কনৌজের যুদ্ধে পরাজয়ের পর সম্রাট হুমায়ুন বুঝে গেলেন তিনি আর মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী আগ্রা ধরে রাখতে পারবেন না। তাকে পেছন থেকে ধাওয়া করে এগিয়ে আসছে শের শাহের সেনাপতি বরমজীদ গৌড়। মাত্র এক রাত আগ্রায় অপেক্ষা করে পরের দিন তিনি আগ্রা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন।
আগ্রা ত্যাগের সময় রাজপরিবারের নারীদেরকে সাথে নেওয়া হবে কি না তা নিয়ে সম্রাট কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন। চৌসার যুদ্ধে তার প্রিয় কন্যা আকিকা বেগম নিখোঁজ হয়েছিলেন। তার ভাগ্যে কী হয়েছিল সেটা পর্যন্ত জানা যায়নি। পরবর্তীতে সম্রাট আক্ষেপ করে বলেছিলেন, কেন তিনি নিজ হাতে আকিকা বেগমকে হত্যা করে আসেননি। সম্রাট হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগম রচিত ‘হুমায়ুননামা’ গ্রন্থে ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে,
বাদশাহ হুমায়ুন মির্জা হিন্দালকে বললেন, আগেরবার এমনই এক যুদ্ধের (চৌসার যুদ্ধ) সময় আমি আকিকা বেগমকে হারিয়েছি। এখনো সেই শোকে আমি মুহ্যমান। আমার বার বার মনে হয়েছে শত্রুর হাতে বন্দি হওয়ার কলঙ্কের চেয়ে কেন আমি নিজ হাতে তাকে হত্যা করলাম না। এখন এই যুদ্ধের সময় হেরেমের মহিলাদের নিয়ে যাত্রা করা খুবই কষ্টকর।
সম্রাটের এ ধরনের কথায় মির্জা হিন্দাল ভড়কে গেলেন। হুমায়ুন আগ্রা ত্যাগ করার আগে হেরেমের নারীদের হত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, এমন সম্ভাবনায় মির্জা হিন্দাল বেশ ভীত হয়ে পড়েন। পরে দ্রুত তিনি নিজেই সম্রাটকে বলেন,
আপন মা বোনদের নিজ হাতে হত্যা করা কতটা বেদনার তা নিশ্চয়ই মহান বাদশাহ বুঝতে পারবেন। আমার জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমি শাহী মহলের সম্মান রক্ষা করবো। মা বোনদের কোনো ক্ষতি হতে দেবো না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাকে শক্তি দেন। যাতে আমি শাহী মহলের মর্যাদা রক্ষা করতে পারি।
কিছুক্ষণ পর হিন্দাল ও আসকারি মির্জা তাদের সাথে থাকা ক্ষুদ্র সেনাদল নিয়ে আলোয়ার আর সম্ভলের দিকে গেলেন রাজকোষ নিয়ে আসার জন্য। সম্রাটের অনুমতিক্রমে তাদের সাথে হেরেমের নারীরাও গেলেন। হেরেমের নারীদের মাঝে ছিলেন মির্জা হিন্দালের মা দিলদার বেগম, বোন গুলচেহারা বেগম, গুলনার আগাচা, নারগুল আগাচা, আফগানি আগাচাসহ মুঘল পরিবারের অন্যান্য নারী সদস্য ও বিভিন্ন আমিরদের পরিবারের নারী সদস্যগণ।
এদিকে সম্রাট হুমায়ুন দ্রুত আগ্রা ত্যাগ করে প্রথমে সিকরি নামক একটি গ্রামে পৌঁছালেন। কয়েক ঘণ্টা এখানে অবস্থান করার পর সম্রাটের কাছে খবর আসলো আফগান সৈন্যরা খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। তাই সম্রাটকে দ্রুতই সিকরি ত্যাগ করতে হলো।
সিকরি থেকে যাত্রা করে সম্রাট ১৫৪০ সালের ২৫ মে দিল্লি পৌঁছালেন। হুমায়ুনের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ আমির এ সময় দিল্লিতে ছিলেন। হুমায়ুন দিল্লি পৌঁছালে তারা সম্রাটের সাথে দিল্লি ত্যাগ করলেন। পরাক্রমশালী মুঘল সাম্রাজ্যের ততদিনে দিল্লি ধরে রাখার মতো ন্যূনতম শক্তিটুকুও ছিলো না। সম্রাট তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে দিল্লি থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে রোহতাক শহরের দিকে যাত্রা করলেন। রোহতাক শহরের বাইরে সম্রাটের সাথে আসকারি, হিন্দাল আর হায়দার মির্জার দলের সাথে সাক্ষাৎ হয়ে গেল। তারা আলোয়ার আর সম্ভল থেকে যতটা সম্ভব রাজকোষ নিয়ে এসেছেন।
