সিজারকে হত্যা করার পর কীভাবে ক্ষমতার পালাবদল হবে তা নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তারা কল্পনা করেছিল সিনেট মেরুদণ্ড সোজা করে শক্ত হাতে হাল ধরবে আর তাদের পুরস্কারে ভূষিত করবে। রোমান জনগণও ফুলের মালা দিয়ে অভিবাদন জানাতে ছুটে আসবে। বাস্তবে সিজারের মৃত্যুতে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হলে সিনেট মোটামুটি দিশেহারা হয়ে গেল। সুটোনিস দাবী করেন, সিজারের প্রতি প্রবল ঘৃণা থেকে যদিও বেশিরভাগ সিনেটর চক্রান্তকারীদের মৌন সমর্থন দিয়েছিল, তারা প্রকাশ্যে কিছু করতে সাহস পাচ্ছিল না। তবে তাদের একটি উগ্রপন্থী ক্ষুদ্র অংশ চাচ্ছিল সাধারণ অপরাধীর মতো সিজারের ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ টিবেরে ছুড়ে ফেলতে। মার্ক অ্যান্টনি তাদের বাধা দেন।
সিজারের মৃতদেহ তার দাসেরা বয়ে বাড়িতে নিয়ে গেল। রোমের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়। এর মধ্যে ব্রুটাস তার সঙ্গিদের নিয়ে ক্যাপিটোলাইন পাহাড়ে জুপিটারের মন্দিরে গিয়ে উঠলেন। সেখান থেকে তিনি জনতাকে তাদের কাজের উদ্দেশ্য বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু একনায়ক হলেও সিজার নগরবাসীর কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। কাজেই চক্রান্তকারীরা বুঝতে পারল মানুষ সিজারের হত্যা ভালভাবে নেয়নি। ফলে নিরাপত্তার খাতিরে তারা নিজেদের ঘরে আবদ্ধ করে ফেলে।
এদিকে মার্ক অ্যান্টনির নেতৃত্বে দ্রুত সিজারের সমর্থকরা একত্রিত হলো। সিজারের সম্পত্তি ও উইল সুরক্ষার জন্যে অ্যান্টনির হস্তগত হয়। তিনি লেপিডাসের সাথে জোট বেধে সেনাদের দিয়ে সিনেটের উপর চাপ তৈরি করলেন। ফলে অধিকাংশ সিনেটর সিজারের হত্যাকারীদের পক্ষে থাকলেও প্রাণভয়ে তারা প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারল না। অ্যান্টনি হত্যাকারীদের সাথে একটা সমঝোতায় এলেন। ১৭ মার্চ অধিবেশনে অ্যান্টনি সিজারের সকল আইন এবং উইল পাশ করে নেন, সিনেট জনসমক্ষে সিজারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুমোদন প্রদান করে। বিনিময়ে অ্যান্টনি হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকেন।
২০ মার্চ সিজারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে বিপুল জনসমাগম হল। অ্যান্টনি উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখলেন। তিনি সিজারের ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহের দিকে ইঙ্গিত করে সুকৌশলে জনতার ক্ষোভ উস্কে দিলেন। শোক প্রকাশ করতে আসা জনতা পরিণত হলো আক্রমণাত্মক মবে। সিজারের মৃতদেহ নিয়ম অনুযায়ী পোড়ানোর পর তারা ছাই ফোরামে স্থাপন করে। এরপর চক্রান্তকারীদের ধরতে বের হয়ে যায়। হত্যাকারীরা বাধ্য হলো শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে। ডেসিমাস চলে যান তার শাসনাধীন সিসাল্পাইন গলে, ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াস রোমের কাছেই থাকলেন।
অ্যান্টনির উচ্চাকাঙ্ক্ষা
৬,০০০ অভিজ্ঞ সেনা অ্যান্টনির অধীনে ছিল। তাদের দিয়ে তিনি নিজের ক্ষমতা শক্ত করেন। লেপিডাসকে শান্ত করতে তাকে পন্টিফ্যাক্স ম্যাক্সিমাসের পদে নিযুক্ত করা হয়। এরপর তাকে হিস্পানিয়াতে পাঠানো হয় পম্পেইয়ের কনিষ্ঠ পুত্র সেক্সটাসের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে। সেখানে সেক্সটাস এর মধ্যেই হিস্পানিয়ার একাংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত গভর্নরকে পরাজিত করে নিজেকে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরেছেন।লেপিডাসের কাজ ছিল সেক্সটাসকে সংবাদ দেয়া যে তিনি রোমে ফিরে পিতার সম্পত্তি বুঝে নিতে পারবেন। অ্যান্টনির আশা ছিল এতে সেক্সটাস বিরোধিতা বাদ দেবেন।
