দ্বিতীয় পর্ব: ঔপনিবেশিক ভারতের সামরিক বাহিনী: সিপাহী বিদ্রোহের পর (পর্ব-২)
ভারতীয় ফৌজের ওপর যতগুলো দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অন্য কোনো ডোমিনিয়নের ফৌজে তা নেই। এর সবচেয়ে প্রধান দায়িত্ব হলো, ভারতীয় ফৌজের সাম্রাজ্যিক (Imperial) দায়িত্ব। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোনো অংশ আক্রান্ত হলে অথবা আক্রমণের আশঙ্কা হলে, অথবা ব্রিটিশ সরকার সাম্রাজ্য কোনো দেশ আক্রমণ করলে, ভারতীয় ফৌজ ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধ করতে বাধ্য। এ বিষয়ে ১৯১৪ সালের ভারত শাসন বিধানেও ভারত সরকারের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধিকার দেওয়া হয়নি। ভারতের বাইরে ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই ভারতীয় ফৌজকে সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ফিল্ড আর্মি হিসেবে তৈরি করে রাখা হয়েছিল। ফলে বার্মা থেকে সোমালিয়া, এডেন থেকে চীন, সবজায়গাতেই ভারতীয় ফৌজকে লড়তে হয়েছে।
বিদ্রোহ-পূর্ব সাম্রাজ্য বিস্তার
ইংরেজরা শুধু ভারত নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেনি, বরং তার আগে থেকেই অন্যান্য অঞ্চলেও সাম্রাজ্য বিস্তার করা শুরু করে দিয়েছে। আগুনে ঘি ঢালার মতো ইংরেজরাও অগণিত ভারতীয় সেপাইদেরকে পেয়ে সাম্রাজ্য বিস্তারে আরও সুবিধা পেয়েছে। দেশীয় সিপাহীকে ইংরেজদের সাম্রাজ্য বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়েছে একেবারে শুরু থেকেই, পলাশীর যুদ্ধের মাত্র ৫ বছর পরেই ১৭৬২ সালে মাদ্রাজ আর্মির একদল সেপাই রয়্যাল নেভির জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ফিলিপিন্সে পৌঁছে স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যদিও ফিলিপিন্সের এই যুদ্ধ ২ বছরের বেশি চালিয়ে যেতে পারেনি ইংরেজরা এবং একসময় স্প্যানিশদের সাথে না পেরে হাল ছেড়ে দেয়। চলে আসার সময় ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া বেশ কিছু সেপাইকে ফেলে আসে তারা। এ কারণে ফিলিপিন্সের কাইন্টা শহরের অধিবাসীদের মধ্যে এখনো ভারতীয় চেহারার লোকজন চোখে পড়ে, যা দেশটির অন্য কোথাও দেখা যায় না।
ভারতবর্ষের পুরো অংশই নজরে ছিল ইংরেজদের। এ কারণে ভারতের ঠিক দক্ষিণে থাকা শ্রীলঙ্কায় ফরাসি ও ওলন্দাজদের সামরিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তারা আর দেরি করেনি। ১৭৯৫ সালে মাদ্রাজের সেপাই বাহিনী পাঠায় ইংরেজরা এবং ওলন্দাজদেরকে হটিয়ে দিয়ে উপকূলীয় অঞ্চল দখল করে ফেলে। এরপরের ২০ বছরে শ্রীলঙ্কার স্থানীয় ক্যান্ডি রাজ্যকে গুড়িয়ে দিয়ে পুরো দ্বীপকেই কব্জা করে নেয় তারা।
১৮১১ সালে ওলন্দাজদের কাছ থেকে জাভা দখল করে নেওয়ার জন্যও মাদ্রাজ ও কলকাতা থেকে জাহাজ বহর পাঠায় ইংরেজরা, যার মধ্যে বেঙ্গল আর্মির বেশ কিছু সিপাহী এবং মাদ্রাজ আর্মির আর্টিলারি ও পাইওনিয়ার দল ছিল। সফলভাবে জাভা দখল করে নিলেও পরবর্তীতে ১৮১৪ সালের অ্যাংলো-ডাচ চুক্তি অনুযায়ী ওলন্দাজদের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমস্ত অঞ্চল হস্তান্তর করে দেয় ইংরেজরা।
