সুবুতাই বাগাতুর: কিংবদন্তী মঙ্গোল সেনানায়ক

চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মঙ্গোল ঘোড়সওয়ারেরা ইউরেশিয়া জুড়ে কী তাণ্ডব চালিয়েছিল তা আজ কারো অজানা নেই। মঙ্গোল রণনেতা সুলদের আশীর্বাদপ্রাপ্ত এই খান তেমুজিন অত্যন্ত দক্ষ সামরিক কর্তা আর প্রশাসক ছিলেন, কিন্তু স্রেফ সম্রাট সুদক্ষ হলেই সাম্রাজ্য শক্তিশালী হয় না। বিরাট এবং ক্রমবর্ধমান মঙ্গোল সাম্রাজ্যে যুদ্ধবিগ্রহ চলতেই থাকতো। কাজেই চেঙ্গিস খানের সমরসজ্জায় দক্ষ এবং কুশলী সামরিক নেতাদের বিশেষ কদর ছিল। এমনই একজন হচ্ছে সুবুতাই বাগাতুর। বাগাতুর শব্দের অর্থ বীর। এক চোখ অন্ধ এবং তরবারীর আঘাতে বিকৃত মুখের এই সামরিক নেতা মঙ্গোলদের দ্বিগ্বিজয়ী হওয়ার অন্যতম কারিগর। 

সুবুতাইয়ের রণকৌশল

তুমান অধিপতি সুবুতাইয়ের অধীনে সাধারণ সময়ে থাকতো ১০ হাজার অশ্বারোহী। সেনা ও অশ্ব উভয়েই বর্মে আবৃত। সুবুতাইসহ মঙ্গোলদের বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের সেনাদলে সবসময় একজন মানুষের অনুপাতে দুই বা ততোধিক ঘোড়া থাকতো। মঙ্গোলরা ছুটতে ছুটতে খুব দ্রুত এক ঘোড়া থেকে অন্য ঘোড়ায় বসতো। ফলে যেখানে সাধারণ অশ্বারোহীদের বিশ্রাম নিতে হয়, সেখানে মঙ্গোলরা খুব অল্প সময়ে বিরাট দূরত্ব পাড়ি দিয়ে এমন জায়গায় হাজির হতো, যেখানে তাদেরকে কেউ কল্পনা করেনি। কখনোই নিজের মূল গন্তব্যকে আগেভাগে প্রকাশ না করায় সুবুতাইকে ঠেকাবার জন্য শত্রুদেরকে নিজেদের সেনাদল ভাগ করে করে ছড়িয়ে দিতে হতো। এই ছত্রভঙ্গ সেনারা পরবর্তী মঙ্গোল আক্রমণের মুখে দাঁড়াতেই পারতো না।

মঙ্গোল অশ্বারোহী; Image Source: Pinterest

সুবুতাই বেশিরভাগ সময়েই তার আরেক কিংবদন্তী সহযোদ্ধা জেবে নোইয়নের সাহায্য পেয়েছিলেন। শত্রুদল খুব শক্তিশালী আর সাহসী হলে সুবুতাইয়ের প্রথম উদ্দেশ্যই থাকতো তাদেরকে ঘিরে ফেলা। মঙ্গোলরা ইচ্ছা করেই এই বেষ্টনীর মধ্যে একটা দুর্বল অংশ রেখে দিত। ঘেরাওয়ের ফলে আতংকিত শত্রুরা এই ছলটা ধরতে পারতো না। পালাতে গিয়ে বেশিরভাগ সময়েই তাদের মধ্যে পূর্বেকার একতা থাকতো না এবং মঙ্গোলরা তখন তাদেরকে তাড়া করে দ্রুতই শেষ করে দিত। কালকা আর মোহি নদীর যুদ্ধে শক্তিশালী ইউরোপীয়রা এই ফাঁদে পড়ে।

