ইহার চেয়ে হতেম যদি
আরব বেদুয়িন !
চরণতলে বিশাল মরু
দিগন্ত বিলীন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মগুলো প্রেম-ভালোবাসা, প্রকৃতি আর মানবতার কথা বললেও স্বয়ং কবিগুরুও বাঙালির আয়েশি ভেতো মিনমিনে পরিবেশ আর আচরণে একপর্যায়ে বিরক্তই বোধহয় হয়েছিলেন। তা না হলে ‘দুরন্ত আশা’ কবিতায় এমন করে আরব বেদুঈনদের বাঁধনহারা বেপরোয়া জীবনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ তৈরী হবে কেন। বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলামেরও আরব বেদুঈন হওয়ার বাসনা থাকবে সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার চরণে তিনি লিখেছেন
‘আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস
আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্নিশ’
আরব অঞ্চলের যাযাবর জাতি বেদুঈনদের কথা শুনলেই সবাই মনে হয় চলে যান বেপরোয়া এক রোমান্টিক কল্পনায়, যেখানে মরুভূমির তপ্ত বালির উপর দিয়ে হাতে অস্ত্র নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে টগবগিয়ে ছুটে চলেছে এক যোদ্ধা। অন্তত প্রায় সময়ই কবি-সাহিত্যিকদের কবিতার পঙ্কতিতে বারেবারেই এই রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার কথা উঠে আসে।
তবে আরবের গোত্রভিত্তিক এই বেদুঈন সম্প্রদায় যে শুধু রোমাঞ্চকর অভিযান করে বেড়ায় তা ভাবলে ভুল হবে। রোমাঞ্চের পাশাপাশি এদের জীবনেও রয়েছে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না। বিশেষ করে বেঁচে থাকা, জীবিকা তথা মরুভূমির শুষ্ক-অনুর্বর পরিবেশে দু’বেলা খাদ্য সংগ্রহের তাগিদে তাদেরকে কঠিন সংগ্রাম করতে হয়। চলুন মরুভূমির এই প্রস্তর কঠিন সম্প্রদায় সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া যাক।
বেদুঈন কারা?
বেদুঈন মূলত আরব উপদ্বীপ (বর্তমান ইয়েমেন, আরব আমিরাত), মধ্যপ্রাচ্য আর উত্তর আফ্রিকা- এসব অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যাযাবর অধিবাসী। গোত্রভিত্তিক জীবনযাপন করা এই সম্প্রদায় নিজেদেরকে প্রকৃত আরব দাবী করে নিজেদেরকে অভিহিত করে থাকে ‘Heirs of Glory’ তথা ‘গৌরবের উত্তরাধিকারী’ হিসেবে।
আরবের অনেক বাসিন্দার কাছেও বেদুঈনরা রোমাঞ্চ আর স্বাধীনতা বা স্বাধীনচেতা জীবনের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তাদের জীবন এত সহজ নয়। ব্রিটিশ ভ্রমণ লেখক স্যার উইলফ্রেড থিসিঙ্গার তার জীবনের একটা বড় সময় বেদুঈনদের সাথে কাটিয়ে লিখেছেন, ”বেদুঈনদের জীবন কঠিন ও ক্ষমাহীন… সবসময় ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় পরিপূর্ণ।“
‘বেদুঈন’ শব্দের অর্থ ‘মরুভূমির মানুষ’। বেদুঈন শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘বেদু’ থেকে। এই শব্দ দ্বারা মরুভূমির স্থায়ী বাসিন্দা (যেমন- কৃষক) আর যাযাবরদের মধ্যে পার্থক্য করা হতো। বেদুঈনরা অন্যান্য পেশার মানুষের মতো একস্থানে বসবাস না করে যাযাবর হিসেবে বিভিন্ন স্থানে বসবাস করত। মূলত তারা উট, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি চরাতো, যেখানে তারা তাদের পোষা প্রাণীদের জন্যে দরকারি খড়-খাগড়া বা ঘাসের সন্ধান পেতো সেখানে পশুর দল নিয়ে বসবাস করত।
