মে ১৯৬৮: একমাসের যে ছাত্র আন্দোলন বদলে দিয়েছিল ফরাসি সমাজব্যবস্থাকে

সেবছর মার্চ মাসের ১৫ তারিখ ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় জাতীয় দৈনিক ‘লে মন্ডে’ পত্রিকা ‘ফরাসিরা বিরক্ত’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলতে থাকা কোনো আন্দোলন, কোনো প্রতিবাদই ফরাসিদের আলোড়িত করে না। ফরাসিরা জীবন নিয়ে বিরক্ত, তাই প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছে! খবরটির এই উক্তিগুলো ছিল ভুল, চরমভাবে বাস্তবতা বিবর্জিত।

কারণ, ফরাসিরা প্রতিবাদ করতে ভুলে যায়নি, আলোড়িত হতেও ভুলে যায়নি। ভেতরে ভেতরে ফরাসিরা যে ক্ষোভে ফুঁসছিল, তা দেখতে পায়নি লে মন্ডে। ক্ষোভের পারদ এত উঁচুতে চড়েছিল, যে হঠাৎ একদিন একটি ছোট্ট আগুনের ফুলকি এসে জ্বালিয়ে দিল সব, দুলে উঠলো পুরো ফ্রান্স আর ফ্রান্সের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা। দেশভর্তি পারদের উপর আগুনের সেই স্ফূলিঙ্গটি পড়েছিল ১৯৬৮ সালের ৩ মে, লে মন্ডের সংবাদ প্রকাশের মাত্র দেড়মাস পর।

মে ১৯৬৮ ছাত্র আন্দোলন; Image Source: marxist.com

শুরুটা হয়েছিল প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় দখল ও বন্ধ ঘোষণার মাধ্যমে। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন, কর্তৃত্ববাদী শিক্ষা কাঠামো বদলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সহজ সম্পর্কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের অগ্নিস্ফূলিঙ্গ কয়েকদিনের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়লো পুরো ফ্রান্সে। ফরাসি বিপ্লবের মতো এটি আপাদমস্তক কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না, বরং এটি ছিল সমাজ কাঠামো বদলে ফেলার এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার বিপ্লব। ফ্রান্সের এই ছাত্র আন্দোলনে কিছুদিনের জন্য থমকে গিয়েছিল পুরো ফ্রান্স, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নিয়মতান্ত্রিক সরকারি কাজকর্ম, রাস্তায় নেমে এসেছিল সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ।

নারী মুক্তির চিরন্তন পথ দেখিয়ে, সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার স্থাপন করে, প্রাপ্তবয়স্কদের যৌন স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, ফ্রান্সের সমাজ সংস্কৃতিতে বিরাট পরিবর্তন এনে তবেই ক্ষান্ত হয় এই বিপ্লব। আর এতসব ঘটেছিল মাত্র ৫০ দিনের ব্যবধানে! যত দ্রুত এই ঐতিহাসিক বিপ্লবের উত্থান ঘটেছিল, ঠিক ততটা দ্রুততায় এটি থেমে যায়।

পটভূমি

১৯৬০-এর দশক ফ্রান্সের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের একটি দশক হতে যাচ্ছে, তা যেন পূর্বনির্ধারিতই ছিল। দশকের শুরুতে ফ্রান্সে মোট শিক্ষার্থী ছিল ১ লক্ষ ৭৫ হাজার। ১৯৬৮ সালে, অর্থাৎ মাত্র ৮ বছরের ব্যবধানে ফ্রান্সের শিক্ষার্থী জনসংখ্যা বেড়ে ৫ লাখে উন্নীত হয়। নব্যসৃষ্ট এই তরুণ সমাজ শিক্ষায়তনের বাইরে গিয়ে জাতীয় প্রেক্ষাপট নিয়ে ভাবতে শেখে।

চার্লস ডি গল; Image Source: Wikimedia Commons

এদিকে আলজেরীয় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের ‘ফোর্থ রিপাবলিক’ (১৯৪৬-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ফরাসি সরকার)- এর পতন হলে ১৯৫৮ সালে অসাংবিধানিক উপায়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসেন চার্লস ডি গল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন ফরাসি সেনানায়ক। ফ্রান্সের বাড়ন্ত তরুণ সমাজ ডি গলের ক্ষমতাকে কখনোই পুরোপুরি সমর্থন করতে পারেনি। তাদের চোখে ডি গল ছিলেন একজন ছদ্মবেশী একনায়ক, যার ক্ষমতাবলয়ে দেশে স্বৈরশাসন, অপশাসন আর সামাজিক অসঙ্গতি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

