২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর ১৮৯ জন যাত্রী নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে পাঙ্কাল পিনাংয়ের উদ্দেশ্যে আকাশে উড়াল দেয় একটি যাত্রীবাহী বিমান। জেটি-৬১০ ফ্লাইটের এই বিমানটি ইন্দোনেশিয়ার লায়ন এয়ারের বহরে যোগ দিয়েছে মাত্র আড়াই মাস হলো। এই তো বছরখানেক আগে লায়ন এয়ার সর্বাধুনিক বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ মডেলের ১২টি বিমান কেনার জন্য মার্কিন জায়ান্ট বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের সাথে চুক্তি করে। সে সময় অবশ্য বোয়িংয়ের এই বিমানের জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁই-ছুঁই। অর্ডারকৃত প্রত্যেক বিমান সংস্থাই চাচ্ছিল তাদেরকে যেন আগে ডেলিভারি দেয়া হয়। সময়মতো বিমান ডেলিভারি দিতে গিয়ে বোয়িং কর্মীদের যেন একটু দম ফেলার ফুসরত নেই।
লায়ন এয়ার ছিল বোয়িংয়ের অন্যতম বড় ক্রেতা। প্রথম চুক্তির কিছুদিন পরেই বড় বড় বিমান সংস্থার সাথে প্রতিযোগিতা করে আরো ২০০টি বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ এর ক্রয়ের চুক্তি সেরে ফেলে তারা। এজন্যই হয়তো তারা একটু আগেই ডেলিভারি পেয়ে যায়। সর্বাধুনিক এই বিমানগুলো হাতে পাওয়ার পর পরই লায়ন এয়ার তাদের বহরে যুক্ত করে নেয়। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে সেই বছরেরই ১৫ আগস্ট সার্ভিসে আসে এই বিমানটি। লায়ন এয়ারলাইন্সের তথ্যমতে, বহরে যুক্ত হওয়ার পর বিমানটি মেঘের দেশে ভেসেছে মাত্র ৮০০ ঘন্টা।
সকাল ৬টা ২০ মিনিটে জাকার্তা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে টেক অফ করে বিমানটি। উড্ডয়নের ৩২ মিনিট পর জাকার্তার এয়ার কন্ট্রোল টাওয়ারে জরুরি অবতরণের জন্য অনুমতি চায় পাইলট। অনুমতি দেয়া হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই কন্ট্রোল টাওয়ারের সাথে সমস্ত যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে বিমানটি। এর মাত্র ১৩ মিনিটের মধ্যেই ১৮৯ জন যাত্রী নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার জাভা সাগরের নীল জলে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। যোগ হয় পৃথিবীর ইতিহাসে আরো একটি শোকাবহ ঘটনা।
এই বিমান বিধ্বস্ত নিয়ে বিশ্বব্যাপী অনেক আলোচনা-সমালোচনা হলেও বিমানের মডেল বা প্রযুক্তিগত কোনো ত্রুটি নিয়ে বড় ধরনের কোনো অভিযোগ কেউ করেনি। এমনকি তখনও লায়ন এয়ারলাইন্স তাদের বহরে যুক্ত থাকা বাকি ১১টি বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ বিমান চলাচল অব্যাহত রাখে। ঐ দুর্ঘটনায় ১৮৯ যাত্রীর সবাই নিহত হন। সাগরের নীল জলে ভাসতে থাকা বিমান, যাত্রীদের ব্যবহৃত কাগজপত্র, বই, ব্যাগ সম্বলিত একটি ছবি টুইটারে ছাড়িয়ে পড়ে। মুহুর্তের মধ্যে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে সারা বিশ্ব।
এই ঘটনার ঠিক সাড়ে চার মাস পর ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান আকাশে উড়েছিল কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির উদ্দেশ্যে। সেদিনও বোধহয় যাত্রীদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। এটি-৩০২ ফ্লাইটের ঐ বিমানটি ১৫৭ জন আরোহী নিয়ে বোলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে সকাল ৮টা ৩৮ মিনিটে। উড়াল দেওয়ার মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই কন্ট্রোল টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর আদ্দিস আবাবা থেকে প্রায় ৬২ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে বিশোফটু শহরের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে সেটি। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় নিহত হযন বিমানের সকল যাত্রী। আরেকবার শোকে মুহ্যমান হয় বিশ্ববাসী। এটিও ছিল বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স-৮।