অ্যান্টনি সিনেটকে ডিঙিয়ে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থাও ভাগাভাগি করলেন। নিজে ছয় বছরের জন্য ট্রান্সাল্পাইন আর সিসাল্পাইন গলের ভার নিলেন, সিরিয়াতে একই সময়ের জন্য পাঠালেন ডোলাবেলাকে। ডেসিমাস পেলেন মেসিডোনিয়া, ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াস ক্রিট আর সাইরেনি প্রদেশ। যেহেতু ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াসের দায়িত্ব ছিল পরবর্তী বছরের জন্য, তাদের সেই বছর সিসিলি আর এশিয়াতে খাদ্যশস্য সংগ্রহের উদেশ্যে প্রেরণ করা হলো। সবাই বুঝতে পারে অ্যান্টনি সিজারের স্থলাভিষিক্ত হবার ইচ্ছা পোষণ করছেন। সিজারের হত্যাকারীরা আবার একজোট হতে থাকে, ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াস সিসিলি আর এশিয়া থেকে সেনাদল গড়ে তোলার পরিকল্পনা করলেন।
সিজারের উইল এবং অক্টাভিয়ান
অ্যান্টনির জন্য সিজারের উইলে বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তিনি যদি মনে করে থাকেন সিজার তাকে উত্তরসূরি নির্বাচন করে গেছেন তাহলে তিনি ভুল করেছিলেন। সিজারের উইলে রোমে প্রত্যেক অধিবাসির জন্য তার অর্থ থেকে ১৫ ডলার বরাদ্দ করা হয়েছিল, টিবের নদীর উত্তর পাড়ে তার বাগান পাবলিক পার্ক হিসেবে দান করা হয়, আরো কিছু অর্থ সামগ্রী সিজার বিভিন্নভাবে দান করেন। তবে সবথেকে চমকপ্রদ অংশ ছিল তার দূরসম্পর্কের ভ্রাতুষ্পুত্র অক্টাভিয়াসকে তিনি পুত্র হিসেবে ঘোষণা করে তাকে সম্পত্তির তিন-চতুর্থাংশ অর্পণ করে যান।
১৮ বছর বয়স্ক অক্টাভিয়াস ছিলেন ইলাইরিকামে, পার্থিয়া অভিযানের উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। সিজারের উইলের খবর পেয়ে মা-বাবার নিষেধ উপেক্ষা করে তিনি দ্রুত রোমে উপস্থিত হন। অ্যান্টনি তাকে সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান। অক্টাভিয়াস তখন নিজের সম্পদ বিক্রি করে সিজারের দেনা মিটিয়ে দিতে শুরু করেন। ফলে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। পরবর্তী বছর সিজারের পালিত পুত্র হিসেবে তিনি আইনগত বৈধতা পান, তার নতুন নাম হয় জুলিয়াস সিজার অক্টাভিয়ানাস (Julius Caesar Octavianus)। আমরা এখন থেকে তাকে অক্টাভিয়ান নামে ডাকব।
অক্টাভিয়ান ছিলেন শীর্ণকায়, ভগ্নস্বাস্থ্যের অধিকারী। সামরিক দিক থেকে তার কোনো দক্ষতাই ছিল না। ফলে সিনেট আর অ্যান্টনি প্রথমে তাকে হেলাফেলার ছলে দেখতেন। তারা কেউই এই তরুণের প্রজ্ঞা আর বিচক্ষণতার কথা জানতেন না, যা ছিল তার বয়সের থেকে যোজন যোজন এগিয়ে। তার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল নিজের দুর্বলতা বুঝতে পারা। তিনি জানতেন সমরবিদ্যায় তিনি অ্যান্টনির সাথে পেরে উঠবেন না, তাই তিনি পরবর্তীতে যোগ্য জেনারেলদের নিজের দলে ভিড়িয়ে নেন। এরাই অক্টাভিয়ানের যুদ্ধজয়ের কাজ করত।
মিউটিনার লড়াই
অ্যান্টনির ক্ষমতা ভাগাভাগি সিনেট অনুমোদন করেনি। সিসাল্পাইন গলের গভর্নর ডেসিমাসও তার কাছে ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। ফলে অ্যান্টনি মেসিডোনিয়া থেকে চারটি লিজিওন জোগাড় করলেন। এদিকে অক্টাভিয়ান ক্যাম্পানিয়া থেকে সেনা সংগ্রহ করে নিজের একটি বাহিনী গড়ে তোলেন। সিজারের পুরোনো অনেক সৈন্যই তার সাথে যোগ দেয়। এমনকি অ্যান্টনির দুটি লিজিয়ন তার পক্ষ ত্যাগ করে অক্টাভিয়ানের দলে চলে গেল। সিজারের সমর্থকদের মধ্যে তৈরি হলো স্পষ্ট বিভাজন।
৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ডিসেম্বর মাসে অ্যান্টনি ইতালি থেকে সিসাল্পাইন গলে চলে যান। সেখানে মিউটিনা শহরে ডেসিমাসকে অবরোধ করেন। এদিকে রোমে তখন চলছে নতুন মেরুকরণ। সিসেরো অপ্টিমেটদের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে অক্টাভিয়ানের সাথে মৈত্রী করেছেন। ৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের জন্য তারা কন্সাল নির্বাচন করেন হিরশিয়াস আর পান্সাকে। ডেসিমাস সাহায্যের আবেদন জানালে সিনেট অ্যান্টনিকে গল ত্যাগের নির্দেশ জারি করে দুই কন্সালকে সেদিকে প্রেরণ করল। সাথে গেলেন অক্টাভিয়ান। মিউটিনার বাইরে দুটি সংঘর্ষের পর এপ্রিলে অ্যান্টনি পিছু হটতে বাধ্য হলেন। হিরশিয়াস আর পান্সা এখানে নিহত হন। সিনেট অক্টাভিয়ানকে উপেক্ষা করে সেনাদলের নেতৃত্ব ডেসিমাসের হাতে তুলে দেয় এবং তাকে রোমে ডেকে ট্রায়াম্ফ প্রদান করে।
অক্টাভিয়ান আর সিনেটের দ্বন্দ্ব
অ্যান্টনির পরাজয়ের পাশাপাশি প্রাচ্যে ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াস ডোলাবেলাকেও পরাজিত ও হত্যা করেন। তাদের হাতে বিরাট সেনা আর নৌবাহিনী মজুদ হলো। সিনেট তাদের হাতে সর্বময় সামরিক ক্ষমতা (maius imperium) অর্পণ করে। মেসালিয়াতে অবস্থানরত সেক্সটাসের হাতে তুলে দেয়া হলো নৌবাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব। সিসেরো সিনেটের সমর্থনে অ্যান্টনিকে জনতার শত্রু ঘোষণা করলেন। তরুণ অক্টাভিয়ানকে তারা হিসেবের মধ্যেই ধরলেন না। এইখানেই তারা তাদের সবথেকে বড় ভুল করে ফেললেন।
পরাজিত হবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই গল ও হিস্পানিয়া থেকে বিশাল সেনাদল তৈরি করে অ্যান্টনি আবার সিসাল্পাইন গলে ঢুকে পড়েন। এবার আর অক্টাভিয়ান তাকে বাধা দিলেন না। অ্যান্টনি সেখানে নিজের আধিপত্য কায়েম করলেন।
অক্টাভিয়ান সিনেটের কাছে তিনটি দাবী করলেন- পরের বছরের জন্য কন্সালের পদ, নিজের জন্য ট্রায়াম্ফ আর তার সেনাদের পুরস্কারের ব্যবস্থা। সিনেট সব দাবী হেসে উড়িয়ে দিল। অক্টাভিয়ান রোমের দিকে মার্চ করলেন। তার সেনাদল শহর দখল করে নিল। ১৯ আগস্ট অক্টাভিয়ান নিজেই নিজেকে ৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কন্সাল নিযুক্ত করলেন, তার সমর্থক পেডিয়াস হলেন দ্বিতীয় কন্সাল। অ্যান্টনির বিরুদ্ধে করা আইন বাতিল করে সিজারের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ আদালত গঠন করা হলো। সেখান থেকে তাদের সকলকে দোষী সাব্যস্ত করে নির্বাসন দেয়া হয়, সেক্সটাসের কপালেও জুটল একই রায়।
দ্য সেকেন্ড ট্রায়াম্ভিরেট
ডেসিমাস সিসাল্পাইন গলে অ্যান্টনির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। তাকে সাহায্য করার জন্য সিনেট আগেই হিস্পানিয়ার শাসক লেপিডাসকে নির্দেশ দিয়েছিল। লেপিডাস ছিলেন সিজারের একনিষ্ঠ সমর্থক, তিনি উল্টো অ্যান্টনির সাথে যোগ দিলেন। এদিকে নার্বোনেস গলের গভর্নরও ডেসিমারসের পক্ষ ত্যাগ করলেন তিনি সম্পূর্ণ একা হয়ে যান। তার সৈন্যরা বেশিরভাগই বিপক্ষ দলে ভিড়ে যায়। ডেসিমাস গলেই মারা যান।
লেপিডাস আর অ্যান্টনির সম্মিলিত বাহিনী ইটালিতে প্রবেশ করল। এখানে রেনাস নদীর তীরবর্তী বরোনিয়া শহরে অক্টাভিয়ান, অ্যান্টনি আর লেপিডাস এক সম্মেলনে মিলিত হন। নিজেদের ভেদাভেদ মিটিয়ে তারা ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াসের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তি একত্রিত করার প্রতিজ্ঞা করলেন। জন্ম হলো সেকেন্ড ট্রায়াম্ভিরেটের। তারা সাম্রাজ্য ভাগাভাগি করলেন। অ্যান্টনি তার পূর্বের অঞ্চলগুলো রেখে দেন, লেপিডাস নিলেন হিস্পানিয়া আর নার্বোনেস গল, অক্টাভিয়ান সিসিলি, সার্ডিনিয়া আর আফ্রিকা। এই ট্রায়াম্ভিরেট প্রথমটির মতো গোপন ছিল না, বরং ২৭ নভেম্বর, ৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ট্রিবিউন কর্তৃক একে আইনসিদ্ধ করা হয়। ট্রায়াম্ভিরেটের প্রত্যেকের উপাধি হয় ট্রায়াম্ভির, এবং পাঁচ বছরের জন্য তারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। ৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে তাদের মেয়াদ কার্যকর হলো।