এদিকে রোহতাকে বাঁধলো আরেক বিপত্তি। সেখানকার অধিবাসীরা সম্রাটের বহর দেখা মাত্রই শহরের ফটক বন্ধ করে দিলো। কনৌজের যুদ্ধে পরাজয়ের পর বেশ লম্বা একটা সময় সম্রাটকে এসব অপমানজনক আচরণের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কেউ কেউ শের শাহের ভয়ে এমন আচরণ করতো, কেউ বা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতো, আবার কেউ বা এক কদম এগিয়ে শের শাহকে খুশি করার জন্যই এমন করতো। ক্ষমতা আসলে এমনই। ক্ষমতা যার হাতে থাকে, দুনিয়া তার সামনে মাথানত করে। আর কারো হাত থেকে ক্ষমতা ফসকে বেরিয়ে গেলেই আর কেউ তাকে চিনতে চায় না।
পরে সম্রাটের সাথে থাকা ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর সহায়তায় সম্রাটকে রোহতাকে প্রবেশ করতে হলো। সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করার পর সম্রাট আফগান বাহিনীর এগিয়ে আসার সংবাদ পেলেন। দ্রুত রোহতাক ত্যাগ করে ১৫৪০ সালের ২৪ জুন তিনি সিরহিন্দ পৌঁছালেন। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে হিন্দালকে সিরহিন্দে কয়েকদিন অবস্থান করার নির্দেশ দিয়ে সম্রাট শতদ্রু নদী পার হলেন। এসময়ই তার কাছে খবর পৌঁছালো, শের শাহ দিল্লির দখল বুঝে নিয়েছে। হৃদয়ভাঙ্গা আবেগ নিয়ে সম্রাট সংবাদটি শুনলেন।
এদিকে বরমজীদ গৌড়ের আফগান বাহিনী সিরহিন্দের কাছাকাছি পৌঁছালে হিন্দাল দ্রুত জলন্ধরে পৌঁছান। সম্রাটের নির্দেশে হিন্দাল আবারো এখানে যাত্রাবিরতি করলেন। তবে কয়েকদিন পরেই আফগানদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে গেলেন তিনি।
শতদ্রু নদী পাড়ি দিয়ে কয়েকদিনের মাঝেই সম্রাট লাহোরে পৌঁছে গেলেন। এরপর লাহোর থেকে মুজাফফর তুর্কমানকে জলন্ধরে প্রেরণ করা হলো মির্জা হিন্দালকে উদ্ধার করার জন্য। অবশ্য মুজাফফর তুর্কমান পৌঁছানোর আগেই মির্জা হিন্দাল আফগান অবরোধ এড়িয়ে বের হতে সক্ষম হন। পরে তারা একসাথে লাহোরে আসলেন। তবে জলন্ধর পর্যন্ত ভূমি আফগানরা নিজেদের দখলে নিয়ে নিলো। এদিকে ১৫৪০ সালের জুলাই মাস নাগাদ সম্রাটের প্রায় সকল আমিরই এক এক করে লাহোরে পৌঁছে গেলেন।
১৫৪০ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৩ মাস সম্রাট হুমায়ুন লাহোরে অবস্থান করেন। এই তিন মাসে তিনি মূলত মুঘলদের মাঝে ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। স্পষ্টতই চৌসা আর কনৌজের যুদ্ধে সম্রাটের পরাজয়ের কারণ ছিল রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ। সম্রাট বুঝতে পেরেছিলেন নিজেদের মতবিরোধ মিটিয়ে এই মুহূর্তে একতাবদ্ধ হওয়া ছাড়া এই বিপদ সামলানোর কোনো পথই আর খোলা নেই।
ঐক্য স্থাপনের ব্যাপারে খোলাখুলি আলোচনার জন্য ৭ জুলাই মুঘল পরিবার ও সমস্ত মুঘল আমিরদের নিয়ে একটি উন্মুক্ত সভার আহ্বান করা হলো। সভার শুরুতেই সম্রাট এই বিপদের দিনে মুঘলদের অভ্যন্তরীণ ঐক্য স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তার পিতা সম্রাট বাবরের সারা জীবনের সংগ্রাম আর অর্জনের কথা বললেন। নিজেদের সামান্য মতপার্থক্য আজ সম্রাট বাবরের অর্জন ব্যর্থতায় পরিণত করতে যাচ্ছে, সে কথা উল্লেখ করে সবাইকে সতর্ক করতেও ভুললেন না।