পর পর দুটি দুর্ঘটনায় নড়েচড়ে বসে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। কারণ, এই দুটি বিমান দুর্ঘটনার মধ্যে দেখা যায় গভীর মিল। দুটি বিমানই উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যে বিধ্বস্ত হয়। ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ বিমান বিধ্বস্ত হবার পর অনেক বিমান সংস্থা এই উড়োজাহাজটি ওড়ানো বন্ধ করে দেয়। বিশেষজ্ঞরা এর প্রযুক্তিতে কোনো ত্রুটি আছে বলে যখন সন্দেহ করছিলেন, তখনও বোয়িং কোম্পানি বলছিল, তাদের বিমান পুরোপুরিই নিরাপদ।
ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ), মার্কিন এ সংস্থাটি নতুন কোনো বিমান নিরাপদ কি না সে বিষয়ে সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে। এই সংস্থা এক জরুরি আদেশে বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তারা ধারণা করে, এ বিমানে কোনো কারিগরি ত্রুটি থাকতে পারে। এরপর বোয়িং আর সুবিধা করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে বিশ্বব্যাপী তাদের ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ মডেলের ৩৭১টি বিমান গ্রাউন্ড করার এক নির্বাহী আদেশ জারি করে।
কিন্তু ঠিক কী প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ বিমানটি বারবার দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছিল সে বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। বেরিয়ে এসেছে মূল রহস্য। আসুন জেনে নেই এই কারিগরি ত্রুটি সম্পর্কে।
বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ মার্কিন জায়ান্ট বিমান নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ‘বোয়িং কমার্শিয়াল এয়ারপ্লেনস’ কর্তৃক নির্মিত দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট জেট এয়ারলাইনার। বিমানটি সর্বপ্রথম আকাশে ওড়ে ২০১৬ সালের ২৯ জানুয়ারি। ২২ মে ২০১৭ সালে মালিন্দো এয়ারের হয়ে আকাশে ওড়ার মাধ্যমে বিমানটির বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয়।
বোয়িংয়ের এই মডেলটি ছিল তাদের একটি সফল সংস্করণ। বাজারের আসার সাথে সাথেই এটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। একের পর এক বিমান সংস্থা চুক্তি করতে থাকে বোয়িংয়ের সাথে। বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ এর গতি ছিল বেশি। এছাড়া এর অবকাঠামোগত সুবিধা, নান্দনিক ডিজাইন এবং সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধার কারণে চাহিদা ছিল ব্যাপক। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই বোয়িং বিভিন্ন বিমান পরিবহন সংস্থার কাছ থেকে ৫০১১ ইউনিট তৈরির অর্ডার পেয়ে যায়। বোয়িংয়ের ইতিহাসে ম্যাক্স-৮ মডেলের বিমানগুলো ছিল সবচেয়ে দ্রুত বিক্রি হওয়া বিমান, যা পূর্বের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দেয়। এই বিমান নিয়ে লাভজনকভাবে বড় মাপের বাণিজ্য করার পরিকল্পনা করে তারা।
বলা চলে, এটি ছিল বোয়িংয়ের এক বিস্ময়কর সফলতা। কিন্তু পর পর একই ধরনের দুটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণে বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা ধারণা করছিল, ম্যাক্স-৮ সংস্করণে সম্ভবত কোনো ত্রুটি রয়ে গেছে। এরপর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বিমান সংস্থা তাদের বহরে থাকা ম্যাক্স-৮ মডেলের সব বিমান আকাশ থেকে নামিয়ে নেয়। সর্বপ্রথম বিমানটি নিষিদ্ধ করে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স। এরপর ধারাবাহিকভাবে চীন, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ বিশ্বের অন্য দেশগুলো। বোয়িং অবশ্য তখনও বলে যাচ্ছিল, তাদের উদ্ভাবিত নতুন বিমানে কোনো সমস্যা নেই। এরপর এফএএ এর নিষেধাজ্ঞা আসার পর তারা বাধ্য হয়ে এই বিমানকে গ্রাউন্ডেড করার আদেশ জারি করে। এখন পর্যন্ত বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ বিমানগুলো বিশ্বব্যাপী গ্রাউন্ডেড রয়েছে।
অ্যান্টি স্টলিং সিস্টেম
অ্যান্টি স্টলিং সিস্টেম একটি নতুন প্রযুক্তি। স্বাভাবিকভাবে বিমান যখন টেক অফ করে তখন মাটির সাথে এর কোণ যদি খুব বেশি খাড়া হয়ে যায়, তাহলে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ, উড্ডয়নের সময় কোনো বিমান যদি খুব খাড়াভাবে আকাশের দিকে উঠতে থাকে, তাহলে তার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার কারণে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা।
