ভারতীয় উপমহাদেশের বর্তমান বিভাজিত রুপ তথা আধুনিক বাংলাদেশের ক্রম অভ্যুদয়ের একেবারে গোড়ায় আছে পলাশীর ঐতিহাসিক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ক্ষমতার লোভে নবাবের বিরুদ্ধাচারণ করে উপমহাদেশে ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার সেরা নজির হয়ে আছেন মীর জাফর আলি খান। সেই পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার করুণ পরাজয়ের কাহিনী আমরা সবাই জানি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই চরম অনৈতিক যুদ্ধ নামক নাটকের সাথে মূল অভিনেতা মীর জাফর ও তার সহচরদের কী পরিণতি হয়েছিলো, তা কয়জন জানি? কতটা ঘোলাটে ছিলো সেই সময় বাংলার আকাশের সূর্য? যতটা আমরা জানি, তার মধ্যেও আছে অনেক ভ্রান্ত তথ্য। আসুন জেনে নিই প্রকৃত ইতিহাস।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন কুচক্রী মীর জাফর ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা ও রাজদ্রোহের কারণে পলাশীর যুদ্ধে মুষ্টিমেয় ইংরেজ সৈন্যের কাছে পরাজিত ও বন্দী হন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। এর কিছুকাল পরেই ইংরেজ সেনাপ্রধান কর্ণেল রবার্ট ক্লাইভ প্রকাশ্য দরবারে মীর জাফরকে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মসনদে বসান। তার গৃহীত পূর্ণাঙ্গ নাম হয় ‘সুজা-উল-মূলক-হিশাম-উদ-দৌলা মীর মোহাম্মদ জাফর আলি খান মহাব্বত জং।’ অর্থাৎ দেশের সাহসী, সাম্রাজ্যের তরবারি, সংগ্রামে ভয়ংকর মীর মোহাম্মদ জাফর আলি খান। পুত্র মিরনের প্রবল আগ্রহে তাকে ‘শাহাম্মত জং’ বা সংগ্রামে সাহসী উপাধি প্রদান করেন। মসনদে বসানোর পর ক্লাইভ এ দেশের প্রচলিত রীতি অনুসারে নবাবকে আনুষ্ঠানিক নজরানা প্রদান করে তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন।
এর আগে মীর জাফর ক্লাইভের সাথে গোপন চুক্তির শর্তানুসারে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার অধিকারে থাকা সরকারী রাজ ভান্ডার ও সেখানে প্রাপ্ত সম্পদের দখল ও ভাগাভাগির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই সরকারী ভান্ডারে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা রৌপ্যমুদ্রায়, ৩২ লাখ টাকা স্বর্ণমুদ্রায়, দুই সিন্দুক ভর্তি সোনার পাতা, চার সিন্দুক ভর্তি হীরা-জহরত ও অপেক্ষাকৃত ছোট দুই সিন্দুক ভর্তি মণিমুক্তা পাওয়া যায়। আরও জানা যায়, নবাবের হারেমে একটি গোপন ভান্ডারে আরও ৮ কোটি টাকা ছিলো। ক্লাইভকে চালাকির মাধ্যমে বঞ্চিত করে এই ৮ কোটি টাকার সবই মীর জাফর, আমির বেগ, রামচাঁদ ও নবকৃষ্ণ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। এই টাকার ভাগ না পেলেও ক্লাইভের পুষিয়ে গিয়েছিলো। তবে নবাবের প্রকাশ্য ভান্ডারে অর্থ না পাওয়ায় এবং গোপন চুক্তির শর্তানুসারে ক্লাইভকে দেড় কোটি টাকা না দিতে পারায় মীর জাফরকে বর্ধমান ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ইংরেজদের কাছে ইজারা দিতে হয়।