হিন্দুস্তানের মূল ভূখণ্ডের বেশিরভাগই ইতোমধ্যেই মুঘলদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখনই নিজেরা ঐক্যবদ্ধ না হলে সমগ্র হিন্দুস্তান থেকে মুঘলদের বিতাড়িত হওয়া এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। উপস্থিত মুঘল সদস্যরা সম্রাট হুমায়ুনের বক্তব্যের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারলেন। তারা বুঝলেন নিজেদের পিঠ বাঁচাতে হলে এই মুহূর্তে সমস্ত মতবিরোধ ঝেড়ে ফেলতে হবে। এই দুর্দিনে একসাথে কাজ করবেন বলে সকলে সম্রাটের নিকট প্রতিজ্ঞা করলেন।
সম্রাট হুমায়ুন তার বক্তব্যের পর পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সকলের মতামত জানতে চাইলেন। প্রথমেই কথা বললেন হুমায়ুনের সৎ ছোট ভাই কামরান মির্জা। তিনি এই পরিস্থিতিতে লাহোরকেও নিরাপদ মনে করছিলেন না। তিনি প্রস্তাব রাখলেন হুমায়ুন সেনাবাহিনী নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের গভীরে চলে যাবেন। সেখানে গিয়ে সেনাবাহিনীতে তিনি নতুন সৈন্য ভর্তি করাবেন আর তাদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকবেন। এদিকে তিনি হেরেমের নারীদের কাবুলে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে হুমায়ুনের সাথে পরে মিলিত হবেন।
কিন্তু কামরানের এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করলেন হিন্দাল মির্জা। তিনি এই মুহূর্তে এভাবে পিছিয়ে না গিয়ে গুজরাট আক্রমণের পক্ষে নিজের মতামত ব্যক্ত করলেন। এতে খুব সহজেই আফগানদের ঘিরে ধরে নির্মুল করা যাবে। ইয়াদগার নাসির মির্জা হিন্দাল মির্জার সাথে একমত হলেন।
তৃতীয় আরেকটি মত ব্যক্ত করলেন হায়দার মির্জা। তিনি পরামর্শ দিলেন সেনাবাহিনী নিয়ে সম্রাট সিরহিন্দ আর রাওয়ালপিন্ডির পার্বত্য অঞ্চলগুলো অধিকার করে নেবেন। হেরেমের নারীরা আপাতত পাহাড়েই থাকবে। কয়েক মাসের মাঝে তিনি নিজে কাশ্মীর দখল করে নেবেন। কাশ্মীর সুরক্ষিত জায়গা হওয়ায় পরিবর্তীতে সেখানে হেরেমের নারীদের নিরাপত্তার জন্য পাঠিয়ে দেয়া যাবে।
পার্বত্য অঞ্চলে মূল সেনাবাহিনীসহ সম্রাট আর হেমেরের নারীরা নিরাপদে থাকবে। শের শাহের আফগান বাহিনী পার্বত্য অঞ্চলে তেমন একটা সুবিধা করতে পারবে না। কারণ তার বাহিনীর মূল শক্তিস্তম্ভ হচ্ছে বিশাল বিশাল কামান। এই কামানগুলো টেনে পাহাড়ের উপরে তোলা সহজ হবে না। তাছাড়া পাহাড়ে খাদ্য সংকটে আফগান সেনাবাহিনীও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সুতরাং শের শাহকে পরাজিত করার এটা একটা উত্তম উপায় হতে পারে এটা।
কিন্তু বাঁধ সাধলেন মির্জা কামরান। তিনি বললেন পাহাড়ের উপরে হেরেমের নারীদের পাঠানো নিরাপদ হবে না। কিন্তু তিনি নিজেও ভালো কোনো বিকল্প বের করতে পারলেন না। এভাবে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা চললো। কিন্তু কোনভাবেই সবাইকে একমত করা গেল না। সম্মেলনের উদ্দেশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হলো।
