ভারতীয় রাজনৈতিক, লেখক ও প্রাক্তন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শশী থারুর। ভারতে ব্রিটিশ শাসন নিয়ে কাজ করেছেন তিনি, রচনা করেছেন Inglorious Empire নামক একটি তুমুল আলোচিত বই। ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত হয় ‘But what about the railways …?’ The myth of Britain’s gifts to India শীর্ষক তার একটি প্রবন্ধ, যেটি ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো সেই প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ।
আজকাল ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের কৈফিয়ত প্রদানকারী অনেকেই আর সাম্রাজ্যবাদী লালসা, শোষণ কিংবা লুটতরাজের মতো মৌলিক বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করেন না। কেননা এই বিষয়গুলোর এত এত প্রামাণ্য দলিল আছে যে, এগুলোর বিরোধিতা করার সুযোগ আর নেই বললেই চলে। তাই তারা ইদানিং একটি পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন: আচ্ছা মানলাম, ২০০ বছর ধরে ব্রিটিশরা যত পারে নিয়েছে, কিন্তু তারা কি রেখেও যায়নি অনেক কিছু, যার সুফল আমরা আজও ভোগ করছি? বিশেষত, রাজনৈতিক ঐক্য ও গণতন্ত্র, আইনের শাসন, রেল যোগাযোগ, ইংরেজি শিক্ষা, এমনকি চা ও ক্রিকেট?
প্রকৃতপক্ষেই, ব্রিটিশরা বলার চেষ্টা করে, একাধিক যুদ্ধ-বিগ্রহগ্রস্ত আদর্শ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তে, একক ‘ভারত’ ধারণাটির জন্ম দেয়াই, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সবচেয়ে বড় অবদান, যার কোনো তুলনাই চলে না।
কিন্তু এই যুক্তির পক্ষে দুঃখজনক বিষয়টি হলো, উপমহাদেশের গোটা ইতিহাস জুড়েই, ঐক্যের প্রতি একটি ঝোঁক বিরাজ করেছে। ভারত ধারণাটির বয়সও হিন্দুদের একদম প্রথম দিককার পুরাণ বেদের সমান, যেখানে হিমালয় ও সমুদ্রের মধ্যবর্তী একটি অঞ্চলকে ‘ভারতবর্ষ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। মাওলানা আজাদ লিখেছেন, উত্তর-পশ্চিমের পাঠান থেকে শুরু করে দক্ষিণের তামিল, সবাইকেই আরবরা মনে করত একটি অভিন্ন সভ্যতার ধারক হিসেবে, এবং তাদেরকে ডাকত ‘হিন্দি’ বলে।
অনেক ভারতীয় শাসকই চেষ্টা করেছিল এই গোটা অঞ্চলটিকে একীভূত করতে, যেমন- যিশু খ্রিস্টের তিনশো বছর পূর্বে করার চেষ্টা করেছিল মৌর্যরা, এবং মুঘলরা তো অনেক কাছাকাছিও পৌঁছে গিয়েছিল, উপমহাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ দখল করে ফেলেছিল তারা। খুব কমই সন্দেহ আছে, ব্রিটিশরা না করলেও কোনো না কোনো ভারতীয় শাসক তার পূর্বসূরীর দেখানো পথ ধরে, কাজটি ঠিকই করে দেখাত।
ভারতে ঐক্য ও সাংসদীয় গণতন্ত্র আনয়নের জন্য ব্রিটেনকে তো কৃতিত্ব দেয়া যায়ই না, বরং ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য এগুলোর বিনাশকারী কিছু ব্রিটিশ নীতিমালার দিকেই আঙ্গুল তোলে – বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া, জাতিগত বিভেদের জন্ম দেয়া, কিংবা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক বৈষম্য নিয়ে আসা। এগুলো সবই করা হয়েছিল একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে, তা হলো ব্রিটিশ আধিপত্যকে জিইয়ে রাখা।
১৭৫৭-পরবর্তী বছরগুলোতে ব্রিটিশরা খুবই চাতুর্যের সাথে ভারতীয় যুবরাজদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে দিতে থাকে, এবং ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির মাধ্যমে তাদের কর্তৃত্ব পাকাপোক্ত করতে থাকে। শতবর্ষ পরে, ১৮৫৭ সালে, হিন্দু ও মুসলিম সৈন্যদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম এবং ক্ষয়িষ্ণু মুগল রাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে দেখে, সতর্ক হয়ে ওঠে ব্রিটিশরা। তখন তারা ওই দুই গোষ্ঠীকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ তৈরি করে দেয়, যাতে তাদের নিজেদের সাম্রাজ্য কোনো হুমকির মুখে না পড়ে। সেই ১৮৫৯ সালেই, বোম্বের ব্রিটিশ গভর্নর, লর্ড এলফিনস্টোন লন্ডনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এই বলে,
“Divide et impera was the old Roman maxim, and it should be ours.”
