গুজরাট থেকে মুঘলদের পলায়ন: মুঘল সাম্রাজ্যের চরম লজ্জাজনক একটি পরিণতি

১৫৩৫ সালের মাঝামাঝির দিকে বাহাদুর শাহকে গুজরাট থেকে বিতাড়িত করার পর হুমায়ুন তার সৎ ছোটভাই আসকারি মির্জাকে গুজরাটের শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করলেন। অন্যদিকে, বাহাদুর শাহ তখন সম্রাট হুমায়ুনের তাড়া খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে দিউতে গিয়ে থিতু হয়েছেন। তিনি পর্তুগীজদের সাথে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার চিন্তা করছিলেন।

সম্রাট হুমায়ুন বাহাদুর শাহকে তাড়া করতে দিউ-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেও থেমে যেতে বাধ্য হন। কারণ, রাজধানীতে তার দীর্ঘ অনুপস্থিতি অনেক সুযোগসন্ধানীকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে উৎসাহ যুগিয়েছে। তাছাড়া মুঘল সীমানার পূর্বদিকে ক্রমেই শের খান শক্তিশালী হয়ে উঠছিলেন। এটাই হুমায়ুনের মাথাব্যথার মূল কারণ ছিলো। আর তাই তিনি দ্রুত গুজরাট অভিযান সমাপ্ত করে আগ্রায় ফিরে যেতে চাচ্ছিলেন।

দিউ ফোর্ট; Source: Youtube

হুমায়ুন আর শের খানের এই সম্পর্কের টানাপোড়নে লাভবান হলেন গুজরাটের সাবেক সুলতান বাহাদুর শাহ।

এদিকে সদ্য বিজিত গুজরাটের দায়িত্বভার আসকারি মির্জার হাতে দেয়া ছাড়া হুমায়ুন গুজরাটে আক্ষরিক অর্থে আর কোনো পরিবর্তন আনেননি। তিনি হয়তো তার ভাইয়ের উপর ভরসা করেছিলেন। কিন্তু আসকারি মির্জা তার উপর এই ভরসার মর্যাদা রাখতে পারেননি। দায়িত্বপ্রাপ্তির প্রথম তিন মাস তিনি গুজরাটের প্রশাসক হওয়া উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসব, দাওয়াত নিয়েই ব্যস্ত রইলেন, যতদিন না ক্ষোভে গুজরাটিরা গণআন্দোলন শুরু করলো!

যে সময় আসকারি মির্জার উচিত ছিলো দ্রুত দক্ষভাবে গুজরাটের প্রশাসন গুছিয়ে ফেলা, সেসময় তিনি আমিরদের সাথে ভোগবিলাসে ব্যস্ত রইলেন। আর হুমায়ুন তার স্বভাবসিদ্ধ ডুব মারলেন মাণ্ডুতে বসে। সাম্রাজ্যের পূর্বদিকে যে শের খান ক্রমেই হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠছে, তিনি যেন তা বেমালুম ভুলে গেলেন!

এদিকে আসকারি মির্জা তার ব্যক্তিত্ব আর প্রভাব কাজে লাগিয়ে না পারলেন গুজরাটিদের খুশি করতে, না পারলেন তার অধীনস্থ মুঘল আমিরদের খুশি করতে। তিনি এ আমিরদের সাথে তার কর্মচারীর মতো আচরণ করতেন, ফলে এ মুঘল আমিররা স্বল্প সময়েই তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। তারা আসকারি মির্জাকে খুব একটা মূল্যায়ন করতো না। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ কোনো নির্দেশ কিংবা আদেশ হুমায়ুনের সরাসরি নির্দেশ ছাড়া মানতো না।

আর অন্যদিকে, গুজরাটের জনগণ সত্যিকার অর্থেই বাহাদুর শাহকে ভালোবাসতো আর তাদের শাসনকর্তা হিসেবে মনে-প্রাণে তাকেই আশা করতো।

