১
১৫৩৮ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে অনেকটা বিনা বাঁধাতেই মুঘল সম্রাট হুমায়ুন বাংলার রাজধানী গৌড় জয় করে নেন। ইতোপূর্বেই শের খান বাংলার হোসেন শাহী রাজবংশের সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহকে অপসারণ করে বাংলার মসনদ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। সুলতান মাহমুদের সাহায্য প্রার্থনার প্রেক্ষিতে সম্রাট সরাসরি বাংলায় অভিযান চালান। সম্রাট বাংলার দিকে অগ্রসর হলে শের খান বাংলা থেকে পালিয়ে রোহতাস দুর্গে আশ্রয় নেন। সাথে করে তিনি নিয়ে যান বাংলার সমৃদ্ধ রাজকোষ।
সম্রাট হুমায়ুনের বাংলা বিজয় সমাপ্ত হলো, তবে তাতে সম্রাট খুব একটা স্বস্তি পেলেন না। গৌড়ে এসে সম্রাটের সামনে সমাধান করার মতো বেশ কিছু সমস্যা এসে উপস্থিত হলো।
শের খানের আফগান বাহিনী গৌড় ত্যাগের পূর্বে নগরীটিকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়ে গেল। ধ্বংসস্তুপ পরিষ্কার করে হুমায়ুনকে নগরীটিকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে।
এছাড়া আফগানরা বাংলায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলো। হুমায়ুন গৌড়ে এসে যত্রতত্র মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখলেন। এসব মৃতদেহ দাফন করার মতো প্রয়োজনীয় লোকও ছিলো না। মুঘল যোদ্ধারা এসব মৃতদেহ দাফনের ব্যবস্থা করলেন।
গৌড়কে মোটামুটি কিছুটা গুছিয়ে হুমায়ুন বাংলাকে কয়েকটি অংশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ করে দিলেন।
২
বাংলার জলবায়ু প্রথম থেকেই সম্রাট হুমায়ুনের ভালো লেগে গিয়েছিলো। তিনি গৌড়ের নাম রাখলেন ‘জান্নাতাবাদ’। অবশ্য গুলবদনের মতে, গৌড় শব্দের ফারসী অর্থ ‘কবর’ হওয়ার কারণে হুমায়ুন বাংলার রাজধানীর নাম পরিবর্তন করেছিলেন।
তবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে দেখা যায়, বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন আহম শাহের মুদ্রায় ‘জান্নাতাবাদ’ নামটি খোদাই করা আছে। অর্থাৎ, গৌড়ের নাম ‘জান্নাতাবাদ’ অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিলো। হুমায়ুন সম্ভবত এই নামটিই পুনর্বহাল করে গিয়েছিলেন।
এদিকে, তেলিয়াগড়ির গিরিপথ থেকে জালাল খান পালিয়ে যাওয়ার পর সম্রাট হুমায়ুন তার ছোটভাই মির্জা হিন্দালকে রাজকীয় সেনাবাহিনীর রসদ সংগ্রহের জন্য তিরহুত আর পূর্ণিয়ার দিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
হিন্দাল ছিলেন তিরহুত আর পূর্ণিয়ার জায়গীরদার। এই দুটি জায়গা হিন্দুস্তানের মূল ভূখন্ড থেকে বাংলার প্রবেশদ্বারের মুখে ছিলো।
কিন্তু হিন্দাল তিরহুত বা পূর্ণিয়া, কোনোখানেই গেলেন না। তিনি সোজা আগ্রার পথ ধরলেন। হিন্দাল তখন মুঘল মসনদের স্বপ্নে বিভোর!