এদিকে, দ্রুত বর্ধমান তরুণ সমাজের ভাবনা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ ডি গলের সরকার দেশকে ক্রমেই একদলীয় শাসনের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। মৌলবাদী আর উদারপন্থী, দুই ধরনের রাজনৈতিক দলই ততদিনে খর্বশক্তির দলে পরিণত হয়েছিল, যেগুলোর পক্ষে গলিস্ট পার্টির সাথে লড়াই করা একপ্রকার অসম্ভব ছিল। ফলে শিক্ষিত ও সচেতন তরুণদের মনে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে।

চে গ্যেভারা, হো চি মিন আর মাও সে তুংয়ের মতো নেতাদের ভক্ত হলেও এই তরুণ সমাজ ফ্রান্সের তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি কিংবা অর্থোডক্স মার্ক্সিস্ট পার্টি, উভয়কেই বর্জন করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আলজেরীয় যুদ্ধ আর সমাকালীন সময়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিরীহ মানুষের মৃত্যুর মিছিলের প্রধান কারণ হিসেবে তারা সাম্রাজ্যবাদকেই মনে করতো। তাই সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতাই ছিল এই গণ অসন্তোষের মূল উপজীব্য।

গোড়াপত্তন

১৯৬৮ সালের জানুয়ারি। ফ্রান্সের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক মন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া মিসোফে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সুইমিং পুল উদ্বোধন করতে এসেছিলেন। অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ পরই তিনি ছাত্রনেতা ড্যানিয়েল বেন্ডিটের আক্রোশের মুখে পড়েন। তখন ফ্রান্সের ছাত্রাবাসগুলোতে নারী-পুরুষের একত্রে রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ ছিল। এই আইনের সমালোচনা করে বেন্ডিট জানান, তরুণদের যৌন হতাশা দূর করতে ব্যর্থ মিসোফে মন্ত্রী হিসেবেও ব্যর্থ। এরপর বেন্ডিটের বক্তৃতার মাঝেই মিসোফে জবাব দেন, বেন্ডিট যেন সুইমিং পুলে ডুব দিয়ে তার গায়ের জ্বালা মেটান! এর জবাবে বেন্ডিট বলেছিলেন,

“ফ্যাসিস্ট সরকারের কাছে এর বেশি আশা করিনি!”

ছাত্রনেতা ড্যানিয়েল বেন্ডিট; Image Source: revoltlib.com

বেন্ডিটের এই উক্তি দু’টি কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত, এ ঘটনার পর থেকে ফ্রান্সের ছাত্রসমাজে বেন্ডিট কিংবদন্তিতুল্য হয়ে ওঠেন। দ্বিতীয়ত, মে মাসের হতে যাওয়া আন্দোলনের গোড়ার ঘটনা হিসেবে ১৯৬৭ সালের ‘যৌন স্বাধীনতা’ আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠিত করে এই উক্তি। ১৯৬৭ সালের সেই আন্দোলনটিও হয়েছিল প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝেই। প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাসে একত্রে বসবাসের অধিকার চেয়ে এই আন্দোলন হয়েছিল, যার সূত্র ধরেই বেন্ডিট যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রীকে আক্রমণ করেছিলেন।

বেন্ডিটের গ্রেফতার

এ ঘটনার প্রায় দু’মাস পর, প্যারিসে অবস্থিত ‘আমেরিকান এক্সপ্রেস’ পত্রিকার অফিসে হামলা হয়। হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে একাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। বাছবিচার ছাড়া এ গ্রেফতারের বিরুদ্ধে মার্চ মাসেই আবারো ফুঁসে ওঠে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এবার শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আরো কিছু শিক্ষার্থী গ্রেফতার হন, যাদের মধ্যে ছিলেন বেন্ডিটও। এরই মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, বেন্ডিটকে দেশান্তরী করা হতে পারে। এরূপ গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে ২২ মার্চ, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এক বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে, যা ‘টুয়েন্টি সেকেন্ড মার্চ মুভমেন্ট’ নামে পরিচিত।

