১৪৯২ সাল, কলম্বাস পা রাখলেন সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন এক নতুন ভূখণ্ডে। সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়! তারা নানা ধরনের উপহার নিয়ে আসে। উপহারগুলোর মধ্যে ছিল নানা ধরনের ফল, খাবার আর একধরনের শুকনো পাতা। আর এ শুকনো পাতাই অভিশাপ বয়ে আনে সারা বিশ্বে।
কলম্বাস প্রথমদিকে এই পাতাগুলোকে গুরুত্ব দেননি, তবে সেখানকার আদিবাসীদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ লক্ষ্য করেন এই পাতা নিয়ে।
১৪৯২ সালেই কলম্বাসের সমুদ্রযাত্রার সহযাত্রী রদ্রিগো দে জেরেজ১ কিউবায় পা রাখেন। তিনিই আদিবাসীদের ধূমপান করতে লক্ষ্য করেন এবং প্রথম ইউরোপীয় ধূমপায়ী হিসেবে নাম লেখান। জেরেজ একপর্যায়ে তুখোড় ধূমপায়ী হয়ে ওঠেন। তিনি স্পেনে ফিরে আসার সময় সাথে করে নিয়ে আসেন বদভ্যাসটি।
জেরেজ হয়ে পড়েছিলেন তুখোড় ধূমপায়ী। কিন্তু তার প্রতিবেশীরা ধূমপানের সাথে পরিচিত ছিল না। বরং নাক-মুখ থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখে প্রচণ্ড আতঙ্কিত হয়েছিল। তাকে তারা শয়তানের সহচারী ভেবে বসে। এ কারণে খুব শীঘ্রই তাকে হলি ইনকুইজিশন২ গ্রেফতার করে এবং ৭ বছর কারাবন্দী করে রাখা হয়।
তবে সে সময় সমুদ্রযাত্রীদের কল্যাণে স্পেন এবং পর্তুগাল দুই জায়গাতেই ধূমপান একটি ঘরোয়া অভ্যাসে পরিণত হয়।
ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজ নাবিকরা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সমস্ত ফাঁকা জায়গায় তামাক রোপণ করেছিলেন, যা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য ছিল যথেষ্ট। এ শতাব্দীর শেষ দিকে তামাক উদ্ভিদ ও তামাকের ব্যবহার কার্যত ইউরোপের প্রতিটি দেশেই চালু হয়েছিল। সে সময় তামাক নাক দিয়ে গ্রহণ এবং ধূমপান দুটোই প্রচলিত ছিল।
তামাকজাত পণ্য গৃহযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। পরবর্তীতে দেখা যায় যুদ্ধের সাথে তামাক বিস্তারের শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সিগারেট জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসে। তামাক প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলো প্রথমসারির সেনাদের কয়েক লক্ষ প্যাক সিগারেট পাঠিয়েছিল এবংএই প্রক্রিয়াতে তৈরি করেছিল কয়েক লক্ষ বিশ্বস্ত ও আসক্ত গ্রাহককে। এমনকি সিগারেট সৈন্যদের রেশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে হাতে তৈরি তুর্কি সিগারেট বিক্রি হত। কিন্তু তখনও সিগারেট সেরকম জনপ্রিয়তা পায়নি, কারণ চিবানোই ছিল তামাক ব্যবহারের জনপ্রিয় ধারা। ১৮৮১ সালে জেমস বনসাক সিগারেট তৈরির মেশিন আবিষ্কার করেন। মূলত তখন থেকেই সিগারেট সত্যিকারের জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর এসময়ই জন্ম হয় আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির। আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি আজও টিকে আছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির অংশ হিসেবে।
১৯২০ এর দশকে তামাক প্রক্রিতাজাত কোম্পানিগুলো নারীদের কাছে সিগারেট বিক্রি শুরু করে। নারীদের জন্য ‘মিল্ড এস মে’ স্লোগানে আলাদা সিগারেট বিপণন শুরু করে ফিলিপ মরিস। ফলশ্রুতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহিলা ধূমপায়ীদের সংখ্যা বেড়ে ১৯৩৫ সালে তিনগুণ হয়ে যায়।
সময়ের সাথে সিগারেটের জনপ্রিয়টা বাড়ছিল, কিন্তু সেই সাথেই চলছিল তামাকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে গবেষণা। ধূমপানের শুরুর দিকেই মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে, অভ্যাসটি শুধু আসক্তিজনকই নয়, বিপদজনকও। গ্রেট ব্রিটেনে ১৭৭১ সালেই তামাক ব্যবহারকারীদের নাকের কান্সারের ব্যাপারে সচেতন করা হয়। জার্মান চিকিৎসকরা ১৭৯৫ সালে পাইপ ধূমপায়ীদের ঠোঁটের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারে অবগত করেন। ১৯৩০ এর দশকে ফুসফুস ক্যান্সারের সাথে তামাকের যোগসূত্র খোঁজা শুরু হয় । অবশেষে সার্জন জেনারেল ১৯৬৪ সালে রিপোর্ট করেন- ধূমপান ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ।
সিগারেট কোম্পানিগুলোর চোখে অন্ধকার নেমে আসে। তাদের আইনের মুখোমুখি করা হয়। ১৯৭০ এর দশকে তামাকের বিজ্ঞাপনের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, তামাক যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তা লেভেলে মুদ্রণ করতে বাধ্য করা হয়।
এরপরও তামাকের বিস্তার রোধ করা যায়নি। তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিগুলো প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করে অন্যের স্বাস্থ্য নষ্ট করে! তামাকের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে, এর সাথে রয়েছে ট্রিলিয়ন ডলারের স্বাস্থ্য খরচ। ধারণা করা হয়, আজ বিশ্বে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি! আর এ ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
কলম্বাস রোগব্যাধি নিয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকায়, যার কারণে প্রায় ৮০% রেড ইন্ডিয়ান নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আবার তার কল্যাণেই সেই শুকনো পাতার অভিশাপে পুড়ছে সারাবিশ্ব।
১. রদ্রিগো দে জেরেজ
১৪৯২ সালে আটলান্টিক মহাসাগরে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের প্রথম সমুদ্রযাত্রার অংশ হিসেবে সান্তা মারিয়ার ওপর দিয়ে আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন রদ্রিগো দে জেরেজ। তার জন্ম স্পেনের দক্ষিণ-পশ্চিমে ছোট্ট শহর আইয়ামোনতে।
২. ইনকুইজিশন
ক্যাথলিক চার্চের এমন একটি প্রতিষ্ঠান ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল ধর্মবিরোধিতার বিরুদ্ধে লড়াই করা।