কাগজ আবিস্কারের পর থেকেই মনের ভাব আদানপ্রদানের মাধ্যম হিসেবে চিঠি চালাচালির যুগ শুরু হয়। তারপর এলো আধুনিক যুগ। টেলিগ্রাম, রেডিও, টেলিফোন, পেজার পেরিয়ে মোবাইলের এসএমএস ও স্মার্টফোন-কম্পিউটারের ইমেইলের যুগ আসার পর ব্যক্তিগত চিঠির যুগ যেন শেষ হয়ে গেছে। হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা প্রিয়জনের সাথে এখন আমরা মুহূর্তেই বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করতে পারছি। ফলে পোস্টাল অফিসের কাজ এখন আমাদের অফিসিয়াল কাগজপত্র পৌঁছানোর কাজেই সীমাবদ্ধ। তারাও এখন আধুনিক যানবাহন, ড্রোন দিয়ে দ্রুত চিঠি ডেলিভারি দেয়ার চেষ্টা করছে। একটি সময় মার্কিন পোস্টাল সার্ভিসকে ব্যঙ্গ করে বলা হতো স্নেইল মেইল। শামুকের দৌড়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ চিঠি ডেলিভারি দিতে তাদের প্রচুর সময় লাগত। এই অপবাদ ঘোচাতে ইউএস পোস্টাল সার্ভিস এই অদ্ভুত প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে রাজি করায়।
প্রাচীনকাল থেকেই দ্রুত বার্তা পাঠানোর জন্য দ্রুতগামী বাহন, কবুতর ব্যবহার করা হতো। স্বল্প দূরত্বে তিরে বেঁধে বার্তা আদানপ্রদানের চল ছিল। ১৮১০ সালে প্রথমে জার্মানরা (আরো ভালোভাবে বললে প্রুশিয়ানরা) আর্টিলারি ব্যবহার করে যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত বার্তা আদানপ্রদানের কথা প্রথম চিন্তা করে। ব্রিটিশ শাসিত আলবেনিয়ার টঙ্গো দ্বীপে জাহাজ নোঙর করানো খুবই কঠিন ছিল। তারাই প্রথম রকেটের সাহায্যে পাঁচ কি.মি. দূরে আরেকটি দ্বীপে চিঠি আদানপ্রদান করেছিল। অস্ট্রিয়ার ফ্রেডরিখ স্মিডেল নামক এক ব্যক্তি প্রথমবারের মতো রকেটের সাহায্যে এক শহর থেকে আরেক শহরে সর্বোচ্চ পরিমাণ (১০২টি) চিঠি পাঠিয়েছিলেন।
ইন্ডিয়ান এয়ার মেইল সোসাইটির সেক্রেটারি স্টিফেন স্মিথ ১৯৩০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের রকেট দিয়ে নদীর ওপারে ২৭০টি চিঠি ও পার্সেল ডেলিভারি দেন। এতক্ষণ যা বলা হলো, এগুলোর সবই ছিল প্রাথমিক যুগের রকেট, যা মূলত আতশবাজির কাজে ব্যবহৃত হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বিজ্ঞানীদের হাত ধরে রকেট ও মিসাইল টেকনোলজি উন্নতি হয়। জার্মান প্রযুক্তি হস্তগত ও তাদের রকেট বিজ্ঞানীদের একটি অংশকে নিজেদের দলে আনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তখন মিসাইল টেকনোলজির শীর্ষস্থানীয় দেশ হয়ে ওঠে। স্নায়ুযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে একের পর এক বানানো হচ্ছে নিত্যনতুন মিসাইল। এদের মধ্যে ক্রুজ মিসাইল অন্যতম।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তখন দ্রুত কাগুজে বার্তা পাঠানোর নতুন কোনো উপায় খুঁজছিল। টঙ্গো আইল্যান্ডের সেই চিঠি পাঠানোর ধারণাকে নতুন করে তাদের সামনে হাজির করেন যুক্তরাষ্ট্রের ডাকবিভাগের পোস্টমাস্টার জেনারেল আর্থার ই. সমারফিল্ড। তিনি মিসাইলের ভেতরে করে চিঠি পাঠানোর একটি পরীক্ষা চালানোর প্রস্তাব দেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সাথে সাথেই রাজি হয়ে যায়। কেননা তারা সদ্য নতুন একটি ক্রুজ মিসাইল বানিয়েছিল যা প্রায় হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে সক্ষম। এই লেখায় উল্লেখিত ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত মিসাইলটির নাম ‘SSM-N-8A Regulus I‘ যা একটি সেকেন্ড জেনারেশন ক্রুজ মিসাইল।
৬,২০৭ কেজি ওজনের ৩২.২ ফুট লম্বা এই মিসাইলটি জাহাজ ও সাবমেরিন থেকে ফায়ার করার উপযোগী করে ১৯৫৫-৬৪ সালের দিকে বানানো হয়। ব্যারেল শেপড ফিউজলাজের এই মিসাইল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জব্দকৃত জার্মান V-1 মিসাইলের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। চিঠি পাঠানোর এই বিশেষ মিশনের জন্য বিস্ফোরক সরিয়ে সেখানে চিঠিভর্তি কন্টেইনার ঢোকান হয়।
পরিকল্পনা করা হলো যে সাগর থেকে ভূমিতে মিসাইল নিক্ষেপ করা হবে। এজন্য ব্যবহার করা হবে মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন ইউএসএস বার্বেরো। এই সাবমেরিনে কিছুদিন আগেই রেগুলাস-১ মিসাইলের রেইল লঞ্চার বসানো হয়েছিল। আর্থার সমারফিল্ড এই মিশনের জন্য নিজে চিঠি লিখেন এবং সেটির তিন হাজার কপি প্রস্তুত করা হয়। চিঠিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার, ভাইস প্রেসিডেন্ট নিক্সন, প্রত্যেক রাজ্যের গভর্নর, কংগ্রেস সদস্য, ডাকবিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ ও প্রত্যেক আমেরিকান নাবিককে উদ্দেশ্য করে লেখেন।