ঠিক এই ধরনের সমস্যা এড়াতেই বোয়িং তাদের নতুন এই সংস্করণে অ্যান্টি স্টলিং সিস্টেম ব্যবহার করে। অ্যান্টি স্টলিং সিস্টেমের কাজ হলো বিমান যখন আকাশে উঠতে থাকবে, তখন কোনোভাবেই যেন অতিরিক্ত খাড়া হয়ে না যায়। অর্থাৎ, বিমানের মাথাকে মাটির দিকে টেনে ধরে রাখাই এ সিস্টেমের কাজ, যাতে করে বিমানটি খাড়াভাবে উঠতে না পারে এবং কোনো ধরনের সমস্যার সম্মুখীন না হয়। কিন্তু এই প্রযুক্তি নিয়েই যত সমস্যা।
ইথিওপিয়ায় দুর্ঘটনা ঘটার পর পরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন পাইলট অভিযোগ করে বসেন, টেক অফের সময় বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ মডেলের বিমানগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তারা যে ধরনের সমস্যার বিষয়টি উপস্থাপন করেন, তার সাথে আবার ইন্দোনেশিয়ার লায়ন এয়ারের বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সময় যে ঘটনা ঘটেছিল তা হুবহু মিলে যায়। আবার এদিকে ইথিওপিয়ার বিমানটিও উড়াল দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঠিক একই কারণে বিধ্বস্ত হয়। অভিযোগকারী আমেরিকান পাইলটরা বলেন, অ্যান্টি স্টলিং সিস্টেমটা সক্রিয় হলেই তা বিমানটির নাক নিচের দিকে নামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিমানের নিরাপত্তা সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য জানানোর জন্য একটি ব্যবস্থা আছে। এর মাধ্যমে পাইলটদের অভিযোগ গ্রহণ করা হয় এবং তাদের পরিচয় গোপন রাখা হয়। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক পাইলট তাদের পরিচয় গোপন রেখে এই বিমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান।
জাকার্তাভিত্তিক একটি এয়ারক্রাফট গবেষণা সংস্থা জানায়, বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্সের ডানার তুলনায় ইঞ্জিন তুলনামূলক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। এই বিষয়টি বিমানের ভারসাম্যের ওপর প্রভাব ফেলে। এই কারণেই দুর্ঘটনা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করে সংস্থাটি।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বোয়িং কমার্শিয়াল এয়ারপ্লেনস মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে। একদিকে আর্থিক লোকসান, অপরদিকে তাদের সুনামেও বেশ ভাটা পড়ে। মূলত প্রতিপক্ষ এয়ারবাসকে টেক্কা দিতেই ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ বাজারে আনে সংস্থাটি। সফল এই প্রজেক্ট যে রাতারাতি ব্যর্থ হয়ে যাবে তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ এর দুর্ঘটনার ফলে বোয়িং কমার্শিয়াল এয়ারপ্লেনস প্রায় ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যা বোয়িংয়ের ইতিহাসে সর্বোচ্চ লোকসান। এছাড়া গত দুই দশকের মধ্যে সেই বছরই বোয়িং সর্বপ্রথম লোকসানের মুখে পড়ে। এদিকে বিশ্বব্যাপী বিমানটি গ্রাউন্ড করার কারণে বোয়িংয়ের শেয়ারের দরপতন ৩৭%-এ গিয়ে ঠেকে। এই ঘটনার পর বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স-৮ বিমান সংক্রান্ত সমস্ত অর্ডার বাতিল করে দেয়। এর নির্মাণাধীন সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। সব মিলিয়ে ১০৩ বছরের ইতিহাসে বোয়িং সবচেয়ে সংকটময় পরিস্থিতিতে পড়ে।
এদিকে বোয়িংয়ের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তার এই দুর্দিনের সুযোগ লুফে নেয়। বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্সের অর্ডার বাতিলের পর বিমান পরিবহন সংস্থাগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে এয়ারবাসের কাছে। সংস্থাটির অর্ডার বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এদিকে শেয়ারের দামও বাড়তে থাকে হু-হু করে। সব মিলিয়ে এই দুটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা ও একটি নতুন প্রযুক্তি বৈশ্বিক বিমানশিল্পের অমূল পরিবর্তন সাধন করে। একটি নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করে সফলতার পরিবর্তে ব্যর্থতার গ্লানি ও আর্থিক ধসের মুখে পড়ে একটি কোম্পানি। এ ঘটনা দীর্ঘদিন মনে রাখবে বিশ্ববাসী।