দেশীয় সিপাহীর সহযোগিতায় ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে ইংরেজদের সাম্রাজ্য বিস্তার সফলতা পেলেও তখনো ভারতবর্ষের পুরোটা দখল করতে পারেনি ইংরেজরা। ১৮১৪ সালে নেপাল অভিযানের মধ্য দিয়ে নেপাল পর্যন্ত ইংরেজদের হাত প্রসারিত হয়। নেপাল যুদ্ধ শেষ হলে যে গুর্খারা লড়েছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে, সেই গুর্খারাই দলে দলে ভর্তি হতে থাকে ইংরেজ শিবিরে। এরপর ১৮১৭ সালে তৃতীয় অ্যাংলো-মারাঠা যুদ্ধের মাধ্যমে মারাঠাদের পতন ঘটলে ভারতের প্রায় সবটুকু অংশই ইংরেজদের অধীনে চলে আসে। বলা বাহুল্য, এ যুদ্ধেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূল অস্ত্র ছিল ভারতীয় সেপাইরা।
বিদ্রোহ-পরবর্তী সাম্রাজ্য বিস্তার
সিপাহী বিদ্রোহ দমন এবং ভারতীয় বাহিনী নতুন করে সংগঠিত হওয়ার পর ইংরেজদের সাম্রাজ্যিক প্রসারের উদ্যোগ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ভারতের বাইরে ব্রিটিশদের ইম্পেরিয়াল বা সাম্রাজ্যিক আগ্রাসনের অস্ত্র হিসেবে ভারতীয় ফৌজকে ব্যবহার করা হতে থাকে। এমনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিযান হলো:
১) দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ (১৮৫৬-১৮৬০): চীনের সাথে প্রায় ৪ বছর ধরে চলা আফিম যুদ্ধের মাঝখানেই সিপাহী বিদ্রোহ হলে চীন থেকে অনেক সেনাদলকে ভারতে ফিরিয়ে আনা হয়। তবে বিদ্রোহ দমনের পর পুনরায় ভারত থেকে চীনে সৈন্য পাঠানো হয়, যাদের মধ্যে ছিল ১৫ নং লুধিয়ানা শিখ রেজিমেন্ট, ২৩ নং পাঞ্জাব পায়োনিয়ার্স এবং মাদ্রাজের স্যাপার্স-মাইনার্স দল।
২) আবিসিনিয়া অভিযান (১৮৬৮): ইথিওপিয়া অর্থাৎ তৎকালীন আবিসিনিয়ার রাজা দ্বিতীয় টিওড্রোসের বিরুদ্ধে ইংরেজদের অভিযানে ভারতীয় ফৌজই মূল ভূমিকা পালন করে। বোম্বে ইনফ্যান্ট্রি, বেঙ্গল ক্যাভালরি ও বেঙ্গল ইনফ্যান্ট্রির অনেকগুলো রেজিমেন্টের পাশাপাশি মাদ্রাজ স্যাপার্স-মাইনার্সের দলও আবিসিনিয়া অভিযান থেকে বীরত্বসূচক পদক নিয়ে ফেরত আসে।
৩) দ্বিতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ (১৮৭৮): প্রথম অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর ব্রিটিশরা আবারো আফগানিস্তানে অভিযান চালায়। এই যুদ্ধের পর কোয়েটা, পিশিনসহ আরও বেশ কিছু অঞ্চল ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। যুদ্ধে প্রথমে জয়লাভ করে আফগান রাজকে চুক্তি করতে বাধ্য করলেও পরবর্তীতে আবার আফগানদের উত্থানে আফগানিস্তান থেকে চলে যেতে হয় ইংরেজদেরকে। এরপর মর্টিমার ডুরান্ডসহ আরও কয়েকজনকে কূটনীতিক হিসেবে রেখে আফগানিস্তানের সাথে সীমানা নিয়ে সম্পর্ক সহজ রাখার চেষ্টা করে তারা।
৪) রুশ-তুর্কি যুদ্ধ (১৮৭৮): যুদ্ধে তুর্কিদের সহযোগিতার জন্য মাল্টায় একটি ভারতীয় সিপাহী ফৌজ প্রেরণ করা হয়, যুদ্ধ শেষে ব্রিটেনকে চুক্তির শর্তানুসারে সাইপ্রাস অঞ্চলের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়।
৫) অ্যাংলো-মিশরীয় যুদ্ধ (১৮৮২): মিশর দখল করে নেওয়া এই যুদ্ধে বিরাট সংখ্যক সিপাহী ফৌজ মিশরে প্রেরিত হয়, যাদের সাহায্যে স্যার গার্নেট ওলসলি তেল-এল-কবির (Tell El Kebir)-এর যুদ্ধে জয়লাভ করেন।
৬) সুদান অভিযান (১৮৮৫-১৮৯৯): আফ্রিকায় আরও শক্ত অবস্থান এবং সাম্রাজ্যের পরিধি আরও বাড়ানোর জন্য সুদানে কয়েক বছর ধরে অভিযান পরিচালনা করে ইংরেজরা যার ফলস্বরূপ সুদানকেও একসময় ইংরেজরা করায়ত্ত্ব করে নেয়। এবং এই অভিযানেও ভারতীয় ফৌজের বেশ কিছু রেজিমেন্ট অংশগ্রহণ করে।