সেনাবাহিনী চালাতে প্রচুর অর্থ প্রয়োজন ছিল। ফলে ট্রায়াম্ভিরেট সুলার দেখানো পথ অনুসরণ করে। প্রস্ক্রিপশনের নামে অপ্টিমেট ও তাদের সমর্থকদের নির্বিচারে হত্যা করে সহায় সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া হয়। উপকূলের দিকে পালিয়ে যাবার সময় সিসেরো ধরা পড়েন। তার শিরশ্ছেদ করা হয়। সিসেরোর মাথা ও শরীর ফোরামে যে পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে তিনি বক্তৃতা করতেন সেখানে পেরেক দিয়ে গেঁথে দেয়া হল। এদিকে ৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অক্টাভিয়ান সিজারের সম্মানে একটি মন্দির নির্মাণ করলেন। সিজারকে দেবতা হিসেবে ঘোষণা করে তার নামকরণ করা হলো Divus Julius। এর মধ্য দিয়ে অক্টাভিয়ান কৌশলে নিজেকে দেবতার বংশধর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেললেন। কিন্তু নিজের অঞ্চলের ভার নিতে গিয়ে তিনি হিমশিম খেয়ে যান। তার অধীনস্থ জেনারেল আফ্রিকা অধিকার করলেও সিসিলি ও সার্ডিনিয়া জুড়ে সেক্সটাসের ক্ষমতা কায়েম হয়। অক্টাভিয়ান তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হবার আগে ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াসের বিহিত করার প্রয়োজন অনুভব করলেন।
ফিলিপির যুদ্ধ
ক্যাসিয়াস আর ব্রুটাস ৮০,০০০ এর মতো সেনা জড়ো করে থ্রেসের ফিলিপি শহরের কাছে অবস্থান নেন। দুইজনের ক্যাম্প ছিল প্রায় তিন কিলোমিটারের ব্যবধানে। তাদের নৌবহর পাহারা বসায় অ্যাড্রিয়াটিকে। তা সত্ত্বেও অ্যান্টনি আর অক্টাভিয়ান তাদের সেনাবাহিনী নিয়ে এখানে পৌঁছে যান। ৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দের গ্রীষ্মে দুই প্রতিপক্ষ মুখোমুখি হলো। ক্যাসিয়াসে বিরুদ্ধে অ্যান্টনি আর ব্রুটাসের বিপক্ষে অক্টাভিয়ান।
ক্যাসিয়াসের শিবিরের একপাশে ছিল জলাভূমি। অ্যান্টনি তার কিছু সৈন্য নিয়ে সেদিক দিয়ে ক্যাসিয়াসকে আক্রমণ করেন। অতর্কিত হামলা উদ্দেশ্য থাকলেও ক্যাসিয়াস শেষ পর্যন্ত টের পেয়ে যান। কিন্তু তার বেশিরভাগ সেনাই তখন ক্যাম্পের বাইরে, অ্যান্টনির মূল বাহিনীর সাথে লড়াই করছে। ফলে তার শিবির অ্যান্টনির হাতে চলে যায়। ক্যাসিয়াসের বাহিনীতে সৃষ্টি হয় চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। তিনি নিজে পালিয়ে কাছাকাছি এক দুর্গে আশ্রয় নেন।
এদিকে ব্রুটাস তীব্র আক্রমণে অক্টাভিয়ানকে ধরাশায়ি করে ফেলেছেন। ব্রুটাস শিবিরে প্রবেশ করলে অক্টাভিয়ান ফিলিপির জলাভূমিতে পালিয়ে যান। এদিকে ক্যাসিয়াসের বিপর্যয়ের সংবাদে ব্রুটাস চটজলদি সেস্থান ত্যাগ করেন কিছু সেনা তার সাহায্যার্থে প্রেরণ করেন। এতে হিতে বিপরীত হয়। ক্যাসিয়াস তাদের অ্যান্টনির সেনা ধরে নিয়ে গ্রেফতার এড়াতে আত্মহত্যা করেন। ফিলিপির প্রথম লড়াই সমাপ্ত হলো। এদিকে অতিরিক্ত সেনা নিয়ে সাগরপথে আসার সময় অপ্টিমেটদের বহর ট্রায়াম্ভিরেটের জাহাজ ডুবিয়ে দেয়।
কিছুদিন পরে সংঘটিত দ্বিতীয় লড়াইয়ে অ্যান্টনির প্রচণ্ড আঘাতে ব্রুটাসের সেনাবিন্যাস ভেঙে পড়ে। এদিকে অক্টাভিয়ান পেছন দিক থেকে ব্রুটাসের শিবির দখল করে নিলে ব্রুটাস দুই দিক থেকে ফাঁদে পড়ে যান। তিনি পালিয়ে যান পার্শ্ববর্তী পাহাড়ি এলাকাতে। সেখানে শত্রু দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়লে তার অনেক সেনাই আত্মসমর্পণ করে। নিজের তরবারির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রুটাস আত্মহত্যা করলেন। তার মৃতদেহ সসম্মানে সমাহিত করা হলো। অ্যান্টনি বলে উঠেছিলেন ষড়যন্ত্রকারীরা সকলেই নিজের লাভের জন্য সিজারকে হত্যা করেছিল, একমাত্র ব্রুটাস ছাড়া। তিনি অন্তর থেকে বিশ্বাস করতেন সিজারের মৃত্যু রোমের জন্য মঙ্গলজনক।
