বিখ্যাত পাঁচ ব্যক্তির মৃতদেহ চুরি হওয়ার গল্প

মাইকেল জ্যাকসন মারা যাওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন, জ্যাকসনের মৃতদেহ দাফন করা হবে ফরেস্ট লন মেমোরিয়াল পার্কের অভ্যন্তরে। ব্যক্তিগত, সুরক্ষিত এই সমাধিসৌধটিতে আরও অসংখ্য বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ, অভিনেতাসহ যশস্বী ব্যক্তিরা চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। শুনতে কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হলেও, মাইকেল জ্যাকসনের জন্য এই সমাধিক্ষেত্রটি পছন্দ করার পেছনে মূল কারণ ছিল মৃতদেহটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অতীতে বেশ কয়েকবার বিখ্যাত ব্যক্তিদের মৃতদেহ চুরি করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবী করেছিল কবর চোররা। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই মাইকেল জ্যাকসনের বেলায় বাড়তি সতর্কতা নেয়া হয়। এবার তাহলে ফিরে দেখা যাক, অতীতে কোন কোন বিখ্যাত ব্যক্তিদের মৃতদেহ চুরি হয়েছিল।

১. চার্লি চ্যাপলিন

নির্বাক যুগ মাতিয়ে রাখা অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনকে দর্শকরা তার ‘লিটল ট্র্যাম্প’ চরিত্রটির জন্য নিশ্চয়ই আরও কয়েকশো বছর মনে রাখবে। ১৯৭৭ সালের বড়দিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কালজয়ী এই ব্যক্তি। মারা যাওয়ার পরপরই ৩০০ পাউন্ড ওজনের ওক কাঠের কফিনে করে সুইজারল্যান্ডের কোরসিয়ার গ্রামে শেষ বিদায় জানানো হয় তাকে। কিন্তু ১৯৭৮ সালের মার্চের ২ তারিখে তার মৃতদেহ চুরি করে কবর চোররা। শুরুতে কয়েকদিন কেউ কোনো কথা না বললেও সপ্তাহখানিক পরে স্যার চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিনের চতুর্থ স্ত্রী উনার কাছে একটি ফোনকল আসে। চোররা তার তাছে মৃতদেহ ফিরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে ৪ লক্ষ সুইস ফ্রাঙ্ক দাবি করে। কবর চোররা তো খুশি মনে ভেবেছিল এমন পারফেক্ট পরিকল্পনা আর হয় না, উনা এবার টাকা না দিয়ে যাবে কোথায়? কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে সদ্য বিধবা লেডি উনা চ্যাপলিন টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, “চার্লি এসব শুনলে প্রচণ্ড বিরক্ত হতো।”

চার্লি চ্যাপলিনের কল্পিত সমাধি; Source: cultofweird.com

জালিয়াতচক্রকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করার উদ্দেশ্যে মুক্তিপণ নিয়ে হাজির হওয়ার সাজানো নাটক করে স্থানীয় পুলিশ। কিন্তু সতর্ক চোররা আগে থেকেই তা টের পেয়ে যাওয়ায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তবে চোর আর পুলিশ উভয়পক্ষই সমান নাছোড়বান্দা হওয়ায় তাদের মধ্যে ইঁদুর-বেড়াল খেলা চলতে থাকে আরও কিছুদিন। মে মাসে কবর চোরদের কাছ থেকে আরেকটি ফোনকল আশা করছিল পুলিশ, কাজেই তারা চ্যাপলিনের বাড়ির ফোনটি আগে থেকেই ট্যাপ করতে থাকে। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে আশপাশের আরও প্রায় ২০০টি ফোনবুথও নজরবন্দী করে তারা।

কাজেই শেষপর্যন্ত যখন চোরদের ফোনকল এলো, খুব সহজেই তা ট্রেস করে পুলিশ। রোমান ওয়ার্ডাস এবং গ্যান্সকো গানেভ নামক দুই ব্যক্তিকে আটক করা হয়। পেশায় তারা দুজনই মোটর মিস্ত্রী। পুলিশকে তারা পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় কবরস্থান থেকে মাইল দশেক দূরের একটি ভুট্টাক্ষেতে, এখানেই লুকিয়ে রাখা হয়েছিল চ্যাপলিনের চুরি করা মৃতদেহ। চ্যাপলিনকে উদ্ধার করে দুই চোরকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। চুরির মূল হোতা হিসেবে রোমানের সাজা হয় চার বছরের কারাদণ্ড, আর তার সহকারী হিসেবে গ্যান্সকোকে ভোগ করতে হয় ১৮ মাসের কারাবাস। চ্যাপলিনকে আবারও আগের কবরস্থানে দাফন করা হয়। তবে এবার কবরের চারপাশে কংক্রিট দিয়ে শক্ত প্রাচীর তৈরি করে দেয়া হয় যাতে আবারও কেউ তার চিরনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে।

