মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ৪৫ জন। সবাই যে দেশের উন্নয়নে সমান কাজ করেছেন তা কিন্তু নয়। কোনো কোনো প্রেসিডেন্ট যেমন প্রশাসন পরিচালনায় চরম দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছেন, আবার ঠিক অনেকেই আছেন যারা তাদের বুদ্ধি, বিবেক এবং দূরদর্শিতা দেখিয়ে প্রশাসন চালিয়েছেন নিষ্ঠার সাথে।
আমেরিকা তাদের প্রশাসনিক ইতিহাসে এমন কয়েকজন প্রেসিডেন্ট পেয়েছে, যাদের কারণেই আজ হয়ত পুরো পৃথিবীতে এতোটা মার্কিন প্রতিপত্তি। তারা দেশের উন্নয়নে কাজ করেছেন, করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন। এমন কয়েকজন প্রেসিডেন্ট আছেন যারা স্থান, কাল, রাজনৈতিক দলের উপরে উঠে আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। আজ আমরা জেনে নিব এমন সাতজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে, যারা আমেরিকার জনগণের কাছে তুমুল জনপ্রিয়।
১) আব্রাহাম লিঙ্কন (১৮৬১- ১৮৬৫)
আব্রাহাম লিঙ্কন এক অবিস্মরণীয় নাম হিসেবে চিরকাল লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন দেশের জন্য কী না করেছেন! গৃহযুদ্ধের ভয়ানক দিনগুলোতে বুদ্ধিদীপ্ত সাহসিকতার সাথে দেশকে যেমন নেতৃত্ব দিয়েছেন, ঠিক তেমনি Emancipation ঘোষণার মাধ্যমে দাসপ্রথার কালো অধ্যায় থেকে আমেরিকাকে দিয়েছেন মুক্তি। নিজের শরীর-স্বাস্থ্যের দিকে কোনো রকমই খেয়াল ছিল না তাঁর। রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি যদি দক্ষতা, বিচক্ষণতার পরিচয় না রাখতেন, তাহলে হয়তো আমেরিকার আজকের এই প্রবল পরাক্রমী অবস্থান অন্যরকমই হতো। গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশ বিনির্মাণ, দক্ষিণের সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে তিনি কাজ করেছেন অক্লান্তভাবে। দেশের জন্য আজীবন কাজ করে যাওয়া এই নেতা আমেরিকার সুখের দিনগুলো দেখে যেতে পারেননি। ১৮৬৫ সালের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়েই তিনি জন উইল্কিস বুথ নামের এক আততায়ীর হাতে নিহত হন।
২) জর্জ ওয়াশিংটন ( ১৭৮৯- ১৭৯৭)
জর্জ ওয়াশিংটন আমেরিকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, নৈতিক কর্তৃত্ব এবং তাঁর কর্মদক্ষতার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ‘জাতির জনক’ হিসেবে পরিচিত জর্জ ওয়াশিংটন হচ্ছেন আমেরিকার ইতিহাসের প্রথম প্রেসিডেন্ট। তেমন কোনো বড় রাজনৈতিক পরিমন্ডল থেকে তিনি উঠে আসেননি। দেশের বৈপ্লবিক যুদ্ধের সময় তিনি ‘কম্যান্ডার ইন চিফ’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধের ক্রান্তিলগ্নে তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দেখিয়েছেন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই আজকের আধুনিক আমেরিকার গোড়াপত্তন ঘটে। দেশের প্রেসিডেন্টের সম্ভাষণের ক্ষেত্রে “Your excellency” শব্দের বদলে আজকের “Mr. President” সম্বোধনের সূচনা তাঁর হাতেই। আমেরিকার সংবিধান রচনার ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩) ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট (১৯৩৩-১৯৪৫)
দেশের ৩২তম প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট ছিলেন আমেরিকার ইতিহাসে প্রচণ্ড জনপ্রিয় একজন প্রেসিডেন্ট। তিনি চারবারের জন্য এই পদে আসীন হয়েছিলেন। অত্যন্ত প্রভাবশালী এই ডেমোক্রেট নেতা দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন অনেকটা সময় ধরেই। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম কর্ণধার হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। একটি ঐক্যবদ্ধ আমেরিকা গঠনে জনমত তৈরি করা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও মৈত্রী স্থাপনে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সারা পৃথিবীব্যাপী তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক মন্দার সময় তিনি সামনে থেকে আমেরিকার নেতৃত্ব দিয়েছেন অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণভাবে। আফ্রিকান আমেরিকানদের চোখে তিনি ছিলেন এক নায়কসুলভ চরিত্র। এছাড়া ক্যাথোলিক, ইহুদি এবং চাইনিজ আমেরিকানদের কাছেও তিনি ছিলেন প্রচণ্ড জনপ্রিয় এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর নামটি একটু বড় হওয়ার কারণে তিনি সংক্ষেপে FDR নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।
৪) থিওডোর রুজভেল্ট (১৯০১-১৯০৯)
