার জন্য জার্মানদের মতো খাদ্য সংকটে তাদেরকে পড়তে হয়নি।
এমন সময় ব্রিটিশ সরকারে পরিবর্তন আসে এবং তাদের নৌ পরিবহণের নেতৃত্বও পরিবর্তন হয়। নতুন অ্যাডমিরাল নতুন নিয়ম তৈরি করেন। ব্রিটিশরা তখন তাদের বাণিজ্য জাহাজগুলোকে নিরাপত্তার সাথে ব্রিটেনে নেওয়ার জন্য কনভয় বা রক্ষীবাহিনী পাঠায়। অন্য জাহাজ নিরাপত্তা দিতে দিতে বাণিজ্য জাহাজগুলোকে ব্রিটিশ বন্দরে পৌঁছাবে- এটাই ছিল উদ্দেশ্য।
যদিও কনভয় পাঠানোর পর সেগুলো যে জার্মানির খুব বেশী U-Boat কে ধ্বংস করতে পেরেছিলো তা নয় কিন্তু তাদের জন্য ব্রিটিশ জাহাজকে আক্রমণ করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ কনভয়ের সাথে সমস্ত বাণিজ্য জাহাজ একসাথে রওনা দিতো। ফলে ব্রিটিশদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয় এবং আগে যে ক্ষতি হয়েছিলো সেগুলোও অনেকাংশে সেরে উঠে। যদিও ব্রিটেন এবং জার্মানির মধ্যে খুব বড় বড় যুদ্ধ হয়নি, কিন্তু এই জলপথের যুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তথ্যসূত্রঃ
[১] Making History – World History from 1914 to the Present – Christopher Culpin.
[২] The World Crisis – Winston Churchill
[৩] প্রথম বিশ্বযুদ্ধ- সাহাদত হোসেন খান, আফসার ব্রাদার্স, ঢাকা
ফিচার ইমেজ – Royal Navy.com