সাম্রাজ্যের পুনর্বিন্যাস
অ্যান্টনি আর অক্টাভিয়ান দুজনেই সন্দেহ করলেন সেক্সটাসের সাথে লেপিডাস গোপনে মিত্রতা করেছেন। ফলে তার ক্ষমতা হ্রাস করতে লেপিডাসকে আফ্রিকার ভার দেয়া হলো। নার্বোনেস গলসহ প্রাচ্যের পূর্ণ দায়িত্ব অ্যান্টনি নিলেন, ইতালি আর হিস্পানিয়া পেলেন অক্টাভিয়ান। অ্যান্টনি তার নিজ অঞ্চলের দিকে যাত্রা করেন। ৪১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিলিসিয়াতে ইজিপ্টের রানি ক্লিওপেট্রা তার সাথে দেখা করলেন, সূচনা হলো ইতিহাসের এক ট্র্যাজেডির।
অ্যান্টনি আর অক্টাভিয়ানের দ্বন্দ্ব
এদিকে ইতালিতে অক্টাভিয়ান প্রায় ১,৭০,০০০ সেনার জন্য জমি বরাদ্দের এক দুরূহ দায়িত্ব পালন করছিলেন, এরা সকলেই ট্রায়াম্ভিরেটের পক্ষে লড়াই করেছে। ফলে বহু এলাকা থেকে জোরপূর্বক জমি ছিনিয়ে নেয়া হলো। এতে অনেকের মধ্যেই তার প্রতি বিরোধিতা দেখা দেয়। অ্যান্টনির স্ত্রী ফুল্ভিয়া আর ভাই অ্যান্টনিয়াস পেরুসিয়া নগর থেকে এতে ইন্ধন দিচ্ছিলেন। তাদের বাড়াবাড়ি সীমা অতিক্রম করলে অক্টাভিয়ান পেরুসিয়া অবরোধ করে তাদের দমন করেন। অ্যান্টনিয়াসকে তিনি ছেড়ে দেন, ফুল্ভিয়া তার স্বামীর কাছে চলে যান, পরে তার মৃত্যু হয়। এই সময়ের মধ্যে সেক্সটাসের সাথে মিত্রতার স্বার্থে অক্টাভিয়ান তার স্ত্রী ক্লডিয়াকে তালাক দিয়ে সেক্সটাসের আত্মীয় স্ক্রিবোনিয়াকে বিয়ে করেন। এসব কারণে অ্যান্টনির সাথে তার মনোমালিন্য দেখা দেয়।
এদিকে লিবেনাস নামে ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াসের এক সমর্থক এই সময় পার্থিয়ানদের সহায়তায় সিরিয়া দখল করে ইজিয়ান সাগরের উপকূল পর্যন্ত চলে এসেছিল। তার ব্যবস্থা করতে সেনা অভিযান জরুরি হয়ে পড়লে অ্যান্টনি ৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইটালিতে ফেরত এলেন। এখানে প্রাথমিক উত্তেজনা শেষে ব্রুন্দিসিয়ামে তার আর অক্টাভিয়ানের মাঝে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। আয়োনিয়ান সাগরের পূর্বে সব এলাকা অ্যান্টনির হয়। আফ্রিকা লেপিডাসের, আর ইটালি তাদের সবার জন্য, বাকি সব এলাকা অক্টাভিয়াস বুঝে নেন। নতুন মিত্রতা পাকাপাকি করতে অ্যান্টনি অক্টাভিয়ানের বোন অক্টাভিয়াকে বিয়ে করলেন।
সেক্সটাসের সাথে সমঝোতা
সিসিলি আর সার্ডিনিয়া জুড়ে সেক্সটাস স্বাধীন কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন। কোনোভাবেই তাকে কাবু করতে না পেরে অক্টাভিয়ান ৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসেনামে তার সাথে আলোচনায় বসলেন। সেখানে সেক্সটাসের ক্ষমতার বৈধতা দেয়া হলো, বিনিময়ে সেক্সটাসে সাগরে জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সম্মত হলেন।
ট্রায়াম্ভিরেটের নবায়ন
৩৯-৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে অ্যান্টনির সহযোগীরা লিবেনাসকে পরাজিত করে হারানো ভূখণ্ড ফিরিয়ে নেয়। পার্থিয়ানদের অ্যান্টনি তাড়িয়ে নিয়ে যান ইউফ্রেটিস পর্যন্ত। তিনি অনুধাবন করলেন, এরা বেশি সাহসী হয়ে গেছে, এদের শক্ত শিক্ষা দিতে হবে। ফলে তিনি পার্থিয়াতে অভিযানের ফয়সালা করলেন। সেই মোতাবেক সৈন্য সংগ্রহের জন্য ৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি ইটালিতে ফেরত আসলেন। এখানে রাগান্বিত অক্টাভিয়ান তাকে বাধা দিলেন, কারণ অ্যান্টনি সেক্সটাসের বিরুদ্ধে তাকে কোনো সাহায্য করেননি। অক্টাভিয়া দুই যুদ্ধংদেহী পুরুষের মধ্যে মধ্যস্ততা করলেন। অ্যান্টনি সেক্সটাসের বিপক্ষে যুদ্ধের জন্য অক্টাভিয়ানকে ১০০ জাহাজ দিলেন। সিদ্ধান্ত হলো লেপিডাস তাকে সহায়তা করবেন। বিনিময়ে অ্যান্টনি অক্টাভিয়ান আর লেপিডাসের থেকে তার অভিযানের জন্য সেনা পাবেন।
