২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৮০। এই তারিখটি আর দশটি সাধারণ দিনের মতো ছিল না। পৃথিবীবাসী এই দিনটি শুরু করে এক অশুভ সংবাদ শোনার মধ্য দিয়ে। তা হলো ইরাকি সুপ্রিম লিডার সাদ্দাম হুসাইন ইরান আক্রমণ করে বসেছেন। আর এর মধ্য দিয়ে তিনি সূচনা করেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে চলা এ যুদ্ধ কেড়ে নেয় প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের প্রাণ এবং বাস্তুচ্যুত করে আরও দুই লক্ষ মানুষকে।
এই যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল দুই দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক এবং সামরিক বিরোধ, যা ১৯৭৯ সালের পর থেকে ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ওই বছর ইরাকের ক্ষমতায় আসেন সাদ্দাম হুসাইন এবং ‘ইসলামী বিপ্লব’ এর মাধ্যমে ইরানের ক্ষমতা দখল করেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। তাদের মধ্যকার শত্রুভাবাপন্নতা দুই দেশের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। যে শত্রুতার শুরু ১৯৭৮ সালে। ঐ বছর সাদ্দাম ইরাকে নির্বাসিত খোমেনিকে ইরাকি শিয়া জনগোষ্ঠীকে সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দেয়ার অপরাধে দেশ থেকে বহিষ্কার করেন। ফ্রান্সে গিয়ে আশ্রয় নেন খোমেনি। পরবর্তীতে এই বহিষ্কারাদেশ সাদ্দামের জন্য একটি রাজনৈতিক ব্যর্থতা এবং খোমেনির জন্য শাপেবর হয়ে দেখা দেয়। কারণ এর ফলে ইরানিদের মধ্যে খোমেনীর প্রতি একধরনের সহানুভূতির সৃষ্টি হয় এবং তার জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে, যাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে তিনি ইরানে ইসলামী বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হন।
খোমেনির ক্ষমতায় আরোহনের পরবর্তী কয়েক মাস ‘শাত-ইল-আরব’ এর উভয়পার্শ্বের মালিকানা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ ক্রমশ যুদ্ধের দিকে গড়ায়। এই নদীটি ঐতিহাসিকভাবে দুই দেশের সীমানা হিসেবে চিহ্নিত। এছাড়াও ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ইরানি সরকার ইরাকের সংখ্যাগুরু শিয়া জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু সুন্নি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উদ্বুদ্ধ করছিল, যা কি না সাদ্দামের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই যেকোনো ধরনের বিদ্রোহ বা ষড়যন্ত্র থেকে নিজেকে এবং ইরাককে নিরাপদ রাখার জন্য তিনি ইরানে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাকি আর্মি সাবধানে ইরানের খুযেস্তান প্রদেশের দিকে এগিয়ে যায় এবং ইরানকে চমকে দিয়ে খোরামশাহর শহর দখল করে নেয়। তবে তারা পাশেই অবস্থিত আবাদান শহরের গুরুত্বপূর্ণ তেল শোধনাগার দখলে নিতে পারেনি। ঐ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। তারা ইরানের বেশ কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়।
তবে ডিসেম্বরের পর থেকে ইরাকি আর্মি শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ইরানি রেভল্যুশনারি গার্ড তাদের অগ্রযাত্রা রুখে দেয়। ইরানের পরিকল্পিত বিশাল পদাতিক বাহিনীর স্রোত সাদ্দামের বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে তোলে। ১৯৮১ সালের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে ইরান তাদের দখলকৃত মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি একে একে পুনরুদ্ধার করা শুরু করে। ফলে ইরাকি বাহিনী রক্ষণাত্মক অবস্থানে চলে যায়। ১৯৮২ সালে ইরান তাদের খোরামশাহর শহর পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়।
অবস্থা বেগতিক দেখে ইরাক স্বেচ্ছায় তাদের দখলকৃত এলাকা থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিতে শুরু করে এবং যুদ্ধ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে শুরু করে। তারা ইরানের সাথে সমঝোতার চেষ্টা চালায়। তবে আয়াতুল্লাহ্ খোমেনির ইরান তখন পিছু হটতে নারাজ। তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় এবং একইসাথে সাদ্দামের সরকারকে উৎখাতের জোর প্রচেষ্টা চালাতে থাকে।
