১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দ। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করলেন তরুণ। কাবুল, পেশোয়ার এবং মুলতান হয়ে সোজা রাজধানী দিল্লি সুলতানের দরবারে। গায়ে বিদেশী পোশাক থাকলেও আচরণে অসংকোচ। বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট। মসনদে বসা সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক তাকে দিলেন লোভনীয় কাজির পদ। কিন্তু স্থির হবার স্বভাব যে তার নেই; বরং বুকে বিশ্ব দেখার তাড়না। কয়েক বছরের মাথায়ই তাই নেমে গেলেন পথে। পরবর্তী জীবনে ঠিকই রেখে যান ভারতের রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি নিয়ে প্রত্যক্ষ দলিল। নির্ভরযোগ্য জ্ঞান আহরণের জন্য ঐতিহাসিকরা তার দ্বারস্থ হয় এখনও।
মূল নাম শেখ আবু আবদুল্লাহ মুহম্মদ; জনমানসে ইবনে বতুতা বলেই সমধিক পরিচিত। মরক্কোর তাঞ্জিয়ার শহরে ১৩০৪ সালে জন্ম নেয়া শিশুর বাবা-মা হয়তো ভাবতেও পারেনি সন্তানের বুকে পৃথিবী দাবড়ে বেড়ানোর জন্য অদম্য তৃষ্ণা। মাত্র একুশ বছর বয়সেই ঘর থেকে বের হয়েছেন পথে। ভয়াল মরুভূমির উত্তপ্ত ঝড়, সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ, দুর্বৃত্তের নির্যাতন, রোগ-ব্যাধি এবং প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা- কী না মোকাবেলা করতে হয়েছে! সবকিছু পেছনে ফেলে স্বপ্নাবিষ্টের মতো দেশ থেকে দেশ ঘুরে ফিরেছেন তিনি। ১৩২৫ থেকে ১৩৫৪ সাল অব্দি প্রায় ত্রিশ বছরে অতিক্রান্ত পথের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৫,০০০ মাইল! নিঃসঙ্গ যাত্রার অভিজ্ঞতা লিখে রেখেছেন অমর গ্রন্থ ‘তুহফাতুন নুজ্জার ফি গারাইব আল আমসার ওয়া আজাইবুল আফসার’-এ।
বাংলায় নোঙর
ইবনে বতুতা বাংলায় প্রবেশ করেন ১৩৪৬ সালে। বর্তমান চট্টগ্রাম বন্দরের নাম তখন সুদকাঁও। বিদেশী বণিকদের কাছে চট্টগ্রাম অপরিচিত ছিল না। যা-ই হোক, চট্টগ্রাম থেকে ব্রহ্মপুত্র নদী হয়ে দেখা করতে যান কামরূপের (বর্তমান সিলেট) বিখ্যাত সুফি শেখ জালাল উদ্দীনের (হযরত শাহজালাল মুজাররেদ-ই ইয়ামেনি) সাথে। গ্রহণ করেন তিন দিনের আতিথ্য। অতঃপর মেঘনা নদী হয়ে প্রথমে হবিগঞ্জ এবং পরে সোনারগাঁও শহরে পোঁছেন ১৩৪৬ সালের ১৪ই আগস্ট। এই যাত্রায় সময় লেগেছিল ১৫ দিন। সবিশেষ সোনারগাঁও থেকে সমুদ্রগামী জাহাজে করে রওনা দেন জাভার উদ্দেশ্যে।
ইবনে বতুতা বাংলায় অবস্থান করেন পৌনে দুই মাসের মতো। জুলাই এবং আগস্ট মাস। ভ্রমণের সিংহভাগই ছিল নদীপথ। বাংলার জনজীবনকে তিনি প্রধানত নদীর বুক থেকেই দেখেছেন। তারপরেও বর্ণনায় শহুরে জনপদের অবস্থা বিম্বিত হয়। বিম্বিত হয় বাজার ব্যবস্থা, সামাজিক রীতি নীতি এবং রাজনৈতিক আধিপত্যের বিবর্তন। বলতে গেলে, ঐ সময়ের বাংলার ইতিহাস অধ্যয়নে ইবনে বতুতাই প্রধান অবলম্বন।
ভৌগোলিক বিবরণ