পরিস্থিতির অবনতি

পুলিশি বাধার মুখেও চলতে থাকে ছাত্রদের আন্দোলন; Image Source: libcom.org

যেকোনো স্বৈরশাসক কিংবা একনায়ক কোনোপ্রকার গণতান্ত্রিক এবং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বা প্রতিবাদকে সরকারবিরোধী মনে করে। ফলে, আন্দোলনের মূল কারণ বা যে সমস্যাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ হচ্ছে, তার দিকে নজর না দিয়ে সরকার আন্দোলন ঠেকানোয় মত্ত হয়ে পড়ে। এতে করে পরিস্থিতি শান্ত হয় না, বরং অস্থিরতা আরো বৃদ্ধি পায়। চার্লস ডি গলের সরকারও একই পথে হেঁটেছিল। ছাত্র আন্দোলন কত বড় হতে পারে, সেটি ধারণা করতে পারেনি তারা। গ্রেফতারকৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে যে আন্দোলন চলছিল, তা মার্চ, এপ্রিল পেরিয়ে মে মাসে পৌঁছুলেও সরকার তাতে গা করেনি। বরং, এই আন্দোলনের মাঝেই সরকার নিয়মিত শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করতে থাকে।

শিক্ষার্থী-পুলিশ মুখোমুখি এবং মূল আন্দোলনের সূচনা

ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা এই যে, মানুষ ইতিহাস থেকে শেখে না। ইতিহাস বলে, জোর করে কোনো আন্দোলন বন্ধ করা কিংবা মুখ চেপে ধরে প্রতিবাদী স্বর বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা কখনো সফল হয়নি। প্রতিটি বৃহৎ আন্দোলনের সূচনাটা এভাবেই হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করে দিয়েছে। ইতিহাসের এই ধারার ব্যত্যয় ঘটেনি ১৯৬৮ সালের ফ্রান্সের ছাত্র আন্দোলনেও।

নানতেরা বন্ধের প্রতিবাদ; Image Source: wnpr.org

মে মাসের শুরুতেই প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের নানতেরা ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সকল প্রকার সমাবেশও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে করে আন্দোলন থেমে যাবে বলেই ধারণা করেছিল প্রশাসন। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছিল উল্টোটা। নিজেদের ক্যাম্পাস বন্ধের ক্ষোভ মেটাতে শিক্ষার্থীরা ৩ মার্চ সরবোন ক্যাম্পাস ঘেরাও করল। এমতাবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজন ছিল শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনায় বসার। কিন্তু সরবোন কর্তৃপক্ষ সভা করে সিদ্ধান্ত নিল, পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেয়া হবে!

যে-ই ভাবনা, সে-ই কাজ। তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর উপর কাঁদুনে গ্যাস, ব্যাটন আর জলকামান নিয়ে হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লো রায়ট পুলিশ। গণগ্রেফতার আর অসংখ্য হতাহতের মধ্য দিয়ে সেদিন আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করা হলো। আর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি শান্ত করে ফেলার পরিকল্পনা করেছিল সরবোন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু, তাদের এই পরিকল্পনা বুমেরাং হয়ে ফিরে এসে তাদেরই আঘাত করেছিল। নানতেরার পর সরবোন ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণায় পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবনতি ঘটলো। শিক্ষার্থীরা ১০ মে সর্বাত্মক প্রতিবাদের ডাক দিল। দাবি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া এবং গ্রেফতারকৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তি।

রক্তক্ষয়ী রাত

মধ্যরাত, ১০ই মে’র প্রথম প্রহর। প্যারিসের রাস্তাগুলো রাতের এরকম মুহূর্তে প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার শ্লোগানে মুখরিত। এক সপ্তাহ আগে যেখানে সরবোনের সামনে মাত্র ৩০০ জন শিক্ষার্থী প্রতিবাদ জানাচ্ছিল, সেখানে ১০ই মে’র মধ্যরাতে প্যারিস জুড়ে ৪০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী রাস্তায়। তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে অনেক সাধারণ মানুষও। শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ‘ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং অথোরিটি’ তথা ওআরটিএফের দিকে এগোতে থাকলে শত শত রায়ট পুলিশ রাস্তা আটকে মুখোমুখি অবস্থান নেয়।

