ভিসুভিয়াস জেগে উঠেছে।
হ্যাঁ! ঘুমন্ত ভিসুভিয়াস জেগে উঠেছে। কাঁচা ঘুম থেকে হঠাৎ করে জেগে ওঠা খোকার মতোই সে রেগে আছে। তার মুখ থেকে রাগের বহ্ণিশিখা বের হচ্ছে অহরহ। তার সাথে বজ্রপাতের মতো গর্জনে কানে তালা লেগে যাওয়ার পালা। তার উপরে ভর দুপুরেই চারপাশ কালো করে আঁধার নেমে এসেছে। গ্রীষ্মের পরিষ্কার আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে ভেবে ভুল হতে পারে। কিন্তু না, সেটা মেঘ নয়।
আকাশে মেঘের মতো দানা বেঁধে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে ভিসুভিয়াসের কালো ধোঁয়া। খেপে ওঠা ষাঁড়ের মতো তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশে।
ভিসুভিয়াস ঘেঁষে অবস্থান করছে রোমান সাম্রাজ্যের নগরী পোম্পেই। এর অধিবাসীরা ভয়ে দিশেহারা। ওদিকে সারনো নদীর তীর ঘেঁষে বানানো বড় মন্দিরে পুরোহিতরা হাজার রোমান দেব-দেবীর পূজো দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। কোন দেবতার রোষানলের ফল এটা তারা সেই হিসাব মিলাতে পারে না কিছুতেই।
জুপিটার, বেলোনা, নাকি জানুস? কে জাগিয়ে তুললেন ভয়ংকর ভিসুভিয়াসকে?
অনেকে একের পর এক বলি দিয়েই যাচ্ছে। আর ওদিকে আরেকদল পালিয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি ছেড়ে। ঠিক তখনই ভিসুভিয়াস প্রচন্ড শব্দে গর্জে উঠলো। স্তব্ধ পোম্পেই তাকিয়ে দেখছে- ক্রুদ্ধ ভিসুভিয়াস এর মুখ ফেটে বের হয়ে আসছে সর্বনাশা লাভা, গ্রাস করে নিচ্ছে পুরো নগরী।
উপরের বর্ণিত ঘটনা কোনো কল্পকাহিনী বা রূপকথা নয়। আজ থেকে ২০০০ বছর পুরাতন ভয়ংকর একটি ঘটনা এটি। জুলিয়ান পঞ্জিকা মতে সাল তখন ৭৯। ক্যালেন্ডারের হিসাবের প্রথম শতাব্দীতেই রোমান সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ নগরী পোম্পেইয়ের পতন ঘটে। কোনো পরাশক্তির হাতে এই পতন ঘটেনি, নয় কোনো দিগ্বিজয়ী বীরের হাতে। পোম্পেই এর অসহায় পরাজয়ের কারণ ছিল এক পর্বত, নাম তার ভিসুভিয়াস!
পোম্পেই নগরীর ভৌগলিক অবস্থান
পোম্পেই নগরী নেপলস থেকে ১৪ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। ধ্বংস হয়ে যাওয়া পুরাতন পোম্পেইয়ের পাশেই গড়ে উঠেছে আধুনিক পোম্পেই। আধুনিক পোম্পেইয়ের বানান Pompei যা পুরাতন পোম্পেই (Pompeii) থেকে আলাদা। নগরীর পাশ দিয়েই সেই ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতি বুকে নিয়ে বয়ে গেছে সারনো নদী। নগরী থেকে ৮ কি.মি. দূরেই সগৌরবে ঘুমিয়ে আছে ভয়াবহ ভিসুভিয়াস।
পুরাতন পোম্পেই নগরী ছিল সৈকতের একটু নিকটবর্তী। কিন্তু নতুন শহরটা একটু ভিতরের দিকে।
১৯৯৭ সালে UNESCO পোম্পেই নগরীকে তাদের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।
পোম্পেই নগরীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে এই নগরীর গোড়াপত্তন করে মধ্য ইতালীয় এক গোষ্ঠী যারা অস্কি নামে পরিচিত। পোম্পেই নগরী ছিল ইতালির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরের জন্য একটি বাইপাস। এজন্যে এই নগরীর গুরুত্ব শুধু রোমান সাম্রাজ্য নয়, গ্রীক সাম্রাজ্যের নিকটও ছিল অপরিসীম। তারই ফলস্বরূপ গ্রীকরা এই নগরী দখল করে নেয় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে।