ইবনে বতুতার লেখায় বাংলার চারটি স্থান এবং তিনটি নদীর নাম খুঁজে পাওয়া যায়। স্থানগুলো সুদকাঁও, কামরু, হবংক এবং সুনুরকাঁও; অন্যদিকে নদীগুলো গঙ্গা, যুন এবং নাহরুল আজরাক। সুদকাও বলতে বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর এবং নগরীকে বোঝানো হয়েছে। কামরু আসলে কামরূপের বিকৃত রূপ। ইবনে বতুতা কামরূপের জনগনের শ্রম এবং ধৈর্যশীলতার প্রশংসা করেছেন। হবংক বর্তমানে হবিগঞ্জ শহরের ১০ মাইল দক্ষিণে হবঙ্গটিলা নামে অভিহিত। আর সোনারগাঁও মেঘনা নদীর তীরে তৎকালীন বিখ্যাত রাজধানী।
চট্টগ্রামের কাছে গঙ্গা নদীর কথা বলেছেন ইবনে বতুতা। বর্তমানে পদ্মা নদীই গঙ্গা। লখনৌতির সাথে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ছিলো এই জলপথেই। গঙ্গার সাথে আবার মিলিত হয়েছে যুন বা যমুনা নদী। যমুনা আর ব্রহ্মপুত্র অভিন্ন। এই যমুনা হয়েই ইবনে বতুতা কামরূপ গিয়েছিলেন। নাহরুল আজরাক বলতে বোঝানো হয়েছে মেঘনা নদীকে। দুই তীরে গ্রাম, বাগান এবং পানিকল। মিশরের নীলনদের পরে বাংলাতেই তিনি পানিকলের ব্যবহার দেখতে পান।
রাজনৈতিক চালচিত্র
সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ পূর্ববাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান। ১৩৩৮ থেকে ১৩৫২ সাল অব্দি তার রাজত্ব ছিল। তার আমলেই ইবনে বতুতা বাংলায় অবতরণ করেন। কিন্তু ফখরুদ্দিন লখনৌতির সুলতান আলি শাহের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকায় দেখা করা হয়ে ওঠেনি।
বর্ণনায় দেখা যায়, সুলতান ফখরুদ্দিন নৌশক্তিতে বলিয়ান ছিলেন। ফলে আক্রমণের জন্য তিনি বেছে নিতেন বর্ষা এবং শীতকালকে। অন্যদিকে আলি শাহের পদাতিক বাহিনী শক্তিশালী। গ্রীষ্মকালকে আক্রমণের জন্য প্রশস্ত সময় মনে করতেন তিনি। উভয়ের মধ্যেকার সংঘর্ষের কারণও তুলে ধরেন ইবনে বতুতা। লখনৌতির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন সুলতান নাসিরউদ্দীন। তার বংশধর গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর বুরকে হত্যা করে দিল্লির সুলতান মাহমুদ আত্মীয় বাহরাম খানকে লখনৌতির মসনদে বসান। সেনাবাহিনীর হাতে বাহরাম নিহত হলে ক্ষমতা দখল করে নেন আলি শাহ। ফখরুদ্দিন তখন চট্টগ্রামে এবং নাসিরউদ্দিন তার পূর্বপুরুষ। পূর্ব পুরুষের মালিকানা আলি শাহের হাতে চলে যাবার দরুণ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ফখরুদ্দিন। ইবনে বতুতা বাংলার সুলতানকে সুশাসক এবং পীর দরবেশের প্রতি শ্রদ্ধাবান হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
সুফিবাদ এবং ইসলাম
বাংলায় তখন সুফিবাদের প্রভাব তুমুল। সুলতান থেকে জনসাধারণ অব্দি তাদের শ্রদ্ধা করতেন। মেঘনা নদী পারাপারে দরবেশেদের ‘পারানি’ লাগতো না। হবংক শহরে সন্ন্যাসী প্রবেশ করতে হলে দিতে হতো আধ দিনার। ক্রোধের কারণ হয়ে উঠলে সুফিদের মৃত্যুদণ্ড দানের নজিরও কম নেই। সঈদা নামে এক ফকির চট্টগ্রামের নায়েব ছিলেন। পরে ক্ষমতার লোভে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ক্রুদ্ধ সুলতান তাকে পরাজিত এবং সংশ্লিষ্ট সাধুদেরসহ প্রাণদণ্ড প্রদান করেন।
