তোমরা ভালো কইরা বাজাও গো দোতারা
সুন্দরী কমলা নাচে!
এ গানের লাইন দুটি শোনেননি, দেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। লোকসঙ্গীত, কাহিনীকাব্য কিংবা পৌরাণিক কাহিনীতেও বার বার উল্লেখ পাওয়া গেছে কমলা সুন্দরীর। প্রাচীন করতোয়া মাহাত্ম্যেও ছিল কমলা সুন্দরীর পদচারণা। তবে কমলা সুন্দরী কি শুধুই লোকমুখে চলে আসা উপকথা? নাকি ঐতিহাসিক কোনো চরিত্র? এ প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা থমকে যেতে হয়। কারণ, বাংলার লিখিত কোনো ঐতিহাসিক দলিল পুণ্ড্রতনয়া কমলার প্রাণের অস্তিত্ব অকাট্যভাবে প্রমাণ করতে পারে না। সেজন্য ধার করতে হয় বিদেশি সাক্ষ্য। দ্বাদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরি কবি কলহন রচিত ঐতিহাসিক ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায় নর্তকী কমলার। সুবিশাল এই গ্রন্থের চতুর্থ খন্ডে অর্ধশতাধিক শ্লোকে নর্তকী কমলার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো- বঙ্গতনয়া কমলা কীভাবে কাশ্মীরি শ্লোকে উপস্থিত হলো? সেটা জানার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হয় ৮ম শতকের পুন্ড্রবর্ধনে।
৮ম শতাব্দীর শেষভাগের কথা। সুবিশাল গৌড় সাম্রাজ্য তখন ভেঙে ছোট ছোট রাজ্যে পরিণত হয়েছে। সেসময় পুন্ড্রনগরের শাসনকর্তা ছিলেন রাজা জয়ন্ত। শাসক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল চারদিকে। তিনি ছিলেন প্রজাদরদী এক রাজা। ফলে তার সময়টা বেশ সুখেই কাটায় পুন্ড্রের সাধারণ মানুষ। ধনসম্পদ আর রাজকীয় গরিমা ছাড়াও পুন্ড্রের আরেকটি খ্যাতি ছিল। সেসময় করতোয়ার তীরে গড়ে ওঠা স্কন্ধ মন্দির বা কার্তিকেয় মন্দিরে বসতো জগদ্বিখ্যাত নাচের আসর। শুধু গীতিনৃত্য নয়, অনেক ঐতিহাসিক মত দিয়েছেন যে প্রাচীন বাংলায় করতোয়ার তীরেই বসেছিল প্রথম যুগের নাটকের আসর। করতোয়ার তীরে গড়ে ওঠা এসব গীতিনৃত্যের আসরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল সুন্দরী কমলা। রূপে-গুণে অনন্য স্কন্ধ মন্দিরের এই দেবদাসীর নাম বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে দূর দেশে। যত পুঁথি-পুরাণে কমলার উল্লেখ আছে, সবখানেই উৎসাহভরে বর্ণনা করা হয়েছে তার রূপ-যৌবন-বুদ্ধিমত্তার। করতোয়ার তটে কমলার নৃত্য যে স্বর্গীয় পরিবেশের অবতারণা করত, তা-ও উঠে এসেছে এসব লোকগানে। কমলা নৃত্যরত অবস্থায় স্কন্ধ মন্দিরের সামনে যে মোহনীয় আবেশ সৃষ্টি হতো, তার উল্লেখ এসেছে এভাবে:
আরে নাচে কমলা সুন্দরী,
দেখ যেন ইন্দ্রপুরী গো!
