যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ পরিচিত ছিলেন মূলত তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য। সেই সাথে অনেকে খ্যাত হয়েছেন তাদের সাহসিকতা, উদারতা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য; অনেকে আবার কুখ্যাত হয়েছেন নিজেদের কুটিল স্বভাবের জন্য। অনেকের আবার ছিলো বিচিত্র সব খেয়াল। কেউ কেউ শুধু নিজের রাজ্য বাড়ানোর জন্য অভিযান চালিয়ে গেছেন বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। কেউ আবার শুধু নিজের স্ত্রীর স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে তৈরি করেছেন তাজমহল। একজন তো শুধু নিজের স্ত্রীকে খুশি করতে তৈরি করেছিলেন সুবিশাল মদের দীঘি এবং মাংসের বন। তিনি হচ্ছেন চীনের শ্যাঙ রাজবংশের শেষ শাসক রাজা ঝৌ জিন।
ঝৌ জিন জানতেন আসলে কিভাবে আমোদপ্রমোদ করা যায়। বিনোদনের সময় হলে তিনি এবং তার রানী চলে যেতেন তাদের প্রমোদ প্রাসাদে এবং তাদের মদের দিঘীতে নেমে পড়তেন।
এর নাম যে শুধু এমনি এমনি মদের দিঘী হয়েছে তা কিন্তু নয়। পুরো ওয়াইনে পরিপূর্ণ দিঘীটি আসলেই অনেক বড় ছিলো। বলা হয়ে থাকে, রাজা ঝৌ জিনের মদের দিঘীটি চারদিকে ২ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ ছিলো। আর এত প্রশস্ত হওয়ার কারণে রাজা নিজের ডিঙি নৌকা নিয়ে সেই দিঘীতে মাঝেমধেই বেরিয়ে পড়তেন।
দিঘীটির ব্যাপারে আরেকটি যে চমকপ্রদ তথ্য রয়েছে তা হলো, এটির ঠিক মাঝখানেই একটি মানুষের তৈরি দ্বীপ ছিলো। দ্বীপটি পরিপূর্ণ ছিলো মাংসের বনে! অর্থাৎ সেই বনটির সকল গাছ তৈরি করা হয়েছিলো রান্না করা মাংস দিয়ে। সুন্দর করে কেটে বিশেষ আকৃতি দিয়ে স্তুপকৃত মাংসগুলোর ভেতর দিয়ে শিক ঢুকিয়ে দিয়ে সেগুলোকে গাছের আকৃতি দেওয়া হয়েছিলো। এমনকি গাছগুলোর ডালপালা দিয়েও ঝুলতো মুরগীর রোস্ট, গরু এবং শূকরের মাংস! রাজা নিজের ডিঙি নৌকাতে সময় কাটাতেন, যখন মন চাইতো নিচের দিঘী থেকে মদ নিয়ে পান করতেন, ক্ষুধা লাগলে মাথার উপরের ঝুলন্ত গাছ থেকে মাংস পেড়ে খেতেন!
বিশ্বের যেকোনো স্থানের থেকে রাজা ঝৌ জিনের এই প্রমোদ প্রাসাদটি ধরা যায় পুরোই অন্যরকম এক আমোদপ্রমোদের স্থান ছিলো। আর সেই স্থানে যে পার্টির আয়োজন করা হতো সেটিও ছিলো ভিন্নরকম, এককথায় অশ্লীল।
সবসময় সেই আসরে প্রায় ৩,০০০ এর মতো নারী-পুরুষ থাকতো এবং রাজার আদেশানুযায়ী তাদের শরীরে কোনো কাপড় থাকা চলতো না। যখনই আদেশ হতো তখনই তাদেরকে রাজার সেই দিঘী থেকে পশুর মতো মদ খেতে হতো বা সেখানে ডুব দেয়া এবং সাঁতার কাটতে হতো। এমনকি রাজার বিশেষ ইশারায় তাদের একে অপরকে তাড়িয়ে ধরে যৌনতায়েও লিপ্ত হতে হতো! এতকিছুর ঠিক মাঝখানে রাজা-রানী বসে থাকতেন এবং এসব উপভোগ করতেন!
বলা হয়ে থাকে, প্রথমদিকে রাজা ঝৌ জিন আসলে অনেক ভালো একজন রাজা ছিলেন। চারদিকে তার সুনাম ছিলো একজন বুদ্ধিমান, বিজ্ঞ এবং শান্তশিষ্ট মানুষ হিসেবে। বিশাল এক মদের দিঘীতে নৌকায় করে ঘুরে বেড়ানো এই বখে যাওয়া রাজার ঠিক বিপরীতই ছিলেন তিনি তার শাসনকালের প্রথমভাগে। কিন্তু কী এমন হলো যে এমন ভালো একজন শাসক পরবর্তীতে এতটা পরিবর্তিত হয়ে গেলেন?