যেকোনো বাইরের শক্তি যখন কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল দখল করে নেয়, তখন তাদের প্রথম কাজই হয় যেকোনো মূল্যে ঐ অঞ্চলের মানুষদের খুশি রাখা। তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আর উন্নয়নের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতে হয় কেন তারা আগের শাসকের চেয়ে উত্তম। আসকারি মির্জার নেতৃত্বে মুঘলরা এই কাজটি না করে ভুল কাজই করলেন। গুজরাট বিজয়ের তিন মাসের মধ্যে তারা গুজরাট কিংবা গুজরাটের জনগণ সংশ্লিষ্ট কোনো কাজেই হাত দিলেন না। ফলে গুজরাটের জনগণের মাঝে চাপা ক্ষোভের জন্ম নিলো।

আর এই ক্ষোভের উদগীরণ শুরু হলো নওসারি থেকে। বাহাদুর শাহের আমির নূরউদ্দিন খান জঁহা সিরাজি নওসারির মুঘল প্রশাসক আবদুল্লাহ খাঁ উজবেককে বিতাড়িত করে নওসারির দখল বুঝে নিলেন। এই ঘটনায় স্থানীয় জনগণও উৎসাহিত হয়ে গুজরাটের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুঘল বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে লাগলো। বিদ্রোহীরা রুমি খাঁ সফরের সাহায্য নিয়ে প্রথমেই সুরাট অধিকার করে নিলো। ফলে সমুদ্র দিয়ে সাহায্য পাওয়ার রাস্তাও বিদ্রোহীদের জন্য খুলে গেলো। এরপর নূরউদ্দিন খান জঁহা সিরাজি আর রুমি খাঁ সফর একযোগে ভরৌচ আক্রমণ চালালেন। ভরৌচের কাসিম হুসেন খাঁ তাদের প্রতিহত করতে না পেরে চাম্পানীর দিকে ছুটলেন। বাহাদুর শাহের আরেক আমির সৈয়দ ইসহাক ক্যাম্বে দখল করে নিলেন। মালিক সৈয়দ আহমেদ লাড বরোদা থেকে বিতাড়িত করলেন দোস্ত ইশাক বেগ আকাকে।

মুঘলদের মাথার উপড়ে যেন মূহুর্তের মাঝেই গোটা আকাশ ভেঙে পড়লো!

তবে, গুজরাটে মুঘলদের এই চরম দুঃসময়েও ইয়াদগার নাসির মির্জা পাটন ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু আসকারি তাকে আহমেদাবাদে চলে আসার নির্দেশ দিলে তিনি পাটন ছেড়ে আসতে বাধ্য হন। খুব সহজেই গুজরাটিরা পাটন পুনরুদ্ধার করে নিলো।

এসময় আহমেদাবাদ, চাম্পনীর আর মাণ্ডু ছাড়া মুঘলদের হাতে গুজরাটের আর কোনো এলাকাই ছিলো না!

চারদিক থেকে যখন শুধুমাত্র বিপর্যয়ের সংবাদই আসছিলো, আসকারি মির্জা আর হিন্দু বেগ তখন প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন হুমায়ুনের সাথে যোগাযোগ করতে। হুমায়ুন তখন মাণ্ডুতে তার রাজকীয় ঘাটিতে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু তিনি তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে কোনো সাড়া দিলেন না। তিনি তার স্বভাবমতো চুপচাপ থেকে নিজেকে নিয়ে মেতে রইলেন।

গুজরাটে মুঘলদের দুরবস্থা দেখে দিউ বন্দরে বসে একজন ঠিকই হাসছিলেন। তিনি হলেন গুজরাটের সাবেক শাসক বাহাদুর শাহ। তিনি এই দিনটির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আজ সেই সুযোগ তার হাতে ধরা দিয়েছে। তিনি দিউ থেকে বেরিয়ে এসে সরখেজে তার রাজকীয় তাবু ফেললেন।