স্কন্ধ মন্দিরের সামনের যে জলসায় কমলা সুন্দরী নৃত্য পরিবেশন করত, সেই জলসায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিদেশি বণিক-পর্যটক ও পুণ্ড্রনগরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকতেন।
অন্যদিকে, কাশ্মীরের সিংহাসনের অধিপতি তখন রাজাধিরাজ জয়াপীর বিনয়াদিত্য। তার অপর পরিচয়- তিনি ছিলেন কাশ্মীর রাজ মুক্তাপীর ললিতাদিত্যের পৌত্র। ৭ম শতকের শেষভাগে বিশ্বজয়ের বাসনায় তিনি কাশ্মীর ছাড়েন। কান্যকুবযো ও সারস্বত জয় করে জয়াপীর মিথিলার দিকে অগ্রসর হতে চান। ইতিহাসের এ পর্যায়ে দুটি কাহিনির দেখা মেলে। অনেকের মতে, জয়াপীরের সৈন্যবাহিনী ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং মিথিলা আক্রমণে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে, জয়াপীর তার সৈন্যবাহিনীকে কাশ্মীর পাঠিয়ে দিয়ে গৌড় রাজ্য ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হন। অপরপক্ষের মত, জয়াপীর নিজ সৈন্যবাহিনী নিয়েই গৌড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। আমরা দুটো কাহিনি ধরেই এগোব। কারণ, কাহিনি ভিন্ন হলেও দুটো গল্পের পরিণতি একই।
প্রথম মতবাদ অনুসারে জয়াপীর গৌড় রাজ্য ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হন। করতোয়ার বুকে ভাসতে ভাসতে বজরা এসে থামে পুণ্ড্রনগরীতে। তিনি পুণ্ড্রনগরীর মানুষ ও সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হন। ঘাটের পাশেই স্কন্ধ মন্দিরের সামনে সেদিনও বসেছিল নৃত্যের আসর। সংস্কৃত রাজতরঙ্গিনীর ইংরেজি অনুবাদে ঘটনার উল্লেখ আছে এভাবে,
The king know dancing, and naturally enough wished to see a dance, and entered the temple of Karttikeya. For a time he sat on a stone at the door of the temple. He had an air of majesty in him which, the people perceived and wondered, and they moved abide from him. It so happened that the dancing girl Kamala, saw with wonder the beautiful king, and his uncommon mein.” (Rajatarangini, Page 85)
নৃত্যের আসরেই কমলাকে প্রথম দেখেন জয়াপীর। বলে রাখা ভালো- জয়াপীর সাধারণ নাগরিকের বেশেই পুন্ড্রনগরীতে প্রবেশ করেছিলেন। সেই নৃত্যের আসরে কমলাকে প্রথমবার দেখেই বিমোহিত হন জয়াপীর। অপলক দৃষ্টিতে আস্বাদন করেন নৃত্যপটিয়সী কমলার রূপ-সৌন্দর্য। করতোয়ার শান্ত-নিঃশব্দ ধারাতেও ব্যাকুল হয়ে ওঠে তার হৃদয়। স্কন্ধ মন্দিরের সামনে কার্তিককে সাক্ষী রেখে অজান্তেই তিনি নিজের হৃদয়দান করেন। জয়াপীর সাধারণ মানুষের বেশ ধরে উপস্থিত হলেও বহু বছরের রাজকীয় অভ্যাস তো আর সহসাই যায় না। ফলে, তিনি মুগ্ধ দৃষ্টিতে নৃত্য উপভোগের সময় থেকে থেকেই অভ্যাসবশত খিলি পানের জন্য হাত বাড়ান। এ ঘটনা বুদ্ধিমতী কমলার দৃষ্টি এড়ায় না। জলসাতেই তিনি নিশ্চিত হন যে, আগন্তক নিশ্চয়ই কোনো রাজবংশের লোক। জয়াপীরের মুগ্ধ দৃষ্টি আর ব্যক্তিত্ব হৃদয় ছুঁয়ে যায় কমলারও। সেই রাতে নিজের বাসগৃহে জয়াপীরকে আমন্ত্রণ জানান কমলা। জয়াপীরকে একজন রাজার মতোই আপ্যায়ন করেন তিনি। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে ভাবের আদান-প্রদান। প্রথম সাক্ষাতেই দুজন দুজনকে প্রেম নিবেদন করেন।
