মিসা অ্যাণ্ড দ্য অরফ্যানস অফ ওয়ার
১৯৪৯-১৯৫৪
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পারমাণবিক বোমা হামলার ধ্বংসের চিহ্ন তখনও মুছে যায়নি। এরই মাঝে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় আরেকটি যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। এবার গণ্ডগোল বাধে নাগাসাকি থেকে মাত্র ১৫০ মাইল (২৪০ কিলোমিটার) দূরে অবস্থিত কোরিয়ায়, পুরো কোরিয়ান প্রণালী অঞ্চল জুড়ে।
আবারও এমন যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখে বাবা খুব শংকিত হয়ে পড়লেন। কারণ, সর্বশেষ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে তখনও সাচিকোর পরিবার ঠিকমতো উঠে দাঁড়াতে পারেনি। তবে, ১৯৫০ সাল নাগাদ এই বিবাদ যখন কোরীয় যুদ্ধের রুপ নিলো, তখন প্রকৃতপক্ষে লাভবান হলো জাপানের অর্থনীতিই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশটির সেনাসদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় জুতা, পোশাক, যন্ত্রাংশ ও অস্ত্রশস্ত্র বানানোর দায়িত্ব দেয়া হলো জাপানকেই। এরই সূত্র ধরে জাপানের ছোটখাট একটি ব্যাংকে চাকরি হয়ে গেলো বাবার।
পরিবারের অবস্থার উন্নতির জন্য মা-ও একটি আইডিয়া বের করলেন। তিনি রুটি বানিয়ে তাতে শিমের আচার ভরে বাজারে বিক্রি করতে শুরু করলেন। সকালবেলায় স্কুলে যাবার আগে সাচিকোর কাজ ছিলো সেই রুটিগুলো বাজারে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।
স্কুলের পর সাচিকো আরেকটি কাজ করতো। সে ধৈর্য ধরে সাকামোতো সিমেট্রির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতো। বোমা হামলার পর সপরিবারে তারা এখানেই আশ্রয় নিয়েছিল। স্যানো মঠ এখান থেকে খুব কাছেই ছিল, খালি চোখেই দেখা যেত। সেই সাথে দেখা যেত এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পাথুরে গেট এবং কর্পূর গাছগুলোকেও।
একজন, দুজন করে পাহাড়ি পথ বেয়ে বাচ্চারা একে একে সাচিকোর কাছে আসতো। তাদের বয়স ছিলো সাত থেকে দশ বছরের মাঝেই। অপুষ্টিতে ভোগা সেই ছেলেমেয়েদের সকলের গায়েই থাকতো ময়লা মাখা, পুরনো জামাকাপড়। এদের সবাই যুদ্ধে বাবা-মাকে হারিয়েছিলো। একা একা কিংবা দলবেধে থাকতো তারা। জুতা পালিশ করে, সিগারেটের অবশিষ্টাংশ কুড়িয়ে পুনরায় বিক্রি করে কিংবা চুরি করেই পেট চালাতো তারা। তাদের না ছিল কোনো থাকার জায়গা, না ছিল যত্নআত্তি করার কোনো মানুষজন। তাদেরকে স্কুলে পাঠানোর জন্যও ছিল না কেউ।
বাচ্চাকাচ্চারা সবাই সাচিকোকে ঘিরে মাটিতে বসে পড়তো, আর সাচিকোও তাদেরকে পড়াতে শুরু করতো। সে অনেকগুলো পেরেক জমিয়েছিল। সেগুলোই বাচ্চাদের হাতে তুলে দিত। তারা নরম মাটিতে লেখালেখি করতো, আর সাচিকো সেসময় নানা রকম নির্দেশনা দিত। তারা তাদের নাম লেখা, যোগ-বিয়োগ করা শিখতো। তাদের কাজে সন্তুষ্ট না হলেই সে বলে উঠতো, “আবার লেখ“, ঠিক যেভাবে মা-ও তাকে বারবার লেখাতেন। বাচ্চারাও তখন আগের লেখাটি ঘষে মুছে নতুন করে লিখতো।
একদিন সে হঠাৎ তাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, “আচ্ছা, বোমাটা যখন বিষ্ফোরিত হলো, তখন তোমরা কোথায় ছিলে?” বাচ্চাগুলো তার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলো। কারণ সেই সময়ের কথা তারা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। কেবলমাত্র চিরতরে হারিয়ে ফেলা মা-বাবা, ভাই-বোনের মতো মানুষগুলোর কথাই তাদের মনে ছিল।
কী হতো যদি সেদিন সাচিকোও তারা বাবা-মাকে হারিয়ে ফেলতো। প্রশ্নটা নিজেকে জিজ্ঞেস করার কোনো দরকার ছিলো না সাচিকোর। উত্তরটা জানা ছিলো তার।
মা-বাবার কাছ থেকে শেখা কোন জিনিসগুলো তাদেরকে শেখাবে সে? তাদের কাছ থেকে শেখা কোন জিনিসগুলো আজীবন মনে রাখার মতোই ছিলো? কিছুক্ষণ ভেবে এরপর বাচ্চাদেরকে নিজের আশেপাশে বসাতো সে, তারপর বলতে শুরু করতো,
“পুরো বিশ্বে আমাদের থাকার জন্য কেবলমাত্র এই জায়গাটিই রয়েছে।
ঘৃণা থেকে কেবলমাত্র ঘৃণারই জন্ম হয়।