পোম্পেইয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একে রোমান এবং গ্রীক সাম্রাজ্যের গণ্যমান্যদের আমোদস্থানে পরিণত করে। তবে ইতিহাসের পাতায় পোম্পেইয়ের আগমন ঘটে দ্বিতীয় সামনাইত যুদ্ধের মাধ্যমে। সামনাইতরা এই যুদ্ধের পরে পোম্পেই দখল করে নেয় এবং জোরপূর্বক রোমান কনফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। সামানাইতদের আমলেই পোম্পেইয়ের সকল স্থাপনা আর মন্দির নির্মিত হয়, যা আজও পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
৮৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পোম্পেইবাসী বৃহৎ ইতালীয় জোটে যোগ দেয় এবং রোমানদের বিরুদ্ধে একটি ব্যর্থ বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে যা রোমান সেনাপতি লুসিয়াস সুলা দক্ষতার সাথে দমন করেন।
তারপর বাকি জোটের সাথে পোম্পেইবাসীকেও রোমান নাগরিকত্ব বরণ করে নিতে হয়। এরপর রোমানরা পোম্পেই নগরীতে রোমান দেবতাদের বিভিন্ন মন্দির এবং বড় বড় রোমান আদলে ডিজাইন করা স্থাপনা নির্মাণ করে। শান্তি ফিরে আসে পোম্পেইয়ের বুকে।
কিন্তু এই সুখ বেশিদিন টিকলো না। ৬২ সালের শুরুতেই পোম্পেইয়ের বুকে আঘাত হানে ভয়াবহ ভূমিকম্প। এর তীব্রতা এতটাই মারাত্মক ছিল যে ৭৯ সালের সেই মহাবিপর্যয়ের আগেও এর ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি পোম্পেই।
৭৯ খ্রিস্টাব্দে কী ঘটেছিল?
পোম্পেই ছিল ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। প্রায়ই দেখা যেত বছরে দুই থেকে চারবার মাঝারি আকারের ভূমিকম্প আঘাত হানতো। যার ফলে পোম্পেইবাসী ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সতর্কতা অবলম্বন করতো না। ৬২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শুরুতে বড় ধরনের ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে সমগ্র ইতালি। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পোম্পেই। ইতিহাসবিদদের মতে রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল আনুমানিক ৬।
ওদিকে ৫ ফেব্রুয়ারি পোম্পেইয়ের জাতীয় দিবস। এ দিন অগাস্টাস সিজারকে জাতির জনক ঘোষণা করা হয়েছিল। সে উপলক্ষে নগরীর রাস্তায় রাস্তায় চলছিল উৎসবের প্রস্তুতি। আতশবাজি, রঙ আর তেলের বাতি দিয়ে শহর রাঙিয়ে তুলেছিল নগরের নারীরা। সবাই ভালো জামাকাপড় পরে রওয়ানা দেন শহরের প্রাঙ্গনে। উৎসব শুরু হবে হবে ঠিক এমন সময় আঘাত হানে ভূমিকম্প। ভেঙে পড়তে থাকে বড় বড় স্থাপনা। জনতার মাঝে ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বিশৃংখলা দেখা দেয় এবং আতশবাজি আর তেলের বাতির বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের কারণে বেশ কিছু বিস্ফোরণ ঘটে, যা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় চারগুণ বাড়িয়ে দেয়।
এর ক্ষতি পূরণ হবার আগেই ১৬ বছরের মাথায় ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়। ধর্মভিরু পোম্পেইবাসী আগুনের দেবতা ভাল্কানালিয়ার পূজা দিয়ে বড় উৎসবের আয়োজন করে।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! পূজার পরদিনই ৭৯ সালের ২৪ আগস্ট ভিসুভিয়াসের চূড়ান্ত অগ্ন্যুৎপাত ঘটে। ধ্বংস হয়ে যায় ভিসুভিয়াস কন্যা পোম্পেই।
পোম্পেইয়ের চিঠি
পোম্পেইতে সেদিন কী হয়েছিল তা জানতে হলে আমাদের কথা বলতে হবে এর একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? ২০০০ বছর পরে কেউ বেঁচে আছেন নাকি!