(“বিভাজন ও শাসনই হলো প্রাচীন রোমান প্রবাদবাক্য, এবং এটি হওয়া উচিৎ আমাদেরও।”)
যেহেতু ব্রিটিশরা এসেছিল এমন একটি ক্রমাধিকারতান্ত্রিক সমাজ থেকে যেখানে শ্রেণীব্যবস্থা গেঁড়ে বসেছে, তাই তারা প্রবৃত্তিগতভাবেই সাদৃশ্যপূর্ণ কিছু একটার সন্ধান করেছিল ভারতবর্ষেও। এ অঞ্চলের ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক, বর্ণভিত্তিক ব্যবধানকে বোঝার চেষ্টা করেছিল তারা, যা একসময় এইসব ব্যবধানকে সংজ্ঞায়ন, বিভাজন ও চিরস্থায়ীকরণের অনুশীলনে পরিণত হয়। তাই ঔপনিবেশিক প্রশাসকরা নিয়মিত এমন সব প্রতিবেদন রচনা করতে এবং জরিপ চালাতে শুরু করে, যেগুলো ভারতবাসীকে তাদের ভাষা, ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত, উপ-জাত এবং গাত্রবর্ণের ভিত্তিতে আরো সংকীর্ণরূপে উপস্থাপন করে। এর ফলে সম্প্রদায় ধারণার কেবল পুনর্জাগরণই ঘটে না, বরং এমন সব নতুন নতুন সম্প্রদায়েরও জন্ম দেয় যে, সেগুলোর অন্তর্ভুক্ত মানুষেরা আগে কোনোদিন সচেতনভাবে চিন্তাই করেনি তারা তাদের পারিপার্শ্বিক সমাজের চেয়ে কোনোভাবে আলাদা বা ব্যতিক্রম।
হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বড় পরিসরের ধর্মীয় দাঙ্গা শুরু হয় কেবল ঔপনিবেশিক শাসনকালেই; কেননা ব্রিটিশরাই এ অঞ্চলে শাসন শুরু করার পর এমন অনেক সমস্যাকে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক রূপে প্রচার করতে থাকে, ইতোপূর্বে যেগুলো ছিল নিছকই সামাজিক। মূলত তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ভারতীয় সমাজে ধর্মই হলো মৌলিক বিভাজনের নেপথ্য-কারণ।
এটি প্রশ্নসাপেক্ষ যে উনবিংশ শতকের আগে ভারতে একটি সামগ্রিক হিন্দু বা মুসলিম পরিচিতির অস্তিত্ব কোনো অর্থ বহন করত কি না। অথচ হিন্দু-মুসলিমদের মাঝে একটি দ্বন্দ্ব ও বিবাদের দেয়াল গড়ে তোলাই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ নীতি: এই ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতি তার চরম শিখরে পৌঁছায় ১৯৪৭ সালে, যখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। দেশভাগের ফলে দশ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে, ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ দেশান্তরী হয়, কয়েক বিলিয়ন রুপির সম্পদ ধ্বংস হয়, এবং সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ইতোমধ্যেই ক্ষতবিক্ষত এক ভূমিতে। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্যর্থতা খুঁজে বের করতে গেলে, যে বিয়োগান্তকতায় এর পরিসমাপ্তি ঘটেছিল, তার চেয়ে বড় আর কিছু পাওয়া যাবে না।