গুজরাটের বাহাদুর শাহ; Source: historydiscussion.net

এদিকে গুজরাটের মুঘল দরবারের অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। মুঘল আমিরদের বেশিরভাগই পারস্পরিক মতভেদ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। গুজরাটের জনগণের এই অসহযোগ আন্দোলনে তারা কার্যত কোনো ভূমিকাই রাখতে পারলেন না। আসকারি মির্জা বুঝে গেলেন, তাকে দ্রুতই আহমেদাবাদ ছাড়তে হবে। তিনি গুজরাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুঘল সৈন্যদের জড়ো করে চাম্পানীরের দিকে অগ্রসর হলেন।

চাম্পানীরের দিকে মুঘল সেনাবাহিনীর এই চরম লজ্জাজনক অবস্থায় পালিয়ে যাওয়ার সময় আসাবল নামক স্থানে বাহাদুর শাহের সাথে আসকারি মির্জার দেখা হয়ে গেলো। দুই বাহিনী তিনদিন মুখোমুখি পড়ে রইলো।

বাহাদুর শাহ প্রথমেই আক্রমণ চালাতে চাইলেন না। কারণ তিনি মুঘলদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি জানেন, যোগ্য নেতৃত্ব পেলে এরা কী করতে পারে। কিন্তু আসকারি মির্জা যুদ্ধের ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখালেন না। তিনদিন পর তিনি তার তাবু গুটিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সড়ে আসলেন।

বাহাদুর শাহ হতভম্ব হয়ে আসকারি মির্জার কান্ডকারখানা দেখছিলেন। তিনি ভাবতেও পারেননি, মুঘলরা এভাবে চরম অবমাননা স্বীকার করে যুদ্ধক্ষেত্রে ত্যাগ করবে!

তবে নিজেকে সামলে নিয়ে মুঘল সেনাবাহিনীকে ধাওয়া করতে ভুল করলেন না তিনি। মুঘলদের পশ্চাৎভাগে আক্রমণ চালাতে একটি বাহিনী প্রেরণ করলেন তিনি।

মুঘল সেনাবাহিনীর পেছনভাগের নেতৃত্বে ছিলেন ইয়াদগার নাসির মির্জা। অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও মূল বাহিনীকে অক্ষত অবস্থায় তিনি এ পরিস্থিতি থেকে টেনে বের করে আনতে পেরেছিলেন। শেষপর্যন্ত আসকারি মির্জা আর তার নেতৃত্বাধীন মুঘল সেনাবাহিনী চাম্পানীরে আশ্রয় চাইলেন।

এ সময় চাম্পানীরের মুঘল গভর্নর ছিলেন তরদী বেগ। তরদী বেগ আসকারি মির্জাকে আশ্রয় দিলেন।

চাম্পানীরে আশ্রয় নিয়েই আসকারি মির্জা তরদী বেগের নিকট কোষাগার থেকে অর্থ চাইলেন। কারণ হিসেবে বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন কাজের কথা বললেন। হুমায়ুন তখন মাণ্ডুতেই অবস্থান করছিলেন। তাই তরদী বেগ জানালেন, সম্রাটের অনুমতি ছাড়া তিনি কোষাগার থেকে কোনো অর্থ ছাড় করাতে পারবেন না।

এদিকে তরদী বেগ হুমায়ুনের নিকট বার্তা পাঠিয়ে হুমায়ুনকে এদিকের পরিস্থিতি সম্পর্কে সব জানিয়ে রাখলেন। সেই সাথে তিনি এটাও জানালেন, আসকারির মতিগতি তার ভালো লাগছে না। আসকারি সম্ভবত আগ্রার দিকে নজর দিতে যাচ্ছে।