বাংলার দরবেশদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ইয়েমেনের শেখ জালালউদ্দিন। বর্তমান সিলেটে তার মাজার অবস্থিত। ইবনে বতুতা তার শারীরিক বিবরণ, পোশাক, জীবনযাপন পদ্ধতি, অলৌকিক মাহাত্ম্য, অতিথিসেবাপরায়ণতা এবং খানাকাহ শরিফের পরিচয় তুলে ধরেছেন। শেখ জালালউদ্দিন বাস করতেন গুহায়; সামনে আস্তানা-কুটির ছিল শিষ্য ও ভক্তদের জন্য। পশমের পোশাক জড়িয়ে লম্বা পাতলা গড়নের দৃঢ় মানুষ। ইবনে বতুতার আগমনের খবর কারো জানার কথা না। অথচ শেখ জালালউদ্দিন তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য চারজন শিষ্য প্রেরণ করেন। দুদিনের দূরত্ব অতিক্রম করে শিষ্যরা ইবনে বতুতাকে বরণ করে নিয়ে আসে। ঘটনাটি বিস্মিত করে তাকে।
এখানেই শেষ না। শেখ জালালউদ্দিনের পোশাক দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। এমন একটা পোশাক চাচ্ছিলেন মনে মনে। কিন্তু সংকোচে প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি। বিদায় মুহূর্তে দরবেশ তাকে অবাক করে দিয়ে সেই পোশাক দান করেন। এছাড়া কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন শাহজালাল; যা পরে চীনে গেলে সত্যে পরিণত হয়। চীনদেশে শেখ বুরহানউদ্দিনের গায়েও তিনি দেখতে পান অনুরূপ পোশাক।
সামাজিক সংস্কৃতি
বাংলার মানুষের জীবনের গভীরে ঢোকার সময় হয়ে ওঠেনি ইবনে বতুতার। তবুও প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে অনেক কিছু। কামরূপের মুসলিম আধিপত্য বিস্তার ও ইসলাম ধর্মের প্রসারের জন্য শেখ জালালউদ্দিনের অবদান ছিল প্রবল। বাংলা জুড়েই সুফি দরবেশেদের প্রচার প্রচারণা খুব সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়। কামরূপ যাবার পথেই গঙ্গায় তিনি হিন্দুদের তীর্থযাত্রা ও তীর্থস্নান দেখেছেন।
ইবনে বতুতা মাত্র এক স্বর্ণ দিনারে আশুরা নামে পরমা সুন্দরি দাসী ক্রয় করেন। তার সহযাত্রী অল্প বয়স্ক ছেলেকে কিনেছিল দুই স্বর্ণ দিনারে। অর্থাৎ সেই সময়ে বাংলায় দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। তবে সেই দাসপ্রথা অনেকটা গেরস্থালি বিষয় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। জাদু আর যোগবিদ্যার জন্য কামরূপ বা কামাখ্যা বরাবরই প্রসিদ্ধ। এখনও জনসমাজে বহু কিংবদন্তি প্রচলিত। ইবনে বতুতা কামরূপের সেই জাদুর প্রসঙ্গে বলতে ভুল করেননি। পরবর্তীতে আরেক ঐতিহাসিক আবুল ফজলের ‘আইন-ই আকবরি’-তেও কামাখ্যার জাদু এবং প্রয়োগকৌশল নিয়ে আলোচনা আছে।
সুলভ পণ্য
বাংলার মতো আর কোথাও এত সস্তায় ধান ও চাল বিক্রি হতে দেখেননি ইবনে বতুতা। বাজারে তখন এক রৌপ্য দিনারে ২৫ রতল চাল পওয়া যেত। দিল্লির এক রতল ১৪ সেরের সমান। সেই হিসাবে এক রৌপ্য দিনারে চালের পরিমাণ ১৪*২৫ = ৮মণ ৩০ সের। মিশরীয় মুদ্রা দিরহাম তখন ভারতে প্রচলিত ছিলো। এক দিরহামে পাওয়া যেত আটটি মোটাসোটা মুরগি কিংবা ১৫টি পায়রা। হৃষ্টপুষ্ট ভেড়ার দাম ২ দিরহাম। ইবনে বতুতা পণ্যের যে মূল্য উল্লেখ করেছেন; তাকে নিম্নরূপে তালিকাবদ্ধ করা যায়।
