সৃষ্টির পর থেকে এই পৃথিবীতে জন্ম হয়েছে নানা সভ্যতার, জন্ম হয়েছে নানা শহরের। প্রাচীন এসব শহরের কোনো কোনোটি টিকে আছে আজও, হয়েছে আরো উন্নত। আবার কোনো কোনো শহর নানা কারণে হারিয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে। প্রাচীন নগরী আটলান্টিস থেকে রহস্যময় এলডোরাডো, এসব প্রাচীন হারিয়ে যাওয়া সভ্যতাগুলো আজও এদের নিজ নিজ রহস্যময় গল্প নিয়ে মানুষের মনে বেঁচে রয়েছে। আফ্রিকার দুর্গম জঙ্গল থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এসব রহস্যময় লুকানো শহরগুলো সবসময় নানা অভিযাত্রী, নানা পর্যটককে আকর্ষণ করেছে। অনুপ্রাণিত করেছে বহু লেখক, বহু চলচ্চিত্র নির্মাতাকে। এসব শহর নিয়ে লেখা হয়েছে বহু বই, তৈরি হয়েছে বহু সিনেমা।
চলুন আজকে জেনে নিই এমনই ৫টি হারিয়ে যাওয়া রহস্যময় শহর সম্পর্কে যার খোঁজ আজও কেউ পায়নি।
১. ‘Z’ এর হারানো শহর
১৯২৫ সালে তিনজনের একটি দল, ব্রিটিশ সার্ভেয়ার কর্নেল পার্সি হ্যারিসন ফাউসেটের নেতৃত্বে ব্রাজিলের ‘মাতো গ্রোসো’ এলাকার দুর্গম জঙ্গলে প্রবেশ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটি প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করা। ফাউসেট এই প্রাচীন শহরের নাম দিয়েছিলেন ‘Z এর হারানো শহর’।
তবে দুঃখজনক ব্যপার হলো এই তিনজনকে আর কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু তা-ই নয়, গত কয়েক দশক ধরে প্রায় ১০০ জন মানুষ যারা এদের খোঁজ করতে গিয়েছিলেন তারাও সেখানে গিয়ে বেমালুম গায়েব হয়ে যান। তাদের কেউই কখনো আর ফিরে আসেন নি। ধারণা করা হয়, ফাউসেটের এই শহরটি ‘কুহুকুগু’ নামের একুশ শতকের শুরুর দিকে আবিষ্কৃত হওয়া একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। একসময় এখানে ৫০,০০০ এর বেশি মানুষের বসবাস ছিল।
২০০৯ সালে আমেরিকান লেখক ডেভিড গ্রান ফাউসেটের এই অভিযান নিয়ে ‘The Lost City of Z’ নামে একটি বই লেখেন। পরবর্তীতে এই বইয়ের উপর ভিত্তি করে একটি মুভিও নির্মাণ করা হয়।
২. আটলান্টিস
সর্বপ্রথম ৩৬০ খ্রিস্টপূর্বে গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর লেখায় আটলান্টিসের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রায় দুই সহস্রাব্দ ধরে এই রহস্যময় হারিয়ে যাওয়া শহরটি বহু অভিযাত্রী, গবেষক, ইতিহাসবিদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে।
বলা হয়ে থাকে এই রহস্যময় দ্বীপটি ছিল খুবই বিস্তীর্ণ। শক্তিশালী একটি রাজ্যের রাজধানী ছিল এই দ্বীপটি। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে উন্নত এই দ্বীপের ছিল একটি প্রতিদ্বন্দ্বীহীন শক্তিশালী নৌবাহিনী।প্লেটোর বর্ণনানুসারে, ৯,৬০০ খ্রিস্টপূর্বে কোনো এক অজানা কারণে “আগুন ও ভূমিকম্পময় ভয়ানক এক রাতে” এই গোটা দ্বীপটাই ধ্বংস হয়ে যায়। ডুবে যায় পানির নিচে।
ডুবে যাওয়া রহস্যময় এই শহরের খোঁজে এ পর্যন্ত অসংখ্য অভিযান চালানো হয়েছে। তবে গবেষকরা এখনো খুঁজে পাননি এই হারানো শহরটিকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে সাম্প্রতিক অভিযানটির নেতৃত্ব দেন কানাডিয়ান-ইসরাইলি সাংবাদিক ও অনুসন্ধানী প্রত্নতত্ত্ববিদ সিমচা জ্যাকোবোভিচি। তার অংশীদার হিসেবে ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জেমস ক্যামেরন। জ্যাকোবোভিচি ও তার দল প্লেটোর লেখা থেকে বিভিন্ন সূত্র নিয়ে ও উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য সমুদ্রের তলদেশে হারানো শহরের ধ্বংসাবশেষের খোঁজ করেন। এ সময় তারা স্পেনের উপকূলে জিব্রাল্টার প্রণালীতে ৬টি ব্রোঞ্জ যুগের পাথর নির্মিত নোঙর খুঁজে পান। এছাড়া আটলান্টিসের অন্য কোনো চিহ্ন তারা খুঁজে পাননি। তাদের এই আবিষ্কার প্রায় ৪,০০০ বছর পুরানো কোনো এক বৃহৎ সভ্যতাকে নির্দেশ করে। হতে পারে এগুলো সেই হারানো আটলান্টিসেরই অংশ।
৩. হারানো লায়োনিস রাজ্য
কিংবদন্তী অনুসারে, লায়োনিস রাজ্য ছিল ব্রিটেনের সিসিলি দ্বীপে অবস্থিত বিশাল এক রাজ্য। কোনো একদিন বিশাল এই রাজ্যকে গিলে নেয় উত্তাল সমুদ্র। কেউ কেউ মনে করেন বর্তমানে সেখানে অবস্থিত ১৪০টি দ্বীপ আসলে সেই ডুবে যাওয়া রাজ্যের পাহাড়চূড়া!