নাহ! কেউ বেঁচে নেই ঠিকই। কিন্তু বেঁচে আছে তাদের একজনের জবানবন্দি। সেই একজনের নাম প্লিনি জুনিয়র।
প্লিনি সিনিয়র ছিলেন প্লিনি জুনিয়রের বড় চাচা। তিনি (প্লিনি সিনিয়র) পোম্পেই অগ্ন্যুৎপাতের সময় রোমান নৌ বাহিনীর প্রধান ছিলেন। তিনি বাহিনী নিয়ে উদ্ধারকাজ চালানোর সময় মৃত্যুবরণ করেন। আর এই ঘটনা দূর থেকে তাকিয়ে ব্যথিত হৃদয়ে অবলোকন করছিল তার ভাতিজা প্লিনি জুনিয়র। প্লিনি সিনিয়রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ইতিহাসবিদ তেকিতাস।
তেকিতাস তার বন্ধুর মৃত্যুকালীন স্মৃতি সম্পর্কে জানতে চেয়ে প্লিনি জুনিয়রকে চিঠি লিখতে বলেন। প্লিনি তাকে দুটি চিঠি দেন, যা এখন পর্যন্ত পোম্পেই দুর্ঘটনার একমাত্র চাক্ষুস দলিল হিসেবে চিহ্নিত।
প্রথম চিঠি মতে, “সকাল থেকেই দূর থেকে ঘন কালো মেঘের মতো ধোঁয়ায় আকাশ ঢেকে গিয়েছিল। দুপুরের দিকে ভিসুভিয়াস থেকে বিপুল পরিমাণে ছাই নির্গত হতে থাকে। মুহুর্তের মধ্যে পোম্পেই নগরীর দালান-কোঠা ঘন ছাইয়ের আবরণে ঢেকে যায়। যার যা কিছু ছিল সব ফেলে যে যেদিকে পারছিল পালিয়ে যাচ্ছিল। সে ছিল এক ভয়াবহ দৃশ্য! কিন্তু পথিমধ্যেই বিষাক্ত গ্যাস আর ছাইয়ের কবলে পড়ে বৃদ্ধ, নারী আর শিশুরা মৃত্যুবরণ করছিল। মরাকান্নার সাথে ভিসুভিয়াসের গগণবিদারী চিৎকার! মনে হচ্ছিল পৃথিবী বুঝি ফেটে যাচ্ছে।”
অধিনায়ক প্লিনি সিনিয়র অগ্ন্যুৎপাতের পরপরই ঘটনা কাছ থেকে দেখার আগ্রহ নিয়ে ছোট একটি নৌবহর নিয়ে রওয়ানা দেন। ঠিক তখন তার বন্ধু রেক্তিনার কাছ থেকে একজন দূত আগমন করেন। রেক্তিনা ভিসুভিয়াস এর দক্ষিণ দিকে অবস্থান করছিলেন এবং উদ্ধারের জন্য প্লিনির সাহায্য কামনা করছিলেন। বন্ধুর জীবন বাঁচাতে প্লিনি তার জাহাজ নিয়ে সেদিকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু বিধি বাম!
ভিসুভিয়াসের ঘন ছাই আর লাভার বর্ষণে সামনে এগিয়ে চলাই দায় হয়ে পড়লো। কিন্তু প্লিনি সাহসী কমান্ডার। তার রক্তে তখন শোণিত হচ্ছিল ‘Fortune Favors the Brave’। প্লিনি হার মানলেন না। বন্ধুর ডাকে সাড়া দিতে গিয়েয়ে তার এই যাত্রার শুরুটাই ছিল, শেষ আর হয়নি।
প্লিনি আর ফিরে আসেননি। একরাত প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে বিষাক্ত ছাই আর গ্যাসের প্রভাবে সেখানেই মৃতুর কোলে ঢলে পড়েন এই বীর। কিন্তু তার বাকি সহকর্মীরা ফিরে আসতে সক্ষম হন।
দ্বিতীয় চিঠিতে প্লিনি জুনিয়র তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। যেখানে তিনি লিখেন, “চারদিক থেকে চিৎকার ভেসে আসছিল। অনেকেই দেবতাদের চিৎকার করে ডাকছিল। কোনো দেবতা কি আছেন? আবার অনেকে অবিশ্বাসে অভিশাপ দিচ্ছিল দেবতাদের। সে এক ভয়াল অভিজ্ঞতা! নিকশ কালো আঁধার। না অমাবস্যার রাত্র ছিল না সেটা। তবুও দেখে মনে হচ্ছিল দপ করে বাতি নিভে গেছে। চারদিকে শুধু আঁধার আর আহাজারি।”
তার মতে, পোম্পেইবাসীর সবার পালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রচুর সময় ছিল, কিন্তু তারা সেটা আমলে নেননি। যার ফলে মিলিয়ন টন ছাইয়ের নিচে সমাধিস্থ হয়ে যান দুই হাজারেরও বেশি হতাভাগা।
দুদিন ব্যাপী অগ্ন্যুৎপাত পুরো পোম্পেইকে ছাই ঢাকা মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে। ভাস্কর্য, স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ আর অসংখ্য মৃতদেহ নিয়ে সভ্যতার আড়ালে চলে যায় পোম্পেই, হাজার বছরের জন্য!
