লেক মিশিগান আর লেক হুরনের মাঝে ছোট্ট এক দ্বীপ। স্থানীয় চিপাওয়া আর অটোয়া গোত্র এর নাম দিয়েছে মিশিলম্যাকিনাক (Michilimackinac)। বর্তমানে এর নাম ম্যাকিন’ও (Mackinac)।
১৬৭০ সালে ফরাসি মিশনারি ফাদার জ্যাকুইস মার্কুয়েট আর লুই জোলিয়েট মিশিগান থেকে পালিয়ে এখানে আবাস গড়েন। তাদের হাত ধরে ম্যাকিন’ও ফরাসি অধিকারে চলে আসে। তখন ইংল্যান্ডের সাথে উপনিবেশ নিয়ে ফ্রান্সের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলমান। বেশ কয়েকবার সংঘর্ষের পর প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশরা ১৭৫৯ সালে ছিনিয়ে নেয় এই দ্বীপ। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দুই বছর পর সাগরপাড়ে এক পাহাড়ের উপর দুর্গ বানায় তারা- ফোর্ট ম্যাকিন’ও। উদ্দেশ্য নিজেদের দখল বজায় রাখা এবং সংলগ্ন সমুদ্রপথ ধরে ব্রিটিশ বাণিজ্যপথ নির্বিঘ্ন করা।
১৭৮৩ সালে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরের পর শিশু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দুর্গসহ দ্বীপটি হস্তান্তর করে তারা। ১৮১৭ সালে দ্বীপে বিনিয়োগ করেন জন জ্যাকব অ্যাস্টর নামে এক ব্যবসায়ী। অনেকেই তাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মাল্টিমিলিওনেয়ার মনে করেন। সে বছর মিশিগান যুক্তরাষ্ট্রে নাম লেখালে অ্যাস্টর এখানে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ফার কোম্পানির একটি বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করেন।
অ্যাস্টরের কোম্পানি ফার কিনতো শিকারিদের থেকে, যাদের বলা হয় ট্র্যাপার। প্রতি বছর জুন মাসে এই ট্র্যাপারদের সম্মেলন হতো ম্যাকিন’ওতে। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকত ফোর্ট ম্যাকিন’ওর সেনারা।
১৮২২ সালের ৬ জুন শুরু হয়েছিল সাধারণ কোনো দিনের মতোই। কিন্তু সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যায় যখন এক ফ্রেঞ্চ-ক্যানাডিয়ান ট্র্যাপার, অ্যালেক্সিস সেইন্ট মার্টিন দুর্ঘটনাবশত আহত হন। তার চিকিৎসা করতে দুর্গ থেকে ছুটে আসেন সেনাবাহিনীর চিকিৎসক উইলিয়াম বিউমন্ট। তাদের দুজনের মাধ্যমে রচিত হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক নতুন অধ্যায়।
উইলিয়াম বিউমন্ট
১৭৮৫ সালের ২১ নভেম্বর লেবাননে জন্ম হয় উইলিয়াম বিউমন্টের। কৃষকের ছেলে বিউমন্ট ২১ বছর বয়সে ঘর ছেড়ে নিউ ইয়র্ক চলে আসেন। তিনি এখানে শিক্ষকের চাকরি করেন ১৮১০ সাল পর্যন্ত।
বিউমন্ট এরপর ভারমন্টের এক চিকিৎসক বেঞ্জামিন চ্যান্ডলারের অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেন। দু’বছরের মাথায় তার রাজ্যের লাইসেন্সিং পরীক্ষা পাশ করে চিকিৎসকও হয়ে যান। বিউমন্টের পরবর্তী গন্তব্য ছিল ইউএস আর্মি। ১৮১২ সালে ক্যানাডার সাথে যুদ্ধের সময় তিনি একজন সার্জনের সহকারী হিসেবে কাজ করেন।
তিন বছর পর লড়াই শেষ হলে বিউমন্ট নিউ ইয়র্কে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। পাঁচ বছর পর তার এক আত্মীয়কে পসার বুঝিয়ে দিয়ে আবারও সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি, তাকে পাঠানো হয় ফোর্ট ম্যাকিন’ওতে।
একটি দুর্ঘটনা
বিউমন্ট ছিলেন কেবলই একজন চিকিৎসক। গবেষণায় কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তার। অথচ তার কাছেই ধরা দেয় বিপাকক্রিয়া গবেষণার সুবর্ণ সুযোগ। আর সেই সুযোগ আসে ক্যানাডিয়ান ট্র্যাপার সেইন্ট মার্টিনের সৌজন্যে।
