ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে রহস্যজনক মৃত্যুর পেছনে যেসব বিষাক্ত পদার্থকে খুঁজে পাওয়া গেছে, আর্সেনিক তাদের মাঝে শীর্ষস্থানীয়। বর্ণ ও গন্ধহীন এ আর্সেনিক ধীরে ধীরে মানবদেহে নিজের শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে।
অধিক মাত্রায় প্রয়োগ করা হলে মাত্র কয়েক ঘন্টার মাঝেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আক্রান্ত ব্যক্তি। অপরদিকে ধীরে ধীরে স্বল্প মাত্রায় প্রয়োগ করা হলে মৃত্যু এমনভাবে ঘটে যে সেটাকে দেখে যে কেউ স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই মনে করবে। এছাড়া এককালে শরীরে আর্সেনিকের উপস্থিতি শনাক্ত করাও ছিলো বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এসব কারণে ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে এমন অনেক অপরাধীই খুঁজে পাওয়া যাবে যারা নিজেদের শিকারের মৃত্যুকে স্বাভাবিক প্রমাণ করতে বেছে নিয়েছিলেন আর্সেনিককে।
আজকের লেখায় আমরা এমনই কয়েকজন নারী সম্পর্কে আলোকপাত করবো যারা নিজেদের ঘৃণ্য স্বার্থ চরিতার্থ করতে বেছে নিয়েছিলেন আর্সেনিককে। তাদের শিকারের তালিকা থেকে বাদ যায় নি বাবা, স্বামী, এমনকি সন্তানের মতো সম্পর্কের মানুষেরাও!
গিউলিয়া তোফানা
সতের শতকের ইতালীর বাসিন্দা গিউলিয়া তোফানা বিষ প্রস্তুতের মাধ্যমেই নিজের জীবিকা নির্বাহ করতেন। রহস্যজনক বিষ ‘অ্যাকুয়া তোফানা’ তৈরির পেছনের কারিগর হিসেবেও মনে করা হয় তাকে। বিচিত্র এ বিষ তৈরির অন্যতম উপাদান ছিলো আর্সেনিক। সেই সাথে থাকতো আরো বেশ কিছু উপাদান। এর মাত্র কয়েক ফোঁটার সাহায্যেই শত্রুকে খতম করে দিতো ক্রেতা।
এখন প্রশ্ন হলো- কারা ছিলো তোফানার সেই বিষের মূল ক্রেতা? তৎকালীন সময়ে সমাজে নারীদের মর্যাদা কিংবা ক্ষমতা কোনোটাই তেমন একটা ছিলো না। সেই সাথে স্বামীদের কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব অনেক নারীর সংসার জীবনকেই করে তুলতো বিপর্যস্ত। আর এ দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যুকেই একমাত্র পন্থা হিসেবে বেছে নিতো অনেক নারী। তাই তাদের কারো কারো ড্রেসিং টেবিলে নানাবিধ প্রসাধনীর পাশাপাশি এক কোণে লুকনো থাকতো ‘অ্যাকুয়া তোফানা’র ছোট্ট বোতলটি।
গিউলিয়া তোফানার ১৮ বছরের ব্যবসার ফলস্বরুপ প্রায় ৬০০ জন মানুষ মারা গিয়েছিলো; আত্মহত্যা কিংবা হত্যা। অবশেষে একদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান তোফানার এক ক্রেতা। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমেই পুরো দলের সন্ধান পায় কর্তৃপক্ষ। ১৬৫৯ সালে মেয়ে ও দলের অন্যান্য সাঙ্গোপাঙ্গসহ মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় তোফানার।
অ্যামি আর্চার-গিলিগান
১৯০৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত কানেক্টিকাটে একটি নার্সিং হোম পরিচালনা করতেন অ্যামি আর্চার-গিলিগান। ১৯১০ সালে মারা যান তার প্রথম স্বামী ও ব্যবসায়িক অংশীদার জেমস আর্চার। অবশ্য আর্চার কিছুদিন আগে জীবন বীমা করিয়ে আসায় স্বামীর মৃত্যু থেকে আর্থিকভাবে ভালোই লাভবান হন অ্যামি!