বেদুঈনদের ইতিহাস
বেদুঈনরা একসময় ‘The Holy Land’ অর্থাৎ বর্তমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের অধিবাসী ছিলো। বাইবেলে তাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাদের জীবনযাত্রা মধ্যপ্রাচ্যে তেল আবিষ্কৃত হওয়ার আগপর্যন্ত বলতে গেলে বাইবেলে বর্ণিত আকারেই ছিলো।
আগে বেদুঈনরা ছিলো মূলত প্যাগান বা প্রকৃতি পূজারি। প্রাচীন নানা ধর্মের ন্যায় তারা মূর্তিপূজা করত। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) আরবে ইসলামের প্রচার আরম্ভ করলে বেদুঈনদের অনেক গোত্র দলে দলে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। মূলত সেই সময় থেকেই বেদুঈনরা সুন্নী মুসলিম, তবে এখনো খ্রিস্ট ধর্ম পালন করে এমন কিছু বেদুইন গোত্রও রয়েছে। মিশরের দক্ষিণ সিনাই ও লিবিয়াতে বসবাসরত কিছু বেদুঈন গোত্র রয়েছে, যাদের ভেতর সুফি মতবাদের প্রভাব রয়েছে।
জীবনযাত্রা
হাজার বছর ধরেই বেদুঈনরা পশুপালন করে আসছে। এসব পশু তারা অন্যান্য পেশাজীবি মানুষদের কাছে বিক্রি করতো। উট, ঘোড়া এবং গাধা মালবাহী প্রাণী হিসেবে এবং ভেড়া ও ছাগল খাদ্য, উলের পোশাক তৈরীতে কাজে আসত। তৎকালীন ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেকটাই বেদুঈনদের উপর নির্ভর করতো, কারণ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে মালামাল পরিবহনের জন্য বেদুঈনদের উপর নির্ভর করতে হতো। বেদুঈনরা এসব মালবাহী দলের জন্যে গাইড রূপে কাজ করত। এরা মরুভূমির মধ্যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত এবং নিরাপত্তা দিত।
বেদুঈনদের খাদ্যতালিকা খুবই সাধারণ। বলতে গেলে খেজুরই তাদের সারা বছরের খাদ্য। এমনও সময় যায় যখন বেদুঈনরা সারা মাস শুধু খেজুর খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। তারা নিজেরা খেজুরের চাষ করে, খেজুরগুলো রোদে শুকিয়ে শীতকালে খাওয়ার জন্য সংরক্ষণ করা হয়।
তবে বেদুঈনদের প্রধান খাদ্য হলো রুটি, দই, দুধ এবং বিভিন্ন রকমের মাংস। মাঝেমধ্যে তারা ভাতও খেয়ে থাকে, তবে সেটা উৎসব বা কোনো বিশেষ উপলক্ষে। তারা ছাগলের মাংস ও চাল একসাথে রান্না করে খেতে পছন্দ করে (যেটা অনেকটা বিরিয়ানীর মতোই)। সকালের নাস্তায় সাধারণত থাকে দই, রুটি এবং কফি।
বেদুঈনদের রুটি অনেকটা আমাদের দেশে তৈরী ‘চা-পাতি’ রুটির মতোই। আটা দিয়ে খামির তৈরী করে গোল গোল বল আকৃতির মতো করে রাখা হয়। এরপর গম্বুজাকৃতির একটি ধাতব পাত্র চুলার উপর রেখে গরম করা হয় এবং এর উপরে রুটি সেঁকা হয়। খুব বেশী খাদ্য সংকট না থাকলে মূলত এই রুটিই বেদুঈনদের প্রাত্যহিক খাদ্য।