হিন্দাল মির্জার বিদ্রোহের খবর দ্রুত রাজধানীতে পৌঁছে গেলো। মীর ফখর আলী হতভম্ব হয়ে দিল্লি থেকে আগ্রা এলেন। তিনি হিন্দাল মির্জাকে জৌনপুরে যেতে রাজি করালেন।
এদিকে বাংলায় হুমায়ুনের দরবার থেকে পালিয়ে খসরু বেগ কুকুলতাশ, মির্জা নজর ও জাহিদ বেগের মতো প্রভাবশালী কিছু আমির হিন্দাল মির্জার সাথে যোগ দিলেন।
৩
হিন্দাল মির্জার বিদ্রোহের খবর বাংলায় বসে হুমায়ুনও পেলেন। তিনি হয়তো ব্যাপারটিকে ছোট ভাইয়ের পাগলামী হিসেবেই বিবেচনা করলেন। নিজে দ্রুত আগ্রা ফিরে না এসে গ্র্যান্ড মুফতি শেখ বাহালুলকে পাঠালেন হিন্দালকে বোঝানোর জন্য। গ্র্যান্ড মুফতি শেখ বাহালুল হিন্দাল মির্জার সাথে দেখা করলেন। হিন্দাল মির্জা শেখ বাহালুলের সাথে কথাবার্তার পর পুরোপুরি শান্ত হয়ে গেলেন।
বাঁধ সাজলেন আরেক বিদ্রোহী মুঘল আমির কনৌজের মির্জা নূরুদ্দিন মুহাম্মদ। পুনরায় বিদ্রোহের আগুন জ্বালালেন হিন্দাল মির্জা। শেষ পর্যন্ত তাদের ষড়যন্ত্রে নির্মমভাবে খুন হলেন গ্র্যান্ড মুফতি শেখ বাহালুল।
হিন্দাল মির্জা নিজেকে স্বাধীন সম্রাট ঘোষণা করলেন। তার নামে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী আগ্রায় খুতবা পাঠ করানো হলো।
আগ্রায় ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে হিন্দাল মির্জা দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করলেন। মীর ফখর আলী আর ইয়াদগার নাসির মির্জা দিল্লির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করলেন।
সম্রাট হুমায়ুন বাংলাতে ব্যস্ত আছেন। তাই হিন্দাল মির্জা দিল্লি অবরোধ করার পূর্বেই মীর ফখর আলী কামরানকে হিন্দালের বিদ্রোহের ব্যাপারে জানিয়ে দিলেন। তিনি কামরানকে দিল্লি রক্ষার আমন্ত্রণ জানালেন। কামরান দ্রুত দিল্লি অভিমুখে ধেয়ে আসতে লাগলেন।
৪
কামরান দিল্লি অভিমুখে আসছে, গোয়েন্দা মারফত এই তথ্য পেয়ে হিন্দাল মির্জা অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে আগ্রা চলে গেলেন। মীর ফখর আলী কামরানকে আগ্রা গিয়ে হিন্দালকে ধাওয়া করতে অনুরোধ করলেন। মীর ফখর আলী জানতেন, কামরানের স্বপ্নও এই মুঘল মসনদ। তাই তিনি কৌশলে কামরানকে দিল্লির আশেপাশেও ঘেষতে দিলেন না।
কামরান মির্জার ধাওয়া খেয়ে হিন্দাল মির্জা আলোয়ারের দিকে চলে গেলেন। তবে শেষপর্যন্ত হিন্দাল মির্জা বুঝলেন তিনি এই বিদ্রোহ থেকে কোনোভাবেই লাভবান হতে পারবেন না। তিনি কামরান মির্জার নিকট আত্মসমর্পণ করলেন।
এদিকে হিন্দাল মির্জা নিজের জায়গীর তিরহুত আর পূর্ণিয়া অরক্ষিত অবস্থায় রেখে আগ্রা চলে যাওয়ায় বিপদে পড়লেন হুমায়ুন। সেই সাথে বিপদে পড়লো হুমায়ুনের সাথে বাংলায় অবস্থান করা বিপুল সংখ্যাক মুঘল যোদ্ধারা।
হিন্দালের জায়গীর বাংলার প্রবেশ পথের মুখে অবস্থিত ছিলো। হিন্দাল এভাবে তিরহুত আর পূর্ণিয়া ত্যাগ করে চলে গেলে এসব স্থানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে গেলো। হিন্দালের বিদ্রোহের কারণে এসব স্থানে রাজধানী থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বাহিনীও পাঠানো সম্ভব হলো না।
