আরব–ইসরায়েলি দ্বন্দ্ব (এবং বিশেষ করে ফিলিস্তিনি–ইসরায়েলি দ্বন্দ্ব) বিশ্বের সবচেয়ে জটিল ও গুরুতর রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র স্থাপিত হওয়ার পর থেকেই এই দ্বন্দ্ব চলে আসছে, এবং এখন পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের কোনো প্রকৃত সুরাহা হয়নি। ইসরায়েলের বিরোধীরা ইসরায়েলকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের ক্যান্সার’ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, কিন্তু অনেক মানুষই এটা ভেবে আশ্চর্য হয়ে থাকেন যে, আরব রাষ্ট্রগুলো সম্মিলিতভাবে জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে ইসরায়েলের তুলনায় এত বেশি শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও কেন এই ‘ক্যান্সার’কে অপসারণ করতে পারেনি?
কার্যত ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই আরব লীগভুক্ত রাষ্ট্রগুলো (মিসর, ট্রান্সজর্দান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, সৌদি আরব ও ইয়েমেন) ইসরায়েলকে আক্রমণ করেছিল, এবং ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৮–১৯৪৯ সালের যুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলোর এই প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, এবং ইসরায়েল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে সমর্থ হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে, এতগুলো আরব রাষ্ট্র মিলে কেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েলকে পরাজিত করতে পারল না?
কিছু ভ্রান্ত ধারণা
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে প্রথমেই আরব–ইসরায়েলি দ্বন্দ্ব সম্পর্কিত কিছু বিষয়কে স্পষ্ট করে নেয়া প্রয়োজন।
প্রথমত, ‘আরব’ শব্দটার প্রায়োগিক ব্যবহার খুবই বিভ্রান্তিকর হতে পারে। বর্তমান বিশ্বে মোট ২২টি আরব রাষ্ট্র রয়েছে– পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত ইমারাত (সংযুক্ত আরব আমিরাত), ইয়েমেন, ওমান, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন ও সৌদি আরব; ‘উর্বর অর্ধচন্দ্র’ (Fertile Crescent) অঞ্চলে অবস্থিত ইরাক, জর্দান, ফিলিস্তিন, লেবানন ও সিরিয়া; উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, মিসর, মৌরিতানিয়া, লিবিয়া ও সুদান; ‘আফ্রিকার শৃঙ্গ’ (Horn of Africa) অঞ্চলে অবস্থিত জিবুতি ও সোমালিয়া; এবং ভারত মহাসাগরে অবস্থিত আফ্রিকান দ্বীপরাষ্ট্র কমোরোস। স্বাভাবিকভাবেই, এই রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যেকটি জাতিগতভাবে আরব, কিন্তু তাদের নিজস্ব ইতিহাস–ঐতিহ্য, কৃষ্টি–সংস্কৃতি, জাতীয় স্বার্থ এবং ভূরাজনৈতিক বিচার–বিবেচনা রয়েছে।
তাত্ত্বিকভাবে, এই ২১টি আরব রাষ্ট্র (ফিলিস্তিনকে বাদ রেখে) যদি একত্রিত হয়ে নিজেদের সামগ্রিক শক্তি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করত, সেক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের সক্রিয় সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া ইসরায়েলের পক্ষে টিকে থাকার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই রাষ্ট্রগুলোর অধিকাংশই কখনো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেনি, এবং করে থাকলেও সেটা ছিল মূলত প্রতীকী (সহজ ভাষায়, ‘লোক দেখানো’)। সত্যিকার অর্থে, কেবল ৪টি আরব রাষ্ট্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রকৃত অর্থে যুদ্ধ করেছে, এবং ইসরায়েলের কাছে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হয়েছে। এই রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে– মিসর, সিরিয়া, ট্রান্সজর্দান/জর্দান ও ইরাক। সুতরাং, ইসরায়েল কখনো পুরো আরব বিশ্বকে পরাজিত করেনি, তারা পরাজিত করেছে আরব বিশ্বের একটি অংশকে।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, মিসর, সিরিয়া ও ইরাকের প্রত্যেকের জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক সম্পদ ইসরায়েলের চেয়ে বেশি, সুতরাং এদেরকে পরাজিত করাও ইসরায়েলের জন্য একটি বড় কৃতিত্ব। কিন্তু যে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া জরুরি, সেটি হচ্ছে, ইসরায়েল কখনো সমগ্র আরব বিশ্বকে পরাজিত করেনি।
দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ সাধারণ মানুষের ধারণা, এ পর্যন্ত ইসরায়েল ও আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে যুদ্ধগুলো হয়েছে, সেগুলো ফিলিস্তিন নিয়ে হয়েছে। এবং অনেকে এটাও ধারণা করেন, এই যুদ্ধগুলোতে আরব রাষ্ট্রগুলোর উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেওয়া। কিন্তু এই দুইটি ধারণাই কার্যত ভুল।
এ পর্যন্ত ইসরায়েল ও আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ৫টি যুদ্ধ হয়েছে। এদের মধ্যে কেবল প্রথম যুদ্ধের (১৯৪৮–১৯৪৯) বিষয়বস্তু ছিল ফিলিস্তিন, এবং কেবল এই যুদ্ধেই আরব রাষ্ট্রগুলোর উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেওয়া। অন্য যুদ্ধগুলোর মূল কারণ ফিলিস্তিন ছিল না। ১৯৫৬ সালের যুদ্ধ হয়েছিল সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে; ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ হয়েছিল আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের তীব্র দ্বন্দ্ব এবং ইসরায়েলের সম্প্রসারণবাদের কারণে; ১৯৭৩ সালের যুদ্ধ হয়েছিল সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমি নিয়ে; এবং ১৯৮২ সালের যুদ্ধ হয়েছিল লেবাননের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে। এই চারটি যুদ্ধেই ফিলিস্তিন ছিল মূলত একটি গৌণ ইস্যু।
সর্বোপরি, ইসরায়েলের সমর্থকদের মতে, আরব–ইসরায়েলি দ্বন্দ্বে আরবরাই বরাবর আগ্রাসী ভূমিকা অবলম্বন করেছে, এবং ইসরায়েল কেবল ‘আত্মরক্ষা’র জন্য আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু কার্যত কেবল ১৯৪৮–১৯৪৯ সালের যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো যুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলোকে আগ্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। ১৯৫৬ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল, ব্রিটেন ও ফ্রান্স মিসরের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল; ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল অতর্কিতে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা ব্যতিরেকে মিসর, সিরিয়া ও জর্দানের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল; ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে মিসর ও সিরিয়া যুদ্ধ আরম্ভ করেছিল ইসরায়েল কর্তৃক আগের যুদ্ধে দখলকৃত মিসরীয় ও সিরীয় ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য; এবং ১৯৮২ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল লেবাননের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল। অর্থাৎ, আরব–ইসরায়েলি দ্বন্দ্বে প্রথম যুদ্ধটি ছাড়া বাকি প্রতিটি যুদ্ধে ইসরায়েল আগ্রাসী ভূমিকায় ছিল।
১৯৪৮–১৯৪৯ সালের যুদ্ধ
এবার প্রথম আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও বিবরণ সংক্ষেপে দেখে নেয়া যাক। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় সাম্রাজ্য মিত্রশক্তির নিকট পরাজিত হয়, এবং ব্রিটেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। ব্রিটেন ফিলিস্তিনকে ‘জাতিপুঞ্জের ম্যান্ডেট’ (League of Nations Mandate) হিসেবে শাসন করতে থাকে, এবং ব্রিটিশ শাসনাধীনে ইউরোপ ও অন্যান্য মহাদেশ থেকে ইহুদিরা দলে দলে ফিলিস্তিনে আসতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে স্থানীয় ফিলিস্তিনি আরবদের সঙ্গে ইহুদি অভিবাসীদের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই দ্বন্দ্ব কার্যত গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ী কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত ব্রিটেন ফিলিস্তিন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে ইচ্ছুক ছিল। এজন্য তারা ফিলিস্তিনি সমস্যা সমাধান করার জন্য জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ আহ্বান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইউরোপীয় ইহুদিরা অক্ষশক্তির ইউরোপীয় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয়েছিল, তাই এ সময় ইহুদিদের প্রতি বিশ্বব্যাপী সহানুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল। এমতাবস্থায় ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনকে তিনভাগে বিভক্ত করার পক্ষে ভোট দেয়। এই প্রস্তাবটি কার্যকরী হলে তদানীন্তন ব্রিটিশ–শাসিত ফিলিস্তিনের ৫৬% ভূমিতে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপিত হতো আর ৪৩% ভূমিতে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি আরব রাষ্ট্র স্থাপিত হতো, এবং আব্রাহামিক ধর্মাবলম্বীদের নিকট অতি পবিত্র জেরুজালেম একটি ‘আন্তর্জাতিক শহরে’ পরিণত হতো।
ইহুদিরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করে, কিন্তু ফিলিস্তিনি আরবরা এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ‘আরব লীগ’ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনে ইহুদি–আরব সংঘাত ক্রমশ তীব্র আকার ধারণ করে। এমতাবস্থায় ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে, এবং একই দিনে ইহুদি নেতারা স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। পরবর্তী দিনই আরব লীগভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর (মিসর, ট্রান্সজর্দান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, সৌদি আরব ও ইয়েমেন) সৈন্যরা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেওয়া।
যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে আরব রাষ্ট্রগুলো আংশিক সাফল্য অর্জন করে, কিন্তু ইসরায়েলিরা তাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৯৪৮ সালের ১১ জুন উভয় পক্ষের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি হয়, কিন্তু ৮ জুলাই পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ সময় জাতিসংঘ উভয় পক্ষের উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ১৮ জুলাই পুনরায় উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়, এবং প্রায় তিন মাস পর ১৫ অক্টোবর পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়। এ পর্যায়ে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যেতে শুরু করে, এবং ইসরায়েলিরা ক্রমাগত সাফল্য অর্জন করতে থাকে। আরব রাষ্ট্রগুলোর সৈন্যরা পিছু হটতে শুরু করে, এবং ইসরায়েলিরা একের পর এক অঞ্চল পুনর্দখল করতে শুরু করে।
ইসরায়েলিদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়ে আরব রাষ্ট্রগুলো ১৯৪৯ সালে একে একে যুদ্ধ থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করে। ১৯৪৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মিসর, ২৩ মার্চ লেবানন, ৩ এপ্রিল জর্দান এবং ২০ জুলাই সিরিয়া ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর মধ্য দিয়ে প্রথম আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের অবসান ঘটে।
এই যুদ্ধে ইসরায়েল যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় অর্জন করে, এবং জাতিসংঘ তাদেরকে ফিলিস্তিনের যে ৫৬% ভূমি প্রদান করেছিল, সেটি তো তারা নিজেদের অধিকারে রাখতে সক্ষম হয়ই, এর পাশাপাশি জাতিসংঘ ফিলিস্তিনি আরবদেরকে ফিলিস্তিনের যে অংশ প্রদান করেছিল, তার প্রায় ৬০% ভূমিও ইসরায়েলিরা দখল করে নেয়। পশ্চিম জেরুজালেম ইসরায়েলের হস্তগত হয়।