নবাব সিরাজের হারেম রক্ষিত অজস্র অর্থ ও সুন্দরী তরুণীকুল হস্তগত করার পর মীর জাফর সীমাহীন ভোগবিলাসে নিমগ্ন হন। পিতার সাথে তরুণপুত্র মিরনও নিঃসঙ্কোচে ভোগবিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক অবস্থার নিয়ন্ত্রণ, সশস্ত্র বাহিনীর বেতন পরিশোধ বা কৃষকদের অবস্থার উন্নতির কোনো চিন্তাই তার মনে উদয় হয় নি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়ে যায় যে, বেতনের অভাবে সৈন্যরা তাদের অসহায় ঘোড়াগুলোকে খাবারের জন্যে মাঠে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। পিতা-পুত্রের অধীন শ’খানেক প্রিয়পাত্র ও নারী ব্যতীত আর কারও নিয়মিত বেতন পাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো না।
রাজ্যের এই কঠিন অবস্থায় মীর জাফরের রাজত্বের এক বছর ও তিন মাস অতিক্রান্ত না হতেই সৈন্যরা ধৈর্য্যহীন হয়ে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাকে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এর ফলে মীর জাফরের বড় ভাই মীর কাজিম ও প্রধান সেনাপতিদের অন্যতম খাজা আবদুল হাদীসহ মীর জাফরের কুটিল চক্রান্তের শিকার হয়ে নির্মমভাবে প্রাণ হারায়। কিন্তু তাতেও পিতা-পুত্রের ভোগসর্বস্ব প্রকৃতির কোনো পরিবর্তন হয় নি। তারা উভয়েই জনগণের কাছে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন। ইংরেজরা তাদের নিয়ে মহা মুশকিলে পড়ে যায়। মীর জাফর যে এতো অপদার্থ, সে কথা তারা ভাবতেও পারে নি। ইংরেজরা তাকে অপসারণের চিন্তা করতে লাগলো। কিন্তু তার স্থানে বসাবে কাকে? তার গুণধর পুত্র মিরন অপদার্থতায় তার পিতার কয়েক গুণ উপরে। তার উপর ইংরেজদের তিনি পাত্তাই দিতে চান না।
এদিকে পূর্ণিয়া নিয়ে মহাবিপদে পড়লেন পিতা-পুত্র। পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা ও মিরনের সারাজীবনের দুষ্কর্মের সাথী, সৈয়দ খাদিম হাসান খান বিদ্রোহী হয়ে গেলেন। ইংরেজ কর্মকর্তার অধীনে বিরাট এক বাহিনী নিয়ে মিরন চললেন খাদিমকে শায়েস্তা করতে। সংবাদ পেয়ে খাদিম তার সৈন্যবাহিনী ও ধন-সম্পদ সব নিয়ে আজিমাবাদ-পাটনার দিকে পালিয়ে গেলেন। মিরন ইংরেজদের সাথে নিয়ে তাকে ধাওয়া করতে থাকলে ভয় পেয়ে খাদিম পাটনা থেকে বেশ দুরে, গঙ্গার উত্তরে জঙ্গলাকীর্ণ এক জায়গায় গিয়ে আত্মগোপন করেন। মিরনও সেই সময় এক জঙ্গুলে জায়গায় শিবির স্থাপন করেন, উদ্দেশ্য খাদিমকে চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়েই ফিরে যাওয়া। কিন্তু সেই মহান উদ্দেশ্য সাধন করার আগে তিনি নিজেই দুনিয়া ছেড়ে দেন।
ইংরেজদের পরম বন্ধু ও সে যুগের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তবতবায়ী তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সিয়ার-উল-মুতাখখিরীন’-এ উল্লেখ করেছেন যে, ঝড়-বৃষ্টিময় এক মহা দুর্যোগের রাতে তাঁবুতে বিশ্রামরত অবস্থায় হঠাৎ বজ্রাঘাতে মিরন মারা যান। পরবর্তীকালে ফরাসি সেনাপতি মসিয় লাসহ অনেকেই একে একটি বানোয়াট কাহিনী বলেছেন। কারণ স্বরুপ বলা হয়, ইংরেজরা মিরনের ঔদ্ধত্য ও তাদের প্রতি অনমনীয় মনোভাব দেখে এক ঝড় –বৃষ্টির রাতে তাকে হত্যা করার ব্যবস্থা করে। পরে তাদের বেতনভুক্ত গোলাম হোসেনকে দিয়ে এমন কাহিনী লিখার ব্যবস্থা করেন যে মিরনের বজ্রাঘাতে মৃত্যুর কাহিনীটি সর্বস্তরের মানুষের কাছে গৃহীত হয়।
