বৃহদাকার পাথরের প্ল্যাটফর্মগুলোতে চলছে অভিজাতদের ভোজনসভার আয়োজন। সবার হাতে হাতে শোভা পাচ্ছে সুরাপাত্র। একদিকে চলছে গানবাজনার আসর। তাদের হাতে দেখা যাচ্ছে পেলিকেন পাখির হাড় দিয়ে তৈরি বাঁশি আর কর্নেট। সমগ্র জায়গা জুড়ে যেন আনন্দ আর শান্তির ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
পৃথিবীর একটি প্রান্তে যখন মিশরের পিরামিডগুলো সবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, ঠিক ঐ সময়ে পৃথিবীর অন্য একপ্রান্তে বিকাশ লাভ করছিল এক নতুন সভ্যতা।
বলছি দক্ষিণ আমেরিকার বুকে গড়ে ওঠা এক প্রাচীন আমেরিকান সভ্যতার কথা। পেরুর সুপে উপত্যকায় অবস্থিত কারাল অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে (খ্রিস্টপূর্ব ৩,৭০০ অব্দ) গড়ে ওঠে এই সভ্যতা। কারাল-সুপে সভ্যতা বা নর্তে চিকো সভ্যতা নামে পরিচিত এই সভ্যতা হলো সবচেয়ে প্রাচীন আন্দীয় তথা আমেরিকান সভ্যতা।
আমেরিকা মহাদেশের প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো এই সভ্যতায় ছিল জটিল প্রাক-কলম্বিয়ান সমাজব্যবস্থা, যা প্রাচীন বিশ্বে গড়ে ওঠা ছয়টি সভ্যতার স্থানগুলোর মধ্যে একটি। বর্তমান উত্তর-মধ্য উপকূলীয় পেরুর নর্তে চিকো অঞ্চলে অবস্থিত, লিমার ২০০ কিলোমিটার উত্তরে সুপের নিকটে বারানকা প্রদেশে এর অবস্থান। পেরুর সুপে উপত্যকায় অবস্থিত কারাল অঞ্চলের নাম থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে। পেরুর এই অঞ্চলকে কথ্যভাষায় বর্তমানে নর্তে চিকো (যার অর্থ উত্তরের ছোট্ট স্থান) বলা হয়। এ থেকেই এর দ্বিতীয় নামটি এসেছে।
ফোর্টালেজা, পাটিভিলকা এবং সুপে নামে তিনটি নদীর ধারে এই সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল। ধারণা করা হয়, এই সভ্যতার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩,০০০। সভ্যতার সর্বোত্তম বিকাশের সময় ছিল সুমেরীয় সভ্যতা থেকেও হাজার বছর পরে, কিন্তু মিশরের পিরামিডগুলো নির্মাণ হওয়ার সমসাময়িক। আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র মেসোআমেরিকার থেকেও এই সভ্যতা প্রায় ২০০০ বছর পুরনো। এই সভ্যতার প্রায় ৩০টি কেন্দ্র খুঁজে পাওয়া গেছে উত্তর-মধ্য পেরুর সমুদ্র উপকূলে। এগুলোর মধ্যে কারাল, আসপেরো, উয়ারিকাঙ্গা, কাবালেত উল্লেখ্যযোগ্য। এসব স্থানে খননকার্য চালিয়ে এই সভ্যতার প্রচুর নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে। এই সভ্যতার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক কৃতিত্ব ছিল এর স্মারক স্থাপত্য, যার মধ্যে রয়েছে মাটির বৃহৎ প্লাটফর্মের ঢিবি, অনেকগুলো চত্বর, বাসস্থানের জন্য তৈরি বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, এবং একটি ২৮ মিটার উঁচু মন্দির। কারালের মূল শহরের কমপ্লেক্স ছিল প্রায় ১৫০ একর বিস্তৃত। এছাড়া পাথরের তৈরি উঁচু প্ল্যাটফর্ম, একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার, প্ল্যাটফর্মের উপর খাওয়াদাওয়ার চিহ্ন, হাড়ের তৈরি বেশ কিছু বাঁশি প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া প্ল্যাটফর্মগুলো উৎসবের জন্যও ব্যবহার করা হতো।