এমনকি ব্রিটিশরা যে দাবি করে থাকে তারা সাম্রাজ্যবাদী শাসনের ছায়ায় ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা চালিয়েছিল, সেটিও সত্য নয়। তৃণমূল পর্যায় থেকে স্বরাজ সৃষ্টির পরিবর্তে, যেটুকুর অস্তিত্ব ইতোপূর্বে ভারতবর্ষে ছিল, সেটুকুও ধ্বংস করে দেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ব্রিটিশরাই সরকার চালানো থেকে শুরু করে কর সংগ্রহ বা আইন প্রণয়নের মতো কাজগুলো করত। ভারতীয়দেরকে দূরে সরিয়ে রাখা হয় এই সবকিছু থেকেই। অবশেষে যখন ব্রিটিশরাজ এ দেশের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয়, তখন সে সরকার পরিচালনার সামান্য অধিকার তুলে দেয় অনির্বাচিত প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় ‘বিধানিক’ পরিষদের হাতে, যার সদস্যরা কেবল অল্প পরিমাণ শিক্ষিত অভিজাতের প্রতিনিধিত্ব করত, এবং যাদের কোনোপ্রকার কর্তব্যবোধ ছিল না জনসাধারণের প্রতি। তাদের হাতে মূলত কোনো অর্থবহ ক্ষমতাই ছিল না। সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাদের সাথে যে ‘শলা-পরামর্শ’ করা হচ্ছে, এতেই তারা সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত থাকত, যদিও কোনো প্রকৃত সিদ্ধান্তই তারা নিজেরা নিত না।
বহুদিন পরে, এমনকি ১৯২০ সালেও, মন্টেগু-চেমসফোর্ড ‘সংস্কার’ আইনের অধীনে, পরিষদে যে ভারতীয় প্রতিনিধিদের প্রবেশের সুযোগ ঘটে, তারা এতই ক্ষুদ্র একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি দ্বারা নির্বাচিত হয় যে, সেখানে প্রতি ২৫০ জনের মধ্যে মাত্র একজন ভারতীয়ের ভোটাধিকার ছিল। এবং তাদেরকে ক্ষমতা দেয়া হয় এমন সব বিষয়ে, যেগুলোর ব্যাপারে ব্রিটিশদের কোনো আগ্রহই ছিল না, যেমন- শিক্ষা কিংবা স্বাস্থ্যব্যবস্থা। এদিকে প্রকৃত ক্ষমতা, যেমন- করবিধি, আইন-শৃঙ্খলা, কিংবা ভারতীয় বিধানিকদের যেকোনো ভোট বাতিল করার কর্তৃত্ব, এগুলো ন্যাস্ত ছিল প্রতিটি প্রদেশের ব্রিটিশ গভর্নরদের উপরই।
অন্যভাবে বলতে গেলে, গণতন্ত্র ছিল এমন একটি জিনিস যেটি ব্রিটিশদের অনিচ্ছুক গ্রাস থেকে ছিনিয়ে আনা লাগত ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের। এটি খানিকটা ধনিক আচরণই বটে যে, দুইশো বছর ধরে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে শোষণ ও অত্যাচারের পর, আজ তাদেরকে ‘গণতান্ত্রিক’ করে তোলার কৃতিত্ব চায় ব্রিটিশরা।
ব্রিটিশরা ভারতকে রাজনৈতিক ঐক্য ও গণতন্ত্র দিয়েছে, এ দাবির একটি অনুসিদ্ধান্ত হলো, তারা মূলত এ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছে। নানাভাবেই এটি ছিল, ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য সাধনে, আত্মধারণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। যেমন- রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর ধারণা ছিল ভারতবর্ষকে দিতে হবে একটি সুন্দর শাসন ব্যবস্থা, একটি সুন্দর আইন, আর সেটি দিতে পারে একমাত্র ব্রিটিশরাই। কিন্তু ব্রিটিশদেরকে ওই আইন প্রতিষ্ঠিত করতে হতো আরো বয়োজ্যেষ্ঠ ও জটিল একটি সভ্যতায়, যাদের ছিল নিজস্ব নৈতিক সংস্কার। তাই এ কাজে সফলতা অর্জনে ব্রিটিশরা কাজে লাগিয়েছিল তাদের ক্রূরতা ও বল প্রয়োগের প্রবৃত্তিকে। এবং ঔপনিবেশিক যুগে, আইনকানুন কোনোভাবেই নিরপেক্ষ ছিল না।