চাম্পানীরের প্রথম মসজিদ ‘শহর কা মসজিদ’;  Source: sandeepachetan.com

তরদী বেগকে কোনোক্রমেই বাগে আনতে না পেরে আসকারি মির্জা তাকে বন্দী করার পরিকল্পনা করতে থাকেন। কিন্তু পরিকল্পনাটি ধরা পড়ে গেলে তরদী বেগ আসকারি মির্জাকে চাম্পানীর থেকে বহিষ্কার করেন। নিজেরই অধীনস্থ একজন আমিরের দ্বারা অপমানিত ও বিতাড়িত হয়ে আসকারি মির্জা তার বাহিনী নিয়ে সোজা আগ্রার দিকে ছুটতে থাকেন।

এদিকে হুমায়ুন যখন তার রাজধানী অভিমুখে আসকারির অগ্রযাত্রার সংবাদ শুনতে পারেন, তখন তার নিদ্রাভঙ্গ হয়। তিনি দ্রুতই আগ্রার দিকে যাত্রা করেন। আসকারির আগে আগ্রা পৌঁছাতে না পারলে তিনি বেশ ঝামেলাতেই পড়ে যাবেন।

চাম্পানীর থেকে মাণ্ডু, দূরত্ব মাত্র ২৪৪ কিলোমিটার; Source: Google Maps

এদিকে গুজরাটিদের এই প্রতিরোধের মুখে তরদী বেগ চাম্পানীরে মোটামুটি নিশ্চিন্তেই অবস্থান করছিলেন, কারণ কাছেই মাণ্ডুতে তার সম্রাট অবস্থান করছিলো। কিন্তু হুমায়ুন আগ্রার দিকে ছুটে গেলে তিনি বুঝে যান চাম্পানীরও মুঘলদের হাত থেকে ফসকে বেড়িয়ে গেলো। তিনিও দ্রুত আগ্রার পথ ধরলেন।

বাহাদুর শাহ নিশ্চিন্তে উল্লেখযোগ্য কোনো লড়াই ছাড়াই ১৫৩৬ সালের ২৪ মে চাম্পানীর দখল করে নিলেন। গুজরাটে মাত্র ১৩ মাসের মুঘল শাসনের অবসান ঘটলো। এবং তা-ও এতটা সহজেই সম্ভব হলো! এ ছিলো সমগ্র মুঘল সালতানাতের জন্য চরম লজ্জাজনক একটি ঘটনা।

চাম্পানীরের একটি প্রবেশদ্বার; Source: sandeepachetan.com

এদিকে চাম্পানীর অধিকার করে বাহাদুর শাহ উদারতার একটি নজির স্থাপন করলেন। দুর্গে যেসব মুঘল কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়ে গিয়েছিলো, বাহাদুর শাহ তাদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার তো করলেনই, এমনকি আগ্রা ফেরত যাওয়ার জন্য তাদের পোষাক, বাহন আর প্রয়োজনীয় অর্থও দিয়ে দিলেন। বাহাদুর শাহ যেন হুমায়ুনকে চোখে আঙুল দিয়ে হুমায়ুনের মাণ্ডুতে তার চুক্তিভঙের ঘটনাটি মনে করিয়ে দিলেন।

চাম্পানীর প্রাচীরের একাংশ; Source:  sandeepachetan.com

প্রশ্ন হচ্ছে, প্রচণ্ড শক্তিশালী মুঘল সাম্রাজ্যকে তার দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী থাকা সত্ত্বেও গুজরাট থেকে কেন এত লজ্জাজনকভাবে পিছু হটতে হলো?

এর পেছনে আসলে এককভাবে কোনো কারণকে দায়ী করা সম্ভব নয়। গুজরাটে মুঘল সাম্রাজ্যের এই লজ্জাজনক পরিণতির পেছনে অনেকগুলো কারণই দায়ী।

প্রথমেই এই লজ্জাজনক পশ্চাৎপসরণের কারণ হিসেবে মাণ্ডুর ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়। মাণ্ডুতে বাহাদুর শাহের সাথে চুক্তির পরও পরিস্থিতির কারণে মুঘলরা বাহাদুর শাহের উপর আক্রমণ চালিয়ে দেয়। প্রচুর গুজরাটি এই ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন।