সেক্সটাস ও লেপিডাসের পরাজয়
৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
অক্টাভিয়ান সিসিলি আর লেপিডাস লিলিবিয়াম অবরোধ করলেন। পূর্বের যেকোনো অভিযানের থেকে এবার অক্টাভিয়ান অনেক বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। সেপ্টেম্বরে তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জেনারেল আগ্রিপ্পা (Marcus Vipsanius Agrippa) নলোচাসের লড়াইতে সেক্সটাসের নৌবাহিনী ধ্বংস করে দিলে সেক্সটাস এশিয়াতে পালিয়ে যান। সেখানে দু’বছর বাদে অ্যান্টনির সেনারা তাকে গ্রেফতার করে মেরে ফেলে।
এদিকে শেষ পর্যন্ত সিসিলি ও সার্ডিনিয়া অক্টাভিয়ানের করতলগত হলো। লেপিডাস এবার হঠকারী এক কাজ করে বসলেন। নিজের শক্তিতে অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে তিনি সিসিলি ও ইতালি ছিনিয়ে নিতে চাইলেন। তার সৈন্যরা অক্টাভিয়ানের দলে গিয়ে যোগ দিলে লেপিডাস বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তার সমস্ত ক্ষমতা ও পদ কেড়ে নিয়ে সাগরপারের কোনো এক শহরে নির্বাসন দেয়া হলো। এখানেই ১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার মৃত্যু হয়।
পার্থিয়ার বিপর্যয়
অ্যান্টনি তার মূল ঘাঁটি করেছিলেন আলেক্সান্ড্রিয়াতে। ক্লিওপেট্রার সাথে তার দহরম মহরম চলছিল পুরোদমে। এর মাঝেই ৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি উত্তর দিকে থেকে আর্মেনিয়া পার হয়ে মিডিয়া অ্যাট্রোপাটেন (Media Atropatene) রাজ্যে প্রবেশ করেন। এখান থেকে তিনি ঢুকে পড়লেন পার্থিয়ানদের অঞ্চলে। ফ্রাটা দুর্গের অবরোধে তিনি পরাজিত হয়ে পালিয়ে আসেন। ২০,০০০ রোমান সেনা এই ব্যর্থ অভিযানে নিহত হয়। অ্যান্টনি পুরো দোষ চাপালেন আর্মেনিয়ার রাজার উপর। তাকে বিশ্বাসঘাতক দাবী করে তিনি আর্মেনিয়া দখল করে নিলেন। একই বছর অ্যান্টিওখে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেন এবং তার বৈধ স্ত্রী অক্টাভিয়াকে পরিত্যাগ করলেন, এটা ছিল অক্টাভিয়ানের সাথে সম্পর্কের ভাঙন। ক্লিওপেট্রার সাথে অ্যান্টনির তিন ছেলে-মেয়েকে বিভিন্ন রাজকীয় উপাধি দিয়ে তাদের বহু এলাকার প্রধান ঘোষণা করা হলো।
৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যান্টনি মিডিয়া অ্যাট্রোপাটেনের রাজার সাথে মৈত্রী স্থাপন করলেন। তিনি পুনরায় পার্থিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা করতে থাকেন। কিন্তু এজন্য নতুন করে সেনা দরকার, আর অক্টাভিয়ানের সাথে মনোমালিন্য হওয়ার কারণে ইতালি থেকে সেনা আনা সম্ভব ছিল না। ফলে অ্যান্টনির সামনে একটাই পথ খোলা, অক্টাভিয়ানকে সরিয়ে দিয়ে একা পুরো রোমান সাম্রাজ্য শাসন করা।
সংঘাতের সূত্রপাত
৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের শেষে ট্রায়াম্ভিরেটের মেয়াদের অবসান হয়। কার্যত লেপিডাসের বহিষ্কার আর ক্লিওপেট্রার সাথে অ্যান্টনির জোটের পরে ট্রায়াম্ভিরের নাম ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিন্তু রোমে তখনও অ্যান্টনির প্রচুর জনসমর্থন ছিল। ৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দুই কন্সাল ছিলেন তার সমর্থক। অক্টাভিয়ান দ্রুত পদক্ষেপ নিলেন। দেবী ভেস্টার মন্দিরে অ্যান্টনির উইল সংরক্ষিত ছিল। তিনি তা কব্জা করে জনসমক্ষে প্রকাশ করলেন। উইলে দেখা গেল অ্যান্টনি সিজারিওনকে সিজারের বৈধ উত্তরাধিকারি বলে মেনে নিয়েছেন, এবং নিজে মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রার পাশে সমাহিত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