কফি বেদুঈনদের এক উল্লেখ করার মতো ঐতিহ্য। বেদুঈনরা দিনের একটা বড় সময় জুড়ে কফি পান করে। আসলে মরুভূমির ভেতর চিত্তবিনোদনের তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কফি পান করা বিনোদনের একটা উৎসও বটে। বেদুঈনরা ঘন ও দানাদার কফি পান করে থাকে, যার মধ্যে এলাচ ও আদার শিকড় থাকে। এগুলো সব একটি পাত্রে নিয়ে ফুটিয়ে তৈরী করা হয়। বেদুঈন সংস্কৃতিতে অতিথি এলে তাকে এই কফি ও খেজুর পরিবেশন করে স্বাগত জানানো হয়। বেদুইনরা নিজেরাই এসব কফি উৎপাদন কর থাকে। বখশিশ বা উপঢৌকন হিসেবেও তারা একে অন্যকে কফি বীজ দিয়ে থাকে।
বেদুঈনদের প্রতিশোধ প্রথা আর যুদ্ধবিগ্রহ
বেদুঈনরা বেশ কলহপ্রবণ বলে পরিচিত। মরুভূমির চরম প্রতিকূল পরিবেশ তাদের চিত্তকে সেভাবেই গড়ে তুলেছে। আগেকার দিনে এক গোত্র আরেক গোত্রকে আক্রমণ করতো পানীয় জলের উৎস, যেমন কুয়া বা জলাধারের দখল নিতে। এছাড়া পালিত পশুদের জন্য চারণভূমির দখল নিতেও যুদ্ধ হতো।
গোত্রগুলো নিজেরা বেশ একতাবদ্ধ এবং সবাই কিছু কঠোর নিয়ম মেনে চলে, যেখানে পরিবারের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কোনো হত্যাকান্ড সংঘটিত হলে প্রতিশোধ নেয়াকে সবকিছুর থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ‘রক্তের বদলে রক্ত’ এখানে মূল মন্ত্র। কোনো পরিবারের কেউ নিহত হলে ঐ পরিবারের প্রথম ৫ জন ভাই বা চাচাতো ভাইদের দায়িত্ব খুনীকে খুঁজে বের করে হত্যা করা। যদি খুনীকে খুঁজে পাওয়া না যায় তবে বেদুঈন প্রথা অনুযায়ী খুনীর পরিবারে অন্য কোনো পুরুষ সদস্যকে হত্যা করা হবে।
বহু শতাব্দী আগে কিছু বেদুঈন গোত্রের জন্য হজ্ব কাফেলাগুলোকে আক্রমণ করাও স্বাভাবিক ঘটনা ছিলো। ১৭৫৭ সালে বনি সাকর গোত্রের কা’দান আর ফাইয়াজের নেতৃত্বে এক বেদুঈন দল একটি হজ্ব কাফেলাকে আক্রমণ করলে প্রায় ২০,০০০ হজ্ব যাত্রী মারা যায়।
বেদুঈনরা মরুভূমির নাড়িনক্ষত্র সম্পর্কে অবগত, মরুভূমির বালিতে সামান্য অচেনা আচড়ও তাদের দৃষ্টি এড়ায় না। হাজার বছর ধরে এই দক্ষতা বেদুঈনদের প্রবৃত্তিতে মিশে গেছে। ঠিক এই দক্ষতাকেই কাজে লাগিয়েছে ইসরায়েলী সেনাবাহিনী। বিশ্বের একমাত্র এই ইহূদী রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারার দায়িত্বে রয়েছে বিশেষায়িত মুসলিম বেদুঈনরা! ইসরায়েলী সেনাবাহিনীতে বেদুঈন ট্র্যাকিং ইউনিট নামের এই শাখায় আরব বেদুঈনরা বহু বছর ধরে তাদের মিলিটারি সার্ভিস দিয়ে আসছে।
আধুনিক বেদুঈনদের অবস্থা
মূলত গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বেদুঈনরা যাযাবর জীবন ছেড়ে দিতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে তেল আবিষ্কৃত হওয়ার পর অর্থনৈতিক উন্নতি হওয়া এর মূল কারণ। বেদুঈনদের সামান্য কিছু গোত্র বাদে সবাই এখন স্থায়ী শহুরে জীবনে যোগ দিয়েছে, যেখানে রয়েছে শান-শওকত। কিন্তু ঐতিহ্যস্বরূপ তারা তাদের সাংস্কৃতিক ব্যাপারগুলো ধরে রেখেছে, যা এখন মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটন শিল্পের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোতে রয়েছে অনেক বেদুঈন ক্যাম্প, যেখানে পর্যটকরা যান একদিনের বেদুইন হওয়ার স্বাদ নিতে।
ফিচার ছবি- Nasib Bitar