মাণ্ডু ফোর্টের একাংশ ; Source: mptourism.com

আর তাই এই ঘটনার পর থেকে গুজরাটিরা মুঘলদের বিশ্বাস করত না। এমনকি মুঘলদের প্রতি তাদের স্বাভাবিক সম্মানবোধটুকুও উঠে গিয়েছিলো।

অন্যদিকে, হুমায়ুন আহমেদাবাদ ত্যাগের পূর্বে আসকারি মির্জাকে গুজরাটের মুঘল প্রশাসক আর তার অধীনস্থ কিছু আমির নিয়োগ দেয়া ছাড়া গুজরাটে উল্লেখযোগ্য কোনো সংস্কারই করেননি। না রাজনৈতিক, না অর্থনৈতিক। আসকারি মির্জা গুজরাটের প্রশাসক হওয়ার পর গুজরাটের জনকল্যাণে কিছুই না করে উৎসব-আনন্দে মেতে রইলেন।

গুজরাটের জনগণের চাপা ক্ষোভের ছাইয়ে আগুন ধরিয়ে দিতে তার এই কাজগুলোই যথেষ্ট ছিলো।

একদিকে বাহাদুর শাহ তখনও জীবিত এবং যেকোনো মুহূর্তে শক্তি সঞ্চয় করে গুজরাট পুনরুদ্ধার করতে পারেন, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছিলো না। বাহাদুর শাহ এটি করার চেষ্টা করলে গুজরাটের জনগণের সহায়তা অবশ্যই পাবেন। গুজরাটের জনগণ তাদের সুলতানকে অনেক ভালোবাসতো। অন্যদিকে, আসকারি মির্জার উচিত ছিলো তার নতুন প্রজাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের আনুগত্য আদায় করা। কিন্তু তিনি তা করার ন্যূনতম চেষ্টাও করলেন না।

গুজরাটের এই লজ্জাজনক পরিণতির পেছনে মুঘল সাম্রাজ্যের অভিভাবক হিসেবে হুমায়ুনের ভূমিকাও কম ছিলো না। তিনি গুজরাটের প্রশাসনিক কাজে বিন্দুমাত্র আগ্রহও প্রদর্শন করেননি। তার অনাগ্রহের এই মাত্রা এতটাই প্রকট ছিলো যে, চাম্পানীরে প্রাপ্ত সম্পদ আগ্রায় পাঠানোর আদেশ দেয়ার প্রয়োজনটুকুও তিনি অনুভব করেননি। পরে এই সম্পদের বিশাল একটি অংশ পুনরায় বাহাদুর শাহের হাতে গিয়ে পড়েছিলো।

‘বাবরনামা’-তে অঙ্কিত হুমায়ুনের একটি চিত্র; Source: Wikimedia Commons

গুজরাটে এই ঘটনার পেছনে মুঘল গোয়েন্দাদের ব্যর্থতাও কোনো অংশে কম ছিলো না। তারা গুজরাটের গণআন্দোলনের ব্যাপারে তাদের শাসকদের কোনোরুপ আগাম সতর্কতা দিতে পারেননি।

এছাড়াও, গুজরাটে মুঘল সাম্রাজ্যের এই লজ্জাজনক সমাপ্তির কারণ হিসেবে বাহাদুর শাহের প্রতি হুমায়ুনের আচরণকেও অনেক ঐতিহাসিক দায়ী মনে করেন। হুমায়ুন যদি বাহাদুর শাহকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করে কাছে টেনে নিতেন, তাহলে বাহাদুর শাহ আজীবনের জন্য মুঘলদের সহযোগী হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু পরিস্থিতি সময়ের দুই মহান এই নৃপতিকে পুরোপুরি উল্টো দিকে ঠেলে দেয়।