এদিকে মুঘল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীন এ সংকট থেকে লাভবান হলেন শের খান আর আফগানরা। শের খান দ্রুত বিহার অধিকার করে নিলেন। এরপর তিনি দ্রুত বেনারস দখল করে নিলেন। বেনারসের মুঘল প্রশাসক মীর ফজল আলীকে হত্যা করা হলো। আরও হত্যা করা হলো প্রায় ৭০০ মুঘল সৈন্যকে।
৫
শের খান এরপর দ্রুত জৈনপুর অবরোধ করলেন। জৈনপুরের মুঘল প্রশাসক বাবা বেগ জলায়র শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। আফগানরা জৈনপুরে সুবিধা করতে না পেরে অবরোধ তুলে চলে গেলো।
শের খান এরপর আক্রমণ চালালেন বাহরাইচ আর সম্ভলে। অপরাজেয় মুঘলদের এসব জায়গা থেকেও পিছু হটতে হলো। সম্ভলের অধিবাসীদের দাসে পরিণত করে শহরটি ধ্বংস করা হলো। খান খানান ইউসুফ খইল মুঙ্গেরে বন্দী হলেন মুসাহিব খানের হাতে।
সম্ভল থেকে আফগান সেনাবাহিনী সোজা রওয়ানা হলো আগ্রা বরাবর। মুঘল জেনারেলরা আফগানদের শক্তভাবে প্রতিরোধ করলেন। আফগানরা আগ্রা পৌঁছাতে পারলো না বটে, তবে ধীরে ধীরে দোয়াবের দক্ষিণ-পূর্বাংশ মুঘলদের হাতছাড়া হয়ে যেতে লাগলো। দখলীকৃত বিস্তীর্ণ মুঘল ভূমি থেকে শের খান রাজস্ব আদায় করতে লাগলেন। মুঘল অর্থে আফগানদের কোষাগার ভর্তি হতে লাগলো।
এদিকে শের খানের এসব তৎপরতার জন্য হুমায়ুন তার রাজধানী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন।
৬
প্রচণ্ড শক্তিশালী আর তখন পর্যন্ত অপরাজেয় মুঘল সাম্রাজ্যের এত দ্রুত অধঃপতনের কারণ কী ছিলো?
এর উত্তর পাওয়া যায় হুমায়ুনের জীবনীকার জওহর আবতাবচির বর্ণনা থেকে। তিনি বলেন,
‘হুমায়ুন (বাংলায় অবস্থানকালে) ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে গেলেন। গৌড় অধিকারের পর প্রায় একমাস কেউ তার দর্শন লাভ করতে পারলো না। তিনি সর্বদাই একান্তে নিজের বাসভবনে সময় কাটাতে লাগলেন।’
আকবরনামার লেখক আবুল ফজলও একই তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন,
‘বাংলার জলবায়ু হুমায়ুনের খুব ভালো লেগে যাওয়াতে তিনি ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে গেলেন।’
তিনি আরো বলেন,
‘যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার কারণে কোনো সংবাদ সময়মতো শিবিরে পৌঁছাতে পারতো না। আর যদি পৌঁছাতোও, তা সম্রাটের কাছে পৌঁছানোর সাহস কারো হতো না। কারণ, সম্রাটের দুঃখের কারণ হতে পারে, এমন কোনো সংবাদ সম্রাটের নিকট পৌঁছানো নিষিদ্ধ ছিলো।’
এই যদি হয় সাম্রাজ্যের কর্ণধারের অবস্থা, তাহলে সেই সাম্রাজ্য অধঃপতিত হবে না কেন?
গৌড় দখলের পর হুমায়ুনের বাংলায় অবস্থান করার বিশেষ কোনো কারণ ছিলো না। বাংলায় পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায়ের কাজ তার জেনারেলরাই করতে পারতেন। কিন্তু আমোদ-প্রমোদের জন্য হুমায়ুন বাংলাতেই থেকে গেলেন।
হিন্দালের বিদ্রোহের সংবাদ শুনে সম্রাটের কি উচিত ছিলো না দ্রুত রাজধানীতে ফিরে আসা? তিনি তা-ও করলেন না।
সম্রাটের যখন এই অবস্থা হয়, শের খান তাহলে সুযোগ নেবেন না কেন?