পরিস্থিতি ভালো কিংবা খারাপ যা-ই হোক না কেন, সবসময় নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে চলবে।
তোমার মনে কখনো কাউকে কালি লাগাতে দেবে না।
পড়াশোনা করো।
নতুন নতুন জিনিস শেখো।
স্যার-ম্যাডামদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। তারাই তোমাদের সঠিক পথের সন্ধান দেবেন।”
… … … …
সাচিকোর ভাবনার জগতে কেবলমাত্র এই এতিম শিশুরাই ছিলো না। ছোটবোন মিসাকে নিয়েও সে বেশ দুশ্চিন্তার মাঝে ছিলো। ন’বছর বয়সী মিসা এতটাই অসুস্থ ছিলো যে, স্কুলে যাওয়া-আসার মতো শারীরিক শক্তি পর্যন্ত মেয়েটির ছিল না।
পারমাণবিক বোমা হামলার পর প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেলেও তখনও অনেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এবং শিশু এর পরিণাম ভোগ করছিলো। মানবদেহের উপর এর প্রভাব নিয়ে কোনো লেখাই প্রকাশ করতে দেয়া হতো না। কিন্তু এর দ্বারা তো আর ক্লান্তি, মাথা ঘোরানো, অসাড়ভাব, নিদ্রাহীনতা ও ক্যানসারের মতো সমস্যা, যা প্রকৃতপক্ষে বিকিরণের জন্যই হয়েছিল, মুছে ফেলা সম্ভব না।
মিসা আক্রান্ত হয়েছিল লিউকেমিয়াতে। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটির জন্য তাদের বাবা-মা কী-ই বা করতে পারতেন? চিকিৎসা করানোর মতো যথেষ্ট অর্থ তাদের হাতে তখন ছিলো না, আবার এমন কারো কথাও তারা জানতেন না, যার মাধ্যমে এ সমস্যার কোনো একটা সমাধান আসতে পারে। তাই তারা রাত-দিন কেবল দুশ্চিন্তা করেই যেতেন।
একই কাজ করতো সাচিকোও। রাস্তাঘাটের এতিম ছেলেমেয়েগুলোকে কীভাবে সাহায্য করতে হয় তা সে জানতো, কিন্তু আপন বোনকে কীভাবে আনন্দে রাখা যায় সেই উপায়ই সে খুঁজে পাচ্ছিলো না। বাচ্চাগুলোকে পড়িয়ে বাসায় ফিরবার পর সারাদিন স্কুলে শেখা সবগুলো গানই মিসাকে শেখাতো সাচিকো। মিসা বলেছিল, গান গাওয়ার সময়ই তার নিজেকে সবচেয়ে বেশি সতেজ মনে হয়।
একসাথে গান গাইতো দু’বোন। ওদিকে গাইতে গাইতেও চিন্তা করতো সাচিকো, আর কী করলে বোনটার মুখে এক চিলতে হাসি ফোটানো যাবে!
… … … …
এভাবেই চারটি বছর পার হয়ে গেলো। মিসাও বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, চলে গিয়েছিল মৃত্যুশয্যায়। বোনের জন্য কিছু করতে পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিল সাচিকো। যদি সে মিসাকে একটি ইচ্ছাপূরণের সুযোগ দিতো, তাহলে সে কী বেছে নিতো? কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে একটি বুদ্ধি আসলো সাচিকোর মাথায়। তাই সে আলাপ সেরে আসলো তাদের স্কুলের মিউজিক টিচারের সাথে।
এরপর যেদিন মিউজিক ক্লাস ছিলো, সেদিন সাচিকো গিয়ে মিসার মাদুরের সামনে উবু হয়ে বসলো। মিসাও হাত বাড়িয়ে, সাচিকোর গলার দু’পাশে হাত দুটো ভালোভাবে জড়িয়ে তার পিঠে উঠে পড়লো! জীবনে প্রথমবারের মতো সত্যি সত্যিই মিসা স্কুলে যাচ্ছিলো!
সাচিকো ক্লাসে পৌঁছানোর পর দেখা গেলো, বসে থাকবার মতো শক্তিও জড় করতে পারছে না মিসা। তাই তাকে পিঠ থেকে নামাবার সময় সাচিকোর বন্ধুবান্ধবেরা তাড়াতাড়ি বেশ কয়েকটি চেয়ার আনার ব্যবস্থা করলো, যাতে করে মিসা সেখানে শুয়ে পড়তে পারে।
মিউজিক ক্লাস শুরু হলো। সবাই গান গাচ্ছিলো। আর সবার সাথে গলা মিলিয়ে মিসাও দুর্বল, কোমল গলায় গেয়ে চলছিলো। অবশেষে মিসার স্বপ্ন পূরণ হলো।
ক্লাস শেষে আবার পিঠে চড়িয়েই মিসাকে নিয়ে বাড়িতে আসলো সাচিকো। বোনের মাদুরের পাশে বসে তার হাত-মুখ ধুইয়ে দিলো সে। এরপর হাতে নিলো তার হাতটা।
খুব ধীরে ধীরে সাচিকোর দিকে ফিরে মিসা বলে উঠলো, “ধন্যবাদ।” বিড়বিড় করে কথাগুলো বললো সে। এটাই ছিল তার শেষ কথা!
স্কুলে একটি বিশেষ, আনন্দময় দিন পার করার পর সাচিকোর ছোট বোনটিও চিরতরে পরপারে পাড়ি জমালো। তোশি, আকি, ইচিরো, মামা, আর এখন মিসা! সাচিকো একেবারে অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়লো। মনে হচ্ছিলো, জালে আটকা পড়ে সে যেন কেবল মৃত্যুর জন্যই অপেক্ষা করছে।
কাঁদতে চাইলো সাচিকো, কিন্তু চোখের পানিও ততদিনে শুকিয়ে গেছে তার।