দিল্লির যাত্রাপথে তরদি বেগ সম্রাট হুমায়ুনের সাথে মিলিত হয়ে একসাথে আগ্রা অভিমুখে যাত্রা করতে লাগলেন। চিতোরের কাছাকাছি হুমায়ুনের সাথে আসকারি মির্জার দেখা হলো। হুমায়ুনের কী মনে করে যেন আসকারি মির্জাকে ক্ষমা করে দিলেন। অবশ্য এক্ষেত্রে মুঘল হেরেমে সম্রাটের সম্মানিত আত্মীয়দের প্রভাবও ছিলো।

সম্রাট হুমায়ুন শুধু আসকারি মির্জাকে ক্ষমা করেই ক্ষান্ত হননি, বরং তিনি আসকারির সমস্ত আমিরকেও ক্ষমা করে দিলেন। মূলত তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণেই গুজরাট এত সহজে মুঘলদের হাত ফসকে বেড়িয়ে গেলো।

এখন দেখা যাক, সমকালীন ঐতিসাহাসিকরা আসকারির এই ধরনের আচরণকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন। আবুল ফজল, নিজাম উদ্দিন, ফিরিশতা, বদায়ূনীসহ সমকালীন অন্যান্য ঐতিহাসিকেরা মত দিয়েছেন, আসকারি অবশ্যই আগ্রা অধিকার করার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তিনি সময় এবং পরিস্থিতির অভাবে সে সুযোগ পাননি।

ফিরিশতা আসকারি প্রসঙ্গে লিখেছেন,

আসকারি চাম্পানীর আর গুজরাটের অন্যান্য অংশ দখল করে নিজের নামে খুতবা পড়াতে আর নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করতে চাচ্ছিলেন।

বদায়ূনী লিখেছেন,

আসকারি হিন্দু বেগের সহায়তায় নিজের নামে খুতবা পড়াতে চাচ্ছিলেন।

অর্থাৎ, তিনি নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করতে চাচ্ছিলেন।

নিজাম উদ্দিন অবশ্য আসকারির এই আচরণের কারণ হিসেবে তরদী বেগকে দায়ী করেছেন। তিনি লিখেছেন, আসকারি যখন তার সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ চাচ্ছিলেন, তখন তরদী বেগ তো তাকে তা দিলেনই না, বরং হুমায়ুনের কাছে তিনি আসকারি বিদ্রোহ করতে পারে, এই মর্মে একটি পত্র পাঠালেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়েই আসকারি আগ্রা দখল করতে ছুটে যাচ্ছিলেন। তারিখ-ই-গুজরাতের লেখক আবু তুরাবও একই মত দিয়েছেন।

সমকালীন ঐতিহাসিকদের থেকে প্রাপ্ত এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে ‘মোগল সম্রাট হুমায়ুন’ গ্রন্থের লেখক ডক্টর হরিশংকর শ্রীবাস্তব বলেছেন,

আসকারির আচরণ খুব একটা দোষের ছিলো না। তিনি গুজরাটে একরকম অপমানিত হয়েই আহমেদাবাদ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাহাদুর শাহের মুখোমুখি হয়েও যুদ্ধ না করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। তিনি তার এই অপমানের উপযুক্ত জবাব দেয়ার চেষ্টা করছিলেন।

আর তাই সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে তার প্রয়োজন ছিলো অর্থের। তিনি খুব সহজেই গুজরাট হারিয়েছিলেন, তাই তিনি আশা করছিলেন খুব সহজেই আবার একে পুনরুদ্ধার করে তার সম্মান ফিরে পাবেন।

তাই তিনি চাম্পানীরে তারই অধীনস্থ গভর্নরের নিকট রাজকোষের অর্থ চাইলেন। কিন্তু তরদী বেগ অর্থ দিতে অস্বীকার করে বসেন, এমনকি বিষয়টি হুমায়ুনকেও জানিয়ে দেন। আসকারি মির্জা এতে আরো বেশি অপমানিত বোধ করলেন।