শ্বেতাঙ্গ কর্তৃক ভারতীয়দের উপর করা অন্যায়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ন্যূনতম শাস্তি; এক ইংরেজ তার ভারতীয় চাকরকে গুলি করে হত্যা করায় তার সাজা হয়েছিল ছয় মাসের জেল, এবং খুবই সামান্য জরিমানা (প্রায় ১০০ রুপি)। অপরদিকে এক ইংরেজ নারীর উপর ধর্ষণ-প্রচেষ্টায় অভিযুক্ত ভারতীয়কে দেয়া হয়েছিল ২০ বছরের কারাদণ্ড। ভারতবর্ষে প্রায় দুই শতকের ব্রিটিশ শাসনে মাত্র তিনটি দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে, যেখানে ভারতীয়দেরকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে ইংরেজদের। ব্রিটিশরা আরো শত-সহস্র ভারতীয়কে হত্যা করেও পার পেয়ে গেছে।
একজন ব্রিটিশের হাতে একজন ভারতীয়ের মৃত্যু সবসময়ই ছিল একটি দুর্ঘটনা। আর একজন ভারতীয়ের কারণে একজন ব্রিটনের মৃত্যু ছিল সর্বোচ্চ অপরাধ। তখনকার দিনে ব্রিটিশ মনিবদের একটি প্রিয় শখ ছিল ভারতীয় চাকরের পেটে লাথি মারা। তো এর ফলে যদি ওই চাকরের মৃত্যু হতো, তাহলে সেই দায় এমনকি চাপিয়ে দেয়া হতো ম্যালেরিয়ার কাঁধেও। পাঞ্চ (ম্যাগাজিন) তো একটি গোটা গীতিকাব্যও লিখে ফেলেছিল ‘দ্য স্টাউট ব্রিটিশ বুট’-কে নিয়ে, যেটিকে বিবেচনা করা হতো নেটিভদের নিয়ন্ত্রণে রাখার যোগ্য হাতিয়ার হিসেবে।
রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে ব্রিটিশ আমলে নানা বিধির মাধ্যমে আইনত অবদমন করা হতো। এসব বিধির মধ্যে একটি হলো রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, যা ছিল ব্রিটেনে বিদ্যমান সমগোত্রীয় আইনের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর। পেনাল কোডে ৪৯টি অনুচ্ছেদ বরাদ্দ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা সংশ্লিষ্ট অপরাধ নিয়ে, যেখানে মৃত্যু সংশ্লিষ্ট অপরাধ নিয়ে অনুচ্ছেদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১১।
অবশ্যই, ব্রিটিশরা ভারতকে ইংরেজি ভাষা দিয়েছে, যার উপকারিতা আজও চোখের সামনে দৃশ্যমান। কিন্তু এটি কি আদতে ছিল ব্রিটিশদের ‘উপহার’? কোনোভাবেই ইংরেজি ভাষাকে ব্রিটিশদের উপহার বলা যাবে না, বরং এটি ছিল উপনিবেশিকতার আরো একটি প্রভাবশালী যন্ত্র। ১৮৩৫ সালে তার সেই কুখ্যাত রচনা ‘মিনিট অন এডুকেশন’-এ লর্ড ম্যাকলে তুলে ধরেছিলেন ইংরেজি শিক্ষার ধ্রুপদী কারণ, যদিও তা গুটিকতক ভারতীয়ের জন্য:
“আমাদেরকে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে এমন একটি শ্রেণী গড়ে তোলার জন্য, যারা আমাদের এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে দোভাষীর ভূমিকা পালন করবে। তারা হবে এমন শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গ, যারা রক্তে-বর্ণে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মত, মূল্যবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিতে ইংরেজ।”