২. টমাস পাইন

টমাস জেফারসনের যুগান্তকারী রাজনৈতিক আইডিয়াগুলো শোনার সৌভাগ্য আমাদের অনেকেরই হয়নি। তবে আব্রাহাম লিঙ্কন, বার্ট্রান্ড রাসেল বা ক্রিস্টোফার হিচেনের সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার বদৌলতে টমাস পাইনের কথা টুকটাক সবাই জানেন। ‘দ্য এইজ অফ রিজন’, ‘কমনসেন্স’ এবং ‘দ্য রাইটস অফ ম্যান’ বইগুলোর জন্য তিনি স্বাধীন আমেরিকার ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক বিপবের অগ্রদূত হিসেবে পরিগণিত হন। সে যা-ই হোক, ১৮০৯ সালে সঙ্গি-সাথীহীন অবস্থায় একেবারে একা একা মারা যান পাইন। সমাজের প্রধান ও প্রচলিত ধর্মগুলো নিয়ে অবিরাম ঠাট্টা করার কারণে একপ্রকার একঘরে করে দেয়া হয়েছিল তাকে। সে অবস্থায় একাকী, নিভৃতে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন তিনি।

বিদ্রোহী লেখক টমাস পাইন; Source: telegraph.co

কিন্তু তা-ই বলে তার যে কোনো ভক্ত ছিল না, তা কিন্তু নয়। পাইন মারা যাওয়ার দশ বছর পরে উইলিয়াম কোবেট নামক এক মৌলবাদী সাংবাদিক চলে আসে পাইনের কবর খুঁজে বের করতে। নিউ ইয়র্কের নিউ রোচেল থেকে কবরটি খুঁজে বের করে সে। এভাবে অযত্নে-অবহেলায় শুয়ে আছে তার আদর্শ, এই দৃশ্য সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। কাজেই কবর খুঁড়ে তার নায়কের অবশিষ্ট হাড়গোড়গুলো ব্যাগে ভরে সাথে করে ইংল্যান্ডে নিয়ে যায় কোবেট। তার ইচ্ছে ছিল পাইনের মৃতদেহ যথাযথ সম্মানের সাথে তার বাড়িতে দাফন করার। কিন্তু বেচারার সেই ইচ্ছে কখনোই সফল হয়নি। কোবেট প্রায় দুই দশক ধরে বিদ্রোহী লেখকের হাড়গোড়গুলো নিজের সাথে নিয়ে ঘুরছিল। কিন্তু তারপর একদিন নিজেই মারা যায় কোবেট আর তার সাথে হারিয়ে যায় পাইনের শেষ চিহ্ন। এর পরের বছরগুলোতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জন পাইনের অবশিষ্টাংশ তার কাছে আছে বলে দাবি করেছেন, কিন্তু কোনোটিই শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। একসময়কার দাপুটে লেখক এখন বিরামহীনভাবে কোথায় আছেন, তা হয়তো জানার আর কোনো উপায় নেই।

৩. ট্যাসোস পাপাড্যুপুলোস

২০০৮ সালে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান সাইপ্রাসের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ট্যাসোস পাপাড্যুপুলোস। তার মৃতদেহ দাফন করা হয় রাজধানী শহর নিকোসিয়ার পার্শ্ববর্তী ডেফটেরা গ্রামের একটি সমাধিক্ষেত্রে। সেখানে প্রায় এক বছর ছিল মৃতদেহটি, প্রেসিডেন্টের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর আগের দিন পর্যন্ত। ২০০৯ সালের ১১ ডিসেম্বর, ট্যাসোসের সাবেক এক দেহরক্ষী সাইপ্রাসের রীতি অনুযায়ী প্রতিদিনের মতো তার কবরে মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসে। প্রতিদিনকার ঘাসের কার্পেটের বদলে এদিন তার চোখে পড়ে বিশাল একটি কালো গর্ত আর মাটির উঁচু ঢিবি। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ঐ দেহরক্ষী জানায়, কবরের অবস্থা দেখেই সে বুঝতে পেরেছিল ভেতরে আর তাদের প্রিয় প্রেসিডেন্টের লাশটি নেই। চুরি হয়েছে মৃতদেহটি।