৭) তৃতীয় অ্যাংলো-বার্মা যুদ্ধ (১৮৮৫): বার্মাকে সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ত্ব করে নেওয়া এই যুদ্ধের অধিকাংশ সৈন্যই প্রেরিত হয় ভারত থেকে, ৩টি প্রেসিডেন্সি বাহিনী থেকেই সিপাহী ফৌজ প্রেরণ করা হয়।
ভারতীয় সিপাহীর সাহায্যে ইংরেজরা ৩ মহাদেশজুড়ে নিজেদের সাম্রাজ্যের আকার বাড়াতে থাকে। তবে এরই মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। ১৮৭৮-৮০ সালে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সুপারিশ করা হয় ৩টি আলাদা প্রেসিডেন্সি বাহিনীর স্বতন্ত্রতা রহিত করা হোক, যদিও তখন ৩টি বাহিনীরই অর্ডিন্যান্স, সরবরাহ কিংবা যানবাহন কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা হতো। তবে এটি করতে আরও কয়েক বছর সময় লেগে যায়। এর মধ্যে আফগান ও বার্মা যুদ্ধে ৩ বাহিনীর বেশকিছু জাত, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলের হিন্দুরা শিক্ষিত হয়ে উঠছে, সেসব জাত ঠিকভাবে যুদ্ধ করতে পারছে না এ অজুহাতে বাহিনী থেকে ছাটাই করা হয়। তাদের জায়গায় ব্যাপকহারে নেপালি গুর্খা, পাঠান, বেলুচি ও পাঞ্জাবি সৈন্য ভর্তি করা হতে থাকে।
ব্যয়বহুল আফগান যুদ্ধের পর খরচ কমানোর জন্য বেশ কিছু পদাতিক ও সওয়ার দল ভেঙে দেওয়া হয় ১৮৮৫ সালে, ভারতীয় ফৌজে স্বেচ্ছায় সৈন্য সংখ্যা কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয় এই প্রথম। তবে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকলে মধ্য এশিয়ায় সৈন্য পাঠানোর প্রয়োজন হলে পুনরায় দলগুলো তৈরি করা হয়।
যে পরিবর্তনের কথা পূর্বে বলা হয়েছিল, সেটি শেষমেশ পূর্ণতা পেতে সময় নেয় ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত। যোগাযোগের সুবিধার অভাবে যে কাজ সমাধা করতে বেগ পেতে হচ্ছিল, রেলগাড়ি-টেলিগ্রাফ আসার পর তা দ্রুত বদলে যেতে থাকল। ১৭৪৮ সাল থেকেই একজন প্রধান হিসেবে থাকলেও ৩ জন আলাদা কমান্ডার-ইন-চিফ ৩ বাহিনী পরিচালনা করতেন। সাধারণত বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রধানই নামে ৩ বাহিনীর প্রধান হিসেবে থাকতেন। অবশেষে বেঙ্গল, মাদ্রাজ ও বোম্বের ৩ বাহিনী একজন Commander-in-Chief of the Army in India-এর অধীনে আসে। বেঙ্গল আর্মিকে ২টি কমান্ডে ভাগ করে এবং বাকি ২টি বাহিনীকে ১টি কমান্ড হিসেবে মোট ৪টি কমান্ডে ভাগ করে একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে একেকটি কমান্ডের ভার দেওয়া হয়। সবার ওপরে রইলেন একজন কমান্ডার-ইন-চিফ।
ভারতীয় ফৌজের র্যাংকিং পদ্ধতি
ভারতীয় ফৌজের ভারতীয় সৈনিকদের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া সামরিক কর্তৃপক্ষ যে র্যাংক পদ্ধতি চালু করেছিলেন, পরবর্তীতে দীর্ঘদিন সেগুলোই প্রচলিত ছিল। তবে ইংরেজ অফিসার এবং পরবর্তীতে উচ্চতর অফিসার র্যাংকে নিযুক্ত ভারতীয়রা ইংরেজ নিয়মই অনুসরণ করতেন, যদিও সেটি তারা রাজকীয় কমিশন (King’s Commission) হিসেবেই লাভ করতেন, ভারতীয় কমিশন অনুযায়ী নয়। ভারতীয় ফৌজে ভারতীয় কমিশন অনুযায়ী র্যাংকগুলো হলো:
লাইট ক্যাভালরি/সওয়ার ফৌজ:
অফিসার র্যাংক: রিসালদার মেজর – রিসালদার – জমাদার
সাধারণ র্যাংক: দফাদার মেজর – দফাদার – ল্যান্স দফাদার
ইনফ্যান্ট্রি/পদাতিক ফৌজ:
অফিসার র্যাংক: সুবেদার মেজর – সুবেদার – জমাদার
সাধারণ র্যাংক: হাবিলদার মেজর – হাবিলদার – নায়েক – ল্যান্স নায়েক
চতুর্থ পর্ব: ঔপনিবেশিক ভারতের সামরিক বাহিনী: কিচেনারের পুনর্গঠন (পর্ব-৪)