ইংরেজি যেভাবে প্রভাব বিস্তার করল গোটা দুনিয়ায়

এই একবিংশ শতাব্দীতে সাবলীলভাবে ইংরেজি বলতে পারা গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাগুলোর মধ্যে একটি। বর্তমান বিশ্বে ৬৭টি দেশে ইংরেজি দাপ্তরিক বা জাতীয় ভাষা হিসেবে স্থান পেয়েছে। আমাদের সবার মনেই কি একবার হলেও এই প্রশ্ন আসে না যে কীভাবে ইংরেজি এভাবে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল?

আজ আমরা জানব কীভাবে এবং কখন ইংরেজি ভাষা একটি সাধারণ ভাষা থেকে আন্তর্জাতিক ভাষায় রূপ নেয়।

ঔপনিবেশিক প্রভাব

যে পরিমাণ জমি ব্রিটিশ রাজের অধীনে ছিল; Courtesy: theweek.co.uk

আমরা যদি একটু ইতিহাসের দিকে লক্ষ্যে করি, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ ব্রিটিশদের দ্বারা শাসিত ছিল। ১৯২২ সালের দিকে ৪৫৮ মিলিয়ন মানুষ ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। পৃথিবীর ২৫% ভূমি, যেখানে ব্রিটিশ শাসন বিরাজমান ছিল, ইংরেজিকে একটি উচ্চমানের ভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকত। চাকরিপ্রত্যাশী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী- সবারই ইংরেজি জানা অত্যাবশ্যক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, যেহেতু ব্রিটিশদের ভাষা ছিল ইংরেজি। এই কারণে সাধারণ জনগণের মধ্যে ইংরেজি একটি ‘ল্যাংগুয়েজ অব এলিট’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

তবে ১৯৫০ সাল আসতে আসতে ব্রিটিশ উপনিবেশ তার শেষ দেখতে শুরু করে। আর ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করলেও এরপরও বেশ কিছু ব্রিটিশ উপনিবেশে ইংরেজি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে রয়ে যায়। বিভিন্ন দেশে এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে; ভারত বা তৎকালীন পাকিস্তানে যখন নতুন করে তাদের সংবিধান লেখা হচ্ছিল, তখন এই বিষয়ে অনেক বিবাদ হয়। ভারতের সংবিধান লেখার সময় অনেকের দাবি ছিল ‘হিন্দুস্তানি’কে (হিন্দি-উর্দুর সম্মিলিত ভাষা) ভারতে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। কিন্তু অনেক পণ্ডিতই এর বিরোধিতা করেন। ড. বি. আর আম্বেড়কারের মতে, যদি শুধু হিন্দিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হতো, তাহলে ভারতের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী অন্যদের থেকে কম গুরুত্ব পেত।

Courtesy: The print

তিনি উদাহরণস্বরূপ বলেন, যদি সংস্কৃত হিন্দিকে দাপ্তরিক ভাষা করা হয়, তাহলে এক্ষেত্রে ব্রাহ্মণরা বেশি সুবিধা পাবে, কেননা সংস্কৃতে তাদের দখল বেশি। এছাড়াও তিনি যুক্তি দেন, যেহেতু ভারতে একেক স্থানের মানুষ আলাদা আলাদা ভাষায় কথা বলেন, তাই ইংরেজিকে দাপ্তরিক ভাষা করা হলে কারো ভাষাকেই ছোট করা হবে না। তিনি ছাড়াও দক্ষিণ ভারতীয় নেতারাও এই ব্যাপার নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন, কারণ যদি হিন্দি বা হিন্দুস্তানিকে দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়, তাহলে উত্তর ভারতীয়রা উচ্চ মর্যাদা দাবি করবে, যেহেতু হিন্দি উত্তর ভারতেই বেশি ব্যবহৃত হয়। তাই সবাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে ইংরেজিই ভারতের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বহাল থাকবে।

তবে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এমন কোনো বিশেষ চর্চা না দেখা গেলেও পাকিস্তানেও কিছুটা এই কারণেই ইংরেজিকে দাপ্তরিক ভাষা করা হয়।

আমরা জানি, পৃথিবীতে ইংরেজিভাষী দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকা অন্যতম, কিন্তু আঠারো শতাব্দীতে আমেরিকায় আরও অনেক ভাষার প্রচলন ছিল। যখন আমেরিকা ১৭৮৩ সালে ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা পায়, তখন তাদেরও মনে হয় যে পুরো আমেরিকার একটি নির্দিষ্ট পরিচয় হওয়া দরকার- যেটা আমেরিকার প্রত্যেকটি রাজ্যকে একত্রিত করে রাখবে। আর স্বাভাবিকভাবেই ভাষার থেকে বড় পরিচয় আর দ্বিতীয়টা হয় না; আমেরিকার জন্য সেই ভাষা ছিল ইংরেজি। যদিও সেই সময় আমেরিকায় অন্য আরও ভাষা ব্যবহৃত হতো, তারপরও আমেরিকার রাজ্যগুলোকে একত্রিত রাখতে ইংরেজিকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয় তখন। এতটাই প্রাধান্য যে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অনেক রাজ্য অন্য ভাষায় শিক্ষাদানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে ১৯২৩ সালের দিকে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট এই নিষেধাজ্ঞাকে অবৈধ ঘোষণা করে।