১০ই মে রাতে এভাবেই শত শত গাড়ি প্যারিসের রাস্তায় উল্টে দেয় শিক্ষার্থীরা। পুলিশের রাবার বুলেটের মুখে এগুলো ছিল ব্যারিকেড; Image Source: libcom.org

পুলিশদের সরাতে শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির মতো পাথর ছুঁড়তে থাকে। কিছুক্ষণ পরই পাল্টা আক্রমণ চালায় পুলিশ। মুহুর্মুহু টিয়ার শেল ছোঁড়ার পাশাপাশি জলকামান আর লাঠিচার্জ চালায় তারা। পুলিশের আক্রমণ থেকে বাঁচতে প্যারিসের প্রশস্ত রাস্তাগুলোয় শত শত ব্যারিকেড তৈরি করে শিক্ষার্থীরা। ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী গ্রেফতার, শিক্ষার্থী ও পুলিশ সহ হাজারখানেক হতাহতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সে রাত, ফ্রান্সের ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে ভয়বহ ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের রাত, পুলিশের বিরুদ্ধে ছাত্র জনতার ব্যারিকেড তোলার রাত।

সেই ঐতিহাসিক রাতে শিক্ষার্থীদের তৈরি ব্যারিকেডের একটি ছবি; Image Source: Wikimedia Commons

শ্রমিক ধর্মঘট

কোনো পরিবর্তনই সংঘর্ষ ছাড়া ঘটে না, কোনো বিপ্লবই রক্ত ছাড়া সফল হয় না। ১০ মে রাতে শিক্ষার্থীদের উপর তাণ্ডবে পুরো ফ্রান্স হতবাক হয়ে যায়। ছাত্র আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন তুঙ্গে ওঠে। ১০ই মে পর্যন্ত যে আন্দোলন কেবল ছাত্র আন্দোলন ছিল, ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তনের জন্য, ১১ই মে থেকে সে আন্দোলন পরিণত হলো কর্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামোর বিরুদ্ধে সমগ্র ফ্রান্সের সর্বাত্মক আন্দোলনে। ফ্রান্সের ইতিহাসে বৃহত্তম ধর্মঘট ডাকল শ্রমিকেরা, রাস্তায় নেমে এল লাখ লাখ শ্রমিক, বন্ধ হয়ে গেল গাড়ির চাকা আর কারখানার মেশিন, স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো ফ্রান্স।

ছোট একটি আন্দোলন এভাবে বৃহদাকার বিপ্লবে পরিণত হবে, সেটা শাসকেরা কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি। অথচ, বিদ্যায়তনকেন্দ্রিক আন্দোলন শেষতক বিদ্যমান কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে রূপ নিল, প্রতিটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক এল। আন্দোলনের তীব্রতায় অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, ফ্রান্সের প্রচলিত আইন ব্যবস্থা, নির্বাহী কাঠামো আর ক্ষমতায় থাকা তৎকালীন সরকারের পতন হবে। চার্লস ডি গল তো কী করবেন বুঝতে না পেরে পশ্চিম জার্মানি চলে গিয়েছিলেন গোপনে। সেখানে পশ্চিম জার্মানির সেনা সহায়তাও কামনা করেছিলেন আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে!

সর্বাত্মক ধর্মঘট ডেকে রাস্তায় নেমে আসে শ্রমিকেরা। ছবিতে বৈশ্বিক অটোমোবাইল জায়ান্ট রেনল্টের শ্রমিকদের দেখা যাচ্ছে; Image Source: laborfest.net

ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে জীবন্ত হয়ে ওঠা এই ছাত্র আন্দোলন ফিনিক্স পাখির মতোই দ্রুত ঝড়ে যায়। ‘মে সিক্সটি এইট’ নামে পরিচিতি পাওয়া এ আন্দোলন ফ্রান্সের রাষ্ট্র কাঠামোতে তীব্র এক ঝাঁকুনি দিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত নড়বড়ে ডি গল সরকার টিকে যায়। পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে এলে মে মাসের ৩০ তারিখ ডি গল দেশবাসীর উদ্দেশে রেডিও ভাষণে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা করছে বলে এক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব উপস্থাপন করেন।