১৯১৩ সালে অ্যামি বিয়ে করেন মাইকেল গিলিগানকে। আশ্চর্যজনকভাবে মাত্র তিন মাস পর তিনিও মারা যান। এর কাছাকাছি সময়ে অ্যামির পরিচালিত সেই নার্সিং হোমে রোগী মৃত্যুর হারও হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। দেখা যায় যে, যেসব রোগী তাদের খরচ একবারে পরিশোধ করেছিলেন, তারাই বেশি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন।
এ ব্যাপারটি খেয়াল করে মৃত এক ব্যক্তির আত্মীয় গিয়ে সংবাদপত্রে বিষয়টি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এরপরই নড়েচড়ে বসে পুলিশ বাহিনী, শুরু হয় কবর থেকে লাশগুলো তুলে সেগুলোর ময়নাতদন্ত। অ্যামির দ্বিতীয় স্বামী মাইকেলসহ আরো বেশ ক’জন মৃত রোগীর দেহে আর্সেনিকের উপস্থিতি খুঁজে পায় কর্তৃপক্ষ।
প্রথমে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলেও পরে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয় অ্যামিকে। অবশেষে ১৯৬২ সালে এক মানসিক হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার। অ্যামির হাতে মোট কতজন মারা গিয়েছে তা স্পষ্ট না হলেও সংখ্যাটি ৫ থেকে ৪৮ এর মাঝে বলেই ধারণা পুলিশের।
বার্থা গিফোর্ড
১৮৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের মোর্স মিল শহরে জন্মগ্রহণ করেন বার্থা গিফোর্ড। পরিণত বয়সে তিনি প্রথমে বিয়ে করেন গ্রাহাম নামের এক ব্যক্তিকে। কিন্তু এ সময়েই তিনি জেন গিফোর্ড নামে আরেকজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় গ্রাহামের। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর বার্থা জেনকে বিয়ে করেন, দুজনে চলে যান কাটাউইসাতে।
এখানে এসে আশাপাশের এলাকায় অল্পদিনের মাঝেই বেশ ভালো সুনাম কামাই করেন বার্থা। এলাকার অসুস্থ মানুষদের প্রায়ই দেখতে যেতেন তিনি। তাদের সেবাশুশ্রূষা করা ও রান্নাবান্না করে দেয়াও ছিলো তার কাজগুলোর মাঝে অন্যতম। এভাবেই ভালো রাঁধুনি হিসেবে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে তার। একইসাথে বার্থা ঘরে বসেই বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক তৈরি করতেন।
এভাবে ভালোই কেটে যাচ্ছিলো বার্থা গিফোর্ডের দিনগুলো। কিন্তু দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করে ১৯১৭ সাল থেকে। সেই বছর এলাকার দুজন মধ্যবয়স্ক সুস্থ-সবল লোক হঠাৎ করেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এদের মাঝে শেরম্যান পাউন্ডস মারা যান গিফোর্ডের বাড়িতেই। অন্যদিকে জিম ওগ্ল নামে আরেক লোক গিফোর্ড পরিবারের সাথে টাকা-পয়সা নিয়ে বাদানুবাদের কিছুদিন পরই রহস্যজনকভাবে মারা যান। ১৯২২ সালে পাউন্ডসের তিন বছর বয়সী নাতনী বার্থাদের সাথে থাকাকালে মারা যায়। ১৯২৩ সালে একইভাবে মারা যায় সাত বছর বয়সী আইরিন। ১৯২৫ সালে মাত্র অল্প কয়েক মাসের ব্যবধানে ইথেল শ্যামেল, তার দুই ছেলে ও আরেক আত্মীয় মারা যান। তাদের সবারই দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন বার্থা। ১৯২৭ সালে মারা যান এড ব্রিনলে নামক আরেক ব্যক্তি।
অল্প কয়েক বছরের ব্যবধানে একই এলাকার এতজন মানুষের রহস্যজনক মৃত্যু পুলিশকে ভাবিয়ে তোলে। তাই কবর থেকে এড ব্রিনলে ও শ্যামেল ভাইদের লাশ তুলে ময়নাতদন্ত করা হয়। তদন্তে তাদের শরীরে বিপুল পরিমাণ আর্সেনিকের উপস্থিতি ধরা পড়ে। শেষ পর্যন্ত জানা যায় যে, তাদের প্রত্যেককে বার্থাই আর্সেনিকের সাহায্যে খুন করেছিলেন।
১৯২৮ সালে দুই খুনের অভিযোগে বার্থার বিচার শুরু হয়। বিচার শেষে তাকে মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ হিসেবে ঘোষণা করে পুলিশি তত্ত্বাবধানে মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠাতে বলা হয়। সেখানেই ১৯৫১ সালে মারা যান বার্থা।
ম্যারি অ্যান গিয়ারিং