৭
হুমায়ুনের ঘুম ভাঙলো তখন, যখন তিনি বুঝতে পারলেন তিনি ফাঁদে পড়ে গেছেন। কিন্তু তখন বাংলায় অবস্থান করা ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় ছিলো না। কারণ বাংলার বিখ্যাত সেই বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। এই বর্ষায় মুঘল সেনাবাহিনী কোনো রকমের চলাচল না করে স্থির অবস্থায় বসে থাকতে বাধ্য হলো।
এর ভেতরে দেখা দিলো প্রচণ্ড খাদ্যসংকট। ফলে মুঘল যোদ্ধারা মারা যেতে লাগলেন। মারা যেতে লাগলো যুদ্ধে ব্যবহৃত পশুও।
প্রচণ্ড সংকটময় এ পরিস্থিতিতে দলত্যাগের ঘটনা বাড়তে লাগলো। সৈন্যরা সুযোগ পেলেই বিনা আদেশে বাংলা ত্যাগ করে আগ্রা পৌঁছানোর চেষ্টা করতে লাগলো। এক ধাক্কায় রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর যোদ্ধাদের মনোবল তলানীতে গিয়ে ঠেকল। এদিকে শের খান কিন্তু থেমে নেই। তিনি তার মতো নিশ্চিন্তে কাজ করে যাচ্ছেন।
সম্রাট হুমায়ুনের বাংলা অভিযানের মূল কারণ ছিলো শের খানকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করে সুলতান গিয়াস উদ্দিন মুহাম্মদ শাহকে মসনদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। সুলতান গিয়াস উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ মারা গেলে সম্রাট নিজেই বাংলা অধিকার করে নিলেন। সেই সাথে শের খানকেও বাংলা ছাড়া করতে সক্ষম হলেন।
এটুকু পর্যন্ত সবই ঠিক ছিলো। কিন্তু তিনি এরপর যা করলেন, তা মোটেও ভালো কোনো নেতৃত্বের গুণাবলীর মাঝে পড়ে না। তার এ সকল ত্রুটির ফলে মুঘল সাম্রাজ্য একটি ভয়ংকর গৃহযুদ্ধে জড়াতে গিয়েও কোনোমতে বেঁচে গেল। কিন্তু রাজধানীতে তার দীর্ঘ অনুপস্থিতি সেদিকের রাজনীতি জটিল করে তুললো, যা দিন শেষে মুঘল সাম্রাজ্যকে বিপদের মুখেই ঠেলে দিয়েছিলো।
বাংলায় অবস্থানের ৯ মাস পর হুমায়ুন ঠিকই তার বিপদ বুঝতে পারলেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি নিজেকে ফাঁদে পড়া অবস্থায় আবিষ্কার করলেন। এখন যেভাবেই হোক তাকে দ্রুত আগ্রা পৌঁছে রাজনীতির এই জটিল পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে।
৮
গৌড় বিজয়ের ৯ মাস পর সম্রাট হুমায়ুন বাংলা ত্যাগ করে আগ্রা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বাংলার প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার জন্য আমিরদের মধ্য থেকে কাউকে আহবান করলেন। কিন্তু বাংলায় মুঘলরা আসলেই এতটা শোচনীয় অবস্থা ছিলো যে কেউই সাহস করে রাজি হলেন না।
আগ্রহী কাউকে না পেয়ে শেষমেষ সম্রাট জাহিদ বেগকে বাংলার প্রশাসক হওয়ার প্রস্তাব দিলেন। জাহিদ বেগ মুখ ফস্কে বলে ফেললেন,
‘আমাকে হত্যার অন্য কোনো পথ না পেয়ে সম্রাট আমাকে বাংলায় রেখে যেতে চাইছেন।’
জাহিদ বেগের এ কথা শুনে সম্রাট অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। জাহিদ বেগ নিজের জীবনের আশঙ্কায় বাংলা থেকে পালিয়ে আগ্রায় মির্জা হিন্দালের সাথে যোগ দিলেন। সাথে নিয়ে গেলেন তার দুই আমির হাজী মুহাম্মদ কোকা আর জনদর বেগকে।
শেষপর্যন্ত জাহাঙ্গীর কুলি খান বাংলার গভর্নরের দায়িত্ব নিলেন। বাংলা রক্ষার জন্য তার অধীনে মাত্র ৫০০০ মুঘল সৈন্য মোতায়েন করে ১৫৩৯ সালের মার্চ মাসে সম্রাট হুমায়ুন গঙ্গা নদীর উত্তর কূল ধরে আগ্রার দিকে এগোতে লাগলেন।