প্রেসিডেন্ট ট্যাসোস পাপাড্যুপুলোস; Source: telegraph.co

এর প্রায় তিন মাস পরে মুক্তিপণের দাবি জানিয়ে ফোন করে কবর চোররা। সেই ফোনকলের সূত্র ধরে নিকোসিয়ারই আরেকটি সমাধিক্ষেত্র থেকে উদ্ধার করা হয় ট্যাসোসের মৃতদেহ। চোরদের গ্রেপ্তার করার পর বের হয়ে আসে আরেক ভয়ঙ্কর কাহিনী। খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এক কয়েদী তার ভাইকে দিয়ে চুরি করিয়েছিল প্রেসিডেন্টের মৃতদেহ। তাদের পরিকল্পনা ছিল মৃতদেহটিকে জিম্মি করে খুনিকে জেল থেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য করবে সরকারকে। কিন্তু বিধি বাম! তাদের তৃতীয় এক সহযোগী, এক ভারতীয় নাগরিক, এখান থেকে তার কোনো ফায়দা হচ্ছে না টের পেয়ে সোজা ট্যাসোসের পরিবারকে ফোন করে বসে। রয়টার্সের কাছে দেয়া বিবৃতিতে এমনটাই জানায় সে। সাইপ্রাসে মৃতদেহ চুরি করা বেআইনি কাজ বলে খুনির দুই সহকারীকে দু’বছর করে জেল খাটতে হয়। আর খুনির যে সাজা এক ফোঁটাও কমেনি তা বলাই বাহুল্য।

৪. আলেকজান্ডার টার্নি স্টুয়ার্ট

উনবিংশ শতাব্দীর বিজনেস টাইকুন আলেকজান্ডার টার্নি স্টুয়ার্টকে এখন আমরা না চিনলেও তার সময়ে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। তার মৃতদেহ চুরি করার জন্য চোররা যে মুখিয়ে থাকবে, সেটা তো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তবে চোররা নিজেরাও বোধহয় ভাবতে পারেনি তাদের প্রতি ভাগ্যদেবতা এতটা সুপ্রসন্ন হবেন। গল্প-উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মতোই ছিল স্টুয়ার্টের জীবন। আয়ারল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডে এসে টিনজাত শুকনো খাবারের ব্যবসা শুরু করে খুব শীঘ্রই ইতিহাসের অন্যতম সেরা ধনীদের তালিকায় নাম লেখান তিনি।

বিজনেস টাইকুন আলেকজান্ডার টার্নি স্টুয়ার্ট; Source: thefamouspeople.com

১৮৭৬ সালে, স্টুয়ার্টের মৃত্যুর ঠিক দু’বছর পরে, নিউ ইয়র্ক শহরের সেন্ট মার্ক চার্চের কবর থেকে চুরি হয়ে যায় তার শরীরটি। চোররা দাবি করে বসে ২০ হাজার ডলার, এখনকার সময়ে তা কম করে হলেও ৫ লাখ ডলারের সমান। পুলিশ আর গোয়েন্দারা মিলে অনেক চেষ্টা করেও চোরদের ধরার কোনো উপায় বের করতে না পারলে শেষমেশ তাদের চাহিদা মোতাবেক মুক্তিপণ দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় স্টুয়ার্টের পরিবার। অবশ্য কথা রেখেছিল কবর চোররা। টাকার বিনিময়ে স্টুয়ার্টের কঙ্কাল, অন্তত একটি মরা মানুষের কঙ্কাল, ফেরত পায় তার পরিবারের সদস্যরা। পরবর্তীতে নিউ ইয়র্কের গার্ডেন সিটিতে পুনরায় সমাহিত করা হয় এই বিজনেস টাইকুনকে।

৫. ভাক্কাড়ের গোরখাদকেরা

এতক্ষণ আমরা যাদের কথা জানলাম, তারা নিজেরা বিখ্যাত ছিলেন বলে কবরচোররা তাদের শবদেহ নিয়েও টানাহ্যাঁচড়া করতে ছাড়েনি। আর এখন আমরা যাদের কথা জানব, তারা লাশ চুরি করে বিখ্যাত হয়েছে বলেই এই তালিকায় স্থান পেয়েছে। বলা হচ্ছিল পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ভাক্কাড় এলাকার গোরচোর আর গোরখাদক দুই ভাইয়ের কথা। কবর খুঁড়ে লাশের অবশিষ্টাংশ খুবলে খাওয়ার অপরাধে দুবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের। কবর থেকে লাশ চুরি করার অপরাধে মুহাম্মদ আরিফ এবং ফারমান আলী নামক দুই ভাই ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো দু’বছরের জন্য জেল খাটে। তাদের বাড়িতে স্যুপের বাটিতে মানুষের হাড় সমেত ছবি প্রকাশিত হয় ‘দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট’ পত্রিকায়।

গোরখাদক দুই ভাই; Source: nbcnews.com

২০১৪ সালের এপ্রিলে পুলিশ আবারও তাদের গ্রেপ্তার করে। এবার তাদের বাড়ি থেকে মানুষ পচা গন্ধ বের হচ্ছিল বলে পুলিশকে খবর দেয় প্রতিবেশিরা। নিউ ইয়র্ক টাইমসের তথ্যানুযায়ী, পুলিশ তাদের দুই ভাইয়ের বাড়ি থেকে একটি বাচ্চার মাথা উদ্ধার করে। সে অপরাধের জন্য ১২ বছর জেল খাটছে তারা।

ফিচার ইমেজ- staticflickr.com

Related Articles

Exit mobile version