বস্তুতই, এ ভাষাটি শেখানো হতো অল্প কিছু মানুষকে, যেন তারা শোষক ও শোষিতের মধ্যস্থাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে। কোনোভাবেই ব্রিটিশরা চায়নি ভারতীয় সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত করতে, এবং এ উদ্দেশ্যে কোনো প্রকার বাজেট বরাদ্দের অভিপ্রায়ও তাদের ছিল না। আমরা ভারতীয়রাই বরং ইংরেজি ভাষাটিকে দখল করেছি, এবং একে আমাদের নিজেদের স্বাধীনতার হাতিয়ারে পরিণত করেছি। আমরা একে কাজে লাগিয়েছি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী অনুভূতি প্রকাশের লক্ষ্যে। তাই এখানে কৃতিত্বটা আমাদেরই, ব্রিটিশদের নয়।
ভারতীয় রেল যোগাযোগ সৃষ্টির ব্যাপারটি কৈফিয়ত প্রদানকারীরা প্রায়শই উল্লেখ করে থাকে ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্যতম প্রধান জনহিতকর কাজ হিসেবে। কিন্তু তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা ভুলে যায় যে, অনেক দেশই রেল যোগাযোগ তৈরি করেছে নিজেরাই, এজন্য তাদেরকে অন্য কোনো দেশ কর্তৃক উপনিবেশিত হতে হয়নি। তবে পরবর্তী তথ্যগুলো আরো মারাত্মক।
রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা প্রথম ভেবেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। নিজেদের বাণিজ্যের সুবিধার্থেই তারা এটি করেছিল। গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিং ১৮৪৩ সালে বলেছিলেন, রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে সুবিধা হবে “দেশটিতে বাণিজ্যের, সরকারি শাসনের এবং স্বৈর নিয়ন্ত্রণের।”
তাদের নিজস্ব ধারণা ও অবকাঠামোতে, ভারতীয় রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অর্থলাভের একটি বড় ধরনের সুযোগ। ব্রিটিশ অংশীদাররা ভারতীয় রেল যোগাযোগে বিনিয়োগের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ কামিয়ে নিয়েছিল। কেননা সরকার শুরুতে কথা দিয়েই রেখেছিল, বিনিয়োগকারীদের তারা দ্বিগুণ অর্থ ফিরিয়ে দেবে। এবং সেই অর্থ পুরোপুরি ছিল ভারতীয়, ব্রিটিশদের এক কানাকড়িও নয়। এভাবেই রেল যোগাযোগের অসিলায়, ভারতীয় করদাতাদের অর্থে ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল ব্রিটনদের কোষাগার।
রেল যোগাযোগের মূল লক্ষ্য ছিল কয়লা, লোহার আকরিক, তুলার মতো কাঁচামাল বিভিন্ন বন্দর পর্যন্ত নিয়ে আসা, যেন ব্রিটিশরা জাহাজে করে সেগুলো নিজেদের দেশে নিয়ে যেতে পারে, নিজস্ব কারখানায় কাজে লাগাতে পারে। মানুষের যাতায়াতের সুবিধাটি ঘটেছিল নিতান্তই ঘটনাক্রমে, কেবল কিছু ব্যতিক্রম বাদে, যখন ঔপনিবেশিক শাসনের স্বার্থেই এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত। ভারতীয়দের জন্য রেলগাড়িতে বরাদ্দ ছিল তৃতীয় শ্রেণীর কামরা। সেগুলোতে কাঠের বেঞ্চি বাদে আর কোনো সুযোগ-সুবিধাই দৃষ্টিগোচর হতো না। কামরাগুলোর অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে, তখনকার দিনেও সেগুলো নিয়ে বিস্তর হাসি-ঠাট্টা ও উপহাস চলত।