যদিও এর মূল কারণ বের করাটা বেশ কঠিন, তবে প্রাচীন চীনা লেখকগণ রাজার এই পরিবর্তনের পেছনে দায়ী করে গেছেন তার স্ত্রী দাজীকে। দাজী ছিলেন সেসময়ে চীনের সবচাইতে সুন্দরী রমণী। বলা হয়ে থাকে, রাজা যে মুহূর্তে দাজীকে দেখেন সে মুহূর্ত থেকে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। তিনি দাজীকে খুশি করার কাজে নেমে পড়েন। দাজীর রূপে তিনি এতটাই মোহাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে, রাজ্যের অন্যান্য কাজের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন।
দাজী নিজে ছিলেন একজন আমুদে নারী। আসরে তিনি অনেক বেশি মদ্যপান করতেন এবং খোলাখুলি যৌনতা নিয়ে রসালাপ করতেন। রাজার মোহ এরপরে লাস্যে পরিণত হয় এবং তিনি যারপরনাই দাজীকে আপন করে পেতে অধৈর্য হয়ে পড়েন। জানা যায়, দাজীর এই লাস্যময়ী স্বভাবের জন্য রাজা ঝৌ জিন তার সঙ্গীতশিল্পীদের আদেশ করেছিলেন যৌনতা নিয়ে অশ্লীল সব গান রচনা করার। দাজীর নিজের অনুরোধেই রাজা তার এমন বিশাল মদের দীঘি তৈরির কাজে নেমে পড়েছিলেন।
দাজী রাজাকে প্রলোভিত করেছিলো এটা বলে,
“আপনাকে একটি মদের দীঘি এবং মাংসের বন বানাতেই হবে, যাতে আপনি আর সবাইকে দেখাতে পারেন যে আপনিই হচ্ছেন দুনিয়ার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত রাজা!”
গল্পে মূলত এমনটাই প্রচলিত রয়েছে। দাজী সম্পর্কে আরো অনেক মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। তবে সকল ক্ষেত্রেই তাকে নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। একটি কিংবদন্তীতে তো এমনও বলা হয়েছে যে, দাজী ছিলো একটি ইচ্ছাধারী ও নয়টি লেজ সম্বলিত শেয়ালের আত্মা। তিনি যখন ইচ্ছা মানুষের রূপ ধারণ করতে পারতেন। কিংবদন্তী রয়েছে যে, তিনি আসরের মানুষদের এক জায়গায় করে একটি নালার ভেতর দিয়ে নিয়ে আসতেন। তারপর নালার শেষ মাথায় তিনি তার আসল রূপে এসে তাদেরকে গিলে খেয়ে ফেলতেন।
সত্যিকার অর্থে মানুষ এসব মতবাদ দিয়ে দাজীকে একপ্রকার পিশাচে রুপ প্রদান করেছিলো। তাদের দাজীকে এমন অপছন্দের কারণ হচ্ছে তার জন্যই তাদের প্রিয় রাজা তাদেরকে ভুলে গিয়েছিলো। সেই সাথে রাজার সেই মদের দিঘী একপ্রকারের বোঝা হয়ে ছিলো তাদের জন্য। কারণ সেই দিঘী তৈরিতে এবং পরবর্তিতে পরিচালিত করতে দরকার হচ্ছিলো প্রচুর অর্থের। দিঘীর মদ, বনের মাংস এবং প্রমোদ আসর চালানোর অর্থ রাজা পূরণ করছিলেন তার নিজের প্রজাদের কষ্টার্জিত অর্থের উপরে উঁচু কর বসিয়ে। প্রজাদের কাছ থেকে এত কর নিয়েও তিনি মোটেই তাদের দেখভালে এগিয়ে আসছিলেন না। কাজেই সাধারণ মানুষের রাজার এই নৈতিক ও চারিত্রিক অবনমনের পেছনে মূল হাত থাকা রানী দাজীর উপর ছিলো প্রচণ্ড আক্রোশ।
ফলে সাধারণ মানুষের সাথে সাথে রাজসভারও অনেকে রাজার প্রতি বিরক্ত হয়ে ওঠেন। অনেকে সাহস নিয়ে রাজার এসব কর্মকাণ্ডের বিরোধিতাও করেন। কিন্তু রাজা এসব প্রতিবাদ মোটেই ভালোভাবে নেননি।
যখন রাজার আপন চাচা রাজার উপরে দাজীর এমন প্রভাব এবং তার মদের দীঘি ও সেখানে অশ্লীল আসরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তখন রাজা জীবন্ত অবস্থাতেই তার শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন করার আদেশ দেন। সেই সাথে চাচার শরীর থেকে তখনও স্পন্দিত হওয়া হৃদপিণ্ড বের করে সবাইকে দেখান।
যেহেতু অভিযোগ আসা শুরু হয়ে গিয়েছিলো, সেহেতু অভিযোগকারীদের বিভিন্নভাবে শাস্তি প্রদানের দিকে এবার মনোযোগ দেন রাজা এবং তার রানী। নিত্যনতুন উপায়ে শাস্তি দেয়াটা তাদের কাছে এক নতুন বিনোদন হিসেবে ধরা দেয়।