পোম্পেইয়ের পুনরুত্থান
অবাক করা কথা হলেও কথাটা সত্য যে, এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা কেউ বেশিদিন মনে রাখেনি। সবাই হঠাৎ করেই ভুলে গেল সবকিছু। ইতিহাসের স্মৃতি থেকে মুছে গেল পোম্পেইয়ের কথা। প্রায় ১৫০০ বছর পর্যন্ত কেউই পোম্পেইয়ের কথা ফের মনে করেনি।
তাহলে আমরা পোম্পেইকে কীভাবে ফের খুঁজে পেলাম?
সেটা ১৫৯৯ সালের ঘটনা। সারনো নদীর গতিপথ পরিবর্তন করার জন্য একদল ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে খনন কাজ চালাচ্ছিলেন ডমিনিক ফোন্তানা। খনন করার সময় প্রাচীনযুগের কিছু দেয়াল খুঁজে পাওয়া গেল যার মধ্যে অনেক অশ্লীল চিত্রকর্ম ছিল। একটি পাথরের পান্ডুলিপিও আবিষ্কৃত হয়। যেখানে রোমান হরফে লেখা ছিল Decurio Pompeii; যার অর্থ দাঁড়ায় পোম্পেই এর নগর পরামর্শক। তখনকার সময়ে অশ্লীল শিল্প বর্জনীয় ছিল। তাই ফোন্তানা সেগুলো ফের মাটিচাপা দিয়ে চলে যান।
কিন্তু এই ঘটনা চাপা থাকে না। সবাই জানতেন সেদিকে কিছু একটি আছে। শিল্পের সেন্সরবোর্ডের ছাড়পত্রের অভাবে সেখানে কেউই এগিয়ে যাননি আরো দীর্ঘ দেড়শত বছর!
১৭৪৮ সালে নেপলসের রাজা চার্লস বারবুন এর আদেশে ইঞ্জিনিয়ার রোকো গিয়াচ্চিনু সকল প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ব, মূর্তি এবং মূল্যবান সামগ্রীর তালিকা স্প্যানিশ রাজ দরবারে পেশ করার লক্ষ্যে অভিযান করেন। ফোন্তানার সেই ঘটনার কথা তার অজানা ছিল না। তাই তিনি সেদিকে ছোটখাট অভিযান পরিচালনা করতে ভোলেন নি। হয়তো ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই’ এই উক্তি তার মনে ছিল। ছাই উড়িয়ে দেখতে যেয়ে তিনি খুঁজে পেলেন পুরো নগরীকে।
বিজয়ীর হাসি হেসে রোকো বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন লুকনো এই সভ্যতার দিকে। তারপর থেকে পোম্পেই নিয়ে আমাদের জানা শুরু!
খননকাজে অগ্রগতি
রোকোর আবিষ্কার এর পর থেকে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের বড় বড় প্রত্নতাত্ত্বিক আর ইঞ্জিনিয়াররা এর খনন কাজে সাহায্য করার জন্য আগ্রহ দেখান। প্রথম বড় আকারের অভিযান পরিচালনা করেন সুইস ইঞ্জিনিয়ার কার্ল ওয়েবার। পরবর্তীতে ফ্রান্সিস্কো লা ভেগা, পিয়েত্রো এবং ক্রিস্টফ সালিসেতি প্রমুখ তাদের নিজস্ব দল নিয়ে অভিযানে সাহায্য করেন।
বড় আকারের সাফল্য আসে ১৮৬৩ সালের দিকে। গিসেপে ফাউরেলি ছাইয়ের ভিতর প্লাস্টার প্রয়োগের মাধ্যমে ভস্মের ভেতর থেকে মৃতদের দেহাবশেষ পুনর্নিমাণ করেন। এরপরই তিনি হাজারো চিত্রকর্ম আর ভাস্কর্যের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করেন, যার অধিকাংশই ছিল অশ্লীল। ফের শুরু হয় দ্বিধা। সভ্যতা আর শিল্পের দ্বন্দ্বে ফের সেগুলো আড়াল করে ফেলা হয়।
এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো। পোম্পেইয়ের সব শিল্পকর্ম দুই হাজার বছর পরও অক্ষত ছিল। কারণ ছাইয়ের প্রলেপ দ্বারা ঢাকা ছিল বলে সেখানে আর্দ্রতা আর বায়ুর পরিমাণ ছিল খুব নগণ্য।
১৮১৯ সালে নেপলসের রাজা ফ্রান্সিস তার রাণীসহ পোম্পেই ভ্রমণ করেন। তখন তিনি অশ্লীল চিত্রকর্ম দেখে বিব্রতবোধ করেন। তার আদেশে প্রচুর অশ্লীল চিত্রকর্ম নেপলসের সিক্রেট জাদুঘরের Gabinetto segreto বা ‘গোপণ কুঠুরি’ নামক একটি কেবিনেটে সিলগালা করে রাখেন। চিত্রকর্মগুলো এখন পর্যন্ত সেখানেই সিলগালা অবস্থায় রয়েছে। খুবই উচ্চপদস্থ শিল্পী এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের জন্য সেই কুঠুরি মাঝে মাঝে খোলা হয়।
