মানব সভ্যতার নৌযুদ্ধের ইতিহাস কম করে হলেও ৩,০০০ বছরের পুরোনো। এই দীর্ঘ সময়ে এমন সব যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে, যেগুলো ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিল। নদী কিংবা সাগরপথে পণ্য পরিবহণ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর ছিল। তাই একসময়, সাগরপথের একটি নির্দিষ্ট এলাকা দখল করার প্রয়োজন দেখা দেয়। সেইসাথে, কোনো ভূখণ্ড দখল করার প্রয়োজনেও পানিতে নৌকা ভাসানোর চল বেড়ে যায়। তারপর থেকে নৌযুদ্ধের ধরন বদলেছে।
সভ্যতা যত এগিয়ে যেতে লাগল, ততই নৌযুদ্ধের কদর বাড়ল। বড় বড় সাম্রাজ্যগুলোও নিজেদের সমৃদ্ধ করতে বিশালাকার সব রণতরী তৈরি করত। সেগুলোর প্রমাণ পাওয়া যায়, বিভিন্ন সময় পানির নিচ থেকে আবিষ্কার হওয়া জাহাজগুলো দেখে। আজকের লেখায় এমন কিছু প্রাচীন নৌযুদ্ধ নিয়ে জানব।
১. সালামিসের যুদ্ধ
পার্সিয়ানদের আর্টেমিসিয়াম এবং থার্মোপাইলি বিজয়ের পর, ‘সালামিসের যুদ্ধ‘ সংগঠিত হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯০ সালের শেষদিকে রাজা জার্্জেস গ্রিসে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। তারা এথেন্সসহ গ্রিসের বেশিরভাগ অঞ্চল দখল করে নেয়। তবে গ্রিসের নৌবাহিনী সেই সময় সালামিসে অবস্থান করছিল। নৌপথে সালামিসে পৌঁছানোর জন্য একটি সরু খাল পার হতে হত। গ্রিক নৌবাহিনী শক্তির দিক থেকে পার্সিয়ানদের চেয়ে দুর্বল ছিল। তাই তারা সরাসরি যুদ্ধের বদলে খালের ওপারে সালামিসে অবস্থান নিয়েছিল। যাতে পার্সিয়ান নৌবাহিনীকে খাল পার হয়ে এখানে আসতে হয়।
গ্রিকদের এই কৌশল পার্সিয়ান নৌবাহিনী ধরতে পারেনি। তাই তারা সালামিসের দিকে নিজেদের রণতরী ভাসাল। কিন্তু সামনে সরু খাল পার হতে গিয়ে, গ্রিক নৌবাহিনীর অতর্কিত হামলার শিকার হলো তারা। ফলে মুহূর্তেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো পার্সিয়ান নৌবাহিনী। তারা যতই সালামিসের দিকে এগিয়ে যায়, গ্রিক বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতাও তত বেড়ে যায়। উপায় না দেখা পার্সিয়ানরা পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ততক্ষণে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে। পার্সিয়ান রাজার পাঠানো নৌবাহিনীর ৩০০টি জাহাজ ধ্বংস করে দেয় গ্রিকরা। অন্যদিকে, তাদের মাত্র ৪০টি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে গ্রিকদের এই বিজয়ের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। গ্রিকদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত হারের পর, রাজা জার্্জেস নিজেকে সামরিক অভিযান থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। আর এই ফাঁকে গ্রিকরা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির দিকে নজর দেয়। একসময় দেখা যায়, দুর্বল গ্রিক বাহিনী পার্সিয়ানদের মোকাবেলা করার সামর্থ্য অর্জন করে ফেলেছে। গ্রিকদের এমন চমৎকার উত্থান পর্বের পেছনে, সালামিসের যুদ্ধ বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
২. ডেল্টার যুদ্ধ
মিশরের ফেরাউন তৃতীয় রামেসেসের সময়ে অসংখ্য মন্দির তৈরি করা হয়। সেগুলোর গায়ে সেই সময়কার নৌযুদ্ধের চিত্র অঙ্কন করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা যখন মন্দিরগুলো খুঁজে পান, তাদের গবেষণায় দেয়ালচিত্রের রহস্য বেরিয়ে আসে। রামেসেসের শাসনকালে, মিশরীয়দের সঙ্গে প্রায়ই সমুদ্রে বাস করা যাযাবরদের যুদ্ধ বাঁধত। ক্রিটের জেক্কের, সিসিলিয়ান, সারডিনিয়ানদের সমন্বয়ে সমুদ্রে যাযাবর সম্প্রদায় আবাস গড়েছিল।
এসব যাযাবর গোষ্ঠী পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যাত্রা করেছিল। তারপর ব্রোঞ্জ যুগের শেষের দিকে আনাতোলিয়া, সিরিয়া, কেনান, সাইপ্রাস এবং মিশরে আক্রমণ চালায় তারা। ঐতিহাসিকদের মতে, এসব সামুদ্রিক যাযাবর গোষ্ঠী ব্রোঞ্জ যুগের বিদায়কে ত্বরান্বিত করেছিল।