ইংরেজি ছাড়া সব ভাষায় অনেক রাজ্যর নিষেধাজ্ঞা; Courtesy: ESLstories

বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব

সবার মনে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে, যেসব দেশ ব্রিটিশ উপনিবেশের আওতায় ছিল না, সেসব দেশে কীভাবে ইংরেজি প্রভাব বিস্তার করল? এর উত্তর রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, যেখানে মিত্র দেশ (ব্রিটেন, আমেরিকা এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) শত্রু দেশ (ইতালি, জার্মানি এবং জাপান)-এর বিরুদ্ধে জয়লাভ করে।

স্বভাবতই যে দল বা জোট যুদ্ধে জয় লাভ করবে, সেই জোটের সংস্কৃতি এবং ভাষা অন্য দেশের থেকে বেশি প্রভাব বিস্তার করে বিশ্বে। তাই, যেহেতু ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বযুদ্ধে জয় লাভ করেছে, তাই তাদের ভাষা (ইংরেজি) পুরো বিশ্বে বিস্তার লাভ করে। এছাড়াও, আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মহাশক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়াও একটি কারণ ইংরেজির পুরো বিশ্বজুড়ে বিস্তারের পেছনে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেখানে অন্য সকল দেশকে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল, সেই একই যুদ্ধে আমেরিকার তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতিই হয়নি। তারা যুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহ করে বিপুল অর্থ আয় করে। এজন্যই যখন যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অনেক দেশে দুর্ভিক্ষ হচ্ছিল, সেখানে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল।

Courtesy: StackExchange/Martin Ording Thomsen

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজিবাদের সাহায্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, ফলে ইংরেজি একটি ব্যবসায়িক ভাষায় রূপান্তরিত হয়। সাথে সাথে আমেরিকার পপ তারকা এবং মিউজিক ব্যান্ডগুলো ইংরেজি ভাষায় নিজেদের গান লেখা শুরু করে এবং বিশ্বজুড়ে কনসার্ট আয়োজন করে বেড়ায়। একই ব্যাপার হলিউডেও লক্ষ্য করা যায়। আমেরিকান গান, চিত্র এবং চলচ্চিত্র একটি গ্লোবাল সেনসেশনে পরিণত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এখানে ইংরেজিকে আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা দেয়ায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে, কেননা অনেকেরই ধারণা যে যদি যুদ্ধে হিটলার বাহিনী জয় লাভ করত, তাহলে হয়তো ইংরেজির জায়গায় জার্মান ভাষা পুরো বিশ্বে বিস্তার লাভ করত।

ইন্টারনেট

শুনতে অদ্ভুত শোনালেও সত্য যে বিশ্বজুড়ে ইংরেজির আধিপত্যের পেছনে ইন্টারনেটের অবদানও অসামান্য। ইন্টারনেটের আঁতুড়ঘর আমেরিকা, এবং পাশাপাশি ইন্টারনেট বিষয়ক সকল প্রতিষ্ঠানও আমেরিকাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া, প্রথম কীবোর্ড এবং টাইপরাইটারও আবিষ্কৃত হয় আমেরিকানের হাতে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তখনকার কিবোর্ড এবং টাইপরাইটার সব ইংরেজি ভাষায় তৈরি করা হয়। এর সাথে সাথে কম্পিউটার এবং মোবাইলে ইংরেজি ভাষা তো রয়েছেই। ‘w3tech.com’ অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বে পুরো ইন্টারনেটের ৫৮.৬% কন্টেন্ট ইংরেজি ভাষায় তৈরি।  

ইংরেজি ভাষার এরূপ প্রভাব বিস্তারের পেছনের গল্পটা অনেকটাই কাকতালীয় বলা চলে। অনেকগুলো বিষয় একের পর এক ঘটে যাওয়ার ফলে ইংরেজি হয়ে উঠেছে পৃথিবীর অন্যতম বহুল ব্যবহৃত ভাষা। তবে অনেকে আবার বলেন, এর পুরোটাই নাকি আগে থেকেই করা পরিকল্পনা! আসলেই কি তাই? সেই আলাপ তোলা রইল আরেকদিনের জন্য…

This article is written in Bengali language.This article contains information about how English became an international language. All necessary sources has been hyperlinked inside.

Feature Image Source: Shutterstock/Sinart Creative

Related Articles

Exit mobile version