একসময় যুদ্ধ ইরাকের সীমান্তে এসে ঠেকে। ইরাকের সীমান্ত সংলগ্ন শহর বসরা দখল করার জন্য ইরান সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে থাকে। শহরের কাছাকাছি তারা আশি হাজার সৈন্য মোতায়ন করে। ১৯৮২ সালের ১৩ মার্চ আক্রমন শুরু হয়। ইরানি রেভল্যুশনারি গার্ডের চারটি ডিভিশন আক্রমণে অংশ নেয়। তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বসরা শহরের উত্তর দিকের প্রধান রাস্তা ধ্বংস করে দেয়া, যাতে করে শহরটি রাজধানী থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে সীমান্তে নিয়োজিত ইরাকি সেনারা তাদের অপেক্ষাকৃত উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে এই আক্রমন প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। পরবর্তী কয়েক মাসে ইরান পুনরায় সংগঠিত হয় এবং ২১ জুলাই আবার ইরাকি সীমান্তে আক্রমন পরিচালনা করে। এবারও ইরাক আক্রমন প্রতিহত করে। তবে উভয় পক্ষই ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্রায় দশ হাজারের বেশি মানুষের প্রানহানি ঘটে, যার মধ্যে তিন হাজার ছিল ইরাকি এবং বাকিরা ইরানি। এই দুই আক্রমন থেকে ইরানের অর্জন ছিল সামান্যই। তবে ইরাকের জন্য যে সামনের দিনগুলো বেশ কঠিন হতে যাচ্ছে এই বার্তাটি ইরান সাদ্দাম হুসাইনকে খুব ভালোভাবেই পৌঁছে দিতে পেরেছিল।
ইরাকি জনগণ দ্রুতই বিংশ শতাব্দীর অন্যতম ধ্বংসাত্মক এবং দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের মাঝে নিজেদের আবিষ্কার করে। ইরাকি সেনারা জীবন বাজি রেখে সীমান্ত রক্ষা করে যায়। একের পর এক ইরানি পদাতিক বাহিনীর আক্রমণ ঠেকিয়ে দেয় তারা। ফলে স্থলযুদ্ধ কিছুটা স্থিতাবস্থায় চলে আসে। তবে উভয় দেশ একে অপরের বিভিন্ন শহর, সামরিক স্থাপনা এবং তেল সমৃদ্ধ এলাকায় মিসাইল এবং বিমান হামলা থেকে বিরত থাকেনি। একইসাথে সমান তালে হামলা চলছিল রপ্তানির উদ্দেশ্যে যাত্রা করা পরস্পরের তেলবাহী জাহাজগুলোতে। ফলে দুই দেশেরই তেল রপ্তানির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়, যা কি না উভয় দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছিলো।
তেলবাহী জাহাজগুলোতে আক্রমণ শুরু হয় ১৯৮৪ সালের দিকে। ঐ বছরের মার্চ থেকে শুরু হয় দুই দেশের মধ্যকার ট্যাঙ্কার যুদ্ধ। এই সময় ইরাক তার উন্নত যুদ্ধ বিমানের সাহায্যে ইরানের তেলবাহী ট্যাংকারগুলোতে মিসাইল হামলা শুরু করে। একইসাথে হামলা চলতে থাকে খার্গ দ্বীপে থাকা ইরানের তেলের স্থাপনাগুলোতে। এসব হামলায় অতিষ্ঠ ইরান একসময় প্রত্যুত্তর দিতে বাধ্য হয়। তারা ইরাকের ট্যাংকারের পাশাপাশি ইরাকের মিত্র দেশগুলোর ট্যাংকারে বিমান হামলা পরিচালনা করে। ইরান, ১৩ মে কুয়েতের এবং ১৬ মে সৌদি আরবের ট্যাংকারে হামলা করে। পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে দুই পক্ষ মিলে ১১টি জাহাজ ধ্বংস করে, যার মধ্যে ১০টিই ছিল ট্যাংকার।
তবে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটানাটি ঘটে ১৯৮৮ সালে। ঐ বছর ইরাকি কুর্দিদের ওপর যে গণহত্যা চালানো হয় তা মানব ইতিহাসে বিরল। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যেসব জাতিগোষ্ঠী রয়েছে তাদের মধ্যে কুর্দিরা অন্যতম। তাদের আবাস মূলত ইরাক, ইরান, সিরিয়া এবং তুরস্ক জুড়ে। দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে আসছে তারা। ইরাক-ইরান যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন ইরান কুর্দিদেরকে ইরাক থেকে স্বাধীনতার জন্য বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে যায়, যাতে করে ইরাক তাদের কুর্দি সমৃদ্ধ উত্তরাঞ্চল হারায়।
অন্যদিকে ইরাক কুর্দিদের যাবতীয় বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করতে থাকে। ফলে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর কুর্দি বিদ্রোহীরা ইরানি বাহিনীতে যোগ দেয় এবং ইরানের সাথে মিলে ইরাকি আর্মির উপর হামলা চালাতে থাকে। এই যুগপৎ আক্রমণ রুখে দেয়ার জন্য ইরাক যে ঘৃণিত পদক্ষেপ নেয় তা ইতিহাসে ‘আল-আনফাল ক্যাম্পেইন’ নামে পরিচিত, যার মধ্যে ছিল কুর্দিদের ওপর বোমা বর্ষণ, গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করা এবং সর্বোপরি নিরীহ কুর্দিদের ওপর রাসায়নিক হামলা চালানো। এটি ‘কুর্দিশ গণহত্যা’ নামেও পরিচিত।