চতুর্দশ শতাব্দীর উইলিয়াম ওরচেস্টারের লেখা ভ্রমণবৃত্তান্ততে সর্বপ্রথম কর্নওয়াল উপকূলে হারিয়ে যাওয়া এক সভ্যতার কথা দেখতে পাওয়া যায়। লেখকের বর্ণনামতে, প্লাবনের পূর্বে সমুদ্র থেকে ৪০ মাইল দূরে বিস্তৃত এক অচেনা স্থান ছিল। তিনি বলেন, “বহু বন, মাঠ সহ ১৪০টি গির্জা, সবই আজ ডুবে আছে পর্বত ও সিসিলি দ্বীপের মধ্যবর্তী স্থানে।”
ইতিহাসের বহু কাহিনীতে এই লায়োনিস রাজ্যের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পটি হলো রাজা আর্থারের কিংবদন্তী। সেখানে বিখ্যাত বীর ত্রিস্তানের বাসস্থান হিসেবে লায়োনিসের উল্লেখ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, যে প্রলয়ের ফলে লায়োনিস ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তা আসলে ঘটেছিল কিংবদন্তীর সেই রাজা আর্থারের সময়কালেই।
তবে গবেষকরা উক্ত স্থানে খোঁজাখুঁজি করে হারানো সেই শহরের কোনো চিহ্ন খুঁজে পান নি। ধারণা করা হয়, ৩,০০০ বছর নিমজ্জিত থাকার ফলে গোটা সভ্যতাটি সমুদ্রে বহু গভীরে হারিয়ে গিয়েছে।
৪. এল ডোরাডো
স্বর্ণ নগরী এল ডোরাডোর কিংবদন্তীর উৎপত্তি হয় ষোড়শ শতাব্দীতে, যখন ইউরোপিয়ানরা নতুন বিশ্বে গুপ্তধন খোঁজার নেশায় মেতে ছিল। বিশেষ করে স্পেন তৎকালীন সময়ে বাঘা বাঘা সব দখলদার ও অভিযাত্রীদের দক্ষিণ আমেরিকায় পাঠিয়েছিল যাতে তারা সেখান থেকে সকল দামী জিনিস খুঁজে দখল করে নিয়ে আসতে পারে। এমন সময় গুজব ওঠে আদ্রিজ পর্বতচূড়ায় রয়েছে এক শহর যেখানে স্বর্ণের কোনো অভাব নেই। যেখানের রাজা সোনার গুঁড়ায় নিজের দেহ আবৃত করে রাখে। এই গল্প থেকেই সেই শহরের নামকরণ করা হয় এল ডোরাডো বা স্বর্ণমোড়া শহর।
ইতিহাস জুড়ে বহু অভিযাত্রী এই শহর খুঁজে বেড়িয়েছে। কিন্ত কেউই এই শহরটি আজ পর্যন্ত খুঁজে পায়নি। এই শহরের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে বহু উপন্যাস। অনেকগুলো চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে এল ডোরাডো নিয়ে।
৫. কালাহারির হারানো শহর
১৮৮৫ সালে কানাডিয়ান অভিযাত্রী ও বিনোদন তারকা গুইল্লারমো ফারিনি পশ্চিমাদের মধ্যে থেকে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকার অনাবিষ্কৃত ও দুর্গম মরুভূমি কালাহারি অতিক্রম করেন। অভিযান শেষে ফিরে এসে তিনি মরুভূমির বালির নিচে চাপা পড়া এক হারানো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের কিছু ছবি সবার সামনে তুলে ধরেন। তার বর্ণনামতে,
“লম্বা লাইনের পাথরের ধ্বংসাবশেষের পাশেই আমরা তাবু গেড়েছিলাম। চীনের দেয়াল যদি ভূমিকম্পে কখনো ধ্বংস হয়ে যায় তবে তা দেখতে যেমনটি লাগবে এটিও ঠিক তেমন দেখতে লাগছিল। পরীক্ষার পর আমরা বুঝতে পারলাম এটি বালির নিচে চাপা পড়া প্রাচীন কোনো গঠনের অংশবিশেষ। আমরা আশেপাশের কয়েক মাইলের মধ্যে এর অন্যান্য অংশের খোঁজ করলাম এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মসৃণ পাথর দেখতে পেলাম। এসব পাথরের মধ্যবর্তী স্থানে সিমেন্টের জোড় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।”
বিংশ শতাব্দী জুড়ে প্রায় এক ডজনের মতো অভিযাত্রী ফারিনির দেওয়া বর্ণনানুযায়ী কালাহারির এই হারানো সভ্যতার খোঁজ করেছেন। কিন্তু কেউ এর কোনো খোঁজ পাননি। তবে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে আমেরিকান অভিযাত্রী জোস গেটসের নেত্রীত্বে ‘এক্সপেডিশন আননোন’ নামে কয়েকটি অভিযান চালানো হয়।
এ সময় এরিয়াল স্ক্যানার ও রাডার ব্যবহার করে ও ফারিনির দেওয়া সূত্রানুসারে কালাহারির গভীরে খোঁজ করতে করতে একসময় এক মরুদ্যানের পাশে মানুষের তৈরি কিছু ধ্বংসাবশেষের খোঁজ পান তারা। এগুলোই হয়তো ফারিনির উল্লেখিত সেই হারিয়ে যাওয়া শহরের অংশ। আগামীর অভিযানগুলোতে হয়তো নিশ্চিত ভাবে জানা যাবে এর পরিচয়।
ফিচার ইমেজ – hdwallpapers.com