স্বভাবতই বাংলার সুলভ মূল্যের কথায় সমৃদ্ধির ধারণা আসা সম্ভব। বস্তুত বাংলার দারিদ্র আর লাঞ্চনা মোটেও কম ছিল না। দাসপ্রথার প্রচলনই প্রমাণ করে দাসত্ব বরণের মতো অতটা নিচু অবস্থানেও মানুষ ছিল। এক রৌপ্য দিনারে প্রায় নয় মন চাল পাওয়া যাচ্ছে কথাটা সত্য। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, সাধারণ মানুষের হাতে কখনো এক দিনার বা দিরহাম আসতো না। হয়তো তামাম জীবন কেটে যেত কড়ি নিয়ে। ইবনে বতুতার কাছে যা সস্তা; বাংলার মানুষের কাছে তা চড়া হওয়া অসম্ভব না।
বাণিজ্য
আন্তঃবাণিজ্য এবং বহির্বাণিজ্যের ইঙ্গিত আছে লেখায়। মেঘনা নদীতে ইবনে বতুতা দেখেছেন অজস্র নৌকার পারাপার। স্থানীয় হাট-বাজারের সংখ্যাও ঢের। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ছিল বেশ রমরমা। মানুষ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে গিয়ে থিতু হতো। সোনারগাঁও থেকে চীন দেশীয় চেপ্টা সমুদ্রপোতে করে তিনি যাত্রা করেন জাভায়। তাতে বোঝা যায়, জাভা আর চীনাদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। মালদ্বীপে থাকা অবস্থায় বলেছেন, এখানকার মানুষ সামুদ্রিক কড়ি সংগ্রহ করে বাংলাদেশ থেকে তার বিনিময়ে চাল আমদানি করতো। এক স্বর্ণ দিনারের মান চার লক্ষ কড়ি।
বাংলাদেশেও তখন কড়ির সাহায্যে লেনদেন হতো। ফলে মালদ্বীপ আর জাভার সাথে বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রমাণিত হয়। জাভার পথে বরাহনগর দ্বীপে বাংলাদেশ এবং জাভা থেকে আগত কয়েকটি মুসলিম পরিবারকে বাস করতে দেখেন তিনি। সেখানকার রাজাকে উপহার দেন বাংলার বস্ত্র।
অবশেষ
ইবনে বতুতা খোরাসানবাসীর প্রসঙ্গ টেনে বাংলাকে অভিহিত করেছেন দোজখ-ই-পুর নিয়ামত; অর্থাৎ প্রাচুর্যপূর্ণ দোযখ। বাংলার আবহাওয়া মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা কিংবা অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রচণ্ড প্রতিকূল। তার উপরে আছে নদীর প্রাধান্য। বর্ষার পানি আর শীতের কুয়াশা অসহনীয়। জলপথ ব্যবহার না করে ভ্রমণ কিংবা অভিযান অসম্ভব। বাংলায় আসাকে অনেকেই রীতিমতো ভয় পেতেন এজন্য। অথচ বাংলার ভূমির উর্বরতা ও সমৃদ্ধি ছিল অতুলনীয়। একবার থিতু হলে ফেরত যেতে চাইতো না কেউ। বাংলা যেন দোজখের পরিবেশ নিয়ে এক নিয়ামতপূর্ণ নগরী।
নিজের দেশে প্রত্যাবর্তনের দুই বছর পরে ১৩৫৬ সালে ভ্রমণকাহিনী লেখা সমাপ্ত করেন ইবনে বতুতা। ১৩৭৮ সালে ৭২ বছর বয়সে মরক্কোর ফেজ নগরীতেই মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার রচনা চতুর্দশ শতকের পৃথিবীর চিত্র আধুনিক মানুষের চোখের সামনে মেলে ধরেছে। তুলে ধরেছে নদীবিধৌত বাংলার মানুষের জীবনযাত্রা। মন্তব্যগুলো অতি সংক্ষিপ্ত এবং সীমিত হলেও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস রচনার উপকরণ হিসাবে তার লেখার মূল্য অপরিসীম।