অন্যদিকে, আরব রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ট্রান্সজর্দান ও মিসরের এই যুদ্ধে ক্ষতি তো হয়ইনি, বরং কার্যত এই যুদ্ধে তারা লাভবান হয়। এই যুদ্ধের সময় ট্রান্সজর্দান ৫,৬৫৫ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট পশ্চিম তীর (West Bank) ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়, এবং এগুলোকে নিজস্ব ভূমি হিসেবে ঘোষণা করে। মিসর ৩৬৫ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট গাজা ভূখণ্ড দখল করে নেয়, এবং সেটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে মিসরের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে না নিলেও কার্যত অঞ্চলটি মিসরের সামরিক উপনিবেশে পরিণত হয়।
সামগ্রিকভাবে, প্রথম আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধে ইসরায়েল সামরিক ও রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করে, এবং ট্রান্সজর্দান ও মিসর সামরিকভাবে পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করে।
আরবদের পরাজয়ের কারণ
এরপর আসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – আরব রাষ্ট্রগুলো তাদের জনসংখ্যা ও সম্পদের দিক থেকে ইসরায়েলের তুলনায় শক্তিশালী হয়েও কেন এই যুদ্ধে পরাজিত হলো? এর নানাবিধ কারণ রয়েছে।
প্রথমত, ৭টি আরব রাষ্ট্র এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, কিন্তু যুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধক্ষেত্রে ইসরায়েলি সৈন্যসংখ্যা ছিল আরবদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এই যুদ্ধে ইসরায়েল মোট ১,১৭,৫০০ সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে নামিয়েছিল, কিন্তু ৭টি আরব রাষ্ট্র সম্মিলিতভাবে মাত্র ৫১,১০০ থেকে ৬৩,৫০০ সৈন্যকে ফিলিস্তিনে প্রেরণ করেছিল। অর্থাৎ, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতি ২ জন ইসরায়েলি সৈন্যের বিপরীতে মাত্র ১ জন আরব সৈন্য ছিল। এবং এটিই স্বাভাবিক যে, যুদ্ধক্ষেত্রে যে পক্ষের সৈন্যসংখ্যা কম, তারা তুলনামূলকভাবে অসুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে।
শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রকৃত অর্থে যুদ্ধ করেছিল মিসর, ইরাক, ট্রান্সজর্দান এবং সিরিয়া। লেবানন, সৌদি আরব ও ইয়েমেনের অংশগ্রহণ ছিল সম্পূর্ণভাবে প্রতীকী। যুদ্ধের সময় মিসর ফিলিস্তিনে প্রেরণ করেছিল প্রায় ২০,০০০ সৈন্য, ইরাক প্রেরণ করেছিল প্রায় ১৮,০০০ সৈন্য, ট্রান্সজর্দান প্রেরণ করেছিল প্রায় ১০,০০০ সৈন্য এবং সিরিয়া প্রেরণ করেছিল প্রায় ৫,০০০ সৈন্য। মাত্র ১,২০০ সৌদি এবং ৩০০ ইয়েমেনি সৈন্য এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৪৮ সালের ৫–৬ জুন সংঘটিত একটি খণ্ডযুদ্ধ ছাড়া কার্যত লেবানন এই যুদ্ধে অংশগ্রহণই করেনি।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, আরব রাষ্ট্রগুলোর কি যুদ্ধক্ষেত্রে এরচেয়ে বেশি সংখ্যক সৈন্য প্রেরণের সামর্থ্য ছিল না? কার্যত তাদের সেই সামর্থ্য ছিল, কিন্তু সেই সামর্থ্যকে তারা কাজে লাগায়নি। কারণ, ফিলিস্তিন বা ফিলিস্তিনি আরবদের স্বার্থরক্ষা কখনো এই রাষ্ট্রগুলোর জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। মিসর, ট্রান্সজর্দান, সিরিয়া ও ইরাকের ফিলিস্তিন সংক্রান্ত নিজস্ব স্বার্থ ছিল, এজন্যই তারা ফিলিস্তিনে তুলনামূলকভাবে বড় সৈন্যদল পাঠিয়েছিল। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে লেবাননের এবং ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে সৌদি আরব ও ইয়েমেনের ফিলিস্তিন নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল না, এজন্য তারা নামকাওয়াস্তে এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, একে তো আরবদের সৈন্যসংখ্যা ছিল কম, তদুপরি, আরব সৈন্যদের তুলনায় ইসরায়েলি সৈন্যদের মনোবল ছিল অনেক বেশি। মাত্র কয়েক বছর আগেই ইহুদিরা ইউরোপে ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয়েছিল, এবং সেই আতঙ্কের রেশ তাদের মধ্যে তখনো স্পষ্ট বিদ্যমান ছিল। আরব রাষ্ট্রগুলো যখন ইসরায়েলকে আক্রমণ করে, তখন ইসরায়েলিদের অনেকেই এই ভেবে আতঙ্কিত হয়েছিল যে, তারা নতুন করে একটি গণহত্যার শিকার হতে যাচ্ছে। ফলে প্রাণ রক্ষার তাগিদে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের চূড়ান্ত সামর্থ্য ব্যবহার করে।