মুঘলদের নিজেদের স্বার্থে যে সময় একতাবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি ছিল, সে সময়ই মতভেদের গোলকধাঁধায় পড়ে মুঘলরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারলেন না। উল্লেখিত প্রস্তাব তিনটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্টই বোঝা যায়, মুঘলদের এই অনৈক্যের মূলে ছিলেন কামরান মির্জা। সমকালীন ঐতিহাসিকেরাও এর জন্য কামরান মির্জাকে দায়ী করেন।
অন্যদিকে সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজল আর হায়দার মির্জা তো সরাসরি কামরান মির্জাকে দায়ী করে বলেন, নিজের স্বার্থের কারণেই তিনি যেকোনো মূল্যে মুঘলদের ঐক্য নষ্ট করতে চাইছিলেন। তিনি চাইছিলেন যেকোনো মূল্যে শের শাহের সাথে যুদ্ধ এড়িয়ে কাবুলে গিয়ে শান্তিতে শাসন করতে। কারণ তিনি বুঝে গিয়েছিলেন শের শাহ যদি এখন আক্রমণ চালায় তাহলে লাহোর কিংবা পাঞ্জাব, কোনোটাই ধরে রাখা যাবে না। তাছাড়া ইতোমধ্যেই সম্রাট হুমায়ুন, আসকারী মির্জা আর হিন্দাল মির্জা যে যার ভূখণ্ড হারিয়ে পথে বসেছে। এখন যদি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে সবাইকে এক হয়ে থাকতে হবে। কামরান কোনো মতেই কাবুলে নিজের একক আধিপত্য হারাতে রাজী ছিলেন না। কাজেই ঐক্য প্রতিষ্ঠা হলে তা কামরানের স্বার্থের বিপরীতেই যেতো।
অন্যান্য মুঘল আমিররাও শের শাহের ভয়ে এতো বেশি ভীত ছিলেন যে, কোনো মতেই তারা আর শের শাহের মুখোমুখি হওয়ার সাহস করছিলেন না। কিন্তু নিজেরা একতাবদ্ধ হওয়ার মানেই ছিল শের শাহের সাথে আবারও যুদ্ধে জড়ানো। অন্যদিকে হিন্দাল মির্জার প্রস্তাবটি যথেষ্ট বিবেচনাপ্রসুত ছিল। মালব অঞ্চলে আফগানরা তখনো আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। গুজরাটের বাহাদুর শাহ পর্তুগীজদের হাতে নিহত হওয়ার পর থেকেই গুজরাটেও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। সুতরাং, আফগানদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য মালব অঞ্চল মুঘলদের জন্য বেশ উপযুক্ত ভূমি হতে পারতো।
হায়দার মির্জার প্রস্তাবও যথেষ্ট উপযুক্ত ছিল। কিন্তু কামরান মির্জার বিরোধীতার কারণে শের শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুঘলদের হারানো ভূখণ্ড উদ্ধারের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তই নেওয়া সম্ভব হলো না।
কামরান কোনোভাবেই মুঘলদের একতাবদ্ধ হতে দিতেন না। পরবর্তীতে তা বোঝা যায় শের শাহের দরবারে গোপনে কামরানের দূত প্রেরণের ঘটনা থেকে। কামরান সদর কাজী আবদুল্লাহ নামক এক ব্যক্তিকে গোপনে শের শাহের দরবারে প্রেরণ করেন, যদিও কিছুদিন পরেই এই খবর লাহোরে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। কামরান মির্জা দূতের মাধ্যমে শের শাহকে প্রস্তাব দেন, পাঞ্জাব তার অধীনে রাখতে দিলে প্রয়োজনে তিনি হুমায়ুনকে বন্দী কিংবা হত্যা করে শের শাহকে বিপদমুক্ত করবেন।
কামরানের পক্ষ থেকে এই বার্তা পেয়ে শের শাহ খুবই খুশি হলেন। তিনি আশ্বস্ত হলেন এই ভেবে যে, এমন চরম বিপদের দিনেও মুঘলরা এখনো একতাবদ্ধ হতে পারেনি। তবে তিনি কামরানের প্রস্তাবে হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না। কারণ সম্রাটকে হত্যার ব্যাপারে শের শাহ তখনো রাজী ছিলেন না। বরং তার উদ্দেশ্য ছিল সম্রাটকে কাবুলের দিকে ঠেলে দেওয়া। আর তিনি নিজের শক্তিতেই তা করতে পারবেন। তাহলে কামরানের সাহায্য নেয়ার প্রশ্ন আসছে কেন?