তারপর বিশ্বযুদ্ধের কারণে অনেকদিনের জন্য কাজ স্থগিত রাখা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এর উদ্ধারকাজ আবারো শুরু হয়।
কেমন ছিল আদিকালের পোম্পেই
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, শহরটি ৩ কি.মি. পরিধির দেয়াল দ্বারা ঘেরাও করা ছিল, যার সর্বমোট ক্ষেত্রফল ৬৬ হেক্টর। দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ সবচেয়ে প্রাচীন। যদিও এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে দ্বিমত বিদ্যমান। শহরের সর্বমোট ৭টি ফটক ছিল।
শহরটি তিনভাগে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু অংশকে ফোরাম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফোরাম ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র। জুপিটার, জুনো এবং মিনারভার বিশাল বিশাল মন্দির ছিল প্রধান ধর্মীয় উপাসনালয়। দক্ষিণ দিকে শহরের হোমড়া-চোমড়াদের বাসস্থান এবং কার্যালয় ছিল।
এর পরের অংশ ছিল ত্রিভুজাকার ফোরাম। সেখানে বড় আকারের একটি গ্যালারি এবং থিয়েটার আবিষ্কৃত হয়েছে। এর নিকটেই গ্রীক দেবতা জিউস এবং দেবতা আইসিসের মন্দির অবস্থিত। শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক স্নানাগার এবং পতিতালয় ছিল। উল্লেখযোগ্য বিলাস মহলের মধ্যে House of Faun বিখ্যাত। এছাড়াও House of Silver Wedding , House of Gladiator এবং প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র House of Vettii বিখ্যাত ছিল। এছাড়াও হাজার হাজার চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য উদ্ধার করা হয় যার অধিকাংশই নেপলস জাতীয় যাদুঘরের গ্যালারীর শোভাবর্ধন করছে।
২০১০ সালের নভেম্বর মাসে House of Gladiator ভারী বর্ষণের কারণে ভেঙে পড়ে। এছাড়াও শহরের এক-তৃতীয়াংশের উদ্ধার কাজ এখনো শেষ হয়নি। প্রত্নতাত্ত্বিকদের আশংকা প্রাকৃতিক কারণে শহরের অধিকাংশ স্থাপনা ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।
২০১৩ সালের জুন মাসে UNESCO আগামী দুই বছরের মধ্যে আশানুরূপ ফলাফল প্রদান করতে ব্যর্থ হলে পোম্পেই শহরকে World Heritage in Danger তালিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে অধ্যাদেশ জারি করেন।
পোম্পেই জেগে উঠেছে। হাজার বছরের নিদ্রা শেষে ফের ভস্মের ভেতর থেকে জেগে উঠেছে পোম্পেই। সেদিনের মুখর শহর আজও মুখরিত পর্যটকদের পদচারণায়। হাজার বছর আগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং করুণ স্মৃতি বুকে নিয়ে সেই ভয়াবহ ভিসুভিয়াসের পাশেই পুনরুত্থান হয়েছে পোম্পেইয়ের।
এখনো এর দেয়ালে দেয়ালে, শহরের পথে-ঘাটে কান পাতলে পোম্পেইবাসীর হাহাকার শোনা যায়। এই করুণ ঘটনাকে রূপালী পর্দায় চিত্রায়িত করে ২০১৪ সালে Pompeii নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় । এর পূর্বেও এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিনি সিরিজ এবং আরো দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। লেখা হয় The Last Days of Pompeii নামক একটি উপন্যাস।
পোম্পেই ফের হারিয়ে যাবে না। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের সাথে একবিংশ শতাব্দীর সরাসরি আলাপচারিতার অসাধারণ মাধ্যম হবার দরুণ পোম্পেইয়ের নাম ইতিহাসে আজীবন অক্ষয় থাকবে।