এছাড়াও, তিনি আন্দোলনকারীদের দ্রুত ঘরে ফিরে না গেলে সেনাবাহিনী মাঠে নামানোরও হুঁশিয়ারি দেন। কমিউনিস্ট পার্টি বাস্তবিকই নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোয় পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চেয়েছিল। তারা শ্রমিক নেতাদের বেতন ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রস্তাবও দিয়েছিল। তথাপি, ক্ষমতায় আরোহণের দিবাস্বপ্ন তারা দেখেনি।

যা-ই হোক, আন্দোলনের তীব্রতা কমে এলেও জুন মাসেও চলছিল ধর্মঘট। তখন ধূর্ত ডি গল দু’টি বুদ্ধিদীপ্ত রাজনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে আন্দোলনের পুনর্জাগরণের পথ পুরোপুরি বন্ধ করেন।

এক. তিনি আন্দোলনকারীদের বিপরীতে হাজারো মানুষকে নিজের সমর্থনে রাস্তায় নামান।

দুই. জুন মাসের মধ্যেই বিদ্যমান সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন করে নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র শক্তিশালী করার ঘোষণা দেন।

এতে দ্রুতই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে, শ্রমিকেরা কাজে ফিরে যায় এবং অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচনে ডি গলই জয়লাভ করেন।

ফলাফল

তরুণ সমাজ যখন চেতনাদীপ্ত হয়, তখন জলকামান তাদের থামাতে পারে না; Image Source: thelandmagazine.org.uk

মে ৬৮ আন্দোলনের ফলাফল কী ছিল? এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকতে হয় ঝানু ইতিহাসবিদ কিংবা সমাজবিজ্ঞানী আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদেরও। মে ৬৮’র ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের ফলাফল নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। কেউ মনে করেন, দীর্ঘ মেয়াদে এর আদতে তেমন কোনো প্রভাবই ছিল না। কেউ আবার এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আলোচনা করতেই অধিক আগ্রহী। গোঁড়া মার্ক্সবাদীরা এই আন্দোলনের প্রভাব স্বীকার করে নেন ঠিকই, তবে একে সফল বলতে নারাজ তারা। তাদের জন্য সফল আন্দোলন মানে সর্বসাধারণের বিপ্লব এবং ক্ষমতা কাঠামোর আমূল পরিবর্তন।

মে ৬৮ আন্দোলনের প্রভাব এবং ফরাসি জনজীবনে এই আন্দোলন সূত্রে আসা পরিবর্তন বুঝতে হলে তলিয়ে দেখতে হবে তাদের প্রাত্যহিক জীবন, ভাবতে হবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মতো। মার্ক্সিস্টরা চিরকালীনই সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে শ্রমিক সমাজকে বেছে নিয়েছে এবং তাদের কেন্দ্র করেই পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু ৬৮’র ছাত্র আন্দোলন সমাজ পরিবর্তনের জন্য সংস্কৃতি আর বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তনকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যে থেকে সমাজের শ্রমিক শ্রেণিকেও ভোগবাদ গ্রাস করেছে। ফলে, তাদের পক্ষে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হওয়া সম্ভব ছিল না। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র কাঠামোর পাশাপাশি পৃথিবী জুড়ে বিস্তার লাভ করা মার্কিন সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও প্রথম আঙুল তুলেছিল এই মে ৬৮’র আন্দোলন।

এই আন্দোলনের প্রাথমিক অর্জন ছিল শ্রমিকদের ভালো বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে নমনীয়তা এসেছিল এর পর থেকে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের এককভাবে দাঁড়িয়ে থেকে লেকচার প্রদানের ব্যবস্থা বদলে শিক্ষার্থীদের অবাধে প্রশ্ন করা আর বিতর্ক করা শুরু হয়েছিল এই আন্দোলনের পরই। কারখানায় শ্রমিকদের সাথে মালিকের সম্পর্ক পূর্বের চেয়ে নমনীয় হয়েছিল এ আন্দোলনের পরই। শুধু তা-ই নয়, এ আন্দোলনের প্রভাবে নারী অধিকার আদায়, যৌন স্বাধীনতা, তৃতীয় লিঙ্গের স্বাধীনতা, বিদেশী সংস্কৃতি- বিশেষ করে, মার্কিন সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে ফরাসি সংস্কৃতির মুক্তি, সর্বোপরি ফরাসিদের দৈনন্দিন জীবনে এসেছিল অসংখ্য পরিবর্তন।

“Bliss was it in that dawn to be alive, But to be young was very heaven!”