অক্টাভিয়ান গুজব রটিয়ে দিলেন অ্যান্টনি রোম থেকে রাজধানী আলেক্সান্ড্রিয়াতে সরিয়ে নেয়ার এবং ক্লিওপেট্রাকে রোমের রানি করার পরিকল্পনা করেছেন। তিনি জানতেন অ্যান্টনির জনসমর্থন প্রচুর, তাই খুব সূক্ষ্মভাবে সব দোষ ক্লিওপেট্রার ঘাড়ে চাপিয়ে তিনি সবাইকে বোঝালেন যে, মিশরীয় এই রমণী অ্যান্টনিকে মোহমুগ্ধ করে রেখেছে। তাকে বাঁচাতে ক্লিওপেট্রাকে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে। তিনি খুব ভাল করেই জানতেন ক্লিওপেট্রার সাথে যুদ্ধে অ্যান্টনি কোন পক্ষ নেবেন। অক্টাভিয়ান সফলভাবে জনমত অ্যান্টনির বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দিতে পারলেন। সিনেট ক্লিওপেট্রার বিপক্ষে যুদ্ধের ডাক দিল।
অ্যাক্টিয়ামের লড়াই
অক্টাভিয়ানের সাথে যুদ্ধ আসন্ন বুঝে ক্লিওপেট্রা আর অ্যান্টনি গ্রিসে সেনা সমাবেশ করেন। ৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে প্রায় লাখখানেক সেনা আর ৬০০ জাহাজ তারা জমায়েত করতে সক্ষম হলেন। অ্যাক্টিয়াম শহরে সেনাবাহিনী আর পার্শ্ববর্তী অ্যাম্ব্রাশিয়ার উপসাগরে নৌবহর শীত কাটাচ্ছিল।
অ্যান্টনির অফিসারেরা বুঝতে পেরেছিলেন অক্টাভিয়ান ক্লিওপেট্রার বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করে আসলে অ্যান্টনিকে উস্কে লড়াইতে নামাতে চাইছেন। তারা বারবার অ্যান্টনিকে ক্লিওপেট্রার সঙ্গ ত্যাগ করার পরামর্শ দেন, কারণ তারা জানতেন তাহলে ক্লিওপেট্রার সাথে যুদ্ধ করার কোনো উৎসাহ অক্টাভিয়ানের থাকবে না। কিন্তু অ্যান্টনি কোনো কথাই কানে তুললেন না।
৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বসন্তে ৮,০০০ সেনা আর ৪০০ জাহাজ নিয়ে অক্টাভিয়ান এপিরাসে এসে পৌঁছলেন। তার নৌবাহিনী আগ্রিপ্পার নেতৃত্বে উপকূল ধরে এগিয়ে গেল। অক্টাভিয়ানের বহরে তুলনামূলকভাবে হালকা জাহাজ বেশি ছিল, এছাড়াও অনেকগুলো জাহাজ এক বিশেষ ধরনের হারপুন বহন করছিল। এই হারপুন ছুড়ে দিয়ে শত্রু জাহাজ আটকে ফেলে তা টেনে কাছে নিয়ে আসা হত, যাতে রোমান মেরিন সেনারা হামলা করতে পারে।
আগ্রিপ্পা উপকূল ধরে এগিয়ে যেতে যেতে ক্লিওপেট্রা ও অ্যান্টনির খাদ্য সরবরাহের রাস্তা বন্ধ করে দিলেন। তিনি তাদের যৌথ নৌবহর খোলা সাগরের দিক থেকে ঘিরে ফেললেন। এদিকে অক্টাভিয়ান সেনাবাহিনী নিয়ে কাছেই অবস্থান নিলেন।
২ সেপ্টেম্বর অ্যান্টনি আর ক্লিওপেট্রা অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হারপুন ছুড়ে আগ্রিপ্পা বহু জাহাজ ডুবিয়ে দেন। অ্যান্টনিকে বহন করা জাহাজও আটকে যায়। তিনি অন্য আরেকটি জাহাজে পালালেন। অক্টাভিয়ানের হাল্কা জাহাজের গতি ও ক্ষিপ্রতার কাছে অ্যান্টনি আর ক্লিওপেট্রার বহর মার খেতে থাকলে অ্যান্টনির পরামর্শে ক্লিওপেট্রা ৬০টি জাহাজ নিয়ে পালিয়ে যান। এর কিছু সময় পরেই অ্যান্টনি কয়েকটি জাহাজ নিয়ে আগ্রিপ্পার ব্যূহ ভেদ করতে সমর্থ হলেন। তিনিও ক্লিওপেট্রার পথ ধরলেন। স্থলবাহিনীকে তিনি নির্দেশ দিলেন এশিয়ার দিকে সরে যেতে। এদিকে বাকি সব জাহাজ আগ্রিপ্পার কাছে আত্মসমর্পণ করে। স্থলবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ ছাড়াই অক্টাভিয়ান বিজয়ী হয়ে গেলেন।
ইজিপ্টের পতন
অ্যাক্টিয়ামের পরাজয়ের পর অ্যান্টনি হতোদ্যম হয়ে পড়েন। ইত্যবসরে ৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অক্টাভিয়ান আলেক্সান্দ্রিয়ার উপকণ্ঠে এসে পৌঁছলে তার অনেক সেনাই পক্ষ ত্যাগ করে। অক্টাভিয়ান আলেক্সান্ড্রিয়া দখল করে নিলে অ্যান্টনি আত্মহত্যা করলেন। এদিকে ক্লিওপেট্রা সিজার ও অ্যান্টনির মতো অক্টাভিয়ানকেও মোহাবিষ্ট করার চেষ্টা করলেন। নিস্কম্প অক্টাভিয়ান তাকে আত্মসমর্পণের শর্ত বেঁধে দেন। ক্লিওপেট্রা বুঝতে পারলেন তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হতে চলেছে। অ্যান্টনির মতো তিনিও আত্মহত্যা করেন। অক্টাভিয়ান তাদের দুজনকে একসাথেই সমাহিত করলেন। সিজারিওনকে হত্যা করা হলো, অ্যান্টনি আর ক্লিওপেট্রার বাকি সন্তানদের অক্টাভিয়ন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ইজিপ্ট রোমের প্রদেশভুক্ত হলো।