৯
সম্রাটের আগ্রা অভিযান মোটেও সহজ হলো না। পথের দুর্গমতা সৈন্যদের মনোবল কমিয়ে দিলো।
আফগানরা আবারও সম্রাটকে তেলিয়াগড়িতে বাঁধা দেয়ার চিন্তা করলো। শের খান তেলিয়াগড়িতে আবারও একটি শক্তিশালী বাহিনী মোতায়েন করলেন। বাংলা থেকে আগ্রা যেতে হলে হুমায়ুনকে এই পথ ধরেই যেতে হবে।
একে তো আফগানদের ধারাবাহিক বাঁধা, অন্যদিকে অতিরিক্ত বর্ষা পুরো পরিস্থিতি জটিল করে তুললো। বর্ষার কারণে রাস্তাঘাট পিচ্ছিল থাকায় সেনাবাহিনীর চলাচল কঠিন হয়ে পড়লো। অতিরিক্ত পরিশ্রমে বিপুল সংখ্যাক ঘোড়া মারা যেতে লাগলো। সেনাবাহিনীতে পর্যাপ্ত রসদ না থাকায় মারা যেতে লাগলেন মুঘল যোদ্ধারাও।
চতুর্মুখী প্রতিকূলতায় সেনাবাহিনীতে চূড়ান্ত বিশৃঙ্ক্ষলা দেখা দিলো। মুঘল সেনাবাহিনীর কমান্ড ভেঙ্গে পড়লো। করুণ এই পরিস্থিতি দেখে হুমায়ুন রীতিমতো ঘাবড়ে গেলেন।
এদিকে সম্রাট ইতোপূর্বেই দিলওয়ার খান লোদীকে মুঙ্গেরে পাঠিয়েছিলেন মুঙ্গের দখল করতে। দিলওয়ার খান লোদী মুঙ্গেরে পৌঁছলেন বটে, তবে সম্ভবত না পৌঁছালেই ভালো হতো। তিনি সেখানে গেলেন এবং আফগানদের হাতে বন্দী হলেন।
সম্রাট তার ভাই আসকারি মির্জাকে মুঙ্গেরে পাঠালেন দিলওয়ার খান লোদীকে উদ্ধার করার জন্য।
সম্রাট আগ্রার পথে চলছিলেন গঙ্গার উত্তর পথ ধরে, কিন্তু বাংলা গিয়েছিলেন গঙ্গার দক্ষিণ পথ ধরে। শের খান ভাবতে পারেন সম্রাট ভয় পেয়ে রাস্তা বদল করে চলছেন। এ কারণে আমিরদের পরামর্শে মুঙ্গের থেকে সম্রাট পথ পরিবর্তন করে গঙ্গার দক্ষিণ পথ ধরেই চলতে শুরু করলেন।
তবে পথ পরিবর্তন করাটা মুঘল সেনাবাহিনীর জন্য ভালো কিছু বয়ে আনেনি। আফগানরা ততদিনে গঙ্গার দক্ষিণ দিকে গিজগিজ করছিলো। মুঘল সেনাবাহিনীকে এর ভেতর দিয়েই ছোটখাট সংঘর্ষ করতে করতে এগোতে হচ্ছিলো। এসব সংঘর্ষে আফগানরা সম্রাটে বিখ্যাত কামান ‘কোহশিকন’ দখল করে নিলো। রুমি খান এই কামানটি অত্যান্ত সফলভাবে চুনার দুর্গে ব্যবহার করেছিলেন।
যাত্রাপথ পরিবর্তন করার পাঁচদিন পর সম্রাট চৌসায় পৌঁছালেন।
১০
হুমায়ুন আগ্রা অভিমুখে রওয়ানা দিয়েছেন, এমন সংবাদ শুনে শের খান বিহার আর জৈনপুরসহ অন্যান্য স্থানে মোতায়েনকৃত সবগুলো আফগান ইউনিটকে রোহতাস দুর্গে ডেকে পাঠালেন। আফগানরা রোহতাসে জড়ো হলো।
তিনি আফগান জেনারেলদের সাথে পরামর্শসভায় বসলেন। তিনি বললেন,
‘সম্রাট হুমায়ুন এতদিন বাংলায় পড়ে থাকার কারণে তার বাহিনীতে বর্তমানে চূড়ান্ত বিশৃঙ্ক্ষলা বিরাজ করছে। তার উপর রাজধানী আগ্রা থেকে বিদ্রোহের খবর পাওয়া গেছে। সম্রাট এখন আর আমার উপর দৃষ্টি দিতে পারবেন না। তোমরা যদি আমার সাথে থাকো, তাহলে আমি নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে চাই।’
শের খানের বক্তব্য শুনে আযম হুমায়ুন সরওয়ানী বললেন,
‘মুঘলদের বিরুদ্ধে যতবারই আমরা এগিয়ে গিয়েছি, নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বারবারই পরাজিত হয়েছি।
ভাগ্য আপনার সহায় হয়েছে। তাই আপনার পতাকাতলে আজ সব আফগানরা আন্তরিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। মুঘলদের বিরুদ্ধে আমরা সর্বদাই উন্মুখ।’