১৮২২ সালের জুন মাসে ২০ বছরের অ্যালেক্সিস সেইন্ট মার্টিন আমেরিকান ফার কোম্পানির ম্যাকিন’ওর সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন। সেখানে কোম্পানির দোকানের সামনে জিনিসপত্র কেনার লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তার পালা এলে দোকান ঢোকেন সেইন্ট মার্টিন, হঠাৎ করেই দুর্ঘটনাবশত সেখানে রাখা শটগান থেকে গুলি ছুটে যায়।
সেইন্ট মার্টিন ছিলেন দু’ফুটেরও কম দূরত্বে। মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। তার পেটে ফুটো তৈরি হয়, সেখান দিয়ে ফুসফুস আর পাকস্থলির অংশবিশেষ বেরিয়ে আসে। খবর পেয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনাস্থলে হাজির হন বিউমন্ট। যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা দিলেও রোগীর সেরে ওঠার ব্যাপারে একেবারেই আস্থাশীল ছিলেন না তিনি।
ঘন্টাখানেকের ভেতর প্রচণ্ড জ্বরে কাবু হয়ে পড়েন রোগী, ক্ষতস্থানে সংক্রমণের সমস্ত লক্ষণ পরিস্ফুট হতে আরম্ভ করে। বিউমন্ট তাকে খাওয়াতে চেষ্টা করলে পেটের ফুটো দিয়ে খাবার আর পানি বেরিয়ে যায়। তবে সেইন্ট মার্টিন চিকিৎসককে আশ্চর্য করেন তার সহ্যশক্তি দিয়ে। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি, পেটের ফুটোর চারপাশের পেশীর চাপে ফুটোর উপর ঢাকনার মতো তৈরি হয়। এই ঢাকনা চাপ দিয়ে ধরে রেখে খেলে সমস্যা হতো না।
বিউমন্টের পরীক্ষা
দুর্ঘটনার পর সেইন্ট মার্টিনকে আমেরিকান ফার কোম্পানি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়। তিনি ম্যাকিন’ও দ্বীপের স্থানীয় ছিলেন না, ফলে স্থানীয়দের থেকেও কোনো সহায়তা পাবার উপায় ছিলো না। তারা পরামর্শ দিলো তিনি যাতে ঘরে ফিরে যান, প্রায় ২,০০০ মাইল দূরে কুইবেকে।
বিউমন্ট বুঝতে পারলেন- শরীরের এই অবস্থায় যাত্রার ধকল সামলাতে পারবে না সেইন্ট মার্টিন। তিনি তাকে গৃহভৃত্যের চাকরি দেন। তার মনে সুপ্ত ইচ্ছে সেইন্ট মার্টিন মোটামুটি শক্তি ফিরে পেলে তাকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করবেন। তার লক্ষ্য সেইন্ট মার্টিনের পেটের ফুটো দিয়ে তার পাকস্থলীর বিপাকক্রিয়া দেখা।
১৮২৫ সালের পয়লা আগস্ট নাগাদ সেইন্ট মার্টিন পরীক্ষার উপযুক্ত হয়ে উঠলেন। নানারকম খাবার সুতোয় বেঁধে পেটের ফুটো দিয়ে পাকস্থলীতে ঢুকিয়ে দেন, দেখতে লাগলেন কীভাবে বিভিন্ন খাবার শরীর প্রক্রিয়াজাত করছে। নির্দিষ্ট সময় পর পর সুতো টেনে খাবার বের করে বিপাকের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন তিনি। এছাড়া পাকস্থলী থেকে রস নিয়ে গবেষণা করেন তিনি।
সামরিক বাহিনীতে বিউমন্টের ছিলো বদলীর চাকরি, যেখানেই যেতেন বিউমন্ট থাকতো তার সাথে। তার পেটের ফুটো ব্যবহার করে গবেষণা করে বিপাকক্রিয়া সম্বন্ধে বহু মূল্যবান তথ্য জোগাড় করেন বিউমন্ট।
১৮২৫ সাল নাগাদ সেইন্ট মার্টিন গিনিপিগ হতে হতে বিরক্ত হয়ে উঠলেন। এমন সময় বিউমন্ট নায়াগ্রা দুর্গে দায়িত্ব পান, সেখানে যাওয়ার পথে কেটে পড়েন সেইন্ট মার্টিন।
বিউমন্ট তার সোনার ডিম পাড়া হাঁসের খোঁজে চারদিকে চিঠি পাঠালেন। তবে পাত্তা পাওয়া গেলো না সেইন্ট মার্টিনের। চার বছর পর অবশ্য কানাডা থেকে তিনি নিজেই হাজির হলেন উইসকনসিনের ক্রফোর্ড দুর্গে, সেখানে তখন অবস্থান করছিলেন বিউমন্ট। তার কাছ থেকে জানা গেল- এই কয় বছরে বিয়ে করে দুই সন্তানের পিতা হয়েছেন তিনি।
বিউমন্ট এবার নিজের অর্থে সেইন্ট মার্টিনের পুরো পরিবারকে দুর্গে নিয়ে এলেন। নতুন করে গবেষণা শুরু হলো, চললো আরো দুই বছর। এরপর সেইন্ট মার্টিন তার পরিবার নিয়ে বাড়ি গেলেন, প্রতিশ্রুতি দিলেন ভবিষ্যতে বিউমন্টের দরকার পড়লে আবার তিনি গিনিপিগ হবেন।