অন্যদিকে, আরব রাষ্ট্রগুলোর সৈন্যদের এই যুদ্ধের লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না, এবং স্বভাবতই তারা এই যুদ্ধে তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে লড়াই করার কোনো প্রচেষ্টা চালায়নি। এটি তাদের পরাজয়ের একটি পরোক্ষ কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তৃতীয়ত, ইসরায়েল ছিল একটি সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র, এবং এজন্য তাদের কাছে এই যুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলোর পরাজয়কে একটি ‘অনন্যসাধারণ’ ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু কার্যত যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আরব রাষ্ট্রগুলোও সুপ্রতিষ্ঠিত বা স্থিতিশীল ছিল না। এদের মধ্যে মিসর ১৯২২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু কার্যত এই যুদ্ধের সময়েও মিসর ছিল ব্রিটেনের একটি আধা–উপনিবেশ (semi-colony)। ১৯৫২ সালের পূর্বে মিসর প্রকৃর অর্থে স্বাধীনতা অর্জন করনি। ইরাক ১৯৩২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়, কিন্তু কার্যত ইরাকও এই যুদ্ধের সময় ব্রিটেনের একটি আধা–উপনিবেশই ছিল, এবং ১৯৫৮ সালের পূর্বে তাদের প্রকৃত স্বাধীনতা আসেনি।
অনুরূপভাবে, সিরিয়া ও লেবানন যথাক্রমে ১৯৪৫ ও ১৯৪৩ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু ১৯৪৬ সালের আগে তারা প্রকৃত স্বাধীনতা পায়নি। জর্দান কেবল ১৯৪৬ সালেই ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, এবং এই যুদ্ধের সময়েও জর্দানীয় সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা ছিলেন ব্রিটিশ। সৌদি আরব ও ইয়েমেন রাজ্য দুইটি যথাক্রমে ১৯৩২ ও ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু প্রথম আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের সময়ে এরাও সেরকমভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল না।
সুতরাং, প্রথম আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েল কার্যত সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এবং আধা–উপনিবেশ প্রকৃতির কতিপয় আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। এজন্য গুণগতভাবে উভয় পক্ষের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। কিন্তু ইসরায়েলি সৈন্যদের মধ্যে এরকম বহুসংখ্যক সৈন্য ছিল, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সশস্ত্রবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করেছিল এবং তাদের আধুনিক যুদ্ধে বিস্তৃত অভিজ্ঞতা ছিল। অনুরূপ কোনো অভিজ্ঞতা আরব রাষ্ট্রগুলোর সৈন্যদের ছিল না।
চতুর্থত, সিরীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সামি মুবায়েবের মতে, আরব রাষ্ট্রগুলোর ইসরায়েলিদের প্রকৃত সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। বিশেষত মিসরীয় রাজা ফারুক এবং সিরীয় রাষ্ট্রপতি শুকরি আল–কুওয়াতলির উপদেষ্টারা তাদেরকে আশ্বস্ত করেছিলেন, যুদ্ধে আরবরা সহজেই বিজয়ী হতে পারবে। অনুরূপভাবে, লেবানিজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাদওয়ান আল–সাঈদের মতে, আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলি সামরিক শক্তি সম্পর্কে সচেতন ছিল না এবং তাদের সৈন্যবাহিনী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। এমতাবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হওয়াটাই ছিল তাদের জন্য স্বাভাবিক।