উনিশ শতকে যুক্তরাজ্যের পূর্ব সাসেক্সের গেস্টলিংয়ে বাস করতেন এক নারী, নাম তার ম্যারি অ্যান গিয়ারিং। ১৮৪৬ সালে ম্যারির স্বামী রিচার্ড গিয়ারিং উত্তরাধিকারসূত্রে ২০ পাউন্ড লাভ করেন। তখনকার সময়ে এ ২০ পাউন্ড নেহায়েত কম কিছু ছিলো না। কিন্তু তাই বলে এজন্য কেউ যে একেবারে খুনের পরিকল্পনা করে বসবে তা বোধহয় কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। কিন্তু এমন ঘটনাই ঘটেছিলো তখন।
১৮৪৮ সালে রহস্যজনকভাবে টানা পাঁচদিন বেশ অসুখে ভুগে মারা যান রিচার্ড। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছিলো হৃদরোগকে। চার মাস পর মারা যায় রিচার্ডের ২১ বছর বয়সী ছেলে জর্জ। এর কয়েক সপ্তাহ পর বাবার মতো একইভাবে মারা যায় ২৬ বছর বয়সী জেমস। এর কিছুদিন পর রিচার্ড-ম্যারি দম্পতির ১৮ বছর বয়সী ছেলে বেঞ্জামিনও একইভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তবে পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ডাক্তাররা এবার আর বেঞ্জামিনের চিকিৎসা বাসায় করতে দিলেন না। বরং তাকে সেখান থেকে আলাদা আরেক জায়গায় নিয়ে চিকিৎসা করলে ধীরে ধীরে সেরে উঠে সে।
এরপরই ডাক্তারদের মনে সন্দেহের দানা বাসা বাঁধে। কবর থেকে তুলে আনা হয় রিচার্ড, জর্জ ও জেমসের মরদেহ। তাদের দেহে বিপুল পরিমাণ আর্সেনিকের উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়। অবশেষে গ্রেফতার করা হয় মা ম্যারি অ্যান গিয়ারিংকে। বিচারে স্বামী ও সন্তানদের খুনের অভিযোগ স্বীকার করেন তিনি। অবশেষে ১৮৪৯ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
ব্লাঞ্চ টেইলর মুর
১৯৫২ সালের কথা, ১৯ বছর বয়সী ব্লাঞ্চ টেইলর মুর বিয়ে করেন জেমস টেইলর নামের এক ব্যক্তিকে। অবশ্য এত অল্প বয়সে তার বিয়ের মূল কারণ ছিলো মদ্যপ বাবা পি. ডি. কাইজারের নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়া। ১৯৬৬ সালে হৃদরোগে ভুগে মারা যান কাইজার। তার দেহে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো আর্সেনিক।
১৯৭৩ সালে কিছুদিন অসুখে ভুগে রহস্যজনকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ব্লাঞ্চের প্রথম স্বামী টেইলর। অবশ্য তখন ব্লাঞ্চ তার সহকর্মী রেমন্ড রেইডের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের প্রকাশ্যে একসাথে ঘোরাফেরা করতে দেখা যেতো। রহস্যজনকভাবে ১৯৮৬ সালে মারা যান রেইডও।
রেভারেন্ড ডুইট মুর নামে আরেক ব্যক্তিকে ততদিনে নিজের মনে স্থান দিয়ে ফেলেছিলেন ব্লাঞ্চ। তাই রেইডের মৃত্যুর পর এবার তার দিকে ঝুঁকে যান তিনি। ১৯৮৯ সালে তাদের বিয়েও হয়। হানিমুন থেকে ফিরে আসার পরপরই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যান ডুইট। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে অসুস্থতার কারণ হিসেবে তার শরীরে আর্সেনিকের উপস্থিতিকে দায়ী করেন ডাক্তাররা। ডুইট সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও আজীবন অসুস্থতা বয়েই বেড়াতে হয়েছে তাকে।
এরপরই সন্দেহের ঘেরাটোপে পড়ে যান ব্লাঞ্চ। জেমস টেইলর ও রেমন্ড রেইডের মৃতদেহ কবর থেকে তুলে এনে পরীক্ষা করা হয়। তাদের দেহে বিপুল পরিমাণ আর্সেনিক খুঁজে পাওয়া যায়। এরপরই গ্রেফতার করা হয় ব্লাঞ্চকে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়। ব্লাঞ্চ অবশ্য সবসময়ই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে গেছেন।
এখন পর্যন্ত অবশ্য ব্লাঞ্চের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় নি। বর্তমানে তার বয়স ৮৩ বছর।
আর্সেনিক-খুনী নারীদের নিয়ে আজ ছিলো আমাদের প্রথম পর্বের আয়োজন। শীঘ্রই আসবে দ্বিতীয় পর্ব। বিষাক্ত এ পদার্থকে কাজে লাগিয়ে নীরবে নিজেদের কাজ সেরে যাওয়া আরো কিছু দুর্ধর্ষ অপরাধীর বর্ণনা থাকবে সেখানেও। ততক্ষণ পর্যন্ত আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি এখানেই।