এবং, অতি অবশ্যই, বর্ণবাদও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল এখানে। যদিও কেবল শ্বেতাঙ্গদের জন্য বানানো কামরার ব্যবস্থা অচিরেই তুলে নেয়া হয়েছিল অর্থনৈতিক বাস্তবোপযোগিতার স্বার্থে, তবু ভারতীয়দের জন্য সাশ্রয়ীমূল্যের নাগালসাধ্য জায়গা ছিল চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত। (স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে একটি কার্টুন এ বিষয়টিকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলেছিল: এতে দেখানো হয়েছিল একটি প্রচণ্ড জনকবলিত রেলগাড়ি, যেটির জানালায় মানুষ ঝুলছে, ছাদ ঢাকা পড়েছে মানুষের নিচে, তৃতীয় শ্রেণীর কামরাগুলো থেকেও মানুষ উপচে পড়ছে, ওদিকে দুজন ব্রিটন প্রথম শ্রেণীর কামরায় আয়েশ করে বসে একে অন্যকে বলছে, “হে বন্ধু, ট্রেনে তো কেউই নেই!”)
রেলের চাকরিও দেয়া হতো না ভারতীয়দের। উপরমহলের দৃষ্টিভঙ্গি এমন ছিল যে, রেলে কেবল ইউরোপীয়দেরই চাকরি দিতে হবে “বিনিয়োগ রক্ষার স্বার্থে”। এ বিষয়টি বেশি করে প্রযোজ্য ছিল সিগনালম্যান, অপারেটর কিংবা স্টিম ট্রেনের রিপেয়ারারদের ক্ষেত্রে। তবে এসবের বাইরেও নীতিমালা এত বেশি ভয়াবহ ছিল যে, বিংশ শতকের গোড়ার দিকেও রেলওয়ে বোর্ডের সকল গুরুত্বপূর্ণ চাকুরে, ডিরেক্টর থেকে শুরু করে টিকেট কালেক্টর, সকলে ছিল শ্বেতাঙ্গ, যাদেরকে বেতনাদিও দেয়া হতো ভারতীয় নয়, ইউরোপীয় মুদ্রাতে।
বর্ণবাদের সাথে আরো একটি জিনিস জোট বেঁধেছিল, সেটি হলো ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্থানীয় দক্ষতাকে দমিয়ে রাখা। ১৮৬২ সালে রেলগাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলার জামালপুর ও রাজপুতানার আজমিরে দুটি রেইলওয়ে ওয়ার্কশপ স্থাপিত হয়েছিল। অল্প দিনের মধ্যেই সেখানকার ভারতীয় যান্ত্রিকরা এত বেশি দক্ষ হয়ে ওঠে যে, ১৮৭৮ সাল নাগাদ তারা নিজস্ব নকশায় লোকোমোটিভ তৈরি করতে শুরু করে দেয়। তাদের সাফল্যের হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে, আর তা দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ব্রিটিশরা। কেননা ভারতীয় লোকোমোটিভগুলো গুণে-মানে ব্রিটিশগুলোর চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না, অথচ সেগুলোর নির্মাণব্যয় ছিল অনেক কম।
এজন্য ১৯১২ সালে ব্রিটিশরা একটি সংসদীয় বিধি পাশ করে, যাতে করে ভারতীয় ওয়ার্কশপগুলোতে লোকোমোটিভের নকশা ও নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৫৪ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে ভারতে ইংল্যান্ড থেকে ১৪,৪০০টি লোকোমোটিভ আমদানি করা হয়, এবং আরো ৩,০০০টি আনা হয় কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি থেকে। অথচ ১৯১২ সালের পর আর একটিও তৈরি হয় না