১৮৩২ সালে বিউমন্ট ওয়াশিংটনে বদলী হয়ে গেলে সেইন্ট মার্টিন ফিরে আসেন। এখানে দেড় বছর কাজ করে তার ওপর গবেষণা সমাপ্ত করেন তিনি। এরপর সেইন্ট মার্টিন চলে যান বাড়িতে, সেখানেই ১৮৮০ সালের ২০ জুন তার মৃত্যু হয়। বিউমন্ট ১৮৪৪ সালে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। তিনি মারা যান সেইন্ট মার্টিনের তিন বছর পর, এপ্রিলের ২৫ তারিখে।
গবেষণার ফলাফল
প্রায় নয় বছর ধরে পরীক্ষা করে কী পেয়েছিলেন বিউমন্ট? তিনি পাকস্থলীতে বিপাকক্রিয়া নিয়ে এমন অনেক তথ্য পান যা কিনা চিকিৎসাবিজ্ঞানকে এগিয়ে দেয় অনেক দূর। ১৮৩৩ সালে নিজের অর্থে একটি বই বের করে (Experiments and Observations on the Gastric Juice and the Physiology of Digestion) সেইন্ট মার্টিনের থেকে প্রাপ্ত তথ্য প্রকাশ করেন তিনি। গবেষণার ফলাফল হিসেবে প্রায় পঞ্চাশটি অনুসিদ্ধান্ত বর্ণনা করেন সেখানে।
বিউমন্ট পাকস্থলী থেকে যে রস আহরণ করেছিলেন তার বিশ্লেষণ করেন ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবলেই ডাংলিংসন। তিনি খুঁজে পান হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের অস্তিত্ব। বিউমন্ট অবশ্য ধারণা করেন- অ্যাসিডের বাইরেও আরো কোনো উপাদান খাবার হজমে সাহায্য করে। ১৮৩৬ সালে পাচক রসে পেপসিন বলে একপ্রকার এনজাইম আবিষ্কৃত হলে তার কথার সত্যতা প্রতিপাদিত হয়। বই প্রকাশিত হবার পর বিউমন্ট অবশ্য সেইন্ট মার্টিনকে আরো কিছু পরীক্ষার জন্য আসতে বলেছিলেন, তবে তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।
সমালোচনা
চিকিৎসা গবেষণার নৈতিকতা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে বিউমন্টের গবেষণা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে। তিনি কি কেবল পরীক্ষার গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহারের জন্য সেইন্ট মার্টিনের যত্নআত্তি করেছিলেন, নাকি চিকিৎসক হিসেবে নিজের দায়বদ্ধতা থেকে? অনেকে বলে থাকেন- সেইন্ট মার্টিনকে প্রথমে আশ্রয় দিয়েছিলেন মেরি লাফ্লুর নামে এক নারী, পরে বিউমন্ট যখন দেখতে পেলেন তার পেটের ফুটো দিয়ে পাকস্থলী দেখা যায় তখন গবেষণা কাজে ব্যবহারের জন্য তাকে নিয়ে আসেন।
আরেকটি বিষয় হলো- বিউমন্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গবেষণা শেষ হলে অপারেশন করে স্থায়ীভাবে তার ফুটো বন্ধ করে দেবেন। তবে তিনি সেরকম কিছু করেননি। রোগীর থেকে যথাযথ অনুমতি নিয়ে তিনি কাজ করেছিলেন কিনা সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। বরঞ্চ এই ব্যাপারে জোর করার ফলেই কিন্তু সেইন্ট মার্টিন প্রথমবার পালিয়ে গিয়েছিলেন, এবং বিউমন্টের শেষবারের অনুরোধেও সাড়া দেননি।
সেইন্ট মার্টিন কয়েকবার বিউমন্টকে বলেছিলেন, যদি তিনি তার শরীর নিয়ে গবেষণাই করতে চান, তাহলে লিখিত চুক্তি করতে। বলা হয়, এরকম একটি চুক্তি করা হয়েছিল, তবে সেখানে সেইন্ট মার্টিনের স্বার্থ কতটা রক্ষিত হয়েছিলো বলা মুশকিল। কারণ তিনি ছিলেন বিউমন্টের বেতনপ্রাপ্ত কর্মচারী, ফলে খুব বেশি অধিকার তার ছিল না। তবে গবেষণার বিনিময়ে বার্ষিক ১৫০ মার্কিন ডলার (আজকের দিনে প্রায় ২,৮০০ মার্কিন ডলার) তিনি পেতেন।
নৈতিকতার দিক থেকে বিউমন্টের পরীক্ষায় প্রচুর সমস্যা আছে। আহত এক ব্যক্তির পরিপুর্ণ চিকিৎসা না করার দায়ে আজকের দিনে তার জেল-জরিমানা হওয়ার কথা ছিল। তবে একথা অস্বীকার করার জো নেই যে, সেইন্ট মার্টিন এক্সপেরিমেন্টের কারণে পাকস্থলীর নানা বৃত্তান্ত জানার সুযোগ হয় আমাদের। ফলে চিকিৎসকদের পক্ষেও সম্ভব হয় আরো ভালোভাবে সেবা দেয়া। এসব কিছুই হয়তো হতো না যদি ১৮২২ সালের সেই দিনে দুর্ভাগা এক ফার শিকারির পেটে গুলির ফুটো তৈরি হতো!