সে আমলে শহরগুলো বিরাট বিরাট প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকতো। দুর্গ আর শহর জয় করবার জন্য চীনা কারিগরদের সাহায্যে সুবুতাই বিশাল বিশাল সব পাথর আর দাহ্য তরল পদার্থ ভর্তি পাত্র ছুড়ে মারবার যন্ত্র বানিয়েছিলেন। আগুন আর পাথরে শহরের প্রাচীর ভেঙে পড়লে মঙ্গোল অশ্বারোহীরা তাদের ভয়ংকর ধনুক আর বাঁকা তরবারি নিয়ে ব্যাপক গণহত্যা চালাতো। হত্যালীলার খবর দ্রুত ছড়ানোর ফলে অন্যান্য শহর আর দুর্গের রক্ষকদের মনোবল ভেঙে পড়তো। চেঙ্গিস খানের মতো সুবুদাইও কেবল জয় করে সন্তুষ্ট থাকতেন না। বিজিত দেশের জনগণের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়ে চেঙ্গিস খানের শাসনাচার জাসা প্রতিষ্ঠা করে তবেই অভিযান সম্পূর্ণ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হতো।

সুবুতাই এবং জেবে; Image Source: Pinterest

সুবুতাই ছিলেন সব দিক বিচারে বিশ্বের ভয়ংকরতম সামরিক কর্তাদের একজন। ২০টি সামরিক অভিযানে ৩২টি জাতিকে পরাস্ত করেছিলেন তিনি। জিতেছিলেন পয়ষট্টিখানা যুদ্ধ। পোল্যান্ড আর হাঙ্গেরির সেনাদলকে কয়েকদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে মঙ্গোলদের ঝান্ডা উড়িয়েছিলেন সুদূর মধ্য ইউরোপে। রুশ, তাতার, কিপচাক, কুমান, চীনা, জর্জীয়, পোল, বুলগার, উজবেক, তুর্কমেন, আজারি, কাজাখসহ সবাই হার মেনেছে বদখত চেহারার এই মঙ্গোলের হাতে। দীর্ঘদিন ধরে সুবুতাইয়ের রণকৌশল বিস্মৃত অবস্থায় ছিল। রুশরা প্রথম নিজেদের সেনাদলে সুবুতাইয়ের রণকৌশল প্রয়োগ করা শুরু করে। সোভিয়েতদের কাছে সুবুতাইয়ের বিশেষ কদর আছে। ‘ডিপ অপারেশন’ নামক সোভিয়েত সমর পরিকল্পনা সুবুতাইয়ের রণনীতির ওপরে ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।

উত্থান ও উল্লেখযোগ্য অভিযানসমূহ

১১৭৫ সালে সুবুতাইয়ের জন্ম হয়। তার পরিবারের লোকেদের বাস ছিল মঙ্গোলিয়ার উত্তরাংশে, সাইবেরিয়াতে। বনচারী এই অধিবাসীদের সাথে দক্ষিণের অনেক মঙ্গোল যাযাবরদের যোগাযোগ ছিল। সুবুতাইয়ের পরিবার ঐতিহাসিকভাবে চেঙ্গিস খানের পরিবারের তাবেঁতে থাকায় দুজনেই অনেক ছোটবেলা থেকে পরিচিত ছিলেন। সুবুতাইয়ের বড় ভাই জেলমি একবার জেবে নামের এক দুর্ধর্ষ তীরন্দাজের হাত থেকে চেঙ্গিস খানকে বাঁচায়। বেপরোয়া জেবে পরে চেঙ্গিস খানের পক্ষে যোগ দেয়। সুবুতাই কিশোর বয়সেই মোঙ্গল খান-ই-খানান এর তাঁবু পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব পায়। ক্রমে তাকে তুমান অধিপতি করে দেওয়া হয়। একেকটি তুমানে ১০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য থাকতো। সমকালীন ঘটনাপঞ্জীতে সুবুতাইকে চেঙ্গিস খানের সবথেকে বিশ্বস্ত সহচরদের মধ্যে একজন বলে নির্দেশ করা হয়।

সুবুতাই বাগাতুর; Image Source: Pinterest

প্রথম জীবনে জেবে নোইয়নের মতো চতুর সামরিক নেতাদের সাহচর্য পেয়ে সুবুতাই ক্রমেই কূটকৌশলী এক যোদ্ধা হিসেবে বেড়ে ওঠেন। চেঙ্গিস খানের জাতশত্রু মেরকিতদেরকে প্রথম সুযোগেই কচুকাটা করে তিনি মঙ্গোল খানের নেকনজর পান। ক্রমেই মঙ্গোলিয়ার স্তেপ থেকে নীরবে বিশ্বের বিচক্ষণতম সেনা নেতাদের একজন চীনের দিকে এগোতে থাকে।