এদিকে কামরানের দূত পাঠানোর কিছুদিন পর সম্রাট হুমায়ুনও শের শাহের নিকট দূতের মাধ্যমে একটি পত্র প্রেরণ করলেন। পত্রে সম্রাট শের শাহকে বললেন, হিন্দুস্তান তিনি শের শাহের জন্য ছেড়ে দিচ্ছেন। বিনিময়ে সিরহিন্দ বরাবর মুঘল ও আফগান সীমানা ভাগ করতে হবে।
শের শাহ জানতেন মুঘলরা এখন দুর্বল। তাদের প্রস্তাব না মানলেও এই মুহূর্তে চলবে। তিনি সম্রাটকে জানালেন, কাবুল আপনার জন্য আমি ছেড়ে দিলাম।
কাবুলকে মুঘল আর আফগানদের সীমানা ঠিক করে আসলে শের শাহ মূলত ইব্রাহীম লোদির আমলের সীমানাকে মুঘল-আফগান সীমানা হিসেবে ঠিক করতে চাইছিলেন। হিন্দুস্তান বিজয়ের আগে মুঘলরা কাবুল পর্যন্তই শাসন করতো। আর অন্যদিকে শের শাহ নিজেকে সুলতান ইব্রাহীম লোদির বৈধ উত্তরসূরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন।
কামরানের বিরোধীতায় লাহোরে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে মুঘলরা কোনোভাবেই একমত হতে পারলো না। মুঘলদের এই ঐক্যহীনতায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হলো শের শাহ। তিনি দ্রুত এগিয়ে এসে সিরহিন্দ দখল করে শতদ্রু নদী অতিক্রম করেন। এরপর সিরহিন্দ থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে সুলতানপুরে দখল করলেন।
শের শাহ সুলতানপুরে এসে পৌঁছালে লাহোরে মুঘলদের মাঝে আতঙ্ক জেঁকে বসে। কারণ শের শাহকে বাঁধা দেবার মতো কোনো সেনাবাহিনী মুঘলদের কাছে ছিল না। তিনি লাহোরের কাছাকাছি এসে পড়ায় মুঘলদের লাহোর ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় রইলো না। কামরান মির্জা দ্রুত হুমায়ুনের কাছ থেকে কাবুল আর কান্দাহারের দিকে যাওয়ার অনুমতি আদায় করে নিলেন।
সম্রাট হায়দার মির্জাকেও কাশ্মীরের দিকে অভিযান চালানোর অনুমতি দিয়ে বিদায় দিলেন। এদিকে সম্রাটের সামনে ৩টি পথ খোলা আছে। অবশিষ্ট যা সৈন্য আছে তা নিয়ে হয় বাদাখশান যাওয়া নয়তো হায়দার মির্জার পিছু পিছু কাশ্মীর যাওয়া। অথবা সিন্ধুর দিকে চলে যাওয়া।
বাদাখশানের ব্যাপারে হুমায়ুন কিছুক্ষণ ভেবে সে ইচ্ছা ত্যাগ করলেন। কারণ সম্রাটের পিতা বাবর কর্তৃক সুলেমান মির্জা নামক তার এক আমিরকে বাদাখশান দিয়ে দিতে হয়েছিল। সম্রাটের এই বিপদের দিনে অবশ্যই বাদাখশান তাকে সাহায্য করবে না। বাদাখশান যাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে যুদ্ধ করে তা দখল করা। কিন্তু এই মুহূর্তে যুদ্ধ করার উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্র বা যথেষ্ট সৈন্য কোথায়?