পঞ্চমত, আরব রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধের সময় তাদের সামরিক কার্যক্রম সমন্বিত করতে পারেনি। ফলে একটি যৌথ সামরিক অভিযানের পরিবর্তে এটি এক একটি বিচ্ছিন্ন সামরিক অভিযানে পরিণত হয়, এবং ইসরায়েলিরা একে একে প্রতিটি আরব সৈন্যদলকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়। আরবদের সমন্বয়হীনতার মূল কারণ ছিল তাদের পরস্পরবিরোধী লক্ষ্য। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যেকের ফিলিস্তিন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য ছিল।
ট্রান্সজর্দানের রাজা প্রথম আব্দুল্লাহ নিজেকে সমগ্র ‘উর্বর অর্ধচন্দ্র’ অঞ্চলের শাসক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন, এবং এই উদ্দেশ্যে ফিলিস্তিন দখল করতে ইচ্ছুক ছিলেন। যুদ্ধের জর্দানীয়দের মূল উদ্দেশ্য ছিল জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনের যত বেশি সম্ভব ভূমি দখল করে নেওয়া এবং নেগেভ মরুভূমির মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে ট্রান্সজর্দানের সরাসরি সংযোগ স্থাপন করা। ধারণা করা হয়, যুদ্ধ চলাকালে এ বিষয়ে ট্রান্সজর্দান ও ইসরায়েলের মধ্যে গোপন সমঝোতা হয়েছিল। ইরাক এক্ষেত্রে ট্রান্সজর্দানকে সমর্থন করে, এবং ইরাকি প্রধানমন্ত্রী নূরী আস–সাঈদের মূল লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনসহ সমগ্র ‘উর্বর অর্ধচন্দ্র’ অঞ্চল নিয়ে একটি ‘বৃহত্তর সিরিয়া’ প্রতিষ্ঠা করা।
অন্যদিকে, মিসরের রাজা ফারুক নিজেকে আরব বিশ্বের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী ছিলেন, এবং মিসরীয়দের লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ ফিলিস্তিনের অংশবিশেষ দখল করে নেওয়া। ট্রান্সজর্দানের প্রভাব হ্রাস করার উদ্দেশ্যে সৌদি আরব মিসরকে সমর্থন দিচ্ছিল। অনুরূপভাবে, সিরিয়া ও লেবাননের উদ্দেশ্য ছিল উত্তর ফিলিস্তিনের অংশবিশেষ দখল করে নেওয়া।
এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য ছিল, এবং সকলেই একে অপরকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখত। এরকম পরিস্থিতিতে কোনো জোটই কার্যকরী হয় না, এবং যুদ্ধক্ষেত্রে আরব জোটও কার্যকরী কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
সর্বোপরি, এই যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েল বহির্বিশ্বের সমর্থন লাভ করে, কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলো অনুরূপ কোনো সমর্থন লাভ করেনি। তৎকালীন বিশ্বের দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই নিজ নিজ স্বার্থে ইসরায়েলকে সহায়তা করে। যুদ্ধ চলাকালে জাতিসংঘ উভয় পক্ষের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, কিন্তু ইসরায়েলিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়, এবং সোভিয়েত মিত্ররাষ্ট্র চেকোস্লোভাকিয়াও ইসরায়েলকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে।
আরব রাষ্ট্রগুলো অনুরূপভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারেনি, আর তাদের সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে দুর্নীতি এক্ষেত্রে আরো বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যেমন: মিসরীয় সরকার থেকে তাদের সশস্ত্রবাহিনীকে নিম্নমানের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা হতো। এ পরিস্থিতিতে ইসরায়েলিরা যুদ্ধক্ষেত্রে সংখ্যাগত আধিক্যের পাশাপাশি অস্ত্রশস্ত্রের ক্ষেত্রেও গুণগত আধিপত্য অর্জন করতে সমর্থ হয়, এবং আরবদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত করতে সক্ষম হয়।
সামগ্রিকভাবে, প্রথম আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের সময় ইসরায়েলিদের সৈন্যসংখ্যা ছিল আরবদের দ্বিগুণ, তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল উন্নততর, তাদের মনোবল ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি, এবং তাদের কূটনৈতিক ও সমন্বয় সংক্রান্ত কার্যক্রম ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি সফল। এর ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে তারা বিজয় অর্জন করে, এবং আরব–ইসরায়েলি দ্বন্দ্ব প্রলম্বিত রূপ ধারণ করে।