ভারতের মাটিতে। ৩৫ বছর বাদে, স্বাধীনতার পর, দেখা যায় ভারতীয়দের যন্ত্রপাতি বিষয়ক জ্ঞান শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। তাই ভারতীয় রেলওয়েকে ব্রিটিশদের সহযোগিতা নিয়েই পুনরায় ভারতে লোকোমোটিভ কারখানা স্থাপন করতে হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, ব্রিটেনে রেইলওয়ের প্রধান প্রাযুক্তিক পরামর্শদাতা যে লন্ডনভিত্তিক রেন্ডেল, তারা এখন আবার খুব বেশি মাত্রায় নির্ভর করে ভারতীয়দের উপর। তাদেরকে সাহায্য করে রাইটস, যেটি ভারতীয় রেলওয়ের অধীনস্থ একটি প্রতিষ্ঠান।
ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন প্রক্রিয়ার ফলে অর্থনৈতিক শোষণ যেমন ঘটেছিল, তেমনই অপব্যয় হয়েছিল লক্ষ লক্ষ টাকার, অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়েছিল অসংখ্য জুতসই শিল্প। সম্ভাবনার নিয়মতান্ত্রিক অগ্রাহ্যতার ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বদলে ভারতীয়রা হয়ে পড়েছিল নখদন্তহীন। আবহমানকাল ধরে চলে আসা সুপ্রাচীন সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, জীবনযাত্রার ধরন বদলে গিয়েছিল, এবং উপনিবেশিত থাকার ফলে ধীরে ধীরে বিলুপ্তি ঘটতে শুরু করেছিল ভারতবাসীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, তাদের আত্ম-পরিচয় ও আত্মসম্মানবোধ।
১৬০০ সালে, যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ব্রিটেন উৎপাদন করছিল বৈশ্বিক জিডিপির মাত্র ১.৮ শতাংশ। অন্যদিকে ভারত উৎপাদন করছিল ২৩ শতাংশ, যা ১৭০০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ শতাংশে। ১৯৪০ সাল নাগাদ, রাজশাসনের প্রায় দুই শতক পর, ব্রিটেন উৎপাদন করছিল বৈশ্বিক জিডিপির ১০ শতাংশ। অথচ ভারত ততদিনে পরিণত হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে। তারা তখন সর্বস্বান্ত, ক্ষুধার তাড়নায় ধুঁকছে। তারা পরিণত হয়েছে দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের সমার্থক শব্দে।
ব্রিটিশরা যখন ভারত ছাড়ে, তারা রেখে যায় এমন একটি সমাজব্যবস্থা, যার শিক্ষার হার ১৬ শতাংশ, গড় প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ২৭ বছর, কার্যত কোনো স্থানীয় শিল্পব্যবস্থা নেই, এবং ৯০ শতাংশ মানুষ বাস করছে এমন একটি রেখার নিচে, আজকের দিনে আমরা যাকে বলি ‘দারিদ্র্যের সীমা’।
যে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশরা দখল করেছিল, সেটি ছিল সম্পদশালী, প্রতিশ্রুতিশীল, বাণিজ্যিকভাবে সমৃদ্ধ একটি সমাজ; যে কারণে মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুরুতে আগ্রহী ছিল। পশ্চাৎপদ বা অনুন্নত তো ছিলই না, বরং উপনিবেশ-পূর্ববর্তী ভারত তখন রপ্তানি করত উচ্চমানের সব পণ্য, যেগুলো ব্রিটেনে ব্যবহার করাকে বিবেচনা করা হতো ‘কেতাদুরস্ত’ হিসেবে। ব্রিটেনের অভিজাতরা তখন পরত ভারতীয় পাট কিংবা মসলিনের তৈরি পোশাক, ঘর সাজাত ভারতীয় রঙ-বেরঙের সুতি কাপড় দিয়ে, আর রসনায় প্রিয় ছিল ভারতীয় মসলা ও চাটনি। সপ্তদশ ও অষ্টদশ শতকে, ব্রিটিশ দোকানিরা চেষ্টা করত বেশি লাভের আশায় সস্তা ইংরেজ কাপড়কে ভারতীয় বলে চালিয়ে দিতে।