অন্যদিকে কাশ্মীর তখনো মুঘলদের হাতে আসেনি। অবশেষে কোন সিদ্ধান্ত না নিয়েই ১৫৪০ সালের ৩১ অক্টোবর সম্রাট হুমায়ুন লাহোর ত্যাগ করলেন। এ সময় সম্রাটের সাথে কামরান মির্জা, আসকারি মির্জা, হিন্দাল মির্জাসহ হেরেমের নারী ও আমিররাও ছিলেন। সম্রাট রাভি নদী পার হয়ে পশ্চিমে অগ্রসর হতে লাগলেন।
এদিকে সম্রাটের লাহোর ত্যাগের ঘটনায় লাহোরে হুলস্থুল শুরু হয়ে গেল। সবাই বুঝে গেলো শের শাহ লাহোরে আসবেনই। বহনযোগ্য যা ছিল তা নিয়ে যে যেভাবে পারলো লাহোর ত্যাগ করতে লাগলো। অন্যদিকে সম্রাট রাভি নদী পেরিয়ে চেনাব নদী, তারপর হাজারা হয়ে খুশাবে পৌঁছালেন।
খুশাব থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে কামরান মির্জা সবার মতামতকে উপেক্ষা করে আসকারি মির্জা, খ্বাজা কলা, সুলতান মির্জাসহ অন্যান্য আমিরদের নিয়ে সম্রাটকে ত্যাগ করে কাবুলের দিকে চলে গেলেন। কামরানের সম্রাটকে কাবুলে যেতে দেয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। কারণ তাতে নিশ্চিতভাবেই কাবুলে কামরানের আধিপত্য হ্রাস পাবে।
এদিকে মির্জা হিন্দাল কামরানের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এবং সম্রাটের এসব মেনে নেয়ায় সম্রাটের উপর প্রচণ্ড অভিমান করলেন। তার উপর এই বিপদের দিনে সম্রাটের সিদ্ধান্তহীনতায় হিন্দাল সম্রাটের উপর ঠিক ভরসাও করতে পারছিলেন না। শেষমেশ ইয়াদগার নাসির মির্জা, কাসিম হুসেনসহ দরবারের বেশ কিছু আমিরদের নিয়ে হিন্দাল সম্রাটকে ত্যাগ করে সিন্ধুর দিকে চলে গেলেন।
নিজের ভাইদের দ্বারাই পরিত্যাক্ত হয়ে সম্রাট দিশেহারা হয়ে গেলেন। শেষপর্যন্ত সম্রাটের যেসব বিশ্বস্ত যোদ্ধা আর আমির সম্রাটের সাথে রয়ে গেলেন তাদের নিয়ে তিনি ১৫৪০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঝিলাম নদী পাড়ি দিয়ে উছ-এ পৌঁছালেন। এদিকে সম্রাটকে ত্যাগ করার প্রায় ২০ দিন পর হিন্দাল মির্জা পুনরায় উছ-এ সম্রাটের সাথে দেখা করে পূর্বের আচরণের জন্য ক্ষমা চাইলেন। সম্রাট হিন্দালকে ক্ষমা করলেন। দুই ভাই আবার এক হয়ে গেলেন।
উছ-এর শাসনকর্তা বখশু লংগার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় সম্রাট উছ-এ এসেছিলেন। তিনি বখশু লংগারকে রাজকীয় খেলাতসহ কিছু উপঢৌকন পাঠালেন। তবে তাতে বখশু লংগার খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না। তিনি জানতেন হুমায়ুন এখন নির্বাসিত একজন সম্রাট। আর একজন নির্বাসিত সম্রাটের নিকট পাওয়ার মতো তেমন কিছুই থাকে না।
তবে বখশু সম্রাটকে একেবারে খালি হাতে ফিরিয়ে দিলেন না। নিজে সম্রাটের সাথে দেখা না করলেও সম্রাটকে ১০০ নৌকা ভর্তি খাদ্য সামগ্রী আর প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করলেন।
খাদ্য ভর্তি এই নৌকাগুলো দিয়েই সম্রাট ১৫৪১ সালের ২৬ জানুয়ারী চেনাব নদী পেরিয়ে ভক্কড়ে পৌঁছালেন। এদিকে খুশাব থেকেই শের শাহের অন্যতম সেনাপতি খাওয়াস খান সম্রাটের পিছু তাড়া করতে লাগলেন। খাওয়াস খান চাইলেই সম্রাটকে বন্দী করতে পারলেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। শের শাহের নির্দেশই সম্ভবত এমন ছিল। হুমায়ুনকে বন্দী করার দরকার নেই, শুধুমাত্র পাঞ্জাব থেকে বিতাড়িত করুন।
এদিকে সম্রাট হুমায়ুনের লক্ষ্য তখন সিন্ধু।
মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে পূর্বে প্রকাশিত সবগুলো পর্ব একসাথে পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
তথ্যসূত্র
১। মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০০৫
২। হুমায়ুননামা, মূল: গুলবদন বেগম, অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, প্রকাশকাল: জানুয়ারী ২০১৬
ফিচার ইমেজ: incredibleworldinformation.blogspot.com