অগাস্টাস সিজার
৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-১৪ খ্রিস্টাব্দ।
দীর্ঘ এই সময় জুড়ে অক্টাভিয়ান রোম এককভাবে শাসন করেন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল রোমের রাজনৈতিক ও সামাজিক অরাজকতা দূর করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, একে শত্রুদের থেকে নিরাপদ রাখা এবং নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই সময় থেকে পরবর্তী ২০০ বছর পর্যন্ত বিরাজমান স্থিতিশীলতা পৃথিবীর যেকোনো সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অদ্বিতীয়, যাপ্যাক্স রোমানা বা প্যাক্স অগাস্টা নামে পরিচিত।
অক্টাভিয়ান ২৮টি লিজিওন রেখে বাকিগুলো ভেঙে দেন। এই ২৮টি লিজিওন আর সহকারী সৈন্য নিয়ে প্রায় তিন লাখ সেনার একটি পেশাদার বেতনভুক্ত বাহিনী তৈরি হয়। এদের ছড়িয়ে দেয়া হয় রোমের সীমান্তবর্তী এলাকাতে রাইন আর দানিয়ুব নদী ধরে। তাদের প্রধান হিসেবে অক্টাভিয়ানের পছন্দের লোকেরাই নিয়োগ পেত। তিনি নিজের নিরাপত্তার জন্য একটি এলিট বাহিনী গঠন করেন, এদের নাম ছিল প্রিটোরিয়ান গার্ড।
অক্টাভিয়ান ডিক্টেটরের রাস্তায় না হেঁটে তার শাসনব্যবস্থাকে অভিহিত করেন প্রিন্সিপেট (Principate), আর তিনি প্রিন্সেপ্স (princeps/ প্রথম বা প্রধান সিটিজেন)। ৩১-২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত তিনি টানা কন্সাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৩ জানুয়ারি, ২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা আরেকবার প্রমাণ করেন, যখন সিনেটে প্রবেশ করে তিনি স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ছেড়ে দেবার ঘোষণা দেন। তিনি ভাল করেই জানতেন তাকে ছাড়া সিনেট অসহায়। অনুমিতভাবেই সিনেটররা বহু অনুনয়-বিনয় করে, তিনিও নিমরাজি হবার ভাব দেখিয়ে তাদের অনুরোধ গ্রহণ করলেন। এই সময় তিনি রোমান সংবিধানে তার প্রথম সংশোধন অনুমোদন করিয়ে নেন। সিনেট তাকে ইম্পেরাতোর সিজার অগাস্টাস (Imperator Caesar Augustus) ঘোষণা করল। ইতালির বাইরে সমস্ত রোমান প্রদেশের উপর তার ইম্পেরিয়াম জারি হয়। সেসব অঞ্চলের রোমান সেনাদল থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তা সবাই তার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য হয়।
ইতালিতে অক্টাভিয়ান ২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত কন্সালশিপ বজায় রাখেন। এই সময় তিনি দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ইতালির উপর তার ইম্পেরিয়াম বর্ধিত করেন। ১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি পন্টিফ্যাক্স ম্যাক্সিমাসের পদ নেন, আর ২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাকে রোমের পিতা উপাধি দেয়া হয় (Father of his Country/Pater Patriae)। অ্যাক্টিয়ামের পর তার শাসনামল ছিল শান্তিপূর্ণ। তিনি সকল কাজে সিনেটের সাথে পরামর্শ করতেন, যদিও শেষ পর্যন্ত তার ইচ্ছাই প্রাধান্য পেত। সিজারের সূত্র ধরে নিজেকে তিনি দেবতার পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করেন।
জীবিত থাকাবস্থাতেই অক্টাভিয়ান বেশ কয়েকজনকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এর মাঝে ছিল তার স্ত্রী লিভিয়ার আগের পক্ষের সন্তান, টিবেরিয়াস। ১৪ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর টিবেরিয়াস শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা দখল করে নেন। এটা পরিস্কার হয়ে গেল- রোম আর কখনোই তার রিপাবলিকান চরিত্রে ফিরে যাচ্ছে না, তা প্রবেশ করেছে রাজতন্ত্রে।