মিরনের এই ঘটনার সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত আরেকটি ঘটনাও এই লেখক তার গ্রন্থে অনেক জোর দিয়ে বলেন। নবাবী লাভের পরপরই মীর জাফর ও মিরনের নির্দেশে নবাব সিরাজের মা আমেনা বেগম ও খালা ঘসেটি বেগমকে ঘাতক বুড়িগঙ্গা নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করে। উচ্ছল ও প্রাণবন্ত ভাষায় সেখানে বর্ণনা আছে যে, মৃত্যুর আগে তারা নাকি অভিশাপ দিয়েছিলেন, মিরন বজ্রাঘাতে মারা যাবে। পরবর্তীকালে কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা অনুসন্ধান করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, এটি সম্পূর্ণরুপে কাল্পনিক একটি কাহিনী।
১৭৬০ সালে ইংরেজ কর্মকর্তা হলওয়েল ব্রিটেনে কর্তৃপক্ষের কাছে যে নথি পেশ করেন তাতে বলা আছে যে, মীর জাফর ঘসেটি বেগম, আমেনা বেগম প্রমুখ সম্ভ্রান্ত নবাব বংশীয় মহিলাকে ঢাকার রাজ কারাগারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন।
মিরনের মৃত্যুর পরে কয়েক মাসের বেশি মীর জাফর মসনদে থাকতে পারেন নি। ইংরেজরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার জামাতা মীর কাশিমকে সিংহাসনে বসান। মীর কাশিম শ্বশুরের মতো মেরুদন্ডহীন ছিলেন না। তার স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে ইংরেজদের সাথে তার বিরোধ বাধে ও বেশকিছু যুদ্ধ হয়। তাকে কোণঠাসা করে ইংরেজরা পুনরায় মীর জাফরকে মসনদে বসান। নির্লজ্জ মীর জাফর তা গ্রহণ করেন এবং নবাব সিরাজের হারেমে প্রাপ্ত অর্থ ও তরুণীদের নিয়ে আরামে দিন কাটাতে থাকেন।
৭৩ বছর বয়সেই রোগাক্রান্ত হয়ে মীর জাফরের শরীর ভেঙে যায়। মহারাজ নন্দকুমার নামে এক কুচক্রী ব্রাহ্মণ তখন তার প্রধানমন্ত্রী ছিলো। সে-ই মাত্র ১০ কী ১২ হাজার টাকার বিনিময়ে ফরাসীদের চন্দননগর দূর্গ ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছিলো। এই অতি ধূর্ত লোকটির প্রভাব তার উপর এতো বেশি ছিলো যে, মৃত্যুর আগে কঠিন কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হলে মীর জাফর একজন সৈয়দ হয়েও হিন্দুদের দেবী কিরীটেশ্বরীর পাদোদক পান করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মীর জাফর প্রদত্ত বংশতালিকা অনুসারে তারা ছিলেন ইরাকের নাজাফ শহরের সৈয়দ। শেষের দিকে তার বংশধররা ‘মীর’ উপাধি ধারণ করা বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম বৈশিষ্ট্যসূচক ‘মির্জা’ উপাধি ধারণ করতে থাকে। পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইস্কান্দার মির্জা ছিলেন মীর জাফরের বংশেরই লোক।
শুধু একজন মানুষের লোভের কারণে পুরো একটি উপমহাদেশের ইতিহাস কীভাবে পরিবর্তিত হতে পারে তার উৎকৃষ্টতম উদাহরণ বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর। তার জীবন যত সুখেরই হোক না কেন, নিন্দনীয় মৃত্যু ও প্রজন্মান্তরে লব্ধ ঘৃণাই তার কৃতকর্মের যোগ্য পরিণাম।