কুতুবখান, হয়বৎ খান নিয়াজী, জালাল খান জালোই, সরমস্ত খান, সুজায়ত খানসহ শের খানের সকল অভিজাত আমিররাই মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে আক্রমণ করার পক্ষে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করলেন। তারা সকলেই বললেন, এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না।
১১
শের খান এবার রোহতাসের দুর্গম পথ ছেড়ে হুমায়ুনের অবস্থান বরাবর এগোতে লাগলেন। মুঘল গোয়েন্দারা শের খানের অগ্রযাত্রা সম্পর্কে সম্রাটকে বার্তা পাঠালেন। হুমায়ুন যাত্রাপথ পরিবর্তন করলেন।
শের খান সম্রাট হুমায়ুনকে আবারও বার্তা পাঠালেন,
‘সম্রাট যদি আমাকে বাংলা ফিরিয়ে দিতে রাজি হন, তাহলে সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করে নিতে আমি প্রস্তিত। বাংলায় আমি সম্রাটের নামেই খুতবা পাঠ করাবো এবং সম্রাটের নামেই মুদ্রা প্রচলন করাবো।’
সম্রাট শের খানের এই বার্তার তাৎক্ষণিক কোন উত্তর দেননি। চৌসার পৌঁছানোর পর তিনি এই বার্তার জবাব দিয়েছিলেন।
এদিকে, সম্রাট তার অগ্রযাত্রা বজায় রেখে চৌসার কাছাকাছি পৌঁছালেন। প্রায় একই সময়ে শের খান চৌসার কাছাকাছি বিহিরা নামক স্থানে সেনা ঘাটি স্থাপন করলেন। মুঘল সেনাঘাটি আর আফগান সেনাঘাটির মাঝ বরাবর বয়ে চলছে কর্মনাশা নদী।
শের খানের আফগান বাহিনী দেখেই কাসিম হুসেন সুলতান সম্রাট হুমায়ুনকে আক্রমণ চালানোর জন্য অনুরোধ করলেন। তিনি বললেন, শের খানের বাহিনী দীর্ঘ পথযাত্রায় ক্লান্ত। আক্রমণ চালানোর জন্য এখনই উপযুক্ত সময়।
কিন্তু বাঁধ সাধলেন মুঈদ বেগ। তিনি তখনো সংঘর্ষ এড়িয়ে মুঘল সেনাবাহিনীর আগ্রা পৌঁছানোর ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। সম্রাট হুমায়ুনও ভেবে দেখলেন বাহিনীর এই অবস্থায় সংঘর্ষ এড়িয়ে যেতে পারলেই তা মঙ্গলজনক হবে।
তিনি আক্রমণ পরিচালনা না করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
১২
সম্রাট হুমায়ুন আর শের খান যখন চৌসায় মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে বসে আছেন, কামরান মির্জা তখন আগ্রায় ছিলেন। তিনি হুমায়ুনের এই দুরবস্থার সংবাদ পেয়েছেন। ভাইয়ের এই দুঃসময়ে তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য তিনি সেনাবাহিনী প্রস্তুত করতে লাগলেন।
কিন্তু তার কিছু আমিরের পরামর্শে তিনি আবারও বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। তারা কামরানকে বোঝালো, হুমায়ুনকে উদ্ধার করলে তিনিই সম্রাট থাকবেন। কিন্তু শের খানের কাছে হুমায়ুন পরাজিত হলে কামরানে ভাগ্য খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
মসনদের লোভ অনেক বড় লোভ। শুধুমাত্র মসনদের জন্যই কামরান মির্জা ভাইকে সাহায্য না করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মুঘল সালতানাতের মসনদ দখলের আশায় তার চোখ চকচক করতে লাগলো।
একদিকে সম্রাটের ভাই কামরান মির্জা মসনদের লোভে সম্রাটকে বিসর্জন দিতে মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে আছেন। অন্যদিকে বিশৃঙ্খল মুঘল সেনাবাহিনী নিয়ে সম্রাট হুমায়ুন চৌসারে বসে প্রমাদ গুনছেন। মুঘল সম্রাটের এই করুণ অবস্থা দেখে শের খান মনে মনে নিশ্চয়ই হাসছিলেন!