আসকারি গুজরাটের গভর্নর ছিলেন, আর তরদী বেগ ছিলেন তারই অধীনস্থ একজন আমির। তাই তিনি আশা করতেই পারেন, তরদী বেগ তার সমস্ত আদেশ মেনে নিবেন। কিন্তু তরদী বেগ এর ধারেকাছে দিয়েও গেলেন না। রাগান্তিত হয়ে আসকারি মির্জা তাকে বন্দী করে রাজকোষ দখলের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এই পরিকল্পনাটি ফাঁস হয়ে গেলে তাকে এক রাতের মাঝে দুর্গ ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

এটা আসকারি মির্জার জন্য ভয়ঙ্কর অপমানজনক ছিলো।

ডক্টর হরিশংকর শ্রীবাস্তব বেশ জোর দিয়েই বলেছেন, তরদী বেগ নিশ্চিত ছিলেন যে, আসকারি তখনও হুমায়ুনের অনুগত ছিলো। কিন্তু তিনি এটাও সন্দেহ করছিলেন, হয়তো আসকারি পরবর্তীতে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এ কারণে তিনি আসকারির উপর সবসময়ই বিশেষ নজর রাখতেন।

তরদী বেগ রাজকোষ আসকারির হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসকারি তাকে বন্দী করে রাজকোষ দখলের পরিকল্পনা করেন। এটা জানতে পেরে অনেকটা বাধ্য হয়েই তিনি আসকারিকে দুর্গ ত্যাগে বাধ্য করেন।

ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখলে, তরদী বেগের আচরণ একইসাথে ঠিক আবার ভুলও ছিলো। গুজরাটে আসকারি মির্জার অধীনস্থ গভর্নর হিসেবে তিনি ভুল ছিলেন। এবং সোজা কথায়, নিজের উর্ধ্বতন আসকারি মির্জার সাথে অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন।

কিন্তু নিজের সম্রাটের দিক দিয়ে দেখলে তিনি ঠিকই ছিলেন। তিনি যা করেছেন, তা হুমায়ুনের প্রতি আনুগত্য থেকেই করতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, আসকারি তখনো সরাসরি হুমায়ুনের অবাধ্যতা না করলেও তার মনে অবশ্যই এই ধরনের পরিকল্পনা ছিলো। অবশ্য এসব ঘটনার পেছনে পরিস্থিতির দায়ও ছিলো অনেকটা।

আসকারি মির্জার চাম্পানীরের আচরণের ব্যাখ্যা পাবার পর স্বাভাবিকভাবেই আরেকটি প্রশ্নের উদয় হয়। আসকারি মির্জা চাম্পানীর ত্যাগ করে মাণ্ডুতে হুমায়ুনের সাথে দেখা না করে তাহলে আগ্রার পথে ছুটলেন কেন?

ডক্টর হরিশংকর শ্রীবাস্তব এই ঘটনার পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন।

প্রথমত, আসকারি লজ্জাবশত আর অপমানিত হওয়ার কারণে আগ্রার দিকে যাচ্ছিলেন। তার বিগত আচরণগুলোর বিস্তারিত সব কিছুই হুমায়ুন তরদী বেগের মাধ্যমে জেনে গিয়েছিলেন। আর তাই লজ্জার কারণে তিনি তার ভাই হুমায়ুনের মুখোমুখি হতে পারছিলেন না। তাছাড়া, গুজরাটকে তিনি এত সহজে শত্রুর কাছে দিয়ে এসেছিলেন যে, এর উপযুক্ত কোনো জবাব দেয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।

তাই লজ্জা আর ভয়ে তিনি হুমায়ুনের মুখোমুখি না হয়ে আগ্রা যেতে চাচ্ছিলেন। তার আশা ছিলো, পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে তিনি হুমায়ুনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারবেন।