আমেরিকার ইতিহাসে সবথেকে কম বয়সে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অধিষ্ঠিত হন থিওডোর রুজভেল্ট। মাত্র ৪২ বছর বয়সে তিনি এই দায়িত্ব পান। দুবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা থিওডোর আমেরিকার জনগণের জন্য কাজ করেছেন অনেক। আমেরিকার এই ২৬তম প্রেসিডেন্ট একাধারে ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক, লেখক, অনুসন্ধানী, প্রকৃতিপ্রেমী, সৈনিক এবং সর্বোপরি একজন সমাজ সংস্কারক। দেশের অভ্যন্তরীন প্রোগ্রাম Square Deal চালু করেন তিনি। এই প্রোগ্রামের অন্তর্ভূক্ত ছিল তিন C; আমেরিকার জাতীয় সম্পদের সংরক্ষণ, দেশের সংস্থাগুলোর উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং ভোগ্য পণ্যের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ। Trust busting এবং Conservation ছাড়াও ১৯০২ সালের কয়লা বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এছাড়া ‘রুশ- জাপানিজ’ যুদ্ধ বন্ধ এবং পানামা খাল নির্মাণে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। রিপাবলিকান দল থেকে নির্বাচিত এই প্রেসিডেন্ট আমেরিকার অভ্যন্তরীণ উন্নতিতে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন।
৫) হ্যারি এস ট্রুম্যান (১৯৪৫-১৯৫৩)
আমেরিকার ৩৩তম প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ক্রান্তিকালে দেশের পুনর্গঠন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। তাঁর সবথেকে বড় অবদান, তিনি আমেরিকার ‘একলা চলো’ নীতি থেকে বেরিয়ে এসে আন্তর্জাতিক মৈত্রী স্থাপনের মাধ্যমে বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি চালু করেন। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতা খর্বকরণের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে আমেরিকার প্রভাব বিস্তারে মনোযোগী হন। তাঁর Truman Doctrine পদক্ষেপ গ্রিস এবং তুর্কীতে কম্যুনিস্ট হুমকি প্রশমিত করা সহ বার্লিন এয়ার লিফটের মতো পদক্ষেপ রাশিয়ার মতো পরাশক্তিকে বার্লিন অবরোধ তুলতে বাধ্য করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপ পুনর্গঠনে ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ‘মার্শাল প্লান’ তহবিল গঠন তাঁর পররাষ্ট্রনীতির আরেক বড় সাফল্য। আমেরিকার সেনাবাহিনীতে বর্ণবৈষম্য দূর করা সহ তিনি তাঁর শাসনামলে গঠন করেন NSC, CIA এবং NSA’এর মতো জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো।
৬) থমাস জেফারসন (১৮০১-১৮০৯)
দুবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকালে থমাস জেফারসন গনতন্ত্রের উন্নয়নে কাজ করেছেন নিরলসভাবে। আমেরিকার এই ৩য় প্রেসিডেন্ট যখন ক্ষমতায় আসেন তখনকার আমেরিকা আজকের অবস্থায় ছিল না। আমেরিকায় গণতন্ত্রের গোড়াপত্তনকারী এই ব্যক্তি ছিলেন গণতন্ত্রের একজন ধারক এবং বাহক। সমাজের প্রভাবশালী গোষ্ঠী থেকে একটি মুক্ত, স্বাধীন সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি কাজ করেছেন। তিনি মনে করতেন-
“পৃথিবীতে গণতন্ত্রই হল সবথেকে শক্তিশালী সরকার ব্যবস্থা।”
জেফারসন হলেন ওয়াশিংটন ডিসিতে অভিষিক্ত হওয়া প্রথম প্রেসিডেন্ট। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অন্যতম এই কারিগর যদিও ব্যক্তিজীবনে দাস পালন করতেন, তবুও তিনি ছিলেন ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় মুক্তি না আসলে যে ব্যক্তিগত মুক্তি সম্ভব নয়, তিনি তা অনুধাবন করেছিলেন। এছাড়া বাক স্বাধীনতা, প্রেস স্বাধীনতায় তিনি কাজ করেছেন। তাঁর গণতান্ত্রিক বিশ্বাস ছিল, ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে একটা স্বাধীন গণতন্ত্র সম্ভব নয়। তিনি তাঁর ক্ষমতাকালীন সময়ে সরকারকে যথাসম্ভব ‘সাধারণ এবং ব্যয়মুক্ত’ রাখতে চেষ্টা করেছেন।
৭) জন এফ কেনেডি (১৯৬১-১৯৬৩)
আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম রোমান ক্যাথোলিক এবং ২য় কনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হলেন জন এফ কেনেডি। আমেরিকার এই ৩৫ তম প্রেসিডেন্ট খুবই ধনী পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও কাজ করেছেন সেনাবাহিনীতে। মন্দা কাটিয়ে আমেরিকার দেশীয় বাজার- অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য তাঁর নেয়া পদক্ষেপগুলো ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। স্নায়ুযুদ্ধের সময় কিউবা, ভিয়েতনামকেন্দ্রিক জটিলতায় সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে নিউক্লিয়ার যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সামাল দেন তিনি। এছাড়া তিনি ছিলেন জনসেবা এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলনের একজন সমর্থক। ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বরে টেক্সাসের ডালাসে আততায়ীর গুলিতে তিনি নিহত হন। JFK নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি।
ফিচার ইমেজ- wallpaperflare.com