মিশরের পিরামিডের মতো কারালেও দেখা মিলবে ছয়টি পিরামিডের। এই পিরামিডের উপর থেকেই কারালের শাসকরা পুরো শহর পর্যবেক্ষণ করতেন। এর ভেতরের সিঁড়িগুলো ২৯ ফুট প্রশস্ত। এছাড়া ভেতরে রয়েছে ছোট ছোট কয়েকটি কক্ষ, জানালা এবং একটি বেদী। এই সভ্যতার লোকেরা শিল্প তৈরি না করলেও তারা তাদের স্থাপত্যশিল্পকে দিয়েছে শৈল্পিক রূপ। নগরের দেয়ালে দেখা মিলবে খোদাই করা বিভিন্ন প্রতিমূর্তির চিত্র। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য থেকে এখানে যথেষ্ট জটিল একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপের অস্তিত্ব পরিষ্কার বোঝা যায়। এখানে পাওয়া গেছে তুলা রাখার জন্য বিশালাকারের গুদামঘর, এবং ভোজের জন্য আলাদা জায়গা যেখানে প্রচুর মানুষ একসঙ্গে খেতে পারত। এই সবকিছু প্রমাণ করে যে, এখানে একটি শক্তিশালী, কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা ছিল।
এই সভ্যতার মানুষ ধাতুর ব্যবহার জানত না। এমনকি মৃৎপাত্র তৈরি বা এর ব্যবহারের কোনো নিদর্শনও এখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া অন্যান্য সভ্যতায় যেমন বিভিন্ন শিল্প বা শৈল্পিক জিনিসপত্র পাওয়া গেছে, এখানে তেমন উল্লেখ্যযোগ্য কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে এখানে পাওয়া গেছে কুইপু, যা সুতার তৈরি এবং হিসাব রাখার জন্য ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা করা হয়। এগুলোতে দেয়া গিঁট সংখ্যাভিত্তিক হিসাব রাখার প্রমাণ করে। পরবর্তীতে ইনকা সভ্যতার লোকেরাও এটি ব্যবহার করে। তবে লিখিত রেকর্ড না থাকলেও অনুমান করা হয় যে, এটি একটি সহযোগিতামূলক এবং অনুপ্রাণিত সংস্কৃতি ছিল।
রুথ শেডি, পেরুর একজন নৃবিজ্ঞানী ও প্রত্নতত্ত্ববিদ, যিনি তার দল নিয়ে ১৯৯৪ সালে কারালে খননকার্য চালিয়ে হাড়নির্মিত ৩২টি বাঁশি খুঁজে পান। এ থেকে ধারণা করা যায় এই সংস্কৃতিতে গানবাজনার যথেষ্ট প্রচলন ছিল। এছাড়াও একই অঞ্চলে ৩৭টি শিঙাজাতীয় বস্তুও খুঁজে পাওয়া গেছে, যা থেকে সুরাপানের বিষয়েও কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া রুথ শেডির খননকার্য থেকে সেই সময়ের কিছু শস্য, ফল ও কন্দজাতীয় উদ্ভিদের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে। সেগুলো মূলত স্কোয়াশ, কয়েক রকমের বিনস, পেয়ারা, লুকুমা, মিষ্টি আলু প্রভৃতি। এছাড়াও পাওয়া গেছে ভুট্টা, মরিচ, মটরশুঁটি, লাউ এসব শস্য ও ফসল চাষের অস্তিত্ব। শেডি কারালকে ‘পবিত্র শহর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
২০০০ সালে কারালের ঠিক পশ্চিমে মার্কো মাচাকুয়ে এবং রোসিও আরামবুরু একটি জিওগ্লিফ (জিওগ্লিফ হলো একটি বড় নকশা যা সাধারণত পাথর, পাথরের টুকরো, নুড়ি বা মাটি দ্বারা মাটিতে নকশা কেটে তৈরি করা হয়) আবিষ্কার করেছিলেন। এই নকশার রেখাগুলো লম্বা চুল এবং একটি খোলা মুখ দিয়ে একটি মানুষের আকৃতিতে তৈরি করা করেছিল।