দ্বিতীয়ত, তিনি সত্যিকার অর্থেই বিদ্রোহ করতে চাচ্ছিলেন।

কিন্তু সবকিছু বিশ্লেষণ করে দেখলে, আসকারির এই আচরণের পেছনে প্রথম কারণকেই প্রধান হিসেবে উল্লেখ করা যায়। কারণ আসকারির তখনও সম্রাট হুমায়ুনে বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মতো মানসিক কিংবা সামরিক, কোনো সক্ষমতাই ছিলো না। এই মতটি আরো বেশি জোরালো হয় আগ্রা যাবার পথে আসকারির সেনাবাহিনীর গতি দেখলে। আসকারি খুবই ধীর গতিতে আগ্রা যাচ্ছিলেন। হুমায়ুনের সাথে আসকারির চিতোরের কাছাকাছি দেখা হয়ে যায়। আসকারি মির্জা যদি আগ্রা আক্রমণ করতে চাইতেন, তাহলে তিনি আরো দ্রুত আগ্রা যেয়ে পৌঁছাতে পারতেন। এক্ষেত্রে পথে আসকারি মির্জার সাথে হুমায়ুনের সাক্ষাৎ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকতো না।

তবে ঘটনা যা-ই হোক না কেন, আর দোষ যারই হোক না কেন, মুঘলরা এমনভাবে গুজরাট ত্যাগ করে এলো যে, বোঝার উপায়ই ছিলো না, মুঘলরা কখনো এই অঞ্চল শাসন করেছিলেন বা তাদের সাথে গুজরাটের কোনোকালে কোনো সম্পর্ক ছিলো। মুঘলরা গুজরাটে এতটাই অপমানিত আর লজ্জিত হয়ে পিছু হটেছিলো। এই ঘটনাটি সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য চূড়ান্ত অপমানের ছিলো। আর এই অপমান দীর্ঘদিন মুঘলদের বয়ে বেড়াতে হয়েছিলো।

তথ্যসূত্র

১। মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০০৫

২। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ: মোগল পর্ব), এ কে এম শাহনাওয়াজ, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ৩য় সংস্করণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০২

৩। Medieval India: From Sultanat to the Mughals Part – II, Satish Chandra

৪। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়, সাহাদত হোসেন খান, আফসার ব্রাদার্স, ২য় মুদ্রণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩

৫। হুমায়ুননামা, মূল: গুলবদন বেগম, অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ, প্রকাশনী: জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৬

এই সিরিজের আগের পর্বসমূহ

১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা || ২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ || ৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল || ৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক || ৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল || ৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল || ৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন || ৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্য || ৯। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস || ১০। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রশস্ত্র || ১১। জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবুর: ‘একজন’ বাঘের উত্থান || ১২। বাদশাহ বাবরের কাবুলের দিনগুলো || ১৩। বাদশাহ বাবর: হিন্দুস্তানের পথে || ১৪। বাদশাহ বাবরের হিন্দুস্তান অভিযান: চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি || ১৫। মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান: হিন্দুস্তানে বাবরের চূড়ান্ত লড়াই || ১৬। খানুয়ার যুদ্ধ: মুঘল বনাম রাজপুত সংঘাত || ১৭। ঘাঘরার যুদ্ধ: মুঘল বনাম আফগান লড়াই || ১৮। কেমন ছিল সম্রাট বাবরের হিন্দুস্তানের দিনগুলো? || ১৯। মুঘল সম্রাট বাবরের মৃত্যু: মুঘল সাম্রাজ্য এবং হিন্দুস্তানের উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের অকাল পতন || ২০। সিংহাসনের ষড়যন্ত্র পেরিয়ে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের অভিষেক || ২১। মুঘল সাম্রাজ্যের নতুন দিগন্ত: সম্রাট হুমায়ুনের ঘটনাবহুল শাসনামল ||  ২২। দিল্লি সালতানাত থেকে মুজাফফরি সালতানাত: প্রাক-মুঘল শাসনামলে গুজরাটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস || ২৩। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযানের প্রেক্ষাপট || ২৪। সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযান: সুলতান বাহাদুর শাহের পলায়ন || ২৫। সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযান ও গুজরাটের পতন

ফিচার ইমেজ: guides.library.illinois.edu

Related Articles

Exit mobile version