জি জিয়া প্রদেশের তাঙ্গুতদের সাথে মঙ্গোল খানের মোটেও বনতো না। তিনি তাঙ্গুতদেরকে উত্তর দিক দিয়ে আক্রমণ করেন। তাঙ্গুতরা যখন যুদ্ধে ব্যস্ত, তখন সুবুতাই দুর্গম পাহাড় আর মরুভূমি পাড়ি দিয়ে পশ্চিম দিক দিয়ে তাঙ্গুত সাম্রাজ্য আক্রমণ করে বসেন। দুই দিক থেকে হামলা ঠেকাতে না পেরে তাঙ্গুতরা রণে ভঙ্গ দেয়। সুবুতাই এর পরেও অনেকবার চীনে হানা দিয়েছেন।

খরেজম সাম্রাজ্যে হামলা

মেরকিত আর কিপচাক জাতির লোকেদের সাথে মঙ্গোলদের বিরোধ কিছুতেই থামছিলো না। ১২১৭ সাল নাগাদ মঙ্গোলরা খরেজম সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়ে। খরেজমের তখনকার শাসক দ্বিতীয় মোহাম্মদ নিজেকে দ্বিতীয় আলেক্সান্ডার  ভাবতেন। অথচ তিনগুণ বড় সেনাদল নিয়ে ইরগিজ নদীর তীরে তিনি সুবুতাইয়ের ২০ হাজার সৈন্যের হাতে বেদম নাকাল হন। কয়েক বছর পরে সুবুতাই ভয়াল কিজিল্কুম মরু পার হয়ে আচমকা বুখারা দখল করে নেন, কিছুদিন পরে প্রায় বিনাযুদ্ধেই সমরখন্দের পতন ঘটে চেঙ্গিস খানের হাতে। উপায়ন্তর না দেখে দ্বিতীয় আলেক্সান্ডার কাস্পিয়ান সাগরের একটি দ্বীপে পালিয়ে যান। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তার সেনাদল ধুলোয় মিশে যায়।

খরেজম সাম্রাজ্য; Image Source: Youtube

ককেশাস

খরেজমের পতন ঘটলেও কিপচাক আর কুমান নামক যাযাবরেরা তখনো ককেশাস এবং দক্ষিণ রাশিয়ার স্তেপে সদর্পে বিরাজ করছে। সুবুতাই মাত্র ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে এক সপ্তাহেই ১২০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে গোটা ককেশাস ঘুরে আচমকা ককেশীয় সাম্রাজ্যগুলোর ওপরে হামলে পড়েন। আজারবাইজান আর জর্জিয়া ছারখার করে দেয় মঙ্গোল সেনারা। শুধু তা-ই নয়, আলান, কিপচাক আর সিরকাসিয়ানদের নিয়ে গড়া যৌথ বাহিনীকেও তিনি হারিয়ে দেন। উপায়ন্তর না দেখে কিয়েভে রুশ রাজন্যবর্গ মিলে এক শক্তিশালী সামরিক জোট গঠন করে মঙ্গোলদের প্রতিরোধ করবার জন্য এগিয়ে আসেন।

সুবুতাই প্রথমে প্রথমে অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে পালাবার ভান করেন। রুশেরা কালবিলম্ব না করে তাদের ধাওয়া করতে থাকে। কালকা নদীর কাছে এসে এই রুশ সেনাদল আগে থাকতে লুকিয়ে থাকা সুবুতাইয়ের মূল সেনাদলটির খপ্পরে পড়ে একরকম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সুবুতাইয়ের জয়রথ হয়তো আরো চলতো, তবে ১২২৯ সালে চেঙ্গিস খানের মৃত্যু হয় এবং খানের সেজো ছেলে ওগেদেই খান ক্ষমতায় বসেন। প্রায় একই সময়ে চীনের জিন রাজবংশের সেনাদলের হাতে মঙ্গোলদের পরাজয় হলে সুবুতাইকে পুনরায় চীনে ডেকে পাঠানো হয়।

কিপচাক সৈন্য; Image Source: Pinterest

আবার চীন আক্রমণ

সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে মঙ্গোলদের পক্ষে শক্তিশালী জিন সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করা সম্ভব হতো না। সুবুতাই টানা তিন সপ্তাহ ধরে চীনা সেনাদের খাদ্য সরবরাহের লাইনগুলো তছনছ করে দিতে থাকেন। ফলে চীনারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সুবুতাইয়ের সেনাদের বিপক্ষে হেরে যায়। জিন সাম্রাজ্যের সামরিক প্রধান এর আগে মঙ্গোলদেরকে তিনবার যুদ্ধে পরাস্ত করেছিলেন। সেই তিনিও সুবুতাইয়ের প্রশংসা করতে বাধ্য হন। সুবুতাই পরে চীনের সং সেনাবাহিনীকেও নিকেশ করেন।