রামেসেস এসব যাযাবর গোষ্ঠীকে সিরিয়ায় দিকে ধাওয়া করেছিলেন। তাদের পরাজিত করার পর, তিনি আবার মিশরে ফিরে আসেন। মিশরে ফেরার পর তিনি বুঝতে পারছিলেন, শত্রুরা মিশরে আক্রমণ করতে পারে। যার কারণে নিজের নৌশক্তি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেন রামেসেস। তার চিন্তা ছিল মিশরীয় বাহিনী, যাযাবরদের নীল নদের তীরবর্তী অঞ্চলের দিকে ধাওয়া করে আনবে। নদী তীরে রামেসেসের তীরন্দাজ বাহিনী লুকিয়ে থাকবে। ফলে দু’দিকের আক্রমণে যাযাবরদের প্রতিহত করতে পারবে তারা।
খ্রিস্টপূর্ব ১১৭৫ সালে মিশরের ফেরাউন রামেসেসের নৌবাহিনী, যাযাবর গোষ্ঠীদের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিল। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মিশরীয় নৌবাহিনী, শত্রুদের নীল নদের তীরবর্তী এলাকায় নিয়ে এসে ঘিরে ফেলে চারদিক থেকে। সংকেত পেতেই রামেসেসের তীরন্দাজ বাহিনী তীর হামলা শুরু করে।
একদিকে সমুদ্রে মিশরীয় নৌবাহিনী আক্রমণ করে যাচ্ছিল। নতুন করে তীর হামলার ফলে, যাযাবরদের নৌবহর দিশা হারিয়ে ফেলে। তাদের বাহিনী প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। শত্রুদের ভেতর যারা বেঁচে গিয়েছিল, তারা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। যাযাবর বাহিনীর এই পরাজয়, মিশরের আশেপাশের রাজ্যগুলোকেও স্বস্তি দিয়েছিল।
৩. অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধ
রোমান প্রজাতন্ত্র থেকে রোমান সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধের বদৌলতে। মার্ক অ্যান্টনি সেই সময় প্রজাতন্ত্রের পূর্বদিকে রোমান বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন। রোমান সিনেটে তার বিরুদ্ধে মিশরের রানী ক্লিওপেট্রার সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগ আনা হয়। অনেকেই মনে করছিলেন, অ্যান্টনি গোপনে একাকী খারাপ কিছু একটার ছক কষছিলেন। এরকম নানা অভিযোগ আর অবিশ্বাস থেকে, অক্টাভিয়ানের সঙ্গে অ্যান্টনির সামরিক জোট ভেঙে যায়। অক্টাভিয়ান রোমান সিনেটের ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেন। ক্ষমতা নেওয়ার পরপরই তার নেতৃত্বে সিনেট, মার্ক অ্যান্টনি এবং মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
মার্ক অ্যান্টনি এবং ক্লিওপেট্রার জোট নিজেদের যুদ্ধকৌশল নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, খ্রিষ্টপূর্ব ৩২ সালের ২ সেপ্টেম্বর, অ্যান্টনি ৫০০ জাহাজের বহর নিয়ে গ্রিসের নিকটবর্তী অ্যাক্টিয়াম উপসাগরে অবস্থান নেন। অন্যদিকে অক্টাভিয়ানের নৌবহরে ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজ। কিন্তু, তার বাহিনী সাজানো হয়েছিল দক্ষ নাবিকদের সমন্বয়ে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, দুই পক্ষই নিজেদের তীরন্দাজ বাহিনীকে কাজে লাগায়। তীরের ফলায় আগুন লাগান থাকায়, মুহূর্তের ভেতর সেখানকার আকাশ কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। তীরের পাশাপাশি বড় বড় পাথরখণ্ডও নিক্ষেপ করছিল উভয় বাহিনী। অক্টাভিয়ানের জাহাজগুলো আকারে ছোট হওয়ায় তারা দ্রুত স্থান বদলাতে পারছিল। ফলে, বিপক্ষ বাহিনীর আঘাত তাদের খুব একটা ক্ষতিসাধন করতে পারছিল না। বিপরীত চিত্র অ্যান্টনি শিবিরে। আকারে বড় জাহাজগুলো সহজে এদিক-সেদিক নেওয়া যাচ্ছিল না। ফলে, শত্রুদের প্রায় সবগুলো আঘাতই বুক পেতে নিচ্ছিল জাহাজগুলো।
সমুদ্রের নিয়ন্ত্রণ ইতোমধ্যে রোমানদের হাতে চলে গিয়েছিল। এ চিত্র দেখে ক্লিওপেট্রা খুব হতাশ হয়ে পড়েন। যুদ্ধের ফলাফল চিন্তা করে তিনি রণে ভঙ্গ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার নৌবহর আক্রমণ বন্ধ করে দিয়ে মিশরের দিকে যাত্রা করে। ফলে অ্যান্টনিও কোনো উপায় না পেয়ে ক্লিওপেট্রার পিছু নেন। এখানেই নৌযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