ইউএসএস বার্বেরোকে প্রথম স্যুভেনির কপিটি হস্তান্তর করা হয়। ইউএস পোস্টাল সার্ভিস ভার্জিনিয়ার নোরফোক নৌঘাঁটিতে সাবমেরিনের উপর অস্থায়ী পোস্ট অফিস স্থাপন করে। আর্থার সমারফিল্ড নিজে মিসাইলের ভেতর চিঠিভর্তি ক্যানিস্টার দুটি লোড করেন। সাবমেরিনটি সকাল সাড়ে নয়টায় ফ্লোরিডার দিকে যাত্রা শুরু করে। এর ক্যাপ্টেন ছিলেন কমান্ডার রবার্ট এইচ ব্লাউন্ট যিনি সদ্যই জাহাজের নেতৃত্বে এসেছিলেন।
১৯৫৯ সালের ৮ জুন। বিকালবেলা ফ্লোরিডা উপকূলের ২০০ মাইল দূর থেকে চিঠিভর্তি ‘SSM-N-8A Regulus-I’ ক্রুজ মিসাইলটি সাবমেরিন থেকে ফায়ার করা হয়। এটি ছিল একটি টেস্ট প্রোটোটাইপ যার টার্গেট ছিল ফ্লোরিডার মেপোর্ট নেভাল অক্সিলারি এয়ার স্টেশনের রানওয়ে। মিসাইলটি ২২ মিনিট ফ্লাইটের পর কোনোরকম দুর্ঘটনা ছাড়াই সফলভাবে ল্যান্ড করতে সক্ষম হয়। চিঠিগুলো ফ্লোরিডার জ্যাকসনভাইল পোস্টঅফিসে পাঠানো হয় এবং সেখান থেকে প্রাপকের ঠিকানায় বিলি করা হয়। এই ঘটনায় উচ্ছাসিত পোস্টমাস্টার জেনারেল আর্থার সমারফিল্ড বলেন,
“This peacetime employment of a guided missile for the important and practical purpose of carrying mail, is the first known official use of missiles by any Post Office Department of any nation. of historic significance to the peoples of the entire world,”
এই ঘটবার আগে সামারফিল্ডের একটি ভবিষ্যদ্বাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক আলোচনা-হাস্যরসের সৃষ্টি করে। তিনি বলেছিলেন,
“before man reaches the moon, mail will be delivered within hours from New York to California, to Britain, to India or Australia by guided missiles. We stand on the threshold of rocket mail.”
রেগুলাস সিরিজের পরের সংস্করণটি ছিল দ্বিগুণ অর্থাৎ এক হাজার নটিক্যাল মাইল রেঞ্জের মিসাইল। কিন্তু নতুন প্রজন্মের UGM-27 Polaris ব্যালাস্টিক মিসাইল কাজ শুরু হওয়ায় এটি ১৯৬৪ সালে অকালে অবসরে যায় এটি। সাবমেরিন ইউএসএস বার্বেরো একই বছরের ৩০ জুন অবসরে যায়। তাকে তিন মাস পর ট্রেনিং এক্সারসাইজে ইউএসএস সোর্ডফিশ নামক অপর একটি সাবমেরিন দিয়ে পার্ল হারবার উপকূলে ডুবিয়ে দেয়া হয়।
মিসাইল দিয়ে চিঠি ডেলিভারির ঘটনা এরপর আর ঘটেনি। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- সমারফিল্ডের এই পাগলাটে প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কেন রাজি হলো? কেন মার্কিন নৌবাহিনী মিলিয়ন ডলারের মিসাইল সামান্য চিঠি পাঠানোর কাজে খরচ করলো? এ ধরনের অস্ত্র তো বানানো হয়েছে সামরিক কাজের জন্য, বেসামরিক বার্তা আদানপ্রদানের জন্য নয়!
আসলে পুরো ঘটনাটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রোপাগান্ডা। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে এই বার্তা দিতে চেয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজের ভূমিতে মিসাইলে করে নিখুঁতভাবে চিঠি ডেলিভারি দিতে পারে তবে সোভিয়েত ভূমিতে নিউক্লিয়ার হামলাও চালাতে সক্ষম। এই কাজে পোস্টমাস্টার জেনারেল আর্থার সামারফিল্ড ছিলেন শুধুমাত্র দাবার ঘুঁটি। তিনি নিজেও মার্কিন মিলিটারি জেনারেলদের চাল ধরতে পারেননি। তার ইচ্ছা ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্পর্ক ভালো করে তাদের অফিসিয়াল ডকুমেন্ট আদানপ্রদানের কাজ বাগিয়ে নেয়া। এটি এতদিন পেন্টাগনের নিজস্ব পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে করা হতো। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি।
উপরন্তু তাকে সংবাদপত্রে হাইলাইট করার মাধ্যমে সাধারণ মার্কিন জনগণ ও রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে অনুকূল সাড়া পাওয়া গেছে যা সেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট বৃদ্ধিতে পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছিল। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মিসাইল দিয়ে চিঠি ডেলিভারির ঘটনা ছিল মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর পর মানুষ পাঠানোর আগপর্যন্ত সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক ঘটনা।