পুণ্ড্রনগরে তখন এক সিংহের উৎপাত শুরু হয়। বহু লোক প্রাণ দেয় এই সিংহের কাছে। কিন্তু কিছুতেই বধ করা যাচ্ছিল না পশুরাজকে। তাই রাজা জয়ন্ত ঘোষণা করেছিলেন- যে এই সিংহের বধ করবে, তাকে উপযুক্ত পুরষ্কার দেওয়া হবে। জয়াপীর কমলার কাছেই জানতে পারেন এসব কথা। তার শরীরে টগবগিয়ে ওঠে যোদ্ধার রক্ত। কাউকে কিছু না জানিয়েই ভোরবেলা নিজের তলোয়ার দিয়ে পশুরাজকে বধ করেন জয়াপীর। কিন্তু, বধের পূর্বেই সিংহের থাবায় জয়াপীরের বাহুবন্ধনী আটকে যায় সিংহের মুখে। সকালে সবাই যখন সিংহের মৃতদেহ দেখতে পান, তখন আনন্দের ঢেউ বয়ে যায় পুন্ড্রনগরে। সেই সাথে সবাই খুঁজতে থাকে সেই বীরকে যে সিংহকে বধ করেছে। দেখা যায়- মৃত সিংহের মুখে লেগে আছে জয়াপীরের নামাঙ্কিত বাহুবন্ধনী। সবাই তখন জেনে যায়, কাশ্মীররাজ লুকিয়ে আছেন পুন্ড্রে। কমলা তখন রাজাকে জানায়- জয়াপীর আছে তার কাছেই। কাশ্মীররাজের অভূতপূর্ব এই বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে পুণ্ড্ররাজ জয়ন্ত নিজের একমাত্র কন্যা কল্যাণীর সাথে তার বিয়ে দেন পুরষ্কার হিসেবে।
ভারতবর্ষে প্রায় সব যুগেই রাজনৈতিক বহুবিবাহের প্রচলন দেখা যায়। কল্যাণীর সঙ্গে জয়াপীরের বিয়েও ছিল তেমনি এক রাজনৈতিক বিয়ে। পুন্ড্ররাজের জামাই হয়ে জয়াপীর ভুলে যাননি কমলার প্রতি তার প্রেমের কথা। তিনি কমলাকেও নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। কার্তিকেয় মন্দিরের দেবদাসী নর্তকী কমলা হয়ে ওঠেন কাশ্মীরের রানী। জয়াপীর তার উভয় স্ত্রীকেই কাশ্মীর নিয়ে যান এবং তাদের নামে দুটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন। একটির নাম কল্যাণপুর, অপরটির নাম কমলাপুর। কথিত আছে- জয়াপীর নিজ বীরত্বে পাঁচটি গৌড় রাজ্য জয় করে তার শ্বশুর পুণ্ড্ররাজ জয়ন্তকে ‘পঞ্চগৌড়রাজ’ হিসেব প্রতিষ্ঠিত করেন।
দ্বিতীয় মতবাদ অনুসারে, জয়াপীর নিজ বাহিনী নিয়েই পুণ্ড্রনগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যজয়। সামরিক খোঁজখবর নেওয়ার উদ্দেশ্যেই তিনি গোপনে পুন্ড্রনগরে উপস্থিত হন। সেখানেই বিমোহিত হন নর্তকী কমলার প্রেমে। এরপর তিনি আতিথ্য নেন কমলার গৃহে। কমলা যখন জয়াপীরের প্রকৃত পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানতে পারেন, তখন অমানিশায় আঁধারে ডুবে যায় তার হৃদয়। জয়াপীরকে সে ভালোবাসে। কিন্তু, ভালোবাসার জন্য মাতৃভূমিকে সে কী করে বিসর্জন দেয়!
অন্যদিকে, কমলা এটাও জানতো যে সিংহের উপদ্রব রোধ করতে পারলে রাজা তার মেয়ের সাথে বিয়ে দেবেন জয়াপীরের। কিন্তু, কল্যাণীর সাথে বিয়ে হলে কী হবে কমলার? অনেক ভেবে তিনি মাতৃভূমির জন্য নিজের প্রেম বিসর্জন দেন। জয়াপীর সিংহের বধ শেষে ঘরে ফিরলে তার বাহুবন্ধনী গোপনে রেখে আসেন মৃত সিংহের পাশে। ফলে, সকালে উঠে যখন রাজা জয়ন্ত জানতে পারেন সিংহের বধ কাশ্মীররাজের কীর্তি, তিনিও বিচক্ষণ রাজার মতোই যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়াকে লাভজনক মনে করেন। নিজের কন্যার সাথে জয়াপীরের বিয়ে দিয়ে আসন্ন যুদ্ধ থেকে রক্ষা করেন নিজ রাজ্য ও রাজ্যের মানুষকে। মাতৃভূমির আজ্ঞায় নিজের প্রেম বিসর্জন দিয়ে কমলা সৃষ্টি করেন দেশপ্রেমের অনন্য নজির। পুণ্ড্ররাজের কন্যা কল্যাণী দেবীর সাথে ধুমধামে বিয়ে হয়ে যায় জয়াপীরের। পূর্বেই বলা হয়েছে, পুন্ড্রের জামাই হয়ে জয়াপীর ভুলে যাননি কমলাকে। যেদিন রাজকন্যা কল্যাণী দেবীর সাথে বিয়ে হয়, সেদিনই সন্ধায় স্কন্ধ মন্দিরের সামনে সাতজনমের বন্ধনে বাঁধা পড়েন রাজা জয়াপীর ও নর্তকী কমলা।
মহাস্থান শহর থেকে দুই মাইল পশ্চিমে এখনও সেই পুরনো স্কন্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট আছে। সেই মন্দিরের সামনে এখন আর নর্তকী কমলার নাচ দেখা যায় না। তবে, শত-সহস্র মানুষের কণ্ঠস্বর এখনও আওয়াজ তোলে,
তোমরা ভালো কইরা বাজাও গো দোতারা
সুন্দরী কমলা নাচে!