রাশিয়া ও ইউরোপ

বুলগার, কুমান এবং কিপচাক জাতির লোকেদের সাথে মঙ্গোলদের বিরোধ অব্যাহত ছিল। ১২৩৬ সালে সুবুতাই রাশিয়া অভিযানে বেরোলেন। তার সাথে ছিল চেঙ্গিস খান তনয় জুচির ছেলে বাতু খানসহ অন্যান্য মঙ্গোল রাজপুত্রগণ। বিরাট এক ধনুক আকারে ভোলগা তীরের বুলগার আর কিপচাক ঘাঁটিগুলোর দিকে মঙ্গোলরা এগিয়ে এলো। আরেক অংশ উরাল পর্বত পাড়ি দিয়ে আচমকা হাজির হলে কিপচাক আর বুলগাররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সুজদালসহ বড় বড় রুশ সাম্রাজ্যগুলোও একে একে মঙ্গোলদের হাতে বিধ্বস্ত হয়। সুবুতাইয়ের জয়রথ গিয়ে থামে সোজা কিয়েভে। রুশ রাজন্যদেরকে ধ্বংস করে এবারে তিনি তাকালেন বাদবাকি ইউরোপের দিকে।

কালকা নদীর যুদ্ধ; Image Source: Magnolia Box

উল্লেখ্য, রাজপরিবারের অংশ না হওয়ায় এসব বিজয় অভিযানে কিন্তু সুবুতাইয়ের বদলে বাতু খান বা অন্যান্য রাজবংশীয়দের কথা বেশি প্রচার পেয়েছে। যা-ই হোক, সুবুতাইয়ের নির্দেশে মঙ্গোলরা পাঁচভাগে বিভক্ত হয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। প্রথম দল উত্তর পোল্যান্ডে, দ্বিতীয় দল দক্ষিণ পোল্যান্ডে, তৃতীয় দল পূর্ব হাঙ্গেরিতে, বাতু খান এবং সুবুতাই স্বয়ং মধ্য হাঙ্গেরি এবং শেষ দল ট্রানসিলভানিয়া দিয়ে এগোতে থাকলো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মঙ্গোলদের এই দলগুলোর ব্যবধান প্রায় ৫০০ মাইল থাকলেও সেই প্রাচীন অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার দিনেও তারা অদ্ভুত শৃংখলা বজায় রেখে এগোতে থাকে। মঙ্গোলরা আসলে কী চায় তা বুঝতে না পেরে হাঙ্গেরি আর পোল্যান্ডের সেনাবাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে।

ছোট ছোট দলগুলো মঙ্গোলদের হাতে চুরমার হয়ে যেতে থাকলো। ১২৪১ সালে সুবুতাই মোহি নদীর যুদ্ধে হাঙ্গেরির মূল সেনাদলকে হারিয়ে দেন। তার বিজয় অভিযানে রোমান সাম্রাজ্যও খুব সম্ভবত বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারতো না। কিন্তু এমন সময়ে ওগেদেই খানের মৃত্যু হয়। রাশিয়ার কুমানরা আবার বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ফলে সুবুতাইকে আবার ফিরে যেতে হয়। স্তেপের যোদ্ধাদের হাত থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচে ইউরোপ।

সুবুতাইয়ের ইউরোপ অভিযান; Image Source: Pinterest

কুমানদেরকে পরাস্ত করে এবং সং সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে কিছু সফল অভিযান চালিয়ে সুবুতাই বর্তমান মঙ্গোল রাজধানী উলান বাটরের কাছে ফিরে আসেন। বাহাত্তর বছর বয়সে এই বাগাতুরের মৃত্যু হয়। জেবে, কুবলাই (কুবলাই খান নয়), জেলমে আর সুবুতাই; এই চারজনকে চেঙ্গিস খানের সবথেকে সেরা সেনানায়কের মর্যাদা দেওয়া হয়। 

ফিচার ইমেজ – WordPress.com

Related Articles

Exit mobile version