প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে ধারণা করা যায়, কারাল সভ্যতায় ধর্মের স্থান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভিত্তিও ছিল। ধারণা করা হয়, এই সভ্যতার নেতৃত্বও ছিল পুরোহিতদের হাতে। লোকেরা বিশ্বাস করত- দেবতা ও অতিপ্রাকৃত শক্তির সাথে পুরোহিতদের যোগাযোগ হতো। এই বিশ্বাসের ক্ষমতাই ছিল তাদের প্রতিপত্তির মূল কারণ। তবে স্বভাবতই কারাল সভ্যতায় প্রচলিত ধর্ম সম্পর্কে খুব কম তথ্য পাওয়া গিয়েছে। একটি প্রাচীন লাউয়ের খোলে দুই হাতে দণ্ডধারী এক অঙ্কিত মূর্তি পাওয়া গেছে, যা থেকে ধারণা করা যায় এখানে কোনো এক দেবতার উপাসনা করা হতো। এই ধরনের দণ্ডধারী দেবমূর্তি কাছাকাছি বিভিন্ন আন্দীয় সভ্যতাতেও পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, কারাল সভ্যতাতেই এই দেবতার পূজা শুরু হয়।
প্রাকৃতিকভাবে এই অঞ্চলটি অত্যন্ত শুষ্ক। দক্ষিণ আমেরিকার দীর্ঘতম পর্বতমালা আন্দিজ থেকে নেমে আসা প্রায় ৫০টি নদী অত্যন্ত শুষ্ক এই অঞ্চল দিয়ে বয়ে গেছে। ফলে এসব নদীতীরে প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার কেন্দ্রগুলোর মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। তাই স্বাভাবিকভাবেই কারাল সভ্যতাও কৃষিপ্রধান অর্থনীতি ছিল। তবে ফসল চাষের পরিবর্তে এই সভ্যতার লোকেরা চাষ করত তুলা। সেই তুলা থেকে তৈরি সুতা দিয়ে বানানো হতো মাছ ধরার জাল। আর সেসব সরবরাহ করা হতো নদী ও সমুদ্র তীরে অবস্থিত এই সভ্যতার বিভিন্ন নগরে। নদী ও সমুদ্র থেকে সংগৃহীত মাছ ও সামুদ্রিক নানা খাদ্যদ্রব্যই ছিল এই সভ্যতার মানুষের বেঁচে থাকার আহার। শিকার করা সামুদ্রিক প্রাণীগুলোর মধ্যে ঝিনুক, সার্ডিন, ক্লাম্প, শেলফিস ছিল প্রধান। তবে নদী এলাকাগুলোতে ফল ও সবজি চাষের নিদর্শনও পাওয়া গেছে। তাই এটা বলা যায় যে- এই সভ্যতা সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতাগুলো থেকে কিছুটা ভিন্ন ছিল।
সাধারণত প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে যুদ্ধবিগ্রহের আলামত দেখা যায়। তবে এই সভ্যতায় যুদ্ধের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। তাই ধারণা করা হয়- এই সভ্যতার মানুষেরা ছিল শান্তিপ্রিয়। আবার এই সভ্যতার শহরগুলো পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো বলে এখানে যুদ্ধবিগ্রহ ছিল না।
প্রায় দুই হাজার বছর সগৌরবে টিকে থাকার পর অবশেষে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এর পতন ঘটে। ধারণা করা হয়, ভূমিকম্প বা এল নিনো জাতীয় কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে এই সভ্যতার মানুষ। আবার আরেকটি মতানুসারে, উপকূল অঞ্চল বরাবর উত্তরে, দক্ষিণে ও পূর্বে আন্দিজ পর্বতের উচ্চভূমিতে এই সময় আরও কতগুলো শক্তিশালী নগরের উত্থান ঘটে। উত্তরদিকে বিভিন্ন খালের চিহ্ন দেখে বুঝতে পারা যায়- এসব অঞ্চলে সেই সময় সেচনির্ভর কৃষিব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ফলে কারাল সভ্যতার মানুষ হয়তো আরও অধিক খাদ্য বা ফসল উৎপাদনের আশায় একসময় তাদের নিজেদের অঞ্চল ছেড়ে আরও উর্বর অঞ্চলের দিকে সরে যায়। ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের নগরগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ে, আর একসময় শুধু পড়ে থাকে তাদের গড়ে যাওয়া সব কীর্তি। বর্তমানে এটি বিশ্বের ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থানগুলোর একটি।