কয়েক হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসের সাথে জুড়ে আছে মহান সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তৎকালীন অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে বহু গুণে এগিয়ে থাকা জাঁকালো সব শহর, যুগান্তকারী সব সৃষ্টি ও আবিষ্কার, বিশ্বমানের উৎপাদন শিল্প, এবং অফুরান সম্ভাবনা। সংক্ষেপে বলতে গেলে, আজকের দিনে সফল আধুনিকতার ছাপ হিসেবে মনে করা হয় যেগুলোকে, তার সবই ছিল ভারতের বুকে। এবং সত্যিই কোনো পার্থিব কারণ ছিল না ভারতের পুনরায় সেই গৌরবোজ্জ্বল সময়ে ফিরে যেতে অক্ষম হওয়ার, যদি না ব্রিটিশরা আত্মসাৎ করে নিয়ে যেত ভারতের অগুনতি সম্পদ।
যদিও বা ভারতে ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ভারতীয়দের কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হয়ে থাকে, মনে রাখতে হবে ব্রিটিশরা সেগুলো ভারতীয়দের উপকারার্থে করেনি কখনোই। আজ ভারতীয়রা রেল যোগাযোগের উপর প্রচণ্ড রকমের নির্ভরশীল। তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বদলে ফেলেছে ব্রিটিশ নীতিমালা। বর্তমানে রেলগাড়ি মূলত ব্যবহৃত হয় মানুষের যাতায়াতে, এবং মালবাহী রেলগাড়িতে চড়া মূল্য ধার্য করা হয়, যেন সেখান থেকে যাত্রীদের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যায় (ব্রিটিশদের কাজের ঠিক বিপরীত)।
এ কারণেই বর্তমানে ব্রিটেনের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিলোপ, অর্থাৎ ভারত শাসনকালে তাদের লালসার কথা বেমালুম ভুলে যাওয়া, অত্যন্ত দুঃখজনক। ইদানিং একটি বিশেষ প্রবৃত্তি ক্রমবর্ধমান, যেটিকে পল গিলরয়ের মতো পণ্ডিত আখ্যা দিচ্ছেন “উত্তর-ঔপনিবেশিক বিষাদবায়ু” হিসেবে। এই রোগের উপসর্গ হলো, সাম্রাজ্যের গরিমা-মহিমা-বৈভব স্মরণ করে আহ্লাদিত হওয়া। ২০১৪ সালে ইউগভের করা একটি জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ৫৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল “গৌরবজনক একটি বিষয়”, আর মাত্র ১৯ শতাংশ বলছে তারা অতীতের অপকর্মের জন্য “লজ্জিত”।
এই যে এত কথা বললাম, এর সাথে আজকের ইন্দো-ব্রিটিশ সম্পর্কের কোনো যোগসাজশ নেই। এটি এখন দুটি সার্বভৌম ও সমান জাতির বিষয়, কোনো ঔপনিবেশিক প্রভু এবং শোষিত প্রজার মধ্যকার ব্যাপার নয়। সত্যিই তো, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন) থেরেসা মে সম্প্রতি ভারত সফরে গিয়ে তার দেশের ব্রেক্সিট-পরবর্তী অর্থনীতির জন্য বিনিয়োগ কামনা করেছেন। যেমনটি আমি প্রায়ই বলে থাকি, আপনার কোনো প্রয়োজন নেই ইতিহাসের বদলা নেয়ার। ইতিহাস নিজেই নিজের বদলা।