তথ্যসূত্র
১। মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০০৫
২। তারিখ-ই-শের শাহ; মূল: আব্বাস সারওয়ানী, অনুবাদ গ্রন্থের নাম: শের শাহ, অনুবাদক: সাদিয়া আফরোজ, সমতট প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারী ২০১৫
৩। রিয়াজ-উস-সালাতীন, মূল লেখক: গোলাম হোসায়ন সলীম, অনুবাদ গ্রন্থের নাম: বাংলার ইতিহাস, অনুবাদক: আকবরউদ্দীন, অবসর প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারী ২০০৮
৪। হুমায়ুননামা, মূল: গুলবদন বেগম, অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, প্রকাশকাল: জানুয়ারী ২০১৬
এই সিরিজের আগের পর্বসমূহ
১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা || ২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ || ৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল || ৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক || ৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল || ৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল || ৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন || ৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্য || ৯। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস || ১০। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রশস্ত্র || ১১। জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবুর: ‘একজন’ বাঘের উত্থান || ১২। বাদশাহ বাবরের কাবুলের দিনগুলো || ১৩। বাদশাহ বাবর: হিন্দুস্তানের পথে || ১৪। বাদশাহ বাবরের হিন্দুস্তান অভিযান: চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি || ১৫। মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান: হিন্দুস্তানে বাবরের চূড়ান্ত লড়াই || ১৬। খানুয়ার যুদ্ধ: মুঘল বনাম রাজপুত সংঘাত || ১৭। ঘাঘরার যুদ্ধ: মুঘল বনাম আফগান লড়াই || ১৮। কেমন ছিল সম্রাট বাবরের হিন্দুস্তানের দিনগুলো? || ১৯। মুঘল সম্রাট বাবরের মৃত্যু: মুঘল সাম্রাজ্য এবং হিন্দুস্তানের উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের অকাল পতন || ২০। সিংহাসনের ষড়যন্ত্র পেরিয়ে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের অভিষেক || ২১। মুঘল সাম্রাজ্যের নতুন দিগন্ত: সম্রাট হুমায়ুনের ঘটনাবহুল শাসনামল || ২২। দিল্লি সালতানাত থেকে মুজাফফরি সালতানাত: প্রাক-মুঘল শাসনামলে গুজরাটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস || ২৩। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযানের প্রেক্ষাপট || ২৪। সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযান: সুলতান বাহাদুর শাহের পলায়ন || ২৫। সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযান ও গুজরাটের পতন || ২৬। গুজরাট থেকে মুঘলদের পলায়ন: মুঘল সাম্রাজ্যের চরম লজ্জাজনক একটি পরিণতি || ২৭। শের খান: হিন্দুস্তানের এক নতুন বাঘের উত্থানের গল্প || ২৮। শের খানের বাংলা অভিযান || ২৯। গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ হত্যাকাণ্ড: সাম্রাজ্যবাদী পর্তুগীজদের বিশ্বাসঘাতকতার একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ || ৩০। শের খানের বাংলা বিজয় || ৩১। সম্রাট হুমায়ুনের বাংলা বিজয়: বাংলা থেকে শের খানের পশ্চাদপসরণ
ফিচার ইমেজ: famousplacesinindia.in