১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে ইরানি সেনা এবং কুর্দি গেরিলা বাহিনী মিলে ইরাকের হালাবজা শহর দখল করে নেয়, যেখানে ইরাকি আর্মির একটি ঘাঁটি ছিল। এর দুই দিন পর ১৬ মার্চ বিকাল থেকে শুরু হয় পঁয়তাল্লিশ মিনিটব্যাপী অভিযান। ইরাকি সুখোই-২২ যুদ্ধ বিমান এবং মি-৮ হেলিকপ্টার থেকে ক্রমাগত রাসায়নিক বোমা ফেলা হয় হালাবজার জনবসতিপূর্ণ এলাকায়। ফলে খুব দ্রুতই একটি সুন্দর বিকাল পরিণত হয় বিভীষিকায়। এই হামলায় প্রাণ হারান ৫,০০০ এর বেশি মানুষ, যাদের বেশির ভাগই ছিল নারী এবং শিশু।
প্রত্যক্ষদর্শীরা ঐ হামলার হৃদয়বিদারক বর্ণনা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, হলুদাভ সাদা মেঘে নিমিষেই চারদিক ঢেকে যায়। গ্যাসের গন্ধ ছিল মিষ্টি আপেলের মতো। গ্যাসের তীব্রতায় ত্বক ও চোখ জ্বালা করছিল এবং শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো তাদের। বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে অনেকে তৎক্ষণাৎ নিজ ঘরেই মৃত্যুবরণ করেন। ভয়ে, আতঙ্কে অসংখ্য মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। অনেকেই শহর ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যেও অনেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে সবুজ রঙের বমি করতে করতে মারা যান। অনেককেই মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে উদভ্রান্তের মতো হাসতে দেখা গিয়েছিল।
যুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়ে সৌদি আরব, কুয়েত এবং প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলো সরাসরি এবং আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কৌশলগতভাবে ইরাককে সমর্থন করেছিল। অন্যদিকে সিরিয়া এবং লিবিয়া ছিল ইরানের পক্ষে। কিন্তু কুর্দিশ গণহত্যার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরাকের এবং সাদ্দামের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পশ্চিমা মিত্রদের সাথে তার দূরত্বের সৃষ্টি হয়। এই হামলার জন্য আমেরিকা সরাসরি সাদ্দামকে দায়ী করে। যদিও সাদ্দাম হুসাইন বরাবরই এই দাবি অস্বীকার করে গিয়েছিলেন এবং দায় চাপিয়েছিলেন ইরানের ওপর।
১৯৮৮ সালে ক্রমশ ভঙ্গুর অর্থনীতি এবং যুদ্ধের ময়দানে বেশ কিছু ব্যর্থতার কারণে ইরান জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়, যা এতদিন তারা প্রত্যাখ্যান করে আসছিলো। ইরাক যুদ্ধ বিরতির জন্য ইরানের দেয়া শর্তসমূহ মেনে নেয় এবং ইরান থেকে সকল সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় আট বছরব্যাপী চলমান ইরাক-ইরান যুদ্ধ। যে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল পাঁচ লক্ষেরও অধিক মানুষ।
এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কেউই বিজয়ী হতে পারেনি। কেননা যেসব লক্ষ্য নিয়ে তারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল তার বেশির ভাগই অপূর্ণ থেকে যায়। কোনো দেশই প্রতিপক্ষের সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি। দুই দেশের সীমান্ত প্রায় অপরিবর্তিতই থেকে যায়। অথচ উভয় দেশের ক্রমশ বর্ধমান অর্থনীতি স্থবির হয়ে যায়।
যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সাদ্দাম হুসাইনকে অন্যান্য আরব দেশগুলোর কাছ থেকে দশ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি অর্থ ধার করতে হয়, যা দেশের অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় এবং পরবর্তীতে কুয়েতের সাথে যুদ্ধের পথ করে দেয়। একইসাথে এই যুদ্ধ দেশের মধ্যে সুন্নি-শিয়া বিরোধকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। অন্যদিকে আয়াতুল্লাহ খোমেনি মধ্যপ্রাচ্যের এক শক্তিমান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন, যিনি কোনো ধরনের বিদেশি সহযোগিতা ছাড়াই ইরানকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন শক্তিশালী ইরাকের হাত থেকে।
দেশের অবকাঠামো পুনরায় ঢেলে সাজাতে সাদ্দাম হুসাইনের তখন বিপুল পরিমাণ অর্থ দরকার। তবে তিনি হাল ছাড়ার পাত্র নন। তাহলে কীভাবে তিনি যোগার করবেন এত অর্থ? এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে আগামী পর্বে।