সর্বপ্রথম তারা একটি কূপ তৈরি করেন, যার ভেতরটা পরিপূর্ণ ছিলো বিষধর সব সাপে। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে সেই কূপে ছুড়ে ফেলা হতো। তারপর তারা আরেকটি শাস্তি দেয়ার পদ্ধতি বের করলেন, যা প্রচলিত ছিলো ‘জ্বলন্ত কামান দণ্ড’ নামে। তারা একটি বিশাল পিতলের কামান তৈরি করেছিলেন, যার নলের উপরে কোনো প্রতিবাদকারীকে বেঁধে ফেলা হতো। তারপর কামানের নলের ভেতরটা জ্বলন্ত কাঠকয়লা দিয়ে পরিপূর্ণ করে অসহায় মানুষটিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো।
তাদের এই শাস্তির সর্বপ্রথম শিকার ছিলেন রাজসভার উপদেষ্টা মেই বো। তার অপরাধ ছিলো তিনি রাজাকে নিজ রাজ্যের মানুষদের হত্যা করার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে মেই বোকে রাজসভায় নিয়ে আসা হয়। তার সমস্ত পোশাক খুলে ফেলা হয় এবং কামানের উপরে বেঁধে ফেলা হয়। তারপর কাঠকয়লা ভেতরে পুরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুরো রাজসভাসদদের এই শাস্তি চোখের সামনে দেখতে বাধ্য করা হয় এবং বলা হয়, “কেউ যদি ক্ষমার অযোগ্য কোনো কিছু বলে তাহলে তার পরিণতি হবে মেই বোয়ের মতো। তাই সকলেই সাবধান!” সেখানে উপস্থিত সকলের নিচুস্বরের কথা ঢেকে যায় মেই বোয়ের মর্মান্তিক চিৎকারে। পুরোটা ঘর পোড়ামাংসের গন্ধে পরিপূর্ণ হয়ে গেলেও কাউকে সেই স্থান ত্যাগ করতে দেওয়া হয়নি যতক্ষণ না শাস্তির কাজটি শেষ হয়।
মেই বোয়ের মৃত্যুর পর জনসাধারণ আরো ভীত হয়ে পড়ে। তাদের আর রাজার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো সাহস থাকে না। রাজা এবং রানী তখন নিশ্চিন্ত মনে তাদের পুরনো আমোদপ্রমোদের জীবনযাত্রায় মেতে ওঠেন।
রাজা ঝৌ জিন তখনও বুঝতে পারেননি যে, তাদের পার্শ্ববর্তী ঝৌ রাজবংশের রাজা য়্যু তাকে এতদিন ধরে চোখে চোখে রাখছিলেন এবং সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন। তিনি অনেকদিন থেকেই চাচ্ছিলেন ঝৌ জিনের রাজ্য আক্রমণ করবেন এবং সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। যখন তার গুপ্তচরেরা এসে জানালো যে, রাজ্যের প্রজারা রাজা ঝৌ জিনের প্রতি প্রচণ্ড রকমের নাখোশ, তখনই তিনি আক্রমণ করলেন।
তিনি মাত্র ১০০ জন সৈন্যকে প্রেরণ করলেন ঝৌ জিনের শহর আক্রমণ করার জন্য। এই ১০০ জন সৈন্যই যথেষ্ট ছিলো। ঝৌ জিনের অধিকাংশ সৈন্য সেই মুহূর্তেই অস্ত্র ছুড়ে ফেলে আত্মসমর্পণ করেছিলো। অনেকে এমনকি আক্রমণকারী দলে যোগদানও করেছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজধানীর পতন হয় এবং ঝৌ জিনের সর্বশেষ সৈন্যরাও তার বিরুদ্ধে চলে যায়।
এরপর রাজা ঝৌ জিন প্রাসাদের এক জায়গায় তার সকল মূল্যবান সম্পদ একত্র করে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেন। তিনি পালিয়ে যাননি। পুরো প্রাসাদ আগুনে পুড়তে থাকা অবস্থায় তিনি তার প্রমোদ স্থানে চলে আসেন এবং শেষবারের মতো তার মদের দীঘির পাশে এসে দাঁড়ান। কিছুক্ষণ সেখানে বসে থাকেন। তারপর ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
রাজা ঝৌ জিনের মৃত্যুর ফলে এমন এক রাজবংশের পতন হলো যা স্থায়ী ছিলো প্রায় ৫৫০ বছর ধরে। তার পতনের ফলে শ্যাঙ রাজবংশেরও পতন হলো এবং চীনে এক নতুন যুগের সূচনা হলো। রাজা ঝৌ জিন মারা গেলেও তার মদের দীঘি ও মাংসের বনের কথা এখনো প্রচলিত রয়েছে। ৩,০০০ বছর পর এখন অব্দি চীনে ‘ওয়াইন পুল অ্যান্ড মিট ফরেস্ট’ বুলি প্রচলিত রয়েছে, যা মূলত দুর্নীতির একটি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ফিচার ইমেজ: jiachengxu.com