এ পরাজয়ের পর মিশরের পতন সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধের এক বছরের মাথায়, অক্টাভিয়ান আলেকজান্দ্রিয়ার মাটিতে পা ফেলেন। নিজেদের সম্মান বাঁচাতে ক্লিওপেট্রা এবং অ্যান্টনি আত্মহত্যা করেন। ফলে কোনোরকম বাধা ছাড়াই, অক্টাভিয়ান মিশরকে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
৪. আরগিনিসার যুদ্ধ
গ্রিক ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত একটি যুদ্ধের নাম আরগিনিসার যুদ্ধ। খ্রিস্টপূর্ব ৪০৬ সালে, এথেন্স আর স্পার্টা’র ভেতর আরগিনিসার উপকূলে এই পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। সেই সময় এথেন্সের নৌবাহিনী ছিল বিশ্বসেরা। কিন্তু স্পার্টানরা প্রথম আক্রমণেই গ্রিকদের ৩০টি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। বিপদ দেখে গ্রিক কমান্ডার কনন, এথেন্সে নৌ সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠান। জবাবে ১৫০টি জাহাজের বিশাল এক বহর পাঠায় এথেন্স।
স্পার্টানরা এই খবর জানতে পেরে, শত্রুদের নৌবহর কননের কাছে পৌঁছানোর আগেই তাদের আক্রমণ করে বসে। স্পার্টা নৌবাহিনীর কাছে ১২০টি জাহাজ ছিল। তাছাড়া গ্রিকদের চেয়ে স্পার্টার নৌ-যোদ্ধারা অনেক বেশি অভিজ্ঞ ছিল। তাছাড়া অভিজ্ঞ গ্রিক যোদ্ধারা তখন কমান্ডার কননের নৌবহরে ছিল। এথেন্স থেকে আসা নৌবহরের সৈনিকরা খুব বেশি পরিণত ছিল না। ফলে স্পার্টানরা ভেবেছিল, সহজেই শত্রুদের পরাস্ত করে বাড়ি ফিরবে তারা।
কিন্তু শীঘ্রই তাদের ভুল ভাঙে। এথেনিয়ান বাহিনীর কৌশলের কাছে সহজেই কাবু হয়ে যায় স্পার্টানরা। তাদের প্রায় সবগুলো জাহাজ গ্রিকদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্পার্টা কমান্ডার ক্যালিক্রাটিডাসকে বন্দি করা হয়, পরে তাকে হত্যাও করা হয়।
৫. রেডক্লিফের যুদ্ধ
প্রাচীন চীনের হান রাজবংশের প্রদীপ একসময় নিভে যেতে শুরু করে। শেষদিকে এসে হানরা তিনটি রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই অঞ্চলগুলোর ক্ষমতা নিয়েছিলেন কাও কাও, লিউ বে এবং সান কোয়ান নামের তিনজন শাসক। এদের ভেতর কাও কাও, ২০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াঙসি নদীর আশেপাশের এলাকাগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে। তার কর্মকাণ্ড অন্য দুটি অঞ্চলের শাসক মেনে নিতে পারেননি। ফলে তারা জোটবদ্ধ হয়ে কাওয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তাদের সমন্বিত বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা ছিল ৫০,০০০ এর মতো। অন্যদিকে কাও এর একক বাহিনীতে ছিল ২৩০,০০০ সৈনিক।
যুদ্ধ শুরুর পর, জোটবাহিনী কাওয়ের বাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠছিল না। তাই তারা নতুন কৌশল অবলম্বন করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা আত্মসমর্পণের ভান করে। প্রত্যুত্তরে কাওয়ে বাহিনী রেডক্লিফের কাছাকাছি এলাকায় পৌঁছে, শত্রুদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তখন জোটের নৌবাহিনী খড়ের ভেতর তেল ঢেলে সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপর জ্বলতে থাকা খড়গুলো কাওইয়ের বাহিনীর দিকে ছুঁড়ে মারতে থাকে।
এতে করে শত্রুপক্ষের সবগুলো জাহাজে আগুন ধরে যায় মুহূর্তের ভেতর। আকস্মিক এই আক্রমণে কাওয়ের নৌবাহিনীর ভেতর বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। বিপদ দেখে কাও নিজের সঙ্গীদের নিয়ে পালিয়ে যান। আর জোটের হাতে যারা ধরা পড়েছিল, তাদের হত্যা করা হয়।
কাও সবসময় উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তিনি কখনোই ভাবতে পারেননি, এমন পরিকল্পিত নৌযুদ্ধে তার বাহিনীকে কেউ পরাজিত করতে পারে। চরম অবিশ্বাস আর হতাশা নিয়ে তিনি নিজ রাজ্যে ফিরে যান। এই যুদ্ধের পরও চীনের তিনটি রাজ্য বহুদিন টিকে ছিল। কিন্তু পুরো চীনকে একত্রে শাসন করার যে স্বপ্ন ছিল কাওয়ের, তা আর বাস্তবায়িত হয়নি।