– উইলিয়াম ওয়ার্ডসওর্থ

ব্রিটিশ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওর্থের উপরের উক্তিগুলো ফরাসি বিপ্লব সম্বন্ধে করা। তার এই উক্তির অর্থ এককথায় করা যায় না। রক্তক্ষয়ী ফরাসি বিপ্লবের সেই সময়গুলোকে প্রাণে বেঁচে থাকাটাই ছিল পরম সুখের। কিন্তু যারা সে সময় তরুণ ছিল, যাদের রক্ত টগবগ করে ফুটত, যাদের গলায় প্রতিবাদ করার মতো স্বর ছিল, যাদের দেহে ছিল বিপ্লব করার শক্তি, বিপ্লবের সেই দিনগুলোতে তারাই ছিল সবচেয়ে সুখী।

তার এই উক্তি তো মে ৬৮’র আন্দোলনেরও প্রতিচ্ছবি। লাঠিসোঁটা, কাঁদুনে গ্যাস আর জলকামান নিয়ে প্রস্তুত মারমুখী পুলিশের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ট্রাউজার কিংবা জিন্স, পায়ে জাম্পার জুতার সাথে প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিফর্মের শার্ট, টাই আর জ্যাকেট পরিহিত শিক্ষার্থীরা। প্রচণ্ডরকম সংঘর্ষ হবে জেনেও এরকম প্রাতিষ্ঠানিক পোশাকে রাস্তায় নেমে এসে শিক্ষার্থীরা বলতে চেয়েছিল, প্রচলিত ব্যবস্থা কিংবা কাঠামো তাদের মানসিকতার সাথে সাংঘর্ষিক। এই সাংঘর্ষিক কাঠামোকে ভেঙে দিতেই তারা ঐক্যবদ্ধ।

‘স্টোলেন কিসেস’ সিনেমার একটি পোস্টার; Image Source: mubi.com

মে ৬৮’র আন্দোলন নিয়ে কবি-সাহিত্যিক আর চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মাঝে অন্যরকম রোমান্টিকতা ছিল। আন্দোলন, আন্দোলনের পটভূমি আর ফলাফল নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করেছেন বিখ্যাত সব নির্মাতা। ফ্রাঁসোয়া ট্রুফোর ‘স্টোলেন কিসেস’, জ্যা লুক গদারের ‘জাস্ট গ্রেট’, ক্লদ চারবোলের ‘নাডা’, বার্নার্ডো বার্তোলুচ্চির ‘দ্য ড্রিমার্স’ সহ অসংখ্য সিনেমা নির্মিত হয়েছে এই ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে। এছাড়াও, জেমস জোনসের ‘মেরি মান্থ অব মে’, গিলবার্ট এডেইরের ‘দ্য হোলি ইনোসেন্টস’-এর মতো অনেক বিখ্যাত উপন্যাসও জন্ম নিয়েছে আন্দোলন থেকে।

৬৮’র ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত সময়গুলোতে ছাত্রদের চেয়ে শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি ছিল। তবু এ আন্দোলন সর্বোত্র ছাত্র আন্দোলন হিসেবে পরিচিত হয়েছে। কেননা এই আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্ররাই পরবর্তীকালে ফ্রান্সের সমাজ ও সংস্কৃতির গভীর পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। এই ছাত্রদের মধ্য থেকেই উঠে এসেছিল পরবর্তীকালের কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্তাব্যক্তিরা, যারা নিজেদের ছাত্রজীবনে করে আসা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন।

শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য হলেও এ আন্দোলনের ভিত্তি ছিল ছাত্ররাই। অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও এ আন্দোলনের রেশ ফরাসি সমাজে এখনো জীবন্ত। অনাগত ভবিষ্যতে এরকম ছাত্র-জনতার গণজোয়ার আবার হবে কিনা, তা বলা মুশকিল। তবে মে ৬৮’র আন্দোলন ফ্রান্সের ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে থাকবে পরিবর্তনের উদাত্ত ডাক হিসেবে, পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে চিরন্তন প্রতিবাদী অনুপ্রেরণা হিসেবে।

This article is in Bangla language. It is about May 1968 French Students' Movement.

All necessary references are hyperlinked inside the